এক পুষ্প দিল বাপে শিবের চরণে।
ঘটক আইবে শীঘ্র বিয়ার কারণে।।
আর পুষ্প দিল বাপ বড়ঘরের বর।
“আমার কন্যার স্বামী হউক দেব পুরন্দর।।”
আর ফুল দিল বাল কুলশীল পাইতে।
বংশ বড় ভট্টাচার্য্য খ্যাতি রাখিতে।।
বর মাগে বংশীদার ভূমিতে পড়িয়া।
“ভাল ঘরে ভাল বরে কন্যার হউক বিয়া।।”
* বংশীবদন : সম্ভবত বংশীদাসের সম্পূর্ণ নাম ছিল বংশীবদন।
(৫) চন্দ্রার নির্জ্জনে পত্রপাঠ
পূজার যোগার দিয়া কন্যা নিরালায় বসিল।
জয়ানন্দের পুষ্পপাত যতনে খুলিল।।
পত্র পইড়ে চন্দ্রাবতীর চক্ষে বয়ে পানি।
কিবা উত্তর দিব কন্যা কিছুই না জানি।।
আর বর পড়ে পত্র চক্ষে বয় ধারা।
“এমন কেন হইল মন শুকের পিঞ্জরা।।
দেখি শুনি সেই ডাল ফুল তুল্যা আনি।
বয়স হইছে এখন হইলাম অরক্ষীনি।।
জৈবন আইল দেহে জোয়ারের পানি।
কেমনে লিখিব পত্র প্রাণের কাহিনী।।
কিমতে লিখিব পত্র বাপ আছে ঘরে।
ফুল তুলে জয়ানন্দ ভালবাসি তারে।।
ছোট হইতে দেখি তারে প্রাণের দোসর।”
সেই ভাবে লেখে কন্যা পত্রের উত্তর।।
“ঘরে মোর আছে বাপ আমি কিবা জানি।
আমি কেমনে দেই উত্তর অবলা কামিনী।।”
যত না মনের কথা রাখিল গোপনে।
পত্রখানি লেখে কন্যা অতি সাবধানে।।
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী করি মনের দিকে চাইয়া।
জয়ানন্দ মাগে বর ধর্ম্ম সাক্ষী দিয়া।। *
শিবের চরণে কন্যা উদ্দেশে করে নতি।
পত্র পাঠাইয়া দিল কন্যা চন্দ্রাবতী।।
পুষ্প তুলিতে কন্যা আর নাহি যায়।
এই মতে সুখে দুঃখে দিন বইয়া যায়।।
* জয়ানন্দ মাগে বর : জয়ানন্দকে বরস্বরুপ পেতে প্রার্থনা করল।
(৬) নীরবে হৃদয় দান
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে চম্পা-নাগেশ্বর।
পুষ্প তুলিতে কন্যা আইল একেশ্বর।।
“তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া।
তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা আছে মালতী-বকুল।
আঞ্চল ভরিয়া তুলব তোমার মালার ফুল।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে রক্তজবা-সারি।
তোমারে করিব পূজা প্রাণে আশা করি।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে মল্লিকা-মালতী।
জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মতন পতি।।
বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে কেতকী-দুস্তর।
কি জানি লেখ্যাছে বিধি কপালে আমার।।”
এইরূপে কান্দে কন্যা নিরালা বসিয়া।
মন দিয়া শুন কথা চন্দ্রাবতীর বিয়া।।
(৭) বিবাহের প্রস্তাব ও সম্মতি
একদিন ত না ঘটক আইল ভট্টাচার্য্যের বাড়ী।
“তোমার ফহরে আছে কন্যা পরমা সুন্দরী।।
কুলে শীলে তুমি ঠাকুর চন্দ্রের সমান।
না দেখি এমন বংশ এথায় বিদ্যমান।।
বয়স হইল কন্যা রূপে বিদ্যাধরী।
ভাল বরে দেও বিয়া ঘটকালি করি।।”
“কেবা বর কিবা ঘর কহ বিবরণ।
পছন্দ হইলে দিব মনের মতন।।”
ঘটক কহিল “সুন্ধ্যা” গ্রামে ঘর। *
চক্রবর্ত্তী বংশে খ্যাতি কুলিনের ঘর।।
জয়ানন্দ নাম তাঁর কাত্তিক কুমার।
সুন্দর তোমার কন্যা যোগ্য বর তার।।
দেখিতে সুন্দর কুমার পড়ুয়া পণ্ডিত।
নানা শাস্ত্র জানে বর অতি সুপণ্ডিত।।
সূর্য্যের সমান রূপ বংশের দুলাল।
সুখেতে থাকিব কন্যা জানি চিরকাল।।
পশ্চিমাল বাতাসে দেখ শীতে লাগে কাটা।
এখন ধইরাছে দেখ মধ্যি গাঙ্গে ভাটা।।
আম আগছে নয়া পাতা ধরিয়াছে বউল।
এই মাসে বিয়া দিতে নাহি গণ্ডগোল।।
করকুষ্টি বিচারিয়া সম্বন্ধ মিলায়।
ভালা বরে কন্যা বিয়া দেওয়া বড় দায়।।
কুষ্টি বিচারি কৈল “সর্ব্ব সুলক্ষণ।
বরকন্যার এমন মিল ঘটে কদাচন।। **
কুষ্টিতে মিলিছে ভাল যখন এই বরে।
এই বরে কন্যাদান করিব সুস্থরে।।” ***
* সুন্ধ্যা : সুন্ধা নদীর তীরের গ্রাম
** কদাচন : কদাচিৎ
*** সুস্থরে : নিশ্চয়
(৮) বিবাহের আয়োজন
সম্বদ্ধ হইল ঠিক করি লগ্ন স্থির।
ভাল দিন হইল ঠিক পরে বিবাহের।।
দক্ষিণের হাওয়া বয় কুকিল করে রা।
আমের বউলে বস্যা গুঞ্জে ভ্রমরা।।
নয়া পাতা যত গাছে নয়া লতা ঘিরে।
ভাল দিন ঠিক হইল শঙ্করের বরে।।
সেই ত দিনে হইব বিয়া সর্ব্ব সুলক্ষণ।
পানখিল দিয়া করে বিয়ার আয়োজন।।
পাড়ার যতেক নারী পান খিলায়।
যতেক নারীতে মিলি তাঁর গান গায়।।
জয় জুকার গীত আর বাজে ঢুল।
উঠানে আকিল কত নানান জাতি ফুল।।
আধিয়া পুছিয়া সবে পানখিল দিয়া। *
আয়োজন করে সবে উতযোগ হইয়া।।
বিবাহের যত কিছু করে আয়োজন।
যতেক দেবতাগণের করিল পূজন।।
পূজিল শঙ্করে আগে দেব অনাদি।
অন্তরে যাহার নাম রাখিয়াছে বাধি।।
একে একে কৈল পূজা যত দেব আর।
শ্যামাপূজা একাচূড়া বনদূর্গা মার।।
আদিবাস হইল শুভ বিয়ার পূর্ব্বদিনে।
ক্রিয়াকাণ্ড আদি যত হইল সুবিধানে।।
চুরপানি ভরে সবে উঠিয়া প্রভাতে।
গীত জুকার যত হইল বিধিমতে।।
আব্যধিক করে বাপে মণ্ডপে বসিয়া।
তার মাটি কাটে যন্ত সধবা মিলিয়া।।
সেই দা মাটিতে ইটা তৈয়ার করিয়া।
পঞ্চ নারী মিলি দিল তৈল লাল দিয়া।।
আব্যধিক হইল শেষ জানি এক মতে।
সোহাগ মাগিল আর মায় বিধিমতে।।
আগে চলে কন্যার মায় ডালা মাথায় লইয়া।
তার পাছে কন্যার খুড়ি লোটা হাতে লইয়া।।
তার পরে যত নারী গীট জুকারে।
সহাগ মাগিল কত বাড়ী বাড়ী ফিরে।।
* পানখিল : পানের খিলি। বাংলাদেশে বিয়ের অনুষ্ঠানে পান খাওয়ার প্রচলন প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে।