মূর্খতা প্রচুর মানুষের মধ্যে দেখি। মূর্খতা ট্রাম্পের মধ্যেও। ট্রাম্প ভাবেন, মেয়েরা যৌনবস্তু ছাড়া খুব বেশি কিছু নয়, যৌনবস্তুদের এমনভাবে পোশাক আশাক পরতে হবে যেন তাদের দেখে পুরুষের যৌন উত্তেজনা জাগে। ট্রাম্পের মতো স্বাতী দেশপাণ্ডেও মেয়েদের যেমন ইচ্ছে তেমন পোশাক পরার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। স্বাতী দেশপান্ডের মতো মানুষেরাও ভাবেন মেয়েরা যৌনবস্তু, তাই মেয়েদের তাঁরা এমন পোশাক পরাতে চান, যে পোশাক পরলে মেয়েদের শরীর প্রদর্শিত হবে না, পুরুষদের যৌন উত্তেজনা জাগবে না। স্বাতী দেশপাণ্ডে আর মৌলবাদী যারা মেয়েদের বোরখা পরতে বাধ্য করেন— একই মানসিকতার লোক। একই উদ্দেশে তাঁরা মেয়েদের শরীর আবৃত করেন। তাঁরা নিশ্চিত মেয়েদের শরীরের খাঁজভাঁজ দেখলে পুরুষেরা এমন উত্তেজিত হবে যে সমাজে ভয়ানক বিচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তাঁরা নিশ্চিত পুরুষেরা নিজেদের যৌন উত্তেজনা শামাল দিতে অক্ষম। আর ওদিকে মেয়েদের শরীর অনাবৃত করতে চান ট্রাম্প। ট্রাম্পের মতো লোকেরা ভেবেই নিয়েছেন যৌন উত্তেজনা জাগানোই মেয়েদের কাজ।
ওঁরা ভিন্ন মানসিকতার মানুষ। কিন্তু দু’পক্ষের মানসিকতাই মেয়েদের ভোগায়। ওঁরা কেউই মেয়েদের মানুষ হিসেবে সম্মান করে না। ওঁদের এক পক্ষ মেয়েদের আবৃত করে, আরেক পক্ষ অনাবৃত করে। দু’পক্ষই সমান নারীবিদ্বেষী। মেয়েরা যারা আত্মসম্মান আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চায়, তাদের উপায় একটিই, ওই দু’পক্ষকেই গ্রাহ্য না করা, নিজের মতো চলা, নিজের যা করতে ভালো লাগে তা করা, নিজের যা পরতে ভালো লাগে তা পরা। যদি শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয়, শাড়ি; সালোয়ার, কামিজ, শার্ট, প্যান্ট, শর্টস টিশার্ট, বিকিনি, স্কার্ট যা কিছু। এখন অনেকে বলতে পারেন, যদি বোরখা পরতে ইচ্ছে হয় বোরখাও। হ্যাঁ বোরখাও। তবে বোরখা পরতে আদৌ কোনও মেয়ে চায় কিনা এই ব্যাপারে আমার কিন্তু যথেষ্ট সংশয়। বোরখা মেয়েরা পরে, পরতে বাধ্য হয় বলে পরে। ভালোবেসে, শখ করে কেউ বোরখা পরে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিছু না পরতে ইচ্ছে হলে কিছু না পরার স্বাধীনতাও কি মানুষের থাকা উচিত নয়? হ্যাঁ সেটিও থাকা উচিত।
যে পোশাকগুলোকে এক সময় পুরুষের পোশাক বলে চিহ্নিত করা হতো সে পোশাকগুলো এখন আর শুধু পুরুষের পোশাক নয়, ঠিক যেমন যে কাজগুলোকে এক সময় পুরুষের কাজ বলে চিহ্নিত করা হতো, সেগুলো আর শুধু পুরুষের কাজ নয়। মেয়েরা প্রমাণ করেছে পুরুষেরা যে কাজ করতে পারে, সে কাজ মেয়েরাও করতে পারে। মেয়েরা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে পারে, মেয়েরা পুলিশ হয়ে চোর ডাকাত ধরতে পারে, মেয়েরা বিমান চালাতে জানে, মহাশূন্যে ভাসতে পারে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে, বড় বড় বিজ্ঞানী হতে পারে, মেয়েরা শ্রমিক হতে পারে, কেরানিগিরিও করতে পারে। যে কোনও পেশার নির্ধারিত পোশাকই মেয়েদের পোশাক। মেয়েরা যেহেতু সর্ববিদ্যায় পারদর্শী, মেয়েদের পোশাকও তাই সর্বরকম। মেয়েদের পোশাক কোনও নির্দিষ্ট পোশাকে সীমাবদ্ধ নয়। তারা যে কোনও পোশাক পরার অধিকার জন্মগতভাবে রাখে, পেশাগতভাবেও রাখে।
মেয়েদের পোশাককে পুরুষেরা তাদের রাজনীতির বিষয় করেছে। মেয়েরা যৌন হেনস্থার শিকার হলে তারা মেয়েদের পোশাককে দোষ দেয়। সমাজ যে সভ্য হয়নি, শিক্ষিত হয়নি, সমাজ যে এখনও মেয়েদের দ্বিতীয় লিঙ্গ বলে বিচার করে, মেয়েদের যৌনবস্তু বলে মনে করে— এ কথা স্বীকার করে না, এ নিয়ে উদ্বিগ্নও হয় না। বরং মেয়েদের আদেশ বা উপদেশ দেয় ছোট পোশাক ছেড়ে বড় পোশাক পরার, এ পোশাক না পরে সে পোশাক পরার। জিন্স না পরে সালোয়ার পরার, সালোয়ার না পরে শাড়ি পরার। বিশেষজ্ঞরা এই যে এত বলছেন যে মেয়েদের পোশাকের কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটে না, তারপরও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে মেয়েরা বা মেয়েদের পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী নয়, দায়ী ধর্ষক, দায়ী ধর্ষকের নারীবিদ্বেষ, দায়ী ধর্ষকের অজ্ঞতা, মূর্খতা, পুরুষতান্ত্রিকতা।
আচ্ছা, পুরুষের ওপর ঘটা কোনও যৌন হেনস্থার দায় কি পুরুষের কোনও পোশাকের ওপর দেওয়া হয়? দেওয়া হলে পোশাক বদলানোর উপদেশ কি মুহুর্মুহু বর্ষণ করা হয় পুরুষের ওপর? মেয়েদের ওপর চলা অন্যায়ের, সত্যিই, কোনও সীমা নেই, শেষ নেই।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
ভারতে অসহিষ্ণুতা
কিছুদিন আগে পদ্মাবতী ছবির শুটিং এ বিখ্যাত পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভান্সালিকে শারীরিক আক্