এই সুলক্ষণগুলি বহুদিনের অনাস্বাদিত সুখের, অপূর্ব্ব-প্রাপ্তির আনন্দের নিশ্চিত সূচক। রাধার অন্তরের দেবতা তাঁহাকে এইভাবে সে সুখ সংবাদ দিলেন, কৃষ্ণ সত্যই আসিবেন। কত বার তিনি তমাল তরুকে কৃষ্ণ ভ্রমে শিহরিত রোমাঞ্চিত দেহে দাঁড়াইয়া সখীকে বলিয়াছিলেন,
‘‘আমার কেন অঙ্গ হৈল ভারি।
আমি যে আর চল্তে নারি।’’
রাধাকে আশ্বাস দিতে যাইয়া সখীরা বলিয়াছেন, কৃষ্ণ সত্যই আসিয়াছেন। সে ভ্রম ঘুচিলে, রাধা পেয়ে নিধি হারাইলাম বলিয়া কাঁদিয়াছেন এবং বলিয়াছেন, “তোরা তো ঠিকই বলেছিলি কৃষ্ণ এসেছিলেন, কিন্তু আমার ভাগ্যে তমাল হ’ল।” কত দিন মেঘকে কৃষ্ণ ভ্রম করিয়া অহেতুক পুলকে তিনি হৃষ্টা হইয়াছেন, কত প্রলাপোক্তি করিয়াছেন, আজ কৃষ্ণকে দেখিয়াও বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না। কি জানি, আবার যদি তমাল বা মেঘ হইয়া যান।
উৎকট কুণ্ঠার সহিত দ্বিধাযুক্ত ভাবে রাধা সখীকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কত বার তে তিনি ছলনা করিয়া নব মেঘ হইয়া গিয়াছেন–
কুঞ্জের দ্বারে ঐ কে দাঁড়ায়ে!
দেখ দেখ গো ও বিশাখে,
ওকি বারিধর কি গিরিধর, ওকি
নবীরন মেঘের উদয় হল।
নাকি মদন মোহন ঘরে এল!
ওকি ইন্দ্রধনু যায় দেখা–নব জলদের মাঝে,
নাকি চুঢ়ার উপর ময়ূর পাখা!
“ও কি বক শ্রেণী যায় চলে, নাকি মুক্তমালা দোলে গলে!
ওকি সৌদামিনী মেঘের গায়, নাকি পীথ বসন দেখা যায়!
ওকি মেঘের গর্জ্জন শুনি, নাকি প্রাণনাথের বংশীধ্বনি।’’
আকাশে উড্ডীন বলাকা-পংক্তি দেখিয়া তিনি কত বার ভূল করিয়াছেন, উহা তাঁহার প্রাণনাথের গলার মুক্তামালা; মেঘের অঙ্গে স্ফূরিত বিদ্যুদ্দাম দেখিয়া মনে করিয়াছেন, উহা তাঁহার বঁধুর অঙ্গের পীতবসন। “সখীরা আজ তোরা ভাল করিয়া দেখিয়া আয়,–সত্যই কি তিনি আসিয়াছেন?”
ভাব-প্রবণতার প্রবল উচ্ছ্বাসে কাব্য উচ্ছৃঙ্খল হইয়া যায়, কবি উন্মত্ততার সম্মূখীন হন। রাধা আজ আনন্দ ও নিরানন্দের দ্বন্দ্বে সেই সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়াছেন, এই ভ্রান্তি মধুর ও কবিত্ব পূর্ণ।
কৃষ্ণকমল এই যে চিত্র আঁকিয়াছেন, তাহা তাঁহার শুধু কল্পনা-জাত নহে। আশ্চর্য্যের বিষয়, এই ভ্রান্তির সমন্তই বাস্তব হইতে পাওয়া। চৈতন্যও “বিজনে আলিঙ্গই তরুণ তমাল”–(“তমালের বৃক্ষ এক নিকটে দেখিয়া, কৃষ্ণ বলি’ তারে যেয়ে ধরে জরাইয়া”)–এবং মেঘকে কৃষ্ণভ্রমে যে সকল কাতরোক্তি করিয়াছেন, তাহা চৈতন্যচরিতামৃতাদি পুস্তকে পাওয়া যায়। সেই চৈতন্যচরিতামৃতের শেষ অঙ্কের পাগল গোরাকে কৃষ্ণকমল এইভাবে কাব্যপটে ধরিয়া রাখিয়াছেন; এই চিত্র স্বপ্ন ও জাগরণের সন্ধিস্থলে; যাঁহারা ইহার আভাষ পাইয়াছেন, তাঁহারা সেই স্বপ্নই চাহিবেন, জাগরণ চাহিবেন না।
সমস্ত সন্দেহের নিরসন হইয়াছে, কৃষ্ণ সত্যই আসিয়াছেন, তখন রাধা বলিতেছেনঃ–
‘‘বহুদিন পরে বঁধুয়া আইলে। দেখা না হইত মরণ হ’লে।’’
চণ্ডীদাসের এই পদ বুঝাইতে যাইয়া কৃষ্ণকমল বলিয়াছেনঃ-
‘‘একবার আসিয়া সমক্ষে, দেখিলে স্বচক্ষে,
(জানতে) কত দুঃখে রক্ষে করেছি জীবন।
ভাল ভাল বঁধু, ভাল তে আছিলে,
ভাল সময় এসে ভালই দেখা দিলে–
আর ক্ষণেক পরে এলে,–দেখা হ’ত না,
তোমার বিরহে সবার হ’ত যে মরণ।’’
চণ্ডীদাসের রাধা বলিতেছেনঃ–
‘‘দুঃখিনীর দিন দুঃখেতে গেল,
তুমি তো মথুরায় ছিলে হে ভাল।
আমার এতেক সহিল অবলা ব’লে,
ফাটিয়া যাইত পাষাণ হ’লে।’’
কোমল জিনিষ অনেক সহিতে পারে, আঘাতে ভাঙ্গে না, যেমন কাদা। যে প্রতিরোধ করিতে চায়, সে না পারিলে ভাঙ্গিয়া যায়, যেরূপ পাষাণ। আমি অবলা বলিয়াই, এত দুঃখ সহিয়া বাঁচিয়া আছি।
‘‘সে সকল কথা রহুক দূরে,
আজ মদনমোহনে পেয়েছি ঘরে।’’
যত দুঃখ পাইয়াছি, তাহা বলিবার দরকার নাই; বলিতে গেলে আনন্দের দিনে, উৎসবের গৃহে বঁধুর নিষ্ঠুরতার কথা ইঙ্গিতে আসিবে–এজন্য রাদা বলিতেছেন, সে প্রসঙ্গ এখন থাকুক। “দুঃখিনীর দিন দুঃখেতে গেল, মথুরা নগরে ছিলে তো ভাল।”
যিনি চক্ষুর পলকে আমায় হারাইতেন, তিনি এই যুগ-যুগ-ব্যাপী কাল আমাকে কিরূপে ভুলিয়া রহিলেন? তাঁহার ভালবাসা যেমন অসীম, নিষ্ঠুরতাও তেমনই অসীম। আজ আনন্দের দিনে সেই কথার উল্লেখের অবকাশ নাই। যেটুকু পাওয়া গিয়াছে, তাহার তিলমাত্র রসবিঘ্নকর কথার এখন অবকাশ নাই।
‘‘নেত্রপলকে যে নিন্দে বিধাতাকে,
এত ব্যাজে দেখা সাজে কি তাহাকে?
যাহৌক দেখা হ’ল, দুঃখ দূরে গেল,
এখন গত কথার আর নাই প্রয়োজন।
এই ‘ভাব-সম্মেলনে’ কৃষ্ণের নিকট রাধা সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। হৃদয়ের অর্গল বন্ধ করিয়া, তিনি মনোমন্দিরে একান্তে তাঁহাকে পাইয়া, যে সকল মধুর কথা তাঁহাকে বলিয়াছেন, তাহা বৈদিক যাজ্ঞিকের হোমকুণ্ডের পার্শ্বে উচ্চারিত উপনিষদের মন্ত্র, “বধূ, তুমি আমার প্রাণ-স্বরূপ। আমি শুধু দেহ-মন নহি, আমার সমন্ত কুলশীল, অভিমান ও সংস্কার আজ তোমাকে সঁপিয়া দিলাম। তুমি অখিল ব্রাহ্মাণ্ডের অধিপতি, তা’ কি আমি জানি না। আমি তুচ্ছ গয়লার মেয়ে—“আহিয়িনী, কুরূপিণী, গ্রাম্য গোপবালিকা।” এই ইন্দ্রিয় রূপ পশুগুলিকে পরিচর্য্যা করাই আমার কাজ, “আমরা সকলেই পশুপালিকা” “আমরা কৃষ্ণসেবার কিবা জানি?” তুমি যোগী ঋষির আরাধ্য—“যোগীজনাঃ জানন্তি”, আমি ভজন পূজনে কিবা জানি? কিন্তু আমার দেহ মন সমন্তই তোমার প্রেম গঙ্গায় ভাসাইয়া দিয়াছি। তোমার পদচ্যূতা গঙ্গার ধারাটি শ্মশান সমান উর্ব্বর মরুভূমিতে পথ হারাইয়া তোমার পদাশ্রয়ে ফিরিয়া আসিয়াছে। পড়শীরা আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিতে ঘৃণা করে। তারা আমাকে ‘কলঙ্কিণী’ বলিয়া ডাকে। কিন্তু তাহাতে আমার দুঃখ নাই। তোমার নামের সঙ্গে আমার কলঙ্ক কথার যোগে আমি গৌরব অনুভব করি। আমি সতী হই বা অসতী হই, তুমিই জান, আমি লোক-চর্চ্চা গ্রাহ্য করি না। আমি কি মন্দ, ভাল তাহা জানি না; আমার পাপ পুণ্য, ধর্ম্মাধর্ম্ম সকলই তোমার যুগল পাদপদ্ম।” পরমহংস দেবও ইহার উপরে কিছু বলেন নাইঃ-
বঁধু, তুমি সে আমার প্রাণ,
দেহ মন আদি, তোহারে সঁপেছি, জাতি-কুল-শীল-মান,
অখিলের নাথ, তুমি হে কালিয়া, যোগীর আরাধ্য ধন,
গোপ-গোয়ালিনী, হাম অতি দীনা, না জানি ভজন-পুজন।
কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোকে, তাহাতে নাহিক দুখ,
বঁধু, তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার গলায় পরিতে সুখ।
পীরিতি রসেতে ঢালি’ তনু মন, দিয়াছি তোমার পায়।
তুমি মোর গতি, তুমি মোর পতি, মন নাহি আন ভার।
সতী বা অসতী তোমাতে বিদিত, ভাল মন্দ নাহি জানি,
কহে চণ্ডীদাস পাপপুণ্য মম তোমার চরণ মানি।”
নিরিবিলি কৃষ্ণকে পাইয়া তিনি কত কথাই না বলিতেছেন,–তাহার প্রতিটি শব্দ , জীবনের অনন্ত দুঃখ, সখা সঙ্গের অনন্দ আনন্দ কত মধুরাক্ষরা কথায়, কত মর্ম্মান্তিক কারুণ্যপূর্ণ অশ্রুধারায় ব্যক্ত হইতেছে। তিনি বলিতেছেনঃ বধু তোমায় আমি আর কি বলিব, তোমাকে আজ যেমন করিয়া পাইয়াছি, সেই প্রাণপতিরূপে যেন তোমার এই মহা অবদান–এই মানবজন্ম ফুরাইয়া না যায়। জীবনের প্রতি অঙ্কে, রস-রূপে, আনন্দময়-রূপে, বিধানকর্ত্তা-রূপে, স্নেহে-প্রেমে-সখ্যে–অঙ্কে, রস-রূপে, আনন্দময়-রূপে, বিধানকর্ত্তা-রূপে, স্নেহে-প্রেমে-সখ্যে—রক্ষক-রূপে–পালক-রূপে যেন সর্ব্বদা তোমাকে পাই, জীবনের সঙ্গি-স্বরূপ যেন তুমি প্রতি মুহূর্ত্ত আমার কাছে থে’ক এবং মৃত্যুকালে যেন তোমার মূর্ত্তি আমার ঊর্দ্ধগত নেত্র কণীনিকায় উজ্জ্বল হইয়া উঠে। জীবনে-মরণে তুমি আমার হইয়া আমার কাছে থে’ক। শুধু জীবনে-মরণে নহে, “জনমে-জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি।” তোমার সঙ্গে তো আমার এক জন্মের সম্বন্ধ নহে–এ সম্বন্ধ জন্ম জন্মেয় কোন জন্মে যেন তোমার কাছ হইতে সংসার আমাকে ভুলাইয়া না লইয়া যায়। এই মরীচিকা-সঙ্কুল, প্রতারণার রাজ্যে অনেকেই আমাকে পথ ভুলাইতে আসিবে রূপ, যশঃ মান, ঐশ্বর্য্য তুমি ঘাটে ঘাটে রাখিয়াছ- আমার মনের বল ও অনুরাগ পরীক্ষা করিতে। কো অশুভ মুহূর্ত্তে যেন তাহারা তোমাকে আড়াল করিয়া না দাঁড়ায়। রাধিকা বলিতেছেন—“হে জীবনধন, তুমি জীবনে আমার হইও, মরণে আমার হইও–জন্মে জন্মে আমার হইও। তোমার চরণ পদ্মের সঙ্গে আমার প্রাণের একটা ফাঁসি লাগিয়া গিয়াছে,–যদি মুহূর্ত্তের জন্য চরণ সরাইয়া লইয়া যাও, তবে সেই প্রেমের ফাঁসীতে আমার প্রাণ যাইবে। তাই আমার সমস্ত তোমাকে নিবেদন করিয়া, এমন হইয়া আমি তোমার চরণের দাসী হইয়াছি। আমার একুলে–স্বামীর কুলে, ওকুলে পিতৃকুলে বৃষভানুর পুরীতে, দুকুলে–বৃন্দাবনে অবস্থিত এই দুকুলে আমার আর কে আছে? বিপথে গেলে কে আমায় উদ্ধার করিবে? বরং মায়ায় আবদ্ধ করিয়া তাহারা তোমার কাছ হইতে আমাকে দূরে লইয়া যায়। এই বিভ্রান্ত মায়াপুরী হইতে আমাকে কে রক্ষা করিবে?
“বঁধু! কি আর বলিব আমি
আমার জীবনে-মরণে মরণে-জীবনে প্রাণনাথ হৈও তুমি।
তোমার চরণে আমার পরাণে বাধিল প্রেমের ফাঁসি,
সব সমপিয়া একমন হইয়া নিশ্চয় হইলাম দাসী।
আমার একুলে, ওকুলে, দু’কুলে গোকুলে, আর মোর কেবা আছে।
রাধা বলি কেহ শুধাইতে নাই, জানাব কাহার কাছে।”
এই ভাবে রাধা একেবারে নিঃস্ব ও নিরাশ্রয় হইয়া তাঁহার আশ্রয় লইয়াছেন। যে আশ্রয়ের পূর্ব্বসংস্কার তাঁহার ছিল, তাঁহার স্বামিকুল, পিতৃকুল–তাহা অস্বীকার করিয়া তিনি তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছেন। নিরাশ্রম নিরবলম্ব হইয়া, তিনি একমাত্র ভগবানকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছেন।