গান–
ঘরে আছিল ঘিরেত বাতি সদাই অগ্নি জ্বলে |
তারে ছুইয়া কুমার পরতিজ্ঞ যে করে ||
ঠিক এমন সময় ছান কইরা ভিজা কাপড়ে কাজলরেখা মন্দিরে প্রবেশ করল | ঢুইকাই দেখে যে
তার স্বামী বাঁইচ্যা উঠছে |
গান–
গ্রহণ ছাড়িলে যেমন চান্দের প্রকাশ |
কুমারে দেখিয়া কন্যা পাইল আশ্বাস ||
প্রভাতের ভানু যিনি ছুরত সুন্দর |
একে একে দেখে কন্যা সর্ব্ব কলেবর ||
কন্যারে দেখিয়া কুমার লাগে চমত্কার |
এমন নারীর রূপ না দেইখ্যাছে আর ||
পরথম যৌবনে কন্যা হীরা-মতি জ্বলে |
কন্যারে দেখিয়া কুমার কহে মিঠা বুলে ||
“কোথা হতে আইলা কন্যা কি বা নম ধর |
কিবা নাম বাপ মার কোন দেশে ঘর ||
কিসের লাগিয়া কন্যা ভ্রম বনে বনে |
স্বরূপ উত্তর দাও এই অভাজনে ||
মাও ত নিঠুরা তোমার বাপ ত নিঠুর |
ঘরের বাইর কইরা তোমায় দিল বনান্তর ||”
আগু হইয়া পরিচয় কহে কঙ্কণ দাসী |
“কঙ্কণে কিন্যাছি ধাই নাম কাঙ্কণ দাসী |”
রাণী হইল দাসী আর দাসী হইল রাণী |
কর্মদোষে কাজলরেখা জন্ম-অভাগিনী ||
সন্ন্যাসীর আদেশ মতে কাজলরেখা স্বামীর নিকট আত্ম-পরিচয় দিতে পারিল না | স্বামীর সঙ্গে
দাসী হইয়াই স্বামীর রাজ্যে চলিয়া গেল |
চন্দ্রাবতী (রচয়িতা নয়নচাঁদ ঘোষ)
[চন্দ্রাবতীকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর উপর গীতিকাব্যটি রচনা করেছেন নয়ানচাঁদ ঘোষ, আনুমানিক ২৫০ বছর আগে। নেয়া হয়েছে দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে। মোট ৩৫৪টি ছত্র আছে এতে, দীনেশচন্দ্র সেন এগুলোকে ১২টি অঙ্কে ভাগ করেছেন।]
(১) ফুল তোলা
“চাইরকোনা পুষ্কুনির পারে চম্পা নাগেশ্বর।
ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর।।”
“আমার বাড়ী তোমার বাড়ী ঐ না নদীর পার।
কি কারণে তুল কন্যা মালতীর হার।।”
“প্রভাতকালে আইলাম আমি পুষ্প তুলিবারে।
বাপেত করিব পূজা শিবের মন্দিরে।।”
“বাছ্যা বাছ্যা ফুল তুলে রক্তজবা সারি।
জয়ানন্দ তুলে ফুল ঐ না সাজি ভরি।।
জবা তুলে চম্পা তুলে গেন্দা নানাজাতি।
বাছিয়া বাছিয়া তুলে মল্লিকা-মালতি।।
তুলিল অপরাজিতা আতসী সুন্দর।
ফুলতুলা হইল শেষ আনন্দ অন্তর।।
এক দুই তিন করি ক্রমে দিন যায়।
সকালসন্ধ্যা ফুল তুলে কেউনা দেখতে পায়।।
ডাল যে নোয়াইল ধরে জয়ানন্দ সাথী।
তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী।।
একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়।
সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায়।।
(২) প্রেমলিপি
পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে।
পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে।। *
পত্র লেখে জয়ানন্দ মনের যত কথা।
“নিতি নিতি তোলা ফুলে তোমার মালা গাঁথা।।
তোমার গাঁথা মালা লইয়া কন্যা কান্দিলো বিরলে।
