- বইয়ের নামঃ মৈমনসিংহ গীতিকা
- লেখকের নামঃদীনেশচন্দ্র সেন
- প্রকাশনাঃ জয় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
কঙ্ক ও লীলা (রচিয়তা – কবি দামোদর দাস, রঘুসুত, নয়ানচাঁদ ঘোষ এবং শ্রীনাথ বানিয়া)
|| ৮ ||
গোপন দীক্ষা
জুহরী জহর চিনে বেনে চিনে সোনা |
পীর প্যাগাম্বর চিনে সাধু কোন জনা ||
পীরের অদ্ভুত কাণ্ড সকলি দেখিয়া |
কঙ্কের পরাণ গেল মোহিত হইয়া ||
সর্ব্বদা নিকটে কঙ্ক ভক্তিপূর্ণ মনে |
চরণে লুটায় তার দেবতার জ্ঞানে ||
তার পর জাতি ধর্ম সকলি ভুলিয়া |
পীরের প্রসাদ খায় অমৃত বলিয়া ||
দীক্ষিত হৈলা কঙ্ক যবন পীরের স্থানে |
সর্ব্বনাশের কথা কঙ্ক কিছুই না জানে ||
জাতি-ধর্ম নাশ হইল রটিল বদনাম |
পীরের নিকটে কঙ্ক শিখিয়ে কালাম ||
পীরের নিকটে যায় কেউ নাহি জানে |
গতায়তি করে কঙ্ক অতি সংগোপনে ||
ভক্তি-মুক্তি-তন্ত্র-মন্ত্র-দেহ মন প্রাণ |
অচিরে গুরুর পদে কৈল সমর্পণ ||
গুরুতে বিশ্বাস আর গুরু ইষ্ট ধন |
দামোদর দাস কহে এই ভক্তের লক্ষণ ||
|| ৯ ||
সত্যপীরের পাঁচালী
দেখিয়া শুনিয়া পীর, কঙ্কেরে করিলা স্থির,
উপযুক্ত ভক্ত এহি জন |
সত্যপীরের পাঁচালী, কঙ্কেরে লিখিতে বলি,
একদিন হৈল-অদর্শন ||
গুরুর আদেশ মানি, লিখিয়া পাঁচালী আনি,
পাঠাইলা দেশে আর বিদেশে |
কঙ্কের লিখন কথা, ব্যক্ত হৈল যথা তথা,
দেশ পূর্ণ হৈল তার যশে ||
কঙ্ক আর রাখাল নহে, কবিকঙ্ক লোক কহে,
শুনি গর্গ ভাবে চমত্কার |
হিন্দু আর মোসলমানে, সত্যপীরে উভে মানে,
পাঁচালীর হৈল সমাদর ||
যেই পূজে সত্যপীরে, কঙ্কের পাঁচালী পড়ে,
দেশে দেশে কঙ্কের গুণ গায় |
বুঝি কঙ্কের দিন ফেরে, রঘুসুত কহে ফেরে,
দুঃখিতের দুঃখ নাহি যায় ||
|| ১০ ||
কঙ্ককে জাতিতে তোলা
জানিয়া শুনিয়া কানে, ভাবে গর্গ মনে মনে,
নহে কঙ্ক সামান্য মানব |
ভক্তিমান অতি ধীর, গর্গ কৈলা মনে স্থির,
কঙ্ক ঘরে তুলিয়া লইব ||
পণ্ডিত সমাজী গণে, একত্র করিয়া ভণে,
“এই কঙ্ক ব্রাহ্মণ-তনয় |
জ্ঞন মানে নাহি রয়, চণ্ডালের অন্ন খায়,
ঘরে নিতে নাহিক সংশয় ||”
এতেক শুনিয়া নন্দু, আর যত গোড়াহিন্দু,
কয় সবে মাথা নাড়াইয়া |
“আমরা সম্মত নহি, আরও শুন সবে কহি,
লহ কঙ্কে মোদের ছাড়িয়া ||”
আর এক দল ভয়ে গর্গে ডরাইয়া |
গর্গের কথায় শুধু গেল সায় দিয়া ||
আদেখা হইলে গর্গ করে কত ফন্দি |
কঙ্কে না তুলিতে গর্গে করে অন্দি সন্দি ||
কত তর্ক-যুক্তি গর্গ সকলে দেখায় |
তবু নাহি সে বিধি দিল পণ্ডিতসভায় ||
কেহ বলে তুলি ঘরে কেহ বলে নয় |
এই মতে নানা স্থানে বহু তর্ক হয় ||
চারি দিকে দাউ দাউ অনল জ্বলিল |
জ্বলিলেন গর্গ মুনি কঙ্ক ভস্ম হইল ||
এমন সুখের ঘর পুড়ে হল ছাই |
নিয়তি খণ্ডিতে পারে হেন সাধ্য নাই ||
আছিল চণ্ডাল কঙ্ক হইল ব্রাহ্মণ |
কঙ্কেরে নাশিতে যুক্তি করে দ্বিজগণ ||
|| ১১ ||
কঙ্কের বিরূদ্ধে ব্রাহ্মণগণের ষড়যন্ত্র
নানামত ভাবি তারা উপায় করিল |
মাপের চোখেতে যেন ধুলা-পড়া দিল ||
রটে কঙ্ক নহে শুধু চণ্ডালের পুত |
মোসলমান পীরের কাছে হৈল দীক্ষিত ||
হিন্দু যত সবে কঙ্কে মোসলমান বলি |
কেহ ছিড়ে কেহ পুড়ে সত্যের পাঁচালী ||
জাতি গেল মোসলমানের পুঁথি নিয়া ঘরে |
যথাবিধি সবে মিলি প্রায়শ্চিত্ত করে ||
আর এক কথা রটে না যায় কথন |
“কঙ্কেরে সঁপেছে লীলা জীবন-যৌবন ||”
সন্ধ্যামন্ত্র নাহি ঝানে বেদাচারহীন |
দুরন্ত দুর্জন যারা সমাজেতে ঘৃণ ||
মদ্য-মাংস খায় সদ্য পাষণ্ড-আচার |
জন্মি ব্রাহ্মণ-কুলে যত কুলাঙ্গার ||
মিথ্যা বদনাম তারা দিল রটাইয়া |
“কলঙ্কী হইয়াছে লীলা কুল ভাঙ্গাইয়া ||”
একে ত কুমারী কন্যা অতি শুদ্ধমতী |
কলঙ্ক রটাইল তার যত দুষ্টমতি ||
কমলা (রচয়িতা দ্বিজ ঈশান)
|| ৩ ||
কমলা–যৌবনাগমে
দেখিতে সুন্দরী কন্যা পরথম যৌবন |
কিঞ্চিত্ করিব তার রূপের বর্ণন ||
চান্দের সমান মুখ করে ঝলমল |
সিন্দুরে রাঙ্গিয়া ঠুট তেলাকুচ ফল ||
জিনিয়া অপরাজিতা শোভে দুই আখি |
ভ্রমরা উড়িয়া আসে সেই রূপ দেখি ||
দেখিতে রামের ধনু কন্যার যুগল ভুরু |
মুষ্টিতে ধরিতে পারি কটিখানা সরু ||
কাকুনি সুপারি গাছ বায়ে যেন হেলে |
চলিতে ফিরিতে কন্যা যৌবন পরে ঢলে ||
আষাঢ় মাস্যা বাশের কেরুল মাটি ফাট্যা উঠে |
সেই মত পাও দুইখানি গজন্দমে হাটে ||
বেলাইনে বেলিয়া তুলিছে দুই বাহুলতা |
কণ্ঠেতে লুকাইয়া তার কোকিলে কয় কথা||
শ্রাবণ মাসেতে যেন কাল মেঘ সাজে |
দাগল-দীঘল কেশ বায়েতে বিরাজে ||
কখন খোপা বান্ধে কন্যা কখন বান্দে বেণী |
কূপে রঙ্গে সাজে কন্যা মদনমোহিনী ||
অগ্নি-পাটের শাড়ী কন্যা যখন নাকি পরে |
স্বর্গের তারা লাজ পায় দেখিয়া কন্যারে ||
আযাইঢ়া জোয়ারে জল যৌবন দেখিলে |
পুরুষ দূরের কথা নারী যায় ভুলে ||
কাজলরেখা (রচিয়তা – অজ্ঞাত)
।।১৪।।
বাপ মায়ের কথা, বংশের কথা না সুধাইয়াই, একমাত্র প্রাণ-দাতা বলিয়া রাজকুমার তাকে বিয়া করতে প্রতিজ্ঞা করল |