- বইয়ের নামঃ বৃহৎ বঙ্গ (১ম ও ২য় খণ্ড)
- লেখকের নামঃ দীনেশচন্দ্র সেন
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০১. পাঠান-রাজত্ব – প্রথম পরিচ্ছেদ
মহম্মদ ইবন বক্তিয়ার খিলিজির শেষজীবন
নদীয়া জয় করিয়া মহম্মদ ইবন বক্তিয়ার যে সকল বিপদে পড়িয়াছিলেন, তবকাৎ-ই-নাসিরী-প্রণেতা মিনহাজ তাহার বর্ণনা দিয়াছেন। নদীয়া-জয়ের সময়ে যে দুইজন সৈনিক মহম্মদ বক্তিয়ারের সহচর ছিলেন, মিনহাজ তাহাদেরই মুখে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনিয়াছিলেন। ইবন বক্তিয়ার নবদ্বীপ বিজয়ের পরে গৌড়ের এদিক্ সেদিক্ লুণ্ঠন করিয়া লক্ষণাবতী ও হিমালয়ের মধ্যবর্ত্তী কোন স্থানের অধিবাসী মেচ্জাতীয় একজন নায়ককে মুসলমানধর্ম্মে দীক্ষিত করেন এবং তাঁহাকে ‘আলি’ উপাধি দেন। আলি মেচের উপদেশে তিনি দশ সহস্র সৈন্য লইয়া তিব্বত জয়ের জন্য রওনা দেন। পথে বর্দ্ধনকোট-সম্মুখে বিশালতোরা বেগবতী নদী। এই নদীর কূল ধরিয়া তিনি দশদিনের পথে পর্য্যটন করিয়া একটা প্রকাণ্ড সেতুর সাক্ষাৎ পান। এই সেটু ২০টি পাষাণনির্ম্মিত খিলানের উপর স্থিত। ইবন বক্তিয়ার সেই সেতু পার হইয়া চলিলেন। দুইজন সেনাপতিকে সেতুরক্ষার জন্য রাখিয়ে গেলেন, ক্রমাগত ১৬ দিন চলিয়া গিয়া একটু দুর্গ-রক্ষিত নগর আক্রমণ করেন, তথায় শুনিতে পান, ২৫ ক্রোশ দূরে একটি স্থান (করমপত্তনে) ৫০,০০০ তুরষ্ক সৈন্য বিদ্যমান আছে, তথায় বহু ব্রাহ্মণ বাস করেন এবং তথায় বৎসরে অনেক সহস্র টাঙ্গন ঘড়া বিক্রয়ের একটা বাজার বসে। কেহ কেহ মনে করেন, উহা আধুনিক দিনাজপুরে জেলার নেক-মর্দ্দনের হাট। মহম্মদ ইবন বক্তিয়ার ভয় পাইয়া অগ্রসর হইলেন না–ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইলেন। খাদ্যের ভয়ানক কষ্ট হইল। শত্রুরা সমস্ত ক্ষেত নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছিল। সৈন্যগণ ঘোড়া মারিয়া সেই মাংস খাইতে লাগিল। ইবন বক্তিয়ার কামরূপ ফিরিয়া আসিয়া শুনিলেন, তাঁহার রক্ষকগণ ঝগড়া করিয়া চলিয়া গিয়াছে এবং শত্রুরা বেগমতী নদীর সেই বিশাল পাষাণ নির্ম্মিত সেতুর দুইটি থাম ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে। তিনি নিকটবর্ত্তী এক দেবমন্দির আক্রমণ করেন। সেখানে দুই তিন হাজার মন স্বর্ণনির্ম্মিত দেবপ্রতিমা ছিল। শত্রুবেষ্টিত হইয়া তিনি ঐ মন্দিরে বন্দীর মত হইয়া রহিলেন, বহুকষ্টে তাঁহার সৈন্যগণ প্রাচীরের একদিক্ ভাঙ্গিয়া নদীর জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল। তীরভূমি হইতে শত্রুর শর তাহাদের ধ্বংসক্রিয়া সাধন করিতে লাগিল। মুসলমান বীর বহুকষ্টে অতি অল্পসংখ্যক পরিকর লইয়া রক্ষা পাইলেন এবং আলি মেচের সাহায্যে দেবকোটে উপস্থিত হইলেন। তথায় পীড়িত হইয়া পড়েন এবং ১২০৫-৬ খৃষ্টাব্দে প্রাণত্যাগ করেন। কেহ কেহ বলেন মহঃ ইঃ বক্তিয়ারের অধীন নারান্কোই স্থানেই শাসনকর্ত্তা আলিমর্দ্দন খিলজি সুবিধা পাইয়া রোগশয্যায় তাঁহাকে নিহত করেন। বহুসংখ্যক সৈন্যক্ষয়ের জন্য তাঁহার প্রতি তাঁহার দলের লোকের আর কিছুমাত্র অনুরাগ ছিল না। মৃত্যুকালে তিনি নিঃসহায় ও বান্ধবহীন অবস্থায় দুর্গতির চরম সীমায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। পরের দেশের সর্ব্বনাশ সাধন করিয়া আলেয়ার আলোর মত সে স্বল্পস্থায়ী যশঃপ্রভা তাঁহাকে গৌরব দান করিয়াছিল তাহার বিনিময়ে তিনি কি লাভ করিলেন?–পার্ব্বত্য প্রদেশে অশেষ বিড়ম্বনা, পরাজয়জনিত লাঞ্ছনা, স্বজনধ্বংস ও অকালমৃত্যু। মহঃ ইঃ বক্তিয়ারের দ্বারা সমস্ত বাঙ্গলাদেশ মুসলমানাধিকৃত হয় নাই। এমন কি নবদ্বীপকে ফিরিয়া জয় করিতে হইয়াছিল। এই সময়ে সম্ভবতঃ কেশবসেন (লক্ষণের পুত্র) গৌড় শাসন করিতেছিলেন এবং মুসলমানদের হাত হইতে দেশ রক্ষা করিতে না পারিয়া পূর্ব্ববঙ্গ আশ্রয় করিয়াছিলেন। বিক্রমপুরে স্বর্ণগ্রাম রাজধানী করিয়া সেনবংশীয়েরা আরও এক শতাব্দীর উর্দ্ধকাল পূর্ব্ববঙ্গে রাজত্ব করিয়াছিলেন।
ইহার কোন সময়ে সেন বংশের এক শাখা লাহোর ও কাশ্মীরে যাইয়া তথায় রাজ্য লাভ করিয়া থাকবেন।
মহম্মদ শিরান–১২০৫-১২০৮ খৃঃ
মহঃ ইবন বক্তিয়ার খিলজির প্রিয়পাত্র মহম্মদ শিরান বঙ্গদেশের রাজা বলিয়া নিজেকে প্রচার করেন। এই ব্যক্তি এরূপ দুর্দ্ধর্ষ ছিলেন যেন, একাই অশ্বারোহণপূর্ব্বক লক্ষণাবতীর নিকট কোন জঙ্গলে ১৮টি হাতী ঠেকাইয়া রাখিয়াছিলেন। তাঁহার অদ্ভুত সাহস দেখিয়া তিব্বতে অভিযানের পূর্ব্বে ইবন বক্তিয়ার তাঁহাকে গৌড়ের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া গিয়াছিলেন। প্রভুর মৃত্যুর পর সামন্তগণ ও নেতারা একত্র হইয়া মহম্মদ শিরানকে রাজপদ প্রদান করেন। রাজা হইয়া তিনি প্রথমেই প্রভুহত্যায় অভিযুক্ত আলিমর্দ্দনকে পরাস্ত করিয়া কারাগারে নিক্ষেপ করেন। কারাধ্যক্ষকে ঘুষ দিয়া আলিমর্দ্দন পলাইয়া মুক্তিলাভপূর্ব্বক দিল্লী যাইয়া কুতুবদ্দিনের অনুগ্রহ লাভ করিয়াছিলেন। কুতুবুদ্দিন এই সময়ে সাম্রাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি গড়িবার প্রয়াসী হইয়া অযোধ্যার শাসনকর্ত্তা কাএমাজ রোমীকে পূর্ব্বাঞ্চলের যুদ্ধ-বিগ্রহের ভার প্রদান করেন। গঙ্গোত্রীর শাসনকর্ত্তা সম্রাট্-সৈন্যদের সহযোগিতা করিয়া দেবকোটের শাসনকর্ত্তৃত্ব প্রাপ্ত হন। অপর অপর সেনাপতিরা দিল্লীশ্বরের অধীনতা স্বীকার না করিয়া কাএমাজ রোমীর সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ চালাইয়াছিলেন, কিন্তু পরাস্ত হইয়া কুচবিহারের দিকে পলায়নপর হন। ইঁহাদের মধ্যে আত্মকলহ উপস্থিত হয়, মহম্মদ শিরা এই কলহের ফলে নিহত হন। মহম্মদ শিরান ১২০৫ হইতে ১২০৮ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন। তাঁহার সময়ে কুতুবুদ্দিন দিল্লীশ্বর ছিলেন (১২০৫-১২১০ খৃ;) কিন্তু তিনি দিল্লীশ্বরের অধীনত্ব স্বীকার করেন নাই।
শিরানের মৃত্যুর পর আলিমর্দ্দন খিলজি দিল্লীশ্বরের সনদ লইয়া বঙ্গদেশের মসনদ দখল করেন (১২০৮-১২১১ খৃঃ)।