- বইয়ের নামঃ দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প
- লেখকের নামঃ দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
অশ্বমেধের ঘোড়া
‘শুনছ? সানাই।’
রেখা থমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ঠিক সেই মুহূর্তে আলোটা ওর মাথার চুলে ভেঙে পড়ে চিবুক আর গলার পাশে একটা হালকা ছায়া সৃষ্টি করল। কাঞ্চন সানাইয়ের সুর বিস্মৃত হয়ে আশ্চর্য চোখে রেখার সেই ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ রেখাকে অপরিচিতা মনে হল। স্বপ্নের অস্পষ্ট স্মৃতির মতো।
‘কি সুর?’
কাঞ্চন চমকে বলল, ‘দাঁড়াও।’ তারপর ভুরু কুঁচকে অন্যমনস্কের মতো খানিক শুনে উত্তর দিল, ‘চন্দ্রকোশা’ হাসল, ‘আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসলে কি হয়, আজ শুক্লপক্ষ তো বটে।’
রেখা চোখ নামিয়ে নিয়েছে। আলোটা মাথার চুল ছাপিয়ে সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। কাঞ্চনের একটা আশ্চর্য উপমা মনে এল। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নাহ। বেশ একটু মোগলাই মেজাজ হচ্ছে।’
রেখা চকিতে হাতের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মোস্ট কর্টেবল জার্নি! ‘ধুৎ!’ কাঞ্চন ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে উত্তর দিল, ‘ও তোমাদের কেরানী ইন্টেলেকচুয়ালদের মানায় উঠে বসতে না বসতেই পৌঁছে যাওয়া। তার ওপর বেবী ট্যাকসিগুলো তো নেহাতই ভালগারা যেন বালিগঞ্জে বান্ধবীর বিয়ের চায়ের নেমন্তন্ন। বড় ট্যাকসিতে তা-ও বনেদী বাড়ির পাত পেতে বসার আভিজাত্য আছে। তোমাদের এই কলকাতা দিন দিন আধুনিক হচ্ছে, বর্বর হচ্ছে, সূক্ষ্মতার নামে দরকচা মেরে যাচ্ছে।’
রেখা ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ‘এত বাণী দিও না মাস্টারমশাই। লোকে ধরে বেঁধে মন্ত্রী বানিয়ে দেবো।’
কাঞ্চন হা-হা করে হেসে উঠল। আশেপাশের লোক চমকে বিরক্ত চোখে তাকাল। লজ্জায় দুজনেই মাথা হেঁট করেছে। একটি প্রৌঢ় পসারী ‘ফুল চাই’ বলে তখনই সামনে এসে দাঁড়াল। কাঞ্চন কখনও পয়সা দিয়ে ফুল কেনে নি। একবার চকিতে রেখার সিঁথির দিকে তাকাল। তার বড় ইচ্ছে হতে লাগল এক ছড়া মালা কিনে বিনুনিতে জড়িয়ে দেয়। কিন্তু রাস্তায় ফুল কিনতে যথারীতি লজ্জা করল। বলল, ‘না।’
রেখা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে পয়সা বের করে দিয়েছে। কাঞ্চন রেখার সাহস দেখে স্তম্ভিত। রেখা কি আজ, রেখা কি, প্রকাশ্যে মালা কিনতে ওর ভয় করল না? ফুলের মালা হাতে একটি মেয়ের সঙ্গে সে এখন বাসে উঠবে?
‘চলো, হাঁটি।’
‘চলো।’
হাঁটার শেষ নেই। এক পথে পা ফেলা। রাস্তাটা চোখের সামনে পালটাতে দেখি কলকাতা রোজ পালটায়। আমরা শুধু রাস্তাটুকুর খবর রাখি হাঁটতে হাঁটতে বড়জোর ময়দান অব্দি যাব। বড়জোর চা খাবো এক পেয়ালা আলো আর অন্ধকারের সমারোহ দেখব। তারপর বাস ধরব। রেখার পাশে খালি জায়গা থাকলেও আমাকে আলাদা বসতে হবে, বা দাঁড়াতো ভিড় ঠেলে নেমে যাবার সময় রেখা হাতে একটা টিকিট গুঁজে দিয়ে যাবো সুযোগ পেলে কিছু একটা বলবো নয়তো অপরিচিতার মতো রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হবে। কন্ডাক্টর কি কোনো কৌতূহলী যাত্রী অকারণে একবার আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাবো তারপর আমি নামব। তারপর বাড়ি যাবা। তারপর রাত্রি। তারপর দিন আর দিনে হাঁটতে হাঁটতে দেখব রাস্তাটা পালটাচ্ছে। কলকাতা কত তাড়াতাড়ি পালটায়।
‘ইস, দেখেছ?
কাঞ্চন যদিও জানত, তবু সেনেট হলের সিঁড়ি আর ছাদের দিকে তাকিয়ে নতুন করে চমকে না। উঠে পারল না। কাঞ্চন সত্যিই আত্মীয়বিয়োগের বেদনা অনুভব করলা সিঁড়ি নেই, খিলান নেই, দরজা নেই। অন্ধকারে কতগুলো পায়রা উড়ছে। ছাদ জুড়ে আকাশ শুধু পিছনের দেয়ালটা এখনও ভাঙে নি। রাঙাদিকে আত্মহত্যা করতে দেখেছিলাম। সমস্ত শরীরটা পুড়ে গেলেও মাথার খোঁপা ঠিক ছিল।
কাঞ্চন ফুটপাতে পা ঠুকে মন থেকে স্মৃতিটা তাড়াল। তারপর গলা ঝেড়ে বলল, ‘জানো, বাংলাদেশে নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির মৃত্যু অনেক দিন হয়েছিল। এবার তার কবরটাও ভেঙে গেল।’ রেখা হঠাৎ অদ্ভুত প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, সে পাগলটা এবার কোথায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করবে?
কাঞ্চন চমকে রেখার দিকে তাকাল। সত্যি, পাগলটা এখন, সত্যি, সেনেট, দাঁড়াও পথিকবর, বন্দী আমার প্রাণেশ্বর, মরি হায় হায় রে।
গমগম করে যেন অজস্র গলা একসঙ্গে হাজার কথা বলে উঠল। কাঞ্চন প্রশ্ন করল, ‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
রেখা হাসল, ‘তোমায় চান্স দিচ্ছি।’
হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘কিসের?’
মালাটা খোঁপায় বেঁধে দেওয়ার।’
রেখা কি মরিয়া? আজকের দিনটাই কি ওকে, আজকের দিনটা, আহ দিনটা দিন গেল, রাত্রি। রাত্রি যায় না যায় না কাঞ্চন স্পষ্ট শুনল সানাই বাজছে। চন্দ্রকোশা সেই আমরা রেস্তোরাঁয়–সুকুমার দুটো মালা—আর প্রফুল্ল সকলকে হতবাক করে এক প্যাকেট সিঁদুর, দুটো লোহার নোয়া—আর সেই মুহূর্তে প্রথম রেখাকে অপরিচিত মনে হয়েছিল। আশ্চর্য লোভে, ভয়ে সিঁদুরের প্যাকেটের দিকে তাকিয়েছিল। অথচ শপথ উচ্চারণের সময়ও তাকে এতটুকু বিচলিত দেখি নি। সকলের তাড়া খেয়ে আমি রেখার ঠাণ্ডা কপালে মুখের দিকে তাকাতে সাহস—কেন আঙুল দিয়ে সিঁদুর লাগাতে হয়–প্রফুল্ল বকেছিল আর রেখা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ফেলেছিল। রেখাকে আমার সেই মুহূর্তে বউ-বউ মনে হচ্ছিল কিন্তু মালাবদল কিছুতেই করতে পারি নি রেখাও কিছুতে মাথায় ঘোমটা—আমরা অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম মাসের শেষ হলেও। প্রত্যেকে কিছু কিছু টাকা এনেছিল। তারপর সন্ধ্যে হল। সুকুমারের টিউশনি আছে, প্রফুল্ল বা চন্দন পালাতে চায়। রেখা রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে কপালের সিঁদুর মুছে ফেলল। রেখার এই মুখটাই আমার পরিচিত। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মাত্র কিছুক্ষণে রেখার কপালের সিঁদুর আমার মনে একটা স্থায়ী স্মৃতি রেখেছে। রেখাকে হঠাৎ বিধবার মতো শূন্য, করুণ মনে হল। দেখলাম বাচাল প্রফুল্লও দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। রেখার কপালের ঠিক মাঝখানে একটা নীল শিরা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।