- বইয়ের নামঃ দিলীপকুমারের গল্প
- লেখকের নামঃ দিলীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
বালির ঘর – দিলীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
দরজায় অনেকক্ষণ ধরে কে কড়া নাড়ছে। মৃগাংক আধা আধো ঘুমের মধ্যেও শুনতে পেল। এই সাতসকালে কে কড়া নাড়ছে। নিশ্চয়ই ঠিকে ঝি। মৃগাংক ভাবল, বাসবী নিশ্চয়ই উঠবে। কিন্তু উঠল না। খাটের ওপাশে শুয়ে আছে ও। বেশবাস অগোছালো। ঘুমুচ্ছে। মৃগাংক এবার ডাকল, দেখ না, ঠিকে ঝি বোধহয়। গলার স্বরে খানিকটা বিরক্তি। ওর ডাক বাঘী শুনতে পেয়েছে কিনা ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু পরক্ষণেই গোটাকয়েক রিক্তিসূচক অস্ফুট আওয়াজ করে পাশ ফিরল বাঘী। উঠবার কোন লক্ষণ নেই। মৃগাংক এবার বিছানায় গড়িয়ে গড়িয়েই বাবীর কাছাকাছি এল। ঠেলল হাত দিয়ে, দেখ না, দুগগার মা এসেছে নিশ্চয়ই।
গায়ে হাত লাগতেই একেবারে যেন ফোঁস করে উঠল, উঃ, বাবা, ঘুমুতেও পারব না একটু। খুলে দাও না দরজাটা।
দরজায় আবার কড়া নাড়ার আওয়াজ। এবার মৃগাংক বিছানা ছেড়ে উঠল, মুখে রিক্তির ছাপ স্পষ্ট। মেজাজটা খিচড়ে গেছে। খাট থেকে নেমে দেখল, বেবিকটে শুয়ে আছে বুবুল, ওর একমাত্র ছেলে। বছর দেড়েক বয়েস। মশারি তুলে ঘুম ঘুম। চোখে বুবুলকে দেখল একবার। যাক্, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।
ঘর থেকে বেরোলেই বারান্দা, তারপর ফ্ল্যাটের সদর দরজা। বারান্দায়। বেরোতেই একঝলক আলো চোখে লাগল। রোদ উঠে গেছে। বেলা কম হয়নি। ঘড়ি দেখল মৃগাংক। সাড়ে ছটা, অর্থাৎ ভোর হয়েছে অনেক আগেই। বারান্দার জানলা দিয়ে আকাশ দেখল ও। নির্মেঘ নীল। শরতের আকাশের মত। ঘরের জানলাগুলো বন্ধ থাকায় সময় বোঝা যায় না। সদর দরজা খুলতেই দেখল, দুগগার মা নয়, একটা বাচ্চা মেয়ে। মৃগাংক চিনতে পারল না।
মেয়েটি কেমন যেন ভয় ভয় মুখে থেমে থেমে বলল, দুগগার মা আজ আসতে পারবে না, বলে দিয়েছে।
মৃগাংক অস্বস্তি অনুভ্র করল, একেই গকাল বেশ রাত করে শোয়া হয়েছে, তার ওপর বাঘী যদি শোনে ঠিকে ঝি আজ আসতে পারবে না, তবে আর রক্ষে থাকবে না। এদিকে বুবুলকে রাখে যে মেয়েটা-মালতী, সে তো আগে থেকেই বলে কয়ে দিনকয়েকের ছুটি নিয়েছে। ওর মাসীর নাকি বিয়ে।
মৃগাংক জিজ্ঞেস করল, কেন, হয়েছে কি দুগগার মার!
—চোখের অসুখ হয়েছে।
—চোখের অসুখ!
মেয়েটা চলে গেলে দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, যেন নিজেকেই, দ্যুৎশালা, যত ঝামেলা সাতসকালে। মনে মনে বিরক্ত ও ক্লান্ত বোধ করল।
ঘরে ফিরে কোন শব্দ না করেই খাটে উঠল, তারপর আবার শুয়ে পড়ল টান টান হয়ে। ভাবল, খবরটা এখন দিয়ে কাজ নেই। পরে বললেই হবে। কিন্তু বাসবী জেগেই ছিল, অবশ্য বিছানা ছেড়ে ওঠেনি, ও ব্যাপারটা বোধহয় আন্দাজ করেছে। বালিশে মুখ গুঁজেই বলল, কে, কার সঙ্গে কথা বলছিলে—
মৃগাংক যেন শুনতেই পায়নি, এমনভাবে চুপ করে রইল।
—কে এসেছিল, আবার জিজ্ঞেস করল বাসবী। আর চুপ করে থাকা চলে না। ওপাশ ফিরে শুয়েছিল মৃগাংক, পাশ না ফিরে বলল, চিনি না একটা বাচ্চা মেয়ে, বলল, দুগগার মা নাকি আজ আসবে না।
—কেন, ওর আবার কী হল! বাসবীর গলার স্বর এবার বেশ তীক্ষ্ণ।
–চোখ উঠেছে, কলকাতায় সকলের হচ্ছে।
—চোখ উঠেছে তো হয়েছে কি, বাসন ক’খানা মেজে দিয়ে যেতে পারল না। বাসবীর বলার রুক্ষ ভঙ্গীটা মৃগাংকর ভাল লাগল না।
আশ্চর্য, ঝিয়ের চোখ উঠেছে, কেন উঠেছে, এসব কী করে জানবে ও।
ভেতরে ভেতরে উত্তপ্ত হলেও ঠাণ্ডা গলায় বলল, জোর করলে হয়ত আসতে পারে, কিন্তু বুবুল, বুবুলের কথা ভেবেই আর কিছু বললাম না।
একটু থেমে হঠাৎ সমাধান খুঁজে পেয়েছে এমনভাবে বলল মৃগাংক, আজকের মত কাঁচের বাসনগুলো বের করে নাও না।
—তুমি তো বলেই খালাস! যত্ত ঝামেলা তো আমার। মুখ ঝামটে উঠল বাসবী।
এবার মৃগাংকর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। মুখে বেশ কয়েকটা খারাপ কথা এসে গিয়েছিল, কিন্তু বাসবীর চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেছে বুবুলের। কাদছে। মৃগাংক কিছু বলবার আগেই বেবিকট থেকে বুবুলকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বাসবী।
মৃগাংক ভেবেছিল আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে, কাল রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি। কিন্তু মেজাজটা বেশ খিচড়ে গেছে, আর ঘুম-টুম হবে না। ভাবল বাড়ি থেকে এক্ষুণি বেরিয়ে যায়, ঝামেলা আর পোষায় না। বন্ধু কেবিনে গেলে পাড়ার দু’য়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে, ওখানেই চা খেতে খেতে আড্ডাও মারা যাবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়ল, বুবুলের জন্য দুধ আনার সময় হয়ে গেছে। পাড়ায় একটা খাটাল আছে, সেখান থেকে রোজ আনতে হয়। ঠিক সময়মত না গেলে আবার খাঁটি দুধ পাওয়া যায় না, দুধ জল মিশেল হয়ে যায়। আগে ঠিক এমন ছিল না। ইদানিং
হরিণঘাটার দুধ প্রায়ই খারাপ হতে থাকায়, কার্ড রিনিউ করবার নানা ঝামেলায়। অনেক লোকই তিক্তবিরক্ত হয়ে এদিকে ভিড় জমিয়েছে। এতগুলি খদ্দের বেমককা পেয়ে শিউচরণের ব্যবহার বেশ দুবিনীত হয়ে উঠেছে, অথচ এই লোকটাই আগে। কিরকম আশ্চর্য বিনয়ী ভদ্র ছিল, নরম করে কথা বলত। আজকাল তো কথায় কথায় বলে, এখানে নাহি পোষায় তো দোসরা জায়গা চলিয়ে যান।
লোকটার কথা শুনে মাঝে মাঝে গা জ্বলে যায় মৃগাংকর, কিন্তু কিছু করবার উপায় নেই। বুবুলের জন্য দুধ চাইই। অথচ শিউচরণ ছাড়া আর কোন গয়লা ও তল্লাটে নেই। ট্রামলাইনটা পেরিয়ে আরো দুয়েকজন আছে বটে, তবে ওখানকার অবস্থাও তথৈবচ।