- বইয়ের নামঃ মৈমনসিংহ গীতিকা
- লেখকের নামঃদীনেশচন্দ্র সেন
- প্রকাশনাঃ জয় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
কঙ্ক ও লীলা (রচিয়তা – কবি দামোদর দাস, রঘুসুত, নয়ানচাঁদ ঘোষ এবং শ্রীনাথ বানিয়া)
|| ৮ ||
গোপন দীক্ষা
জুহরী জহর চিনে বেনে চিনে সোনা |
পীর প্যাগাম্বর চিনে সাধু কোন জনা ||
পীরের অদ্ভুত কাণ্ড সকলি দেখিয়া |
কঙ্কের পরাণ গেল মোহিত হইয়া ||
সর্ব্বদা নিকটে কঙ্ক ভক্তিপূর্ণ মনে |
চরণে লুটায় তার দেবতার জ্ঞানে ||
তার পর জাতি ধর্ম সকলি ভুলিয়া |
পীরের প্রসাদ খায় অমৃত বলিয়া ||
দীক্ষিত হৈলা কঙ্ক যবন পীরের স্থানে |
সর্ব্বনাশের কথা কঙ্ক কিছুই না জানে ||
জাতি-ধর্ম নাশ হইল রটিল বদনাম |
পীরের নিকটে কঙ্ক শিখিয়ে কালাম ||
পীরের নিকটে যায় কেউ নাহি জানে |
গতায়তি করে কঙ্ক অতি সংগোপনে ||
ভক্তি-মুক্তি-তন্ত্র-মন্ত্র-দেহ মন প্রাণ |
অচিরে গুরুর পদে কৈল সমর্পণ ||
গুরুতে বিশ্বাস আর গুরু ইষ্ট ধন |
দামোদর দাস কহে এই ভক্তের লক্ষণ ||
|| ৯ ||
সত্যপীরের পাঁচালী
দেখিয়া শুনিয়া পীর, কঙ্কেরে করিলা স্থির,
উপযুক্ত ভক্ত এহি জন |
সত্যপীরের পাঁচালী, কঙ্কেরে লিখিতে বলি,
একদিন হৈল-অদর্শন ||
গুরুর আদেশ মানি, লিখিয়া পাঁচালী আনি,
পাঠাইলা দেশে আর বিদেশে |
কঙ্কের লিখন কথা, ব্যক্ত হৈল যথা তথা,
দেশ পূর্ণ হৈল তার যশে ||
কঙ্ক আর রাখাল নহে, কবিকঙ্ক লোক কহে,
শুনি গর্গ ভাবে চমত্কার |
হিন্দু আর মোসলমানে, সত্যপীরে উভে মানে,
পাঁচালীর হৈল সমাদর ||
যেই পূজে সত্যপীরে, কঙ্কের পাঁচালী পড়ে,
দেশে দেশে কঙ্কের গুণ গায় |
বুঝি কঙ্কের দিন ফেরে, রঘুসুত কহে ফেরে,
দুঃখিতের দুঃখ নাহি যায় ||
|| ১০ ||
কঙ্ককে জাতিতে তোলা
জানিয়া শুনিয়া কানে, ভাবে গর্গ মনে মনে,
নহে কঙ্ক সামান্য মানব |
ভক্তিমান অতি ধীর, গর্গ কৈলা মনে স্থির,
কঙ্ক ঘরে তুলিয়া লইব ||
পণ্ডিত সমাজী গণে, একত্র করিয়া ভণে,
“এই কঙ্ক ব্রাহ্মণ-তনয় |
জ্ঞন মানে নাহি রয়, চণ্ডালের অন্ন খায়,
ঘরে নিতে নাহিক সংশয় ||”
এতেক শুনিয়া নন্দু, আর যত গোড়াহিন্দু,
কয় সবে মাথা নাড়াইয়া |
“আমরা সম্মত নহি, আরও শুন সবে কহি,
লহ কঙ্কে মোদের ছাড়িয়া ||”
আর এক দল ভয়ে গর্গে ডরাইয়া |
গর্গের কথায় শুধু গেল সায় দিয়া ||
আদেখা হইলে গর্গ করে কত ফন্দি |
কঙ্কে না তুলিতে গর্গে করে অন্দি সন্দি ||
কত তর্ক-যুক্তি গর্গ সকলে দেখায় |
তবু নাহি সে বিধি দিল পণ্ডিতসভায় ||
কেহ বলে তুলি ঘরে কেহ বলে নয় |
এই মতে নানা স্থানে বহু তর্ক হয় ||
চারি দিকে দাউ দাউ অনল জ্বলিল |
জ্বলিলেন গর্গ মুনি কঙ্ক ভস্ম হইল ||
এমন সুখের ঘর পুড়ে হল ছাই |
নিয়তি খণ্ডিতে পারে হেন সাধ্য নাই ||
আছিল চণ্ডাল কঙ্ক হইল ব্রাহ্মণ |
কঙ্কেরে নাশিতে যুক্তি করে দ্বিজগণ ||
|| ১১ ||
কঙ্কের বিরূদ্ধে ব্রাহ্মণগণের ষড়যন্ত্র
নানামত ভাবি তারা উপায় করিল |
মাপের চোখেতে যেন ধুলা-পড়া দিল ||
রটে কঙ্ক নহে শুধু চণ্ডালের পুত |
মোসলমান পীরের কাছে হৈল দীক্ষিত ||
হিন্দু যত সবে কঙ্কে মোসলমান বলি |
কেহ ছিড়ে কেহ পুড়ে সত্যের পাঁচালী ||
জাতি গেল মোসলমানের পুঁথি নিয়া ঘরে |
যথাবিধি সবে মিলি প্রায়শ্চিত্ত করে ||
আর এক কথা রটে না যায় কথন |
“কঙ্কেরে সঁপেছে লীলা জীবন-যৌবন ||”
সন্ধ্যামন্ত্র নাহি ঝানে বেদাচারহীন |
দুরন্ত দুর্জন যারা সমাজেতে ঘৃণ ||
মদ্য-মাংস খায় সদ্য পাষণ্ড-আচার |
জন্মি ব্রাহ্মণ-কুলে যত কুলাঙ্গার ||
মিথ্যা বদনাম তারা দিল রটাইয়া |
“কলঙ্কী হইয়াছে লীলা কুল ভাঙ্গাইয়া ||”
একে ত কুমারী কন্যা অতি শুদ্ধমতী |
কলঙ্ক রটাইল তার যত দুষ্টমতি ||
কমলা (রচয়িতা দ্বিজ ঈশান)
|| ৩ ||
কমলা–যৌবনাগমে
দেখিতে সুন্দরী কন্যা পরথম যৌবন |
কিঞ্চিত্ করিব তার রূপের বর্ণন ||
চান্দের সমান মুখ করে ঝলমল |
সিন্দুরে রাঙ্গিয়া ঠুট তেলাকুচ ফল ||
জিনিয়া অপরাজিতা শোভে দুই আখি |
ভ্রমরা উড়িয়া আসে সেই রূপ দেখি ||
দেখিতে রামের ধনু কন্যার যুগল ভুরু |
মুষ্টিতে ধরিতে পারি কটিখানা সরু ||
কাকুনি সুপারি গাছ বায়ে যেন হেলে |
চলিতে ফিরিতে কন্যা যৌবন পরে ঢলে ||
আষাঢ় মাস্যা বাশের কেরুল মাটি ফাট্যা উঠে |
সেই মত পাও দুইখানি গজন্দমে হাটে ||
বেলাইনে বেলিয়া তুলিছে দুই বাহুলতা |
কণ্ঠেতে লুকাইয়া তার কোকিলে কয় কথা||
শ্রাবণ মাসেতে যেন কাল মেঘ সাজে |
দাগল-দীঘল কেশ বায়েতে বিরাজে ||
কখন খোপা বান্ধে কন্যা কখন বান্দে বেণী |
কূপে রঙ্গে সাজে কন্যা মদনমোহিনী ||
অগ্নি-পাটের শাড়ী কন্যা যখন নাকি পরে |
স্বর্গের তারা লাজ পায় দেখিয়া কন্যারে ||
আযাইঢ়া জোয়ারে জল যৌবন দেখিলে |
পুরুষ দূরের কথা নারী যায় ভুলে ||
কাজলরেখা (রচিয়তা – অজ্ঞাত)
।।১৪।।
বাপ মায়ের কথা, বংশের কথা না সুধাইয়াই, একমাত্র প্রাণ-দাতা বলিয়া রাজকুমার তাকে বিয়া করতে প্রতিজ্ঞা করল |
গান–
ঘরে আছিল ঘিরেত বাতি সদাই অগ্নি জ্বলে |
তারে ছুইয়া কুমার পরতিজ্ঞ যে করে ||
ঠিক এমন সময় ছান কইরা ভিজা কাপড়ে কাজলরেখা মন্দিরে প্রবেশ করল | ঢুইকাই দেখে যে
তার স্বামী বাঁইচ্যা উঠছে |
গান–
গ্রহণ ছাড়িলে যেমন চান্দের প্রকাশ |
কুমারে দেখিয়া কন্যা পাইল আশ্বাস ||
প্রভাতের ভানু যিনি ছুরত সুন্দর |
একে একে দেখে কন্যা সর্ব্ব কলেবর ||
কন্যারে দেখিয়া কুমার লাগে চমত্কার |
এমন নারীর রূপ না দেইখ্যাছে আর ||
পরথম যৌবনে কন্যা হীরা-মতি জ্বলে |
কন্যারে দেখিয়া কুমার কহে মিঠা বুলে ||
“কোথা হতে আইলা কন্যা কি বা নম ধর |
কিবা নাম বাপ মার কোন দেশে ঘর ||
কিসের লাগিয়া কন্যা ভ্রম বনে বনে |
স্বরূপ উত্তর দাও এই অভাজনে ||
মাও ত নিঠুরা তোমার বাপ ত নিঠুর |
ঘরের বাইর কইরা তোমায় দিল বনান্তর ||”
আগু হইয়া পরিচয় কহে কঙ্কণ দাসী |
“কঙ্কণে কিন্যাছি ধাই নাম কাঙ্কণ দাসী |”
রাণী হইল দাসী আর দাসী হইল রাণী |
কর্মদোষে কাজলরেখা জন্ম-অভাগিনী ||
সন্ন্যাসীর আদেশ মতে কাজলরেখা স্বামীর নিকট আত্ম-পরিচয় দিতে পারিল না | স্বামীর সঙ্গে
দাসী হইয়াই স্বামীর রাজ্যে চলিয়া গেল |
চন্দ্রাবতী (রচয়িতা নয়নচাঁদ ঘোষ)
[চন্দ্রাবতীকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর উপর গীতিকাব্যটি রচনা করেছেন নয়ানচাঁদ ঘোষ, আনুমানিক ২৫০ বছর আগে। নেয়া হয়েছে দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে। মোট ৩৫৪টি ছত্র আছে এতে, দীনেশচন্দ্র সেন এগুলোকে ১২টি অঙ্কে ভাগ করেছেন।]
(১) ফুল তোলা
“চাইরকোনা পুষ্কুনির পারে চম্পা নাগেশ্বর।
ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর।।”
“আমার বাড়ী তোমার বাড়ী ঐ না নদীর পার।
কি কারণে তুল কন্যা মালতীর হার।।”
“প্রভাতকালে আইলাম আমি পুষ্প তুলিবারে।
বাপেত করিব পূজা শিবের মন্দিরে।।”
“বাছ্যা বাছ্যা ফুল তুলে রক্তজবা সারি।
জয়ানন্দ তুলে ফুল ঐ না সাজি ভরি।।
জবা তুলে চম্পা তুলে গেন্দা নানাজাতি।
বাছিয়া বাছিয়া তুলে মল্লিকা-মালতি।।
তুলিল অপরাজিতা আতসী সুন্দর।
ফুলতুলা হইল শেষ আনন্দ অন্তর।।
এক দুই তিন করি ক্রমে দিন যায়।
সকালসন্ধ্যা ফুল তুলে কেউনা দেখতে পায়।।
ডাল যে নোয়াইল ধরে জয়ানন্দ সাথী।
তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী।।
একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়।
সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায়।।
(২) প্রেমলিপি
পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে।
পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে।। *
পত্র লেখে জয়ানন্দ মনের যত কথা।
“নিতি নিতি তোলা ফুলে তোমার মালা গাঁথা।।
তোমার গাঁথা মালা লইয়া কন্যা কান্দিলো বিরলে।
পুষ্পবন অন্ধকার তুমি চল্যা গেলে।।
কইতে গেলে মনের কথা কইতে না জুরায়।
সকল কথা তোমার কাছে কইতে কন্যা দায়।।
আচারি তোমার বাপ ধর্ম্মেকর্ম্মে মতি।
প্রাণের দোসর তার তুমি চন্দ্রাবতী।।
মাও নাই বাপ নাই থাকি মামার বাড়ী।
তোমার কাছে মনের কথা কইতে নাহি পারি।।
যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমার চান্দবদন।
সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন।।
তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই।
সর্ব্বস্ব বিকাইবাম পায় তোমারে যদি পাই।।
আজি হইতে ফুলতোলা সাঙ্গ যে করিয়া।
দেশান্তরি হইব কন্যা বিদায় যে লইয়া।।
তুমি যদি লেখ পত্র আশায় দেও ভর।
যোগল পদে হইয়া থাকবাম তোমার কিঙ্কর।।”
* আড়াই অক্ষর : অতি সংক্ষিপ্ত। আড়াই অক্ষরে মন্ত্রের কথা অনেক প্রাচীন বাঙ্গালা পুঁথিতেই আছে। ময়মনসিংহের গীতি-কাব্যগুলির মধ্যে অনেক জায়গাতেই আড়াই অক্ষরে লিখিত চিঠির কথা পাওয়া যায়।
(৩) পত্র দেওয়া
আবে করে ঝিলিমিলি সোনার বরণ ঢাকা।
প্রভাতকালে আইল অরুণ গায়ে হলুদ মাখা।। *
হাতেতে ফুলের সাজি কন্যা চন্দ্রাবতী।
পুষ্প তুলিতে যায় পোথাইয়া রাতি।। **
আগে তুলে রক্তজবা শিবেরে পূজিতে।
পরে তুলে মালতীফুল মালা না গাঁথিতে।। ***
হেনকালে নাগর আরে কোন কাম করে।
পুষ্পপাতে লইয়া পত্র কন্যার গোচরে।।
“ফুল তুল ডাল ভাঙ্গ কন্যা আমার কথা ধর।
পরেত তুলিবা ফুল চম্পা-নাগেশ্বর।।”
“পুষ্প তোলা হইল শেষ বেলা হইল ভারি।
পূবেত হইল বেলা দণ্ড তিন চারি।।
আমারে বিদায় কর না পারি থাকিতে।
বসিয়া আছেন পিতা শিবেরে পূজিতে।।”
“আজিত বিদায় লো কন্যা জনমের মত।”
চন্দ্রার হাতে দিল আরে সেই পুষ্পপাত।।
পুত্র নাইসে নিয়া কন্যা কোন কাম করে।
সেইক্ষণ চল্যা গেল আপন বাসরে।।
* আবে … … … মাখা : অরুণদেবের স্বর্ণ বর্ণ মেঘ ভেদ করে ঝিলমিল করছে। তিনি হলুদ দ্বারা স্নাত হয়ে উদিত হয়েছেন।
** পোথাইয়া : পোহাইয়া
*** “না” অর্থশূন্য হলেও এখানে “হ্যাঁ” অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে মূলত কথাটার উপর জোর দেয়ার জন্য।
(৪) বংশীর শিবপূজা, কন্যার জন্য বরকামনা
পুষ্পপাত বান্ধি কন্যা আপন অঞ্চলে।
দেবের মন্দির কন্যা ধোয় গঙ্গার জলে।।
সম্মুখে রাখিল কন্যা পূজার আসন।
ঘসিয়া লইল কন্যা সুগন্ধি চন্দন।।
পুষ্পপাতে রাখে কন্যা শিবপূজার ফুল।
আসিয়া বসিল ঠাকুর আসন উপর।।
পূজা করে বংশীবদন শঙ্করে ভাবিয়া। *
চিন্তা করে মনে মনে নিজ কন্যার বিয়া।।
“এত বড় হইল কন্যা না আসিল বর।
কন্যার মঙ্গল কর অনাদি শঙ্কর।।
বনফুলে মনফুলে পূজিব তোমায়।
বর দিয়া পশুপতি ঘুচাও কন্যাদায়।।
সম্মুখে সুন্দরী কন্যা আমি যে কাঙ্গাল।
সহায়-সঙ্গতি নাই দরিদ্রের হাল।।”
এক পুষ্প দিল বাপে শিবের চরণে।
ঘটক আইবে শীঘ্র বিয়ার কারণে।।
আর পুষ্প দিল বাপ বড়ঘরের বর।
“আমার কন্যার স্বামী হউক দেব পুরন্দর।।”
আর ফুল দিল বাল কুলশীল পাইতে।
বংশ বড় ভট্টাচার্য্য খ্যাতি রাখিতে।।
বর মাগে বংশীদার ভূমিতে পড়িয়া।
“ভাল ঘরে ভাল বরে কন্যার হউক বিয়া।।”
* বংশীবদন : সম্ভবত বংশীদাসের সম্পূর্ণ নাম ছিল বংশীবদন।
(৫) চন্দ্রার নির্জ্জনে পত্রপাঠ
পূজার যোগার দিয়া কন্যা নিরালায় বসিল।
জয়ানন্দের পুষ্পপাত যতনে খুলিল।।
পত্র পইড়ে চন্দ্রাবতীর চক্ষে বয়ে পানি।
কিবা উত্তর দিব কন্যা কিছুই না জানি।।
আর বর পড়ে পত্র চক্ষে বয় ধারা।
“এমন কেন হইল মন শুকের পিঞ্জরা।।
দেখি শুনি সেই ডাল ফুল তুল্যা আনি।
বয়স হইছে এখন হইলাম অরক্ষীনি।।
জৈবন আইল দেহে জোয়ারের পানি।
কেমনে লিখিব পত্র প্রাণের কাহিনী।।
কিমতে লিখিব পত্র বাপ আছে ঘরে।
ফুল তুলে জয়ানন্দ ভালবাসি তারে।।
ছোট হইতে দেখি তারে প্রাণের দোসর।”
সেই ভাবে লেখে কন্যা পত্রের উত্তর।।
“ঘরে মোর আছে বাপ আমি কিবা জানি।
আমি কেমনে দেই উত্তর অবলা কামিনী।।”
যত না মনের কথা রাখিল গোপনে।
পত্রখানি লেখে কন্যা অতি সাবধানে।।
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী করি মনের দিকে চাইয়া।
জয়ানন্দ মাগে বর ধর্ম্ম সাক্ষী দিয়া।। *
শিবের চরণে কন্যা উদ্দেশে করে নতি।
পত্র পাঠাইয়া দিল কন্যা চন্দ্রাবতী।।
পুষ্প তুলিতে কন্যা আর নাহি যায়।
এই মতে সুখে দুঃখে দিন বইয়া যায়।।
* জয়ানন্দ মাগে বর : জয়ানন্দকে বরস্বরুপ পেতে প্রার্থনা করল।
(৬) নীরবে হৃদয় দান
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে চম্পা-নাগেশ্বর।
পুষ্প তুলিতে কন্যা আইল একেশ্বর।।
“তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া।
তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা আছে মালতী-বকুল।
আঞ্চল ভরিয়া তুলব তোমার মালার ফুল।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে রক্তজবা-সারি।
তোমারে করিব পূজা প্রাণে আশা করি।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে মল্লিকা-মালতী।
জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মতন পতি।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে কেতকী-দুস্তর।
কি জানি লেখ্যাছে বিধি কপালে আমার।।”
এইরূপে কান্দে কন্যা নিরালা বসিয়া।
মন দিয়া শুন কথা চন্দ্রাবতীর বিয়া।।
(৭) বিবাহের প্রস্তাব ও সম্মতি
একদিন ত না ঘটক আইল ভট্টাচার্য্যের বাড়ী।
“তোমার ফহরে আছে কন্যা পরমা সুন্দরী।।
কুলে শীলে তুমি ঠাকুর চন্দ্রের সমান।
না দেখি এমন বংশ এথায় বিদ্যমান।।
বয়স হইল কন্যা রূপে বিদ্যাধরী।
ভাল বরে দেও বিয়া ঘটকালি করি।।”
“কেবা বর কিবা ঘর কহ বিবরণ।
পছন্দ হইলে দিব মনের মতন।।”
ঘটক কহিল “সুন্ধ্যা” গ্রামে ঘর। *
চক্রবর্ত্তী বংশে খ্যাতি কুলিনের ঘর।।
জয়ানন্দ নাম তাঁর কাত্তিক কুমার।
সুন্দর তোমার কন্যা যোগ্য বর তার।।
দেখিতে সুন্দর কুমার পড়ুয়া পণ্ডিত।
নানা শাস্ত্র জানে বর অতি সুপণ্ডিত।।
সূর্য্যের সমান রূপ বংশের দুলাল।
সুখেতে থাকিব কন্যা জানি চিরকাল।।
পশ্চিমাল বাতাসে দেখ শীতে লাগে কাটা।
এখন ধইরাছে দেখ মধ্যি গাঙ্গে ভাটা।।
আম আগছে নয়া পাতা ধরিয়াছে বউল।
এই মাসে বিয়া দিতে নাহি গণ্ডগোল।।
করকুষ্টি বিচারিয়া সম্বন্ধ মিলায়।
ভালা বরে কন্যা বিয়া দেওয়া বড় দায়।।
কুষ্টি বিচারি কৈল “সর্ব্ব সুলক্ষণ।
বরকন্যার এমন মিল ঘটে কদাচন।। **
কুষ্টিতে মিলিছে ভাল যখন এই বরে।
এই বরে কন্যাদান করিব সুস্থরে।।” ***
* সুন্ধ্যা : সুন্ধা নদীর তীরের গ্রাম
** কদাচন : কদাচিৎ
*** সুস্থরে : নিশ্চয়
(৮) বিবাহের আয়োজন
সম্বদ্ধ হইল ঠিক করি লগ্ন স্থির।
ভাল দিন হইল ঠিক পরে বিবাহের।।
দক্ষিণের হাওয়া বয় কুকিল করে রা।
আমের বউলে বস্যা গুঞ্জে ভ্রমরা।।
নয়া পাতা যত গাছে নয়া লতা ঘিরে।
ভাল দিন ঠিক হইল শঙ্করের বরে।।
সেই ত দিনে হইব বিয়া সর্ব্ব সুলক্ষণ।
পানখিল দিয়া করে বিয়ার আয়োজন।।
পাড়ার যতেক নারী পান খিলায়।
যতেক নারীতে মিলি তাঁর গান গায়।।
জয় জুকার গীত আর বাজে ঢুল।
উঠানে আকিল কত নানান জাতি ফুল।।
আধিয়া পুছিয়া সবে পানখিল দিয়া। *
আয়োজন করে সবে উতযোগ হইয়া।।
বিবাহের যত কিছু করে আয়োজন।
যতেক দেবতাগণের করিল পূজন।।
পূজিল শঙ্করে আগে দেব অনাদি।
অন্তরে যাহার নাম রাখিয়াছে বাধি।।
একে একে কৈল পূজা যত দেব আর।
শ্যামাপূজা একাচূড়া বনদূর্গা মার।।
আদিবাস হইল শুভ বিয়ার পূর্ব্বদিনে।
ক্রিয়াকাণ্ড আদি যত হইল সুবিধানে।।
চুরপানি ভরে সবে উঠিয়া প্রভাতে।
গীত জুকার যত হইল বিধিমতে।।
আব্যধিক করে বাপে মণ্ডপে বসিয়া।
তার মাটি কাটে যন্ত সধবা মিলিয়া।।
সেই দা মাটিতে ইটা তৈয়ার করিয়া।
পঞ্চ নারী মিলি দিল তৈল লাল দিয়া।।
আব্যধিক হইল শেষ জানি এক মতে।
সোহাগ মাগিল আর মায় বিধিমতে।।
আগে চলে কন্যার মায় ডালা মাথায় লইয়া।
তার পাছে কন্যার খুড়ি লোটা হাতে লইয়া।।
তার পরে যত নারী গীট জুকারে।
সহাগ মাগিল কত বাড়ী বাড়ী ফিরে।।
* পানখিল : পানের খিলি। বাংলাদেশে বিয়ের অনুষ্ঠানে পান খাওয়ার প্রচলন প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে।
(৯) মুসলমান কন্যার সাথে জয়চন্দ্রের ভাব
পরথমে হইল দেখা সুন্ধা নদীর কূলে।
জল ভরিতে যায় কন্যা কলসী কাকালে।।
চলনে খঞ্জন নাচে বলনে কুকিলা।
জলের ঘাটে গেলে কন্যা জলের ঘাট লালা।
“কে তুমি সুন্দরী কন্যা জলের ঘাটে যাও।
আমি অধমের পানে বারেক ফির্যা চাও।।
নিতি নিতি দেখ্যা তোমায় না মিটে পিয়াস।
প্রাণের কথা কও কন্যা মিটাও মনের আশ।।
পরকাশ কইরা কইতে নারি মনের ধর।
তুমি কন্যা এই জগতে প্রাণের দোসর।”
সরমে মরণ আইল কথা কওয়া দায়।
জলের ঘাটে গিয়া নাগর উকিজুকি চায়।।
লিখিয়া রাখিল পত্র ইজল গাছের মূলে।
এইখানে পড়িব কন্যা নয়ন ফিরাইলে।।
“সাক্ষী হইও ইজল গাছ নদীর কূলে বাসা। *
তোমার কাছে কইয়া গেলাম মনের যত আশা।।
এইখান আসিব কন্যা সুন্দর আকার।
এই পত্র দেখাইও আমার সমাচার।।
অন্ধকারের সাক্ষী তোমরা চান্দ আর ভানু।
এইখানে আসিবে কন্যা সোনার বরণ তনু।।
সোনার বরণ তনু কন্যা চম্পকবরণী।
তার কাছে কইও আমার দুঃখের কাহিনী।।
ফির্যা আসে জলের ঢেউ পায়ের কাছে খাড়া।
এইখান বসিয়া আমি দেখিন পশরা।।”
ভাবিয়া চিন্তিয়া নাগর যুক্তি স্থির কৈল।
কালি প্রাতে তুলতে ফুল পুষ্পবনে গেল।।
যে খান ফুট্যাছে ফুল মালতী-মল্লিকা।
ফুট্যা আছে টগর-বেলি আর শেফালিকা।।
হাতেতে ফুলের সাজি কপালে তিলক-ছটা।
ফুল তুলিতে যায় কুমার মনে বিন্ধ্যা কাঁটা।।
* ইজল : হিজল গাছ
(১০) দুঃসংবাদ
ঢুল বাজে ডাগর বাজে জয়াদি জুকার।
মালা গাঁথে কুলের নারী মঙ্গল আচার।।
এমন কালে দৈবেতে করিল কোন কাম।
পাপেতে ডুবাইল নাগর চৈদ্দ পুরুষের নাম।।
কি হইল কি হইল কথা নানান জনে কয়।
এই যে লোকেরা কথা প্রত্যয় না হয়।।
পুরীতে জুড়িয়া উঠে কান্দনের রোল।
জাতিনাশ দেখ্যা ঠাকুর হইল উতরুল।।
“কপালের দোষ, দোষ নহে বিধাতার।
যে লেখ্যা লেখ্যাছে বিধি কপালের আমার।।
মুনির হইল মতিভ্রম হাতীর খসে পা।
ঘাটে আস্যা বিনা ঝড়ে ডুবে সাধুর না।।”
পাড়া-পড়সি কয় “ঠাকুর কইতে না জুয়ায়।
কি দিব কন্যার বিয়া ঘটল বিষম দায়।।
অনাচার কেল জামাই অতি দুরাচার।
যবনী করিয়া বিয়া জাতি কৈল মার।।”
শিরেতে পড়িল বাজ মঠের মাথায় ফোড়।
পুরীর যত বাদ্যভাণ্ড সব হৈল দূর।।
ধুলায় বসিল ঠাকুর শিরে দিয়ে হাত।
বিনাদোষে হইল যেন শিরে বজ্রপাত।।
(১১) চন্দ্রার অবস্থা
“কি কর লো চন্দ্রাবতী ঘরেতে বসিয়া।”
সখিগণ কয় কথা নিকটে আসিয়া।।
শিরে হাত দিয়া সবে জুড়য়ে কান্দন।
শুনিয়া হইল চন্দ্রা পাথর যেমন।।
না কান্দে না হাসে চন্দ্রা নাহি বলে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।।
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।
জানিতে না দেয় কন্যা জল্যা মরে মনে।।
এক দিন দুই দিন তিন দিন যায়।
পাতেতে রাখিয়া কন্যা কিছু নাহি খায়।।
রাত্রিকালে শর-শয্যা বহে চক্ষের পানি।
বালিশ ভিজিয়া ভিজে নেতের বিছানি।।
শৈশবের যত কথা আর ফুলতুলা।
নদীর কূলেতে গিয়ে করে জলখেলা।।
সেই হাসি সেই কথা সদা পড়ে মনে।
ঘুমাইলে দেখিব কন্যা তাহারে স্বপনে।।
নয়নে না আসে নিদ্রা অঘুমে রজনী।
ভোর হইতে উঠে কন্যা যেমন পাগলিনী।।
বাপেত বুঝিল তবে কন্যার মনের কথা।
কন্যার লাগিয়া বাপের হইল মমতা।।
সম্বন্ধ আসিল বড় নানা দেশ হইতে।
একে একে বংশীদাস লাগে বিচারিতে।।
চন্দ্রাবতী বলে “পিতা, মম বাক্য ধর।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর।।
শিবপূজা করি আমি শিবপদে মতি।
দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি।।”
অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।
“শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে।।”*
* জয়ানন্দকে ভুলে যেতে চন্দ্রাবতী রামায়ণ লিখেছিলেন, কিন্তু মুদ্রিত হয়নি। এটার পাণ্ডুলিপি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে আছে।
(১২) শেষ
নির্ম্মাইয়া পাষাণশিলা বানাইলা মন্দির।
শিবপূজা করে কন্যা মন কর স্থির।।
অবসরকালে কন্যা লেখে রামায়ণ।
যাহারে পড়িলে হয় পাপ বিমোচন।।
জন্মথ থাকিব কন্যা ফুলের কুমারী। *
একনিষ্ট হইয়া পূজে দেব ত্রিপুরারী।।
শুধাইলে না কয় কথা মুখে নাহি হাসি।
একরাত্রে ফুটা ফুল ঝুইরা হইল বাসি।।
এমন কালেতে শুন হইল কোন কাম।
যোগাসনে বৈসে কন্যা লইয়া শিবের নাম।।
বম্ বম্ ভোলানাথ গাল-বাদ্য করি।
বিহিত আচারে পূজে দেব ত্রিপুরারী।
বৈশাখ মাসেতে হয় রবি খরতর।
গাছেতে পাকিল আম অতি সুবিস্তর।।
বারতা লইয়া আসে পত্রে ছিল লেখা।
চন্দ্রাবতী সঙ্গেতে করিতে আইল দেখা।।
এই পত্রে লিখিয়াছে দুঃখের ভারতী।
জয়ানন্দ দিছে পত্র শুন চন্দ্রাবতী।
পত্রে পড়ীল কন্যা সকল বারতা।
পত্রেতে লেখ্যাছে নাগর মনের দুঃখ কথা।।
“শুনরে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই।
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই।।
অমৃত ভাবিয়া আমি খাইয়াছি গরল।
কন্ঠেতে লাগিয়া রইছে কাল-হলাহল।।
জানিয়া ফুলের মালা কালসাপ গলে।
মরণে ডাকিয়া আসি আন্যাছি অকালে।।
তুলসী ছাড়িয়া আমি পূজিলাম সেওরা।
আপনি মাথায় লইলাম দুঃখের পসরা।।
জলে বিষ বাতাসে বিষ না দেখি উপায়।
ক্ষমা কর চন্দ্রাবতী ধরি তোমার পায়।।
একবার দেখিব তোমায় জন্মশেষ দেখা।
একবার দেখিব তোমার নয়নভঙ্গি বাঁকা।।
একবার শুনিব কন্যা মধুরসবাণী।
নয়নজলে ভিজাইব রাঙ্গা পা দুইখানি।।
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
পুণ্যমুখ দেখ্যা আমি জুড়াইব অন্তরা।।
শিশুকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের মালা।
তোমারে দেখিতে কন্যা মন হইল উতালা।।
জলে ডুবি বিষ খাই গলায় দেই দড়ি।
তিলেক দাড়াইয়া তোমার চান্দমুখ হেরি।।
ভাল নাহি বাস কন্যা এই পাপিষ্ঠ জনে।
জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে।।
এই দেখা চক্ষের দেখা এই দেখা শেষ।
সংসারে নাহিক আমার সুখশান্তির লেশ।।
একবার দেখিয়া তোমার ছাড়িব সংসার।
কপালে লেখ্যাছে বিধি মরণ আমার।।”
পত্র পড়ি চন্দ্রাবতী চক্ষের জলে ভাসে।
শিশুকালের স্বপ্নের কথা মনের মধ্যে আসে।।
এক বার দুই বার তিন বার করি।
পত্র পড়ে চন্দ্রাবতী নিজ নাম স্মরি।।
নয়নের জলে কন্যার অক্ষর মুছিল।
এক বার দুই বার পত্র যে পড়িল।।
“শুন শুন বাপ আগো শুন মোর কথা।
তুমি সে বুঝিবে আমি দুঃখিনীর ব্যথা।।
জয়ানন্দ লেখে পত্র আমার গোচরে।
তিলেকের লাগ্যা চায় দেখিতে আমারে।।”
“শুন গো প্রাণের কন্যা আমার কথা ধর।
একমনে পূজ তুমি দেও বিশ্বেশ্বর।।
অন্য কথা স্থান কন্যা নাহি দিও মনে।
জীবন মরণ হইল যাহার কারণে।।
নষ্ট হইল পুজার ফুল ছুঁইল যবনে।
না লাগে উচ্ছিষ্ট ফল দেবের কারণে।।
আছিল গঙ্গার জল অপবিত্র হইল।
বিধাতা সাধিছে বাদ সব নষ্ট হইল।।
তুমি যা লইছ মাগো সেই কাজ কর।
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর।।
পত্র লিখি চন্দ্রাবতী জয়ের গোচরে।
পুষ্পদূর্ব্বা লইয়া কন্যা পশিল মন্দিরে।
যোগাসনে বসে কন্যা নয়ন মুদিয়া।
একমনে করে পূজা ফুলবিল্ব দিয়া।।
শুকাইল আঁখির জল সর্ব্ব চিন্তা দূরে।
একমনে পূজে কন্যা অনাদি শঙ্করে।।
কিসের সংসার কিসের বাস কেবা পিতামাতা।
পূজিতে তুলিল কন্যা শৈশবের কথা।
জয়ানন্দ চুলি কন্যা পূজয়ে শঙ্করে।
একমনে ভাবে কন্যা হর বিশ্বেশ্বরে।
শান্তিতে আছয়ে কন্যা একনিষ্ঠ হইয়া।
আসিল পাগল জয়া শিকল ছাড়িয়া।।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী তোমারে শুধাই।
জীবনের শেষ তোমায় একবার দেখ্যা যাই।।
আর না দেখিব তোমায় নয়ন চাহিয়া।
দোষ ক্ষমা কর কন্যা শেষ বিদায় দিয়া।।”
কপাটে আঘাত করে শিরে দিয়া হাত।
বজ্রের সমান করে বুকেতে নির্ঘাত।।
যোগাসনে আছে কন্যা সমাধিশয়নে।
বাহিরের কথা কিছু নাহি পশে কানে।।
পাগল হইয়া নাগর কোন কাম করে।
চারিদিকে চাহিয়া দেখে নাহি দেখে কারে।।
না খোলে মন্দিরের কপাট নাহি কয় কথা।
মনেতে লাগিল যেমন শক্তিশেলের ব্যথা।।
পাগল হইল জয়ানন্দ ডাকে উচ্চৈস্বরে।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দেও আমারে।।
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
ইহজন্মের মতন কন্যা দেও মোরে সাড়া।।
দেবপূজার ফুল তুমি গঙ্গার পানি।
আমি যদি ছুই কন্যা হইবা পাতকিনী।।
নয়ন ভরে দেখ্যা যাই জন্মশোধ দেখা।
শৈশবের নয়ান দেখি নয়ানভঙ্গি বাঁকা।।”
না খোলে মন্দিরের দ্বার মুখে নাহি বাণী।
ভিতরে আছরে কন্যা যৈবনে যগিনী।।
চারি দিকে চাইয়া নাগর কিছু নাহি পায়।
ফুট্যাছে মালতীফুল সামনে দেখতে পায়।।
পুষ্প না তুলিয়া নাগর কোন কাম করে।
লিখিল বিদায়পত্র কপাট উপরে।
“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।।”
ধ্যান ভাঙ্গি চন্দ্রাবতী চারিদিকে চায়।
নির্জন অঙ্গন নাহি কারে দেখতে পায়।।
খুলিয়া মন্দিরের দ্বার হইল বাহির।
কপাটে আছিল লেখা পড়ে চন্দ্রাবতী।
(এই লাইনটি নেই)
অপবিত্র হইল মন্দির হইল অধোগতি।
কলসী লইয়া জলের ঘাটে করিল গমন।
করিতে নদীর জলে স্নানাদি তর্পণ।।
জলে গেল চন্দ্রাবতী চক্ষে বহে পানি।
হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজানি।। **
একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়ানন্দের দেহ।।
দেখিতে সুন্দর নাগর চান্দের সমান।
ঢেউয়ের উপর ভাসে পুন্নুমাসীর চান।।
আঁখিতে পলক নাহি মুখে নাই সে বাণী।
পারেতে খাড়াইয়া দেখে উমেদা কামিনী।। ***
স্বপ্নের হাসি স্বপ্নের কান্দর নয়ান চান্দে গায়।
নিজের অন্তরের দুষ্কু পরকে বুঝান দায়।।
* জন্মথ : আজন্ম আইবড়
** ধরিছে উজানি : উজান বয়ে চলছে
*** উমেদা : উন্মত্ত
দস্যু কেনারামের পালা (রচয়িতা – চন্দ্রাবতী)
কেনারামের জন্ম ও নানা কষ্ট
তার পরে যশোধরা শুন দিয়া মন |
মাসেকের মধ্যে হৈল গর্ভের লক্ষণ ||
সুগোল সুন্দর তনুগো লাবণি জড়িত |
সর্ব্ব অঙ্গ দিনে দিনে হইল পূরিত ||
অজীর্ণ অরুচি আর মাথাঘোরা আদি|
আলস্য জড়তা হৈল আছে যত ব্যাধি।।
সর্ব্ব অঙ্গে জ্বলে মাথা তুলিতে না পারে।
আহার করিয়া মাত্র ফেলে বমি করে।।
রুচী হৈল চূকা আর ছিকর মাটিতে |
বিছানা ছাড়িয়া শুয়ে কেবল ভূমিতে ||
এহি মতে দশ মাস দশ দিন গেল |
পরেত গর্ভেত এক ছাওয়াল জন্মিল।।
চন্দ্রাবতী কয় শুনগো অপুত্রার ঘরে।
সুন্দর ছাওয়াল হৈল মনসার বরে।।
মায়ের অঞ্চলের নিধিগো মায়ের পরাণী।
দিন দিন বাড়ে যেমন চাঁদের লাবণী।।
ছয় না মাসের শিশুগো হইল যখন।
মহা আয়োজনে করে অন্ন পরশন।।
বাছিয়া রাখিল মায়ে গো শুন কিবা নাম।
দেবীর পূজার কিনা তাই “কেনারাম”।।
হায়রে দারুণ বিধি কি লিখিয়া ভালে |
মরিলা জননী হায়রে সাত মাসের কালে ||
কোলেতে লইয়া পুত্র কান্দে খেলারাম |
“কি হেতু হৈলা মর প্রতি বাম ||
মাও ভিন্ন কে বা জানেরে পুত্রের বেদন |
যাহার স্তনেতে হয় শরীর পালন ||
সেই মায়ের নিলা কারি কিসের কারণে |
কি মতে বাঁচাইয়া পুত্র রাখিব জীবনে ||
অপুত্রা ছিলামগো মোরা সেই ছিল ভাল |
ভুলাইয়া মায়ায় পরে কেন দেও শেল ||”
কান্দিয়া কান্দিয়া তবে যায় খেলারাম |
পুত্র কোলে উপনিত দেবপুর গ্রাম ||
সোহিত গ্রামেতে হয় মাতুল আলয় |
মামার বাড়ীতে কেনা কিছুদিন রয় ||
দুগ্ধ দিয়া মামী তার পালয়ে কুমারে |
দিনে দিনে বাড়েগো শিশু দেবতার বরে।।
এক না বছরের শিশু হইল যখন।
খেলারাম গেল তীর্থ করিতে ভ্রমণ।।
এক দুই করি পার তিন বছর গেল।
খেলারাম ঘরে আর ফিরিয়া না আসিল।।
এমত সময় পরে শুন সভাজন।
আকাল হইলোগো অনাবৃষ্টির কারণ।।
এক মুষ্টি ধান্য নাহি গৃহস্থের ঘরে।
অনাহারে পথে ঘাটে যত লোক মরে।।
আগেত বৃক্ষের ফল করিল ভোজন।
তাহার পরে গাছের পাতা করিল ভক্ষণ।।
পরেও ঘাসেতে নাহি হইল কুলান।
ক্ষুধায় কাতর হইল যত লোকজন।।
গরুবাছুর বেচিয়া খাইল খাইল হালিধান।
স্ত্রীপুত্র বেচে নাহি গো গণে কুলমান।
পরমাদ ভাবিল মাতুল কেমনে বাচে প্রাণ।
কেনারামে বেচল লইয়া পাঁচ কাঠা ধান।।
দেওয়ান ভাবনা (রচিয়তা – অজ্ঞাত)
(অজানা কবির রচনা “দেওয়ান ভাবনা” পালা। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে এটি চন্দ্রাবতীর রচনা।)
|| ৩ ||
গাঁথ গাঁথ সুন্দর কন্যালো মালতীর মালা |
ঝইরা পড়ছে সোনার বকুল গো ঐনা গাছের তলা ||
তোমার বিয়ার ঘটক আইছে লো কালুকা বিহানে |
কেমন করে দিব বিয়াগো ভাবে মনে মনে ||
বরমা যে লেখ্যাছে কলমরে কপালে তোমার |
ভাবিয়া চিন্তিয়া মায় দেখে অন্ধকার ||
এইতনা ঘটক ফির্ য়া গেলগো পছন্দ না হয় |
চান্দের সমান কন্যাগো বর যে কালা হয় ||
এই ঘটক ফির্ য়া গেলরে আর ঘটক আইল |
সোনাইর বিয়া দিতে মায়ের গো মন না উঠিল ||
যেমন সুন্দর কইন্যা গো তেমন না আইল বর |
তার মধ্যা থাকব জামাইর বারবাংলার ঘর ||
সোনার কার্ত্তিক অইবো জামাই গো যেমন চান্দের ছটা |
কুলে শীলে বংশে ভালা গো জমিদারের বেটা ||
যতেক সম্বন্ধ আইল গো সোনাইর মায়ে নাই সে বাসে |
এহি মতে আইল ঘটক পরতি মাসে মাসে ||
দেওয়ানা মদিনা / আলাল দুলালের পালা (রচিয়তা – জালাল গাইন / মনসুর বয়াতী)
|| ২ ||
আওরতের লাগ্যা কান্দে দেওয়ান সোনাফর |
আলাল দুলাল কাইন্দা অইল জর্ জর্ ||
কান্দিয়া কান্দিয়া তারা ভূমিতে লুটায় |
দানা পানি ছাড়্যা কেবল করে হায় হায় ||
মায়ের জানে পুতের বেদন অন্যে জান্ ব কি |
মায়ের বুকের লৌ পুত্র আর ঝি ||
দুই না ছেউরা ছাওয়ালে বুকেতে করিয়া |
সোনাফর মিঞা কান্দে মাথা থাপাইয়া ||
দুধের ছাওয়ালে কেমনে বাঁচাই পরাণে |
অনাধারে মরে কেমনে দেখিব নয়ানে ||
মা মা বল্যা যখন আরে আলাল দুলাল কান্দে |
বুকেতে আমার হয়রে ছেল যেমন বিন্ধে ||
কি দিয়া বুঝাইয়া রাখি চেউড়া পুত্রেরে |
কে বা খাওন দেয় আরে পরিলাম ফেরে ||
মর্ য়াত না গেছ আওরাত গিয়াছ মারিয়া |
তিনলা পরাণি মার্ য়া গেছ পলাইয়া ||
কি দুষ্মনি কইর্ য়াছিলাম আর জনমে আমি |
তার পর্ তিশোধ লইয়া এই না জন্মে তুমি ||
বান্যাচঙ্গের দেওয়ান আমি নাহি মোর সমান |
অদুন্যাই ধন দৌলত গোলাভরা ধান ||
পন্থের ফকির অইল আরে আমার থাক্যা সুখী |
দুনিয়াতে নাই আর আমার মত দুখী ||
কি করিব ধন দৌলতে আর কি ছার দেওয়ানি |
দিলের দুঃখেতে যদি চক্ষে ঝরে পানি ||
কেবা খাইব আমার যে এই ধন দৌলত |
শূণ্য অইল ঘর মোর মরিয়া আওরাত ||
বুকে ছেল দিয়া গেলা তুমি কোন্ পরাণে |
দুনিয়া যে দেখি আমি আন্ধাইর নয়ানে ||
তুমি যে আছিলা আন্ধাইর ঘরের বাতি |
তুমি যে আছিলা আমার হৃদ-পিঞ্জরার পংখী ||
তোমারে ছাড়িয়া আমি বাঁচি কোন পরাণে |
তেজিতাম পরাণি আমি তোমার কারণে ||
তোমার পিছ লইতাম আমি এই আছিল মনে |
দুধের বাচ্চা রাইখ্যা গিয়া ফালাইলা বে-নালে ||
এইনা কানেদে দেওয়ান আরে বুক না কুটিয়া |
পাড়া পরশী পরা’ব পাইল তারে না বোঝাইয়া ||
ঘর খালি অইল আর গুরজান না চলে |
সোনার সংসার বের্ত্তা হায়রে যায় যে বিফলে ||
ঘরের লক্ষ্মী জননা আরে তার যে লাগিয়া |
বান্ধা সংসার মিঞার যায় যে ভাসিয়া ||
দিবা নিশি চিন্তে মিঞার দুঃখ অইল দিলে |
দরবার বিচার হায়রে কিছু না চলে ||
কিসের সংসার কিসের বাস কেমনে সুখ মিলে |
মনসুর বয়াতি কয় সুখ না থাকলে দিলে ||
উজীর নাজীর সবে আরে এই না দেখিয়া |
মিয়ার নিকট কয় দরশন দিয়া ||
“শুন্ খাইন দেওয়ান সাহেব শুন্ খাইন আমার কথা |
সোনার সংসার আপনারে নষ্ট অইল বির্থা ||
আর এক সংসার কর্ য়া রাখ্যুয়াইন দেওয়ানি বজায় |
এক জনের লাগ্যা কেন সগল জলে যায় ||”
কান্দিয়া দেওয়ান কয় আরে উজীরে নাজীরে |
“দুধের বাচ্চা আলাল দুলাল আছে মোর ঘরে ||
তারার দুঃখ দেখ্যা আমার ফাট্যা যায় বুক |
সাদি করিলে অইব দুঃখের উপর দুখ ||
সতাই না বুঝে সতীন-পুতের বেদন |
সতির-পুতে দেখে সতাই কাঁটার সমান ||
সেই কাঁটা তুইল্যা সতাই দূরেতে ফালায় |
এরে দেখ্যা মন নাই সে সাদি করতে চায় ||
কলিজার লৌ মোর আলাল দুলাল |
দুঃখের উপর দুঃখ দিয়া না বাড়াই জঞ্জাল ||
আলাল দুলালে বিবি আমায় সপ্যা দিয়া |
সাদি না করিতে গেল মানা যে করিয়া ||
বিয়া নাই সে করবাম আমি সংসারের লাগিয়া |
কিসের সংসার আলাল দুলালে মারিয়া ||
তারা মুখ দেখ্যা আছি আরে বাঁচিয়া পরাণে |
রাক্ষসের হাতে নাই সে দিবাম জীবমানে ||
এই কথা শুনিয়া উজার কয় মিঞার কাছে |
কান্দিয়া কাটিয়া সাহেব ফয়দা নাই সে আছে ||
সতাই সকল সাহেব আরে না হয় সমান |
সতীন্ পুতের লাগ্যা কেউ দেয় জান পরাণ ||
আলাল দুলালে যতন করিবাম সকলে |
দুঃখ নাই সে পাইব কিছু সতাই বাদী অইলে ||
দিলের দুঃখ দূর কইরা কর্ খাইন এক বিয়া |
সোনার সংসার পাল্ খাইন যতন করিয়া ||
এই কথা শুনিয়া মিয়া চিন্তে মনে মনে |
কিছু ফয়দা নাই মোর সংসার ছাড়নে ||
সোনার কলি আলাল দুলাল রহিলে বাঁচিয়া |
সংসার না থাকলে তারা খাইব করিয়া ||
সংসার নষ্ট অইলে পরে অইব তারার দুঃখ |
চিরদিন দুঃখে হায় ফাটিব যে বুক ||
আমার বুকের ধন রাখবাম যতন করিয়া |
কি সাধ্য সতাই নেয় তারারে কাড়িয়া ||
এই মতে দেওয়ান আরে চিন্তে মনে মনে |
উজীর নাজীর লাগা পাছে বিয়ার কারণে ||
মনস্থির কইরা দেওয়ান অইলা সম্মত |
সাদি অইলা গেল পরে যেমন বিহিত ||
মলুয়া (রচয়িতা চন্দ্রাবতী)
বন্দনা
আদিতে বন্দিতে গাই আনাদি ঈশ্বর |
দেবের মধ্যে বন্দি গাই ভোলা মহেশ্বর ||
দেবীর মধ্যে বন্দি গাই শ্রীদুর্গা ভবানী |
লক্ষ্মী সরস্বতী বন্দুম যুগল নন্দিনী ||
ধন সম্পদ মিলে লক্ষ্মীরে পূজিলে |
সরস্বতী বন্দি গাই বিদ্যা যাতে মিলে ||
কার্ত্তিক গণেশ বন্দুম যত দেবগণ |
আকাশ বন্দিয়া গাই গড়ুর পবন ||
চন্দ্র সূর্য বন্দিয়া গাই জগতের আখি |
সপ্ত পাতাল বন্দুম নাগান্ত বাসুকী ||
মনসা দেবীরে বন্দুম আস্তিকের মাতা |
যাহার বিষের তেজ ডরায় বিধাতা।।
ভক্ত মধ্যে বন্দিয়া গাই রাজা চন্দ্রধর।
তার সঙ্গে বন্দিয়া গাই বেউলা-লক্ষ্মীন্দর।।
নদীর মধ্যে বন্দিয়া গাই গঙ্গা ভাগীরথী।
নারীর মধ্যে বন্দিয়া গাই সীতা বড় সতী।।
বক্ষের মধ্যে বন্দিয়া গাই আদ্যের তুলসী।
তীর্থের মধ্যে বন্দিয়া গাই গয়া আর কাশী।।
সংসারের সার বন্দুম বাপ আর মায়ে।
অভাগীর জনম হইল যার পদ ছায়ে।।
মুনির মধ্যে বন্দিয়া গাই বাল্মীকি তপোধন।
তরুলতা বন্দিয়া গাই স্থাবর জঙ্গম।।
জল বন্দুম স্থল বন্দুম আকাশ পাতাল।
হর শিরে বন্দিয়া গাই কাল মহাকাল।।
তার পরে বন্দিলাম শ্রীগুরু চরণ।
সবার চরণ বন্দিয়া জানাই নিবেদন।।
চার কুনা পৃথিবী বন্দিয়া করিলাম ইতি।
সলাভ্য বন্দনা গীতি গায় চন্দ্রাবতী।।
জলপ্লাবন ও দুর্ভিক্ষ
মন্দ্যান্যা আইশনারে পানি ভাটি বাইয়া যায়।
চান্দ বিনোদে ডাক্যা কইছে তার মায়।।
“উঠ উঠ বিনোদ আরে ডাকে তোমায় মাও।
চান্দ মুখ পাখলিয়া মাঠের পানে যাও।।
মাঠের পানে যাওরে যাদু ভালা বান্দ আইল।
আগণ মাসেতে হইবে ক্ষেতে কার্তিকা সাইল।।
মেঘের ডাকে গুরু গুরু ডাক্যা তুলে পানি।
সকাল কইরা ক্ষেতে যাও আমার যাদুমণি।।
আশমান ছাইল কালা মেঘে দেওয়ায় ডাকে বইয়া।
আর কত কাল থাকবে যাদু ঘরের মাঝে শুইয়া||”
আইল আইশনারে পানি উভে কর্ ল তল|
ক্ষেতে কিশ্যি ডুবাইয়া দিল না রইল সম্বল।।
দেশে আইল দূর্গাপূজা জগত্ জননী।
কুলের ছাল্যা বান্ধ্যা দিয়া পূজে দূর্গা রাণী।।
এই মতে আশ্বিন গেল, আইল কার্ত্তিক মাস।
ষরু শস্য ক্ষেতে নাই হইল সর্ব্বনাশ।।
লাগিয়া কার্ত্তিকের উষ গায়ে হইল জ্বর।
বিনোদের মায়ে কান্দে হইয়া কাতর।।
জোড়া মইষ দিয়া মায় মানসিক করে।
মায়ত করিয়া কয় পুত্র বুঝি মরে।।
দোবের দোয়াতে পুত্র পরাণের বাচিল।
এমতে কার্ত্তিক গিয়া আগুণ পড়িল।।
উত্তরিয়া শীতে পরাণ কাঁপে থরথরি।
ছিড়া বসন দিয়া মায় অঙ্গ রাখে মুরি।।
ভালা হইল চান্দ বিনোদ দেবতার বরে।
ঘরে নাই সে লক্ষ্মীর দানা লক্ষ্মী পূজার তরে।।
ধারেতে কাচি আন্যা মায়ে তুল্যা দিল হাতে।
“ক্ষেতে যাওরে পুত্র আমার ধান্য যে কাটিতে।।”
পাঞ্চ গাছি বাতার ডুগল হাতেতে লইয়া।
মাঠের মাঝে যায় বিনোদ বারমাসী গাইয়া।।
আশ্বিনা পানিতে দেখে মাঠে নাইক ধান।
এরে দেখ্যা চান্দ বিনোদের কান্দিল পরাণ।।
চান্দ বিনোদ আসি কয় মায়ের কাছে।
“আইশনা পানিতে মাও সব শস্যি গেছে।।”
মায়ে কান্দে পুত্র কান্দে সিরে দিয়ে হাত।
সারা বছরের লাগ্যা গেছে ঘরের ভাত।।
টাকায় দেড় আড়া ধান পইড়াছে আকাল।
কি দিয়া পালিব মায় কুলের ছাওয়াল।।
পোষ মাসে পোষা আন্ধি বিনোদে ডাকিয়া।
মায় পুতে যুক্তি করে ঘরেতে বসিয়া।।
আছিল হালের গরু বেচিয়া খাইল।
পাঁচ গোটা ক্ষেত বিনোদ মাজনে দিল।।
খেত খোলা নাই তার, নাই হালের গরু।
না বুনায় ধান কালাই না বুনায় সরু।।
ভাবিয়া চিন্তিয়া বিনোদ কোন কাম করে।
মাঘ ফাল্গুন দুই মাস কাটাইল ঘরে।।
চৈত বৈশাখ মাস গেল এই মতে।
জৈষ্ঠ মাসেতে বিনোদ পিঁজরা লইল হাতে।।
মায়েরে ডাকিয়া কয় মধুরস বাণী।
“কুড়া শিগারে যাইতে বিদায় দাও মা জননী।।”
ঘুম থাক্যা উঠ্যা বিনোদ মায়েরে কহিল।
কুড়া শিগারে যাইতে বিদায় মাগিল।।
টিক্কা না জ্বালাইয়া বিনোদ হুক্কায় ভরে পানি।
ঘরে নাই বাসি ভাত কালা মুখখানি।।
ঘরে নাই খুদের অন্ন কি রান্ধিব মায়।
উপাস করিয়া পুত্র শিকারেতে যায়।।
মায়ের আক্ষির জলে বুক যায়রে ভাসি।
ঘরতন বাহির হইল বিনোদ বিলাতের উপাসী।।
জষ্ঠি মাসে রবির জ্বালা পরনের নাই বাও।
পুত্রেরে শিগার দিয়া পাগল হইল মাও।।
মহুয়া (রচয়িতা দ্বিজ কানাই)
|| ১৬ ||
প্রেমের জয়
পাষাণে বান্ধিয়া হিয়া বসিল শিওরে |
নিদ্রা যায় নদীয়ার ঠাকুর হিজল গাছের তলে ||
আশমানের চান্দ যেমন জমিনে পড়িয়া |
নিদ্রা যায় নদীয়ার চান্ অচৈতন্য হইয়া ||
একবার দুইবার তিনবার করি |
উঠাইল নামাইল কন্যা বিষলক্ষের ছুরি ||
“উঠ উঠ নদ্যাঠাকুর কত নিদ্রা যাও |
অভাগী মহুয়া ডাকে আঁখি মেইল্যা চাও ||
পাষাণ বাপে দিল ছুরি তোমায় মারিতে |
কিরূপে বধিব তোমায় নাহি লয় চিতে ||
পাষাণ আমার মা ও বাপ পাষাণ আমার হিয়া |
কেমনে ঘরে যাইবাম ফিইরা তোমারে মারিয়া ||
জ্বালিয়া ঘিয়ের বাতি ফু দিয়া নিবাই |
তুমি বন্ধুরে আমার আর লইক্ষ্যা নাই ||
তুমারে মারিয়া আমি কেমনে যাইবাম ঘরে |
পাষাণ হইয়া মা ও বাপে বধিল আমারে ||
কাজ নাই ভিন দেশী বন্ধুরে দুঃখ নাইরে করি |
আমার বুকে মারবাম আমি এই বিষলক্ষ্যের ছুরি ||”
কি কর কি কর কন্যা কি কর বসিয়া |
কাঞ্চা ঘুম জাগে ঠাকুর স্বপন দেখিয়া ||
শিওরে বসিয়া দেখে কান্দিছে সুন্দরী |
হাতে তুইল্যা লইছে কন্যা বিষলক্ষ্যের ছুরি ||
“শুন শুন ঠাকুর আরে শুন মোর কথা |
কঠিন তোমার প্রাণ পিওয়া কঠিন মাতা পিতা ||
শানে বান্ধা হিয়া আমার পাযাণে বান্ধা প্রাণ |
তোমায় বধিতে বাপে করিল সইন্ধান ||
হাতেত আছিল মোর বিষলক্ষের ছুরি |
তোমারে ছাড়িয়া বন্ধু আমার বুকে মারি ||
পালাইয়া মায়ের ধন নিজের দেশে যাও |
সুন্দর নারী বিয়া কইরা সুখে বইসা খাও ||
বরামনের পুত্র তুমি রাজার ছাওয়াল |
তোমার সুখের ঘরে আমি হইলাম কাল ||
কি করিতে কি করিলাম নাহি পাই দিশা |
অরদিশ হইয়া আমি……………….||
মাও ছাড়ছি বাপ ছাড়ছি ছাড়ছি জাতি কুল |
ভমর হইলাম আমি তুমি বনের ফুল ||
তোমার লাগিয়া কন্যা ফিরি দেশে বিদেশে |
তোমারে ছাড়িয়া কন্যা আর না যাইবাম দেশে ||
কি কইবাম বাপ মায়ে কেমনে যাইবাম ঘরে |
জাতি নাশ করলাম কন্যা তোমারে পাইবার তরে ||
তোমায় যদি না পাই কন্যা আর না যাইবাম বাড়ী |
এই হাতে মার লো কন্যা আমার গলায় ছুরি ||
“পইড়া থাকুক বাপ মাও পইড়া থাকুক ঘর |
তোমারে লইয়া বন্ধু যাইবাম দেশান্তর ||
দুই আঁখি যে দিগে যায় যাইবাম সেইখানে |
আমার সঙ্গে চল বন্ধু যাইবাম গহীন বনে ||
বাপের আছে তাজি ঘোড়া ঐ না নদীর পারে |
দুইজনেতে উঠ্যা চল যাইগো দেশান্তরে ||
না জানিবে বাপ মায় না জানিবে কেহ |
চন্দ্র সূর্য সাক্ষী কইরা ছাইড়া যাইবাম দেশ ||
আবে করে ঝিলিমিলি নদীর কুলে দিয়া |
দুইজনে চলিল ভালা ঘোড়ায় সুয়ার হইয়া ||
চান্দ সূরুজ যেন ঘোড়ায় চলিল |
চাবুক খাইয়া ঘোড়া শণেতে উড়িল ||
রূপবতী (রচিয়তা – অজ্ঞাত)
|| ১ ||
রাজ্য করে রাজচন্দ্র রামপুর শহরে |
বারবাংলার ঘর বান্ ছে ফুলেশ্বরীর পারে ||
গড় খন্দর রাজার লাখের জমিদারী |
হস্তি ঘোড়া আছে রাজার পাইক পটুয়ারী ||
ঢুলী নাগারচী রাজার রাজ্যে বাস করে |
রসুনচকি বাজায় তারা হাফার খানা ঘরে ||
সেইত গীত না শুনিয়া রাজা জাগে বিয়ান বেলা |
দরবারে বসিল রাজা সহিত আমলা ||
সভাজনেরে রাজা ডাক দিয়া কয় |
“নবাবের দরবারে যাইতে উচিত যে বোধ হয় ||”
গণকে ডাকিয়া রাজা দিন স্থির করে |
অষ্ট দিন বাকি আছে যাইতে নবাবের সরে ||
কানা চইতা উভুতিয়া তারা দুইটি ভাই |
পানসী সাজাইতে তারা পাইল ফরমাই ||
ষোল দাঁড় জুইত করে আরও তুলে পাল |
পানসীতে ভরিয়া রাজা তুলে মালামাল ||
আবের কাঁকই লইল রাজা আবের চিরুনী |
আবেতে রাঙ্গিয়া লইল খাড়ি আর বিউনী ||
হাত্তির দাঁতের পাটি লইল গজমতি মালা |
ভেট দিতে নবাবের করিল যে মেলা ||
খাজনা উগাইয়া তঙ্কা লইল দশ হাজার |
গাউইয়া বাজুইয়া লইল সঙ্গে এক ঝাড় ||
উজান পানি বাইয়া রাজা পানসী বাইয়া যায় |
নাগরীয়া যত লোক করিল বিদায় ||
দানদক্ষিণা আদি পূণ্যকার্য করি |
রাণীর কাছে সঁপিয়া গেল কুলের কুমারী ||
চারিদিকে নানা গ্রাম নেহালিয়া দেখে |
ফুলেশ্বরী উথারিয়া পড়ে নরসুন্দার মুখে ||
সেই নদী ছড়াইয়া যায় ঘোড়া-উত্রা বাইয়া |
মেঘনা সায়রে পানসী চলিল ভাসিয়া ||
ঢেউয়ের করে বাইড়াবাইড়ি কাছাড় ভাইঙ্গা পড়ে |
এই মতে যার রাজা নবাবের সরে ||
তিন মাসথাক্যা রাজা জলের উপর |
চাইর মাসে গেল রাজা নবাবের সর ||
সঙ্গের যতেক দ্রব্য যত লোকজনে |
একে একে ভেট দিল নবাবের স্থানে ||
পূবইয়া আবের কাকই আবের চিরুনী |
চক্ষে না দেখেছি শুধু লোকমুখে শুনি ||
শীতল পাটি পাইয়া তবে শিতল হইল মন |
পাইল ভেটের দ্রব্য যত আয়োজন ||
দশ হাজার তঙ্কা পাইয়া খুসী হইল মিঞা |
রাজচন্দ্রে দিলা ঘর বাছাই করিয়া ||
নবাবের সরে রাজা আছে খুসী মন |
ঘরেতে থাকিয়া রাণী দেখিল স্বপন ||