(৯) মুসলমান কন্যার সাথে জয়চন্দ্রের ভাব
পরথমে হইল দেখা সুন্ধা নদীর কূলে।
জল ভরিতে যায় কন্যা কলসী কাকালে।।
চলনে খঞ্জন নাচে বলনে কুকিলা।
জলের ঘাটে গেলে কন্যা জলের ঘাট লালা।
“কে তুমি সুন্দরী কন্যা জলের ঘাটে যাও।
আমি অধমের পানে বারেক ফির্যা চাও।।
নিতি নিতি দেখ্যা তোমায় না মিটে পিয়াস।
প্রাণের কথা কও কন্যা মিটাও মনের আশ।।
পরকাশ কইরা কইতে নারি মনের ধর।
তুমি কন্যা এই জগতে প্রাণের দোসর।”
সরমে মরণ আইল কথা কওয়া দায়।
জলের ঘাটে গিয়া নাগর উকিজুকি চায়।।
লিখিয়া রাখিল পত্র ইজল গাছের মূলে।
এইখানে পড়িব কন্যা নয়ন ফিরাইলে।।
“সাক্ষী হইও ইজল গাছ নদীর কূলে বাসা। *
তোমার কাছে কইয়া গেলাম মনের যত আশা।।
এইখান আসিব কন্যা সুন্দর আকার।
এই পত্র দেখাইও আমার সমাচার।।
অন্ধকারের সাক্ষী তোমরা চান্দ আর ভানু।
এইখানে আসিবে কন্যা সোনার বরণ তনু।।
সোনার বরণ তনু কন্যা চম্পকবরণী।
তার কাছে কইও আমার দুঃখের কাহিনী।।
ফির্যা আসে জলের ঢেউ পায়ের কাছে খাড়া।
এইখান বসিয়া আমি দেখিন পশরা।।”
ভাবিয়া চিন্তিয়া নাগর যুক্তি স্থির কৈল।
কালি প্রাতে তুলতে ফুল পুষ্পবনে গেল।।
যে খান ফুট্যাছে ফুল মালতী-মল্লিকা।
ফুট্যা আছে টগর-বেলি আর শেফালিকা।।
হাতেতে ফুলের সাজি কপালে তিলক-ছটা।
ফুল তুলিতে যায় কুমার মনে বিন্ধ্যা কাঁটা।।
* ইজল : হিজল গাছ
(১০) দুঃসংবাদ
ঢুল বাজে ডাগর বাজে জয়াদি জুকার।
মালা গাঁথে কুলের নারী মঙ্গল আচার।।
এমন কালে দৈবেতে করিল কোন কাম।
পাপেতে ডুবাইল নাগর চৈদ্দ পুরুষের নাম।।
কি হইল কি হইল কথা নানান জনে কয়।
এই যে লোকেরা কথা প্রত্যয় না হয়।।
পুরীতে জুড়িয়া উঠে কান্দনের রোল।
জাতিনাশ দেখ্যা ঠাকুর হইল উতরুল।।
“কপালের দোষ, দোষ নহে বিধাতার।
যে লেখ্যা লেখ্যাছে বিধি কপালের আমার।।
মুনির হইল মতিভ্রম হাতীর খসে পা।
ঘাটে আস্যা বিনা ঝড়ে ডুবে সাধুর না।।”
পাড়া-পড়সি কয় “ঠাকুর কইতে না জুয়ায়।
কি দিব কন্যার বিয়া ঘটল বিষম দায়।।
অনাচার কেল জামাই অতি দুরাচার।
যবনী করিয়া বিয়া জাতি কৈল মার।।”
শিরেতে পড়িল বাজ মঠের মাথায় ফোড়।
পুরীর যত বাদ্যভাণ্ড সব হৈল দূর।।
ধুলায় বসিল ঠাকুর শিরে দিয়ে হাত।
বিনাদোষে হইল যেন শিরে বজ্রপাত।।
(১১) চন্দ্রার অবস্থা
“কি কর লো চন্দ্রাবতী ঘরেতে বসিয়া।”
সখিগণ কয় কথা নিকটে আসিয়া।।
শিরে হাত দিয়া সবে জুড়য়ে কান্দন।
শুনিয়া হইল চন্দ্রা পাথর যেমন।।
না কান্দে না হাসে চন্দ্রা নাহি বলে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।।
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।
জানিতে না দেয় কন্যা জল্যা মরে মনে।।
এক দিন দুই দিন তিন দিন যায়।
পাতেতে রাখিয়া কন্যা কিছু নাহি খায়।।
রাত্রিকালে শর-শয্যা বহে চক্ষের পানি।
বালিশ ভিজিয়া ভিজে নেতের বিছানি।।
শৈশবের যত কথা আর ফুলতুলা।
নদীর কূলেতে গিয়ে করে জলখেলা।।
সেই হাসি সেই কথা সদা পড়ে মনে।
ঘুমাইলে দেখিব কন্যা তাহারে স্বপনে।।
নয়নে না আসে নিদ্রা অঘুমে রজনী।
ভোর হইতে উঠে কন্যা যেমন পাগলিনী।।
বাপেত বুঝিল তবে কন্যার মনের কথা।
কন্যার লাগিয়া বাপের হইল মমতা।।
সম্বন্ধ আসিল বড় নানা দেশ হইতে।
একে একে বংশীদাস লাগে বিচারিতে।।
চন্দ্রাবতী বলে “পিতা, মম বাক্য ধর।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর।।
শিবপূজা করি আমি শিবপদে মতি।
দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি।।”
অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।
“শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে।।”*
* জয়ানন্দকে ভুলে যেতে চন্দ্রাবতী রামায়ণ লিখেছিলেন, কিন্তু মুদ্রিত হয়নি। এটার পাণ্ডুলিপি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে আছে।
(১২) শেষ
নির্ম্মাইয়া পাষাণশিলা বানাইলা মন্দির।
শিবপূজা করে কন্যা মন কর স্থির।।
অবসরকালে কন্যা লেখে রামায়ণ।
যাহারে পড়িলে হয় পাপ বিমোচন।।
জন্মথ থাকিব কন্যা ফুলের কুমারী। *
একনিষ্ট হইয়া পূজে দেব ত্রিপুরারী।।
শুধাইলে না কয় কথা মুখে নাহি হাসি।
একরাত্রে ফুটা ফুল ঝুইরা হইল বাসি।।
এমন কালেতে শুন হইল কোন কাম।
যোগাসনে বৈসে কন্যা লইয়া শিবের নাম।।
বম্ বম্ ভোলানাথ গাল-বাদ্য করি।
বিহিত আচারে পূজে দেব ত্রিপুরারী।
বৈশাখ মাসেতে হয় রবি খরতর।
গাছেতে পাকিল আম অতি সুবিস্তর।।
বারতা লইয়া আসে পত্রে ছিল লেখা।
চন্দ্রাবতী সঙ্গেতে করিতে আইল দেখা।।
এই পত্রে লিখিয়াছে দুঃখের ভারতী।
জয়ানন্দ দিছে পত্র শুন চন্দ্রাবতী।
পত্রে পড়ীল কন্যা সকল বারতা।
পত্রেতে লেখ্যাছে নাগর মনের দুঃখ কথা।।
“শুনরে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই।
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই।।
অমৃত ভাবিয়া আমি খাইয়াছি গরল।
কন্ঠেতে লাগিয়া রইছে কাল-হলাহল।।
জানিয়া ফুলের মালা কালসাপ গলে।
মরণে ডাকিয়া আসি আন্যাছি অকালে।।
তুলসী ছাড়িয়া আমি পূজিলাম সেওরা।
আপনি মাথায় লইলাম দুঃখের পসরা।।
জলে বিষ বাতাসে বিষ না দেখি উপায়।
ক্ষমা কর চন্দ্রাবতী ধরি তোমার পায়।।
একবার দেখিব তোমায় জন্মশেষ দেখা।
একবার দেখিব তোমার নয়নভঙ্গি বাঁকা।।
একবার শুনিব কন্যা মধুরসবাণী।
নয়নজলে ভিজাইব রাঙ্গা পা দুইখানি।।
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
পুণ্যমুখ দেখ্যা আমি জুড়াইব অন্তরা।।
শিশুকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের মালা।
তোমারে দেখিতে কন্যা মন হইল উতালা।।
জলে ডুবি বিষ খাই গলায় দেই দড়ি।
তিলেক দাড়াইয়া তোমার চান্দমুখ হেরি।।
ভাল নাহি বাস কন্যা এই পাপিষ্ঠ জনে।
জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে।।
এই দেখা চক্ষের দেখা এই দেখা শেষ।
সংসারে নাহিক আমার সুখশান্তির লেশ।।
একবার দেখিয়া তোমার ছাড়িব সংসার।
কপালে লেখ্যাছে বিধি মরণ আমার।।”