পুষ্পবন অন্ধকার তুমি চল্যা গেলে।।
কইতে গেলে মনের কথা কইতে না জুরায়।
সকল কথা তোমার কাছে কইতে কন্যা দায়।।
আচারি তোমার বাপ ধর্ম্মেকর্ম্মে মতি।
প্রাণের দোসর তার তুমি চন্দ্রাবতী।।
মাও নাই বাপ নাই থাকি মামার বাড়ী।
তোমার কাছে মনের কথা কইতে নাহি পারি।।
যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমার চান্দবদন।
সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন।।
তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই।
সর্ব্বস্ব বিকাইবাম পায় তোমারে যদি পাই।।
আজি হইতে ফুলতোলা সাঙ্গ যে করিয়া।
দেশান্তরি হইব কন্যা বিদায় যে লইয়া।।
তুমি যদি লেখ পত্র আশায় দেও ভর।
যোগল পদে হইয়া থাকবাম তোমার কিঙ্কর।।”
* আড়াই অক্ষর : অতি সংক্ষিপ্ত। আড়াই অক্ষরে মন্ত্রের কথা অনেক প্রাচীন বাঙ্গালা পুঁথিতেই আছে। ময়মনসিংহের গীতি-কাব্যগুলির মধ্যে অনেক জায়গাতেই আড়াই অক্ষরে লিখিত চিঠির কথা পাওয়া যায়।
(৩) পত্র দেওয়া
আবে করে ঝিলিমিলি সোনার বরণ ঢাকা।
প্রভাতকালে আইল অরুণ গায়ে হলুদ মাখা।। *
হাতেতে ফুলের সাজি কন্যা চন্দ্রাবতী।
পুষ্প তুলিতে যায় পোথাইয়া রাতি।। **
আগে তুলে রক্তজবা শিবেরে পূজিতে।
পরে তুলে মালতীফুল মালা না গাঁথিতে।। ***
হেনকালে নাগর আরে কোন কাম করে।
পুষ্পপাতে লইয়া পত্র কন্যার গোচরে।।
“ফুল তুল ডাল ভাঙ্গ কন্যা আমার কথা ধর।
পরেত তুলিবা ফুল চম্পা-নাগেশ্বর।।”
“পুষ্প তোলা হইল শেষ বেলা হইল ভারি।
পূবেত হইল বেলা দণ্ড তিন চারি।।
আমারে বিদায় কর না পারি থাকিতে।
বসিয়া আছেন পিতা শিবেরে পূজিতে।।”
“আজিত বিদায় লো কন্যা জনমের মত।”
চন্দ্রার হাতে দিল আরে সেই পুষ্পপাত।।
পুত্র নাইসে নিয়া কন্যা কোন কাম করে।
সেইক্ষণ চল্যা গেল আপন বাসরে।।
* আবে … … … মাখা : অরুণদেবের স্বর্ণ বর্ণ মেঘ ভেদ করে ঝিলমিল করছে। তিনি হলুদ দ্বারা স্নাত হয়ে উদিত হয়েছেন।
** পোথাইয়া : পোহাইয়া
*** “না” অর্থশূন্য হলেও এখানে “হ্যাঁ” অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে মূলত কথাটার উপর জোর দেয়ার জন্য।
(৪) বংশীর শিবপূজা, কন্যার জন্য বরকামনা
পুষ্পপাত বান্ধি কন্যা আপন অঞ্চলে।
দেবের মন্দির কন্যা ধোয় গঙ্গার জলে।।
সম্মুখে রাখিল কন্যা পূজার আসন।
ঘসিয়া লইল কন্যা সুগন্ধি চন্দন।।
পুষ্পপাতে রাখে কন্যা শিবপূজার ফুল।
আসিয়া বসিল ঠাকুর আসন উপর।।
পূজা করে বংশীবদন শঙ্করে ভাবিয়া। *
চিন্তা করে মনে মনে নিজ কন্যার বিয়া।।
“এত বড় হইল কন্যা না আসিল বর।
কন্যার মঙ্গল কর অনাদি শঙ্কর।।
বনফুলে মনফুলে পূজিব তোমায়।
বর দিয়া পশুপতি ঘুচাও কন্যাদায়।।
সম্মুখে সুন্দরী কন্যা আমি যে কাঙ্গাল।
সহায়-সঙ্গতি নাই দরিদ্রের হাল।।”