যেখানে তমাল-ডালে বাঁধিয়া রাখার কথা আছে, সেখানে গায়েন আখর দিয়া দস্তুর-মত একটি পদ রচনা করিয়া উহার ব্যাখ্যা করিয়াছে–
‘‘যদি আসিয়া সই, বঁধু শুধায় রাই কই,
তখন তোরা বলিস্ তারে–তোমার বিরহে রাই মরেছে,–
আমরা ফেলি নাই, ওই তমাল ডালে বাঁধা আছে–
সে যে তোমারে দেখাবার লাগি।
যদি হা-রাধে, হা-রাধে করি’, বধুঁ উঠে ফুকরি,
তবে আমার সেই মৃত তনু বঁধুর চরণেতে দিও ডালি।’’
রায়-শেখরের পদটির এই ভায্য মূর্খ গায়েন করিয়াছে। তাহাকে অবশ্য কবির কাব্যের উৎকৃষ্ট বোদ্ধা বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। অবশ্য এই পদ ও আখর কীর্ত্তনিয়ার মুখে না শুনিলে, ইহার সৌন্দর্য্য সমগ্রভাবে ধরা পড়িবে না।
কৃষ্ণ মথুরায় যাইরা সব ভুলিয়াছেন। কিন্তু গোপীকে যত বড় ঐশ্বর্য্যের কথাই শুনাই না কেন, সে ভুলিবার পাত্র নহে। সে শুধু প্রাণকেই বড় বলিয়া জানে, ধনমান তাহার কাছে নগণ্য। ঐশ্বর্য্যের সঙ্গে মাধুর্য্যের প্রভেদ দেখাইবার জন্যই বৈষ্ণব কবির মাধুরের পরিকল্পনা। মধুরাবাসিনীর দর্পের উত্তর গোপী ঝঙ্কার দিয়া বলিতেছে “কিসের বড়াই করিস্ মথুরাবাসিনি! তোদের মণি মুক্ত-জহরৎ–এসকলের মধ্যে ব্রজের একটা ধূলি-রেণুরও দাম নাই।”
এইজন্যই সেই ধূলির জন্য সমন্ত ভারতবর্ষ বৃন্দাবনের দিকে ছুটিয়াছে, তাহারা মথুরার ঐশ্বর্য্য দেখিতে চায় না। এই রেণুর উপর শত শত মঠ, অট্টালিকা–(তাহাদের শীর্ষে সোণার কলস) উঠিয়াছে। আরও কতকাল ধরিয়া উঠিবে কে জানে! সেখানে যে প্রাণ বঁধুর পদরজঃ আছে, তার চেয়ে মূল্য কাহার বেশী? কৃষ্ণ যখন তাঁহার সপ্ততল মন্দিরের চূড় হইতে গোপীমুখার বিন্দনিঃসৃত “জয় রাধে, শ্রীরাধে” বাণী শুনিলেন, তখন তিনি দ্রুতগতিতে নীচে ছুটিয়া আসিলেন–তাঁহার রাজদণ্ড, রাজপরিচ্ছদ, রাজমুকুট কোথায় পড়িয়া রহিল? তিনি পাগলের মত ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া বলিলেন “এ নাম কে শুনালে? মথুরার লোক তো সে নাম জানে না, তাহারা তো যশ মান ধনের কাঙ্গাল, তাহারা তো ও নাজ জানে না। কে এই উষর মরুভূমির মধ্যে আমার কাণে অমৃত-তুল্য নাম শুনালে?” তখন তাঁহার ধরা পরিবার অবকাশ হল না, এক পায়ে পায়জামা অপর পায়ে ধড়ার অংশ, এক হাতে রাজদণ্ড, অপর হাত বাঁশী খুজিতেছে। উম্মত্ত বেশে তিনি রাধার কাছে যাইতে ছুটিয়াছেন।
রাধা সখীদের মধ্যে কৃষ্ণ জয়ন্ময় ‘রাধা’ দেখিতেছেন, রাধাভাবে তিনি উদভ্রান্ত। পুরাণে কথিত আছে, এইরূপ ভাবাবেশে প্রহলাদ ব্যাঘ্রের গল জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিলেন, “তুমি কি আমার পদ্ম পলাশ লোচন হরি?” কৃষ্ণ ললিতা সখীকে ধরিয়া উন্নত্ত ভাবে বলিলেন, “কই কই, প্রেমমরি! পরশিয়ে অঙ্গ শীতল হই–আমি জ্বলে যে আছি, বহুদিন না দেখিয়ে আমি জ্বলে যে আছি।” ললিতা হাসিয়া, সরিয়া গিয়া বলিল, “এ কি কহে বঁধু, তুমি কারে বলি কারে ধরহে বঁধু! আমি তোমার রাই নই, আমি ললিতা, তোমার প্রেমময়ী রাই দাঁড়িয়ে ওই,–বঁধূ, চোখে লেগেছে কি রাই-রূপের ধাঁধা, তাই জগৎ ভরে দেখছ রাধা-রাধা!” কৃষ্ণ পাগলের মত “কই কই প্রেমময়ী” বলিতে বলিতে পুনরায় সুদেবীকে ধরিলেন, সে হাসিয়া সরিয়া যাইতে যাইতে বলিল, “এ কি করহে বঁধূ, তুমি কারে বলি’ কারে ধর হে বঁধূ! আমি রাই নই, আমি সুদেবী, তোমার প্রেমময়ী রাই দাঁড়িয়ে ওই–বঁধূ সবে ঘোরে তেমার চক্রে, তুমি ঘোর বঁধূ রাধা-চক্রে।”
এই সকল ভাব কৃষ্ণকমল মহাপ্রভুর বিভ্রান্ত প্রেমলীলা হইতে সঙ্কলন করিয়াছিলেন। পূর্ব্বোক্ত পদে সত্যই কৃষ্ণ জগন্ময় রাধা দেখিয়া ছিলেন–সে কথা ললিতা বলিয়াছিল। সত্যই তিনি উন্মত্তবৎ রাধাচক্রে পড়িয়া দিশেহারা হইয়াছিলেন–সে কথা সুদেবী বলিয়াছিল। তাহারা কৃষ্ণের এই প্রেম তন্ময়তা বুঝিতে পারিয়াছিল, কিন্তু এখনকার রুচিবিদ গণ এই পদে শ্লীলতার অভাব দেখিয়া লজ্জিত। এইরূপে সম্পূর্ণ বিদেশী ভাবের আয়ত্ত হওয়াতে যাঁহাদের স্বরূপ নিলাম হইয়া গিয়াছে, তাঁহারা বৈষ্ণবপদতীর্থে প্রবেশের অনধিকারী, “পড়িলে ভেড়ার শৃঙ্গে, ভাঙ্গে হীরার ধার”।
আমি পূর্ব্বে যে প্রশ্নের উথাপন করিয়াছি, এখন পর্য্যন্ত তাহার উত্তর দেওয়া হয় নাই। কৃষ্ণ তো মথুরায় গেলেন, এইখানে কি মাথুর লীলার পরিসমাপ্তি? তিনি কি সত্যই চিরদিনের জন্য প্রেমের হাঠ ভাঙ্গিয়া গেলেন? আমি বলিয়াছি, বৈষ্ণবেরা কৃষ্ণ লীলার শেষ স্বীকার করেন নাই। মন্দিরের ভিত ধ্বসিয়া পড়িল, বিগ্রহ অপহৃত, সিংহাসন শূণ্য হইয়া রহিল। কিন্তু যাহা বাহিরে ছিল, সেই অন্তরের ধনকে ভক্ত অন্তরে কুড়াইয়া পাইল। তাঁহার রূপ তাহারা নয়নে গাথিয়া রাখিল, হৃদয়নাথকে হৃদয়ের অন্তঃপুরে শত দ্বার দিয়া আমন্ত্রণ করিয়া আনিল। তাহারা একথা বলিল না যে, কৃষ্ণ চিরদিনের জন্য বৃন্দাবন ছাড়িয়া গিয়াছেন, বিদ্যাপতির রাধা বলিলেন,
‘‘যব হরি আওব গোকুল-পুর
ঘরে ঘরে নগরে বাজব জয়-তুর।’’
বৃন্দাবনে তিনি ফিরিয়া আসিবেন, রাধা নিজের হৃদয়ে তাহার পূর্ব্বাভাস উপলব্ধি করিয়াছেন। এবার বিজয় বাজনা (জয়তুর) বাজাইয়া তাঁহাকে বরণ করিবার সময় হইয়াছে। কিন্তু এবার সমস্ত আয়োজনসম্ভার মানসীপূজার উপকরণ।
‘‘পিয়া যব আয়ব এ মঝু-গেহে,
মঙ্গল আচার করব নিজ দেহে।’’
তিনি আসিবেন, কিন্তু বর্হিদ্বার দিয়া আসিবেন না,–এই দেহই শ্রীমন্দির হইবে, “human body is the highest temple of God”. মঙ্গলাচরণ সমস্তই দেহে করিতে হইবে। বিদেহী, চিন্ময় কৃষ্ণ হৃদয়ে আসিতেছন,
‘‘বেদী করব হাম আপন অঙ্গমে।
ঝাড়ু করব তাহে চিকুর বিছানে।’’
আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়া তাঁহার বেদী রচনা করিব এবং আমার আলুলায়িত কুন্তল দিয়া সম্মার্জ্জনী তৈরী করিয়া তাঁহার পথ পরিষ্কার করিব। আর,
‘‘আলিপনা দেয়ব মতিম হার,
মঙ্গল কলস করব কুচভার।’’
আমার কণ্ঠ-বিলম্বিত সুদীর্ঘ মুক্তার হারই আলিপনা-স্বরূপ হইবে, বাহিরের আঙ্গিনায় আলিপনা দেওয়ার প্রয়োজন নাই। বহির্দ্বারে তাঁহার সম্বর্দ্ধনার্থ মঙ্গল ঘট স্থাপন করার দরকার নাই, আমার স্তন যুগ্মই মঙ্গল ঘট স্বরূপ হইবে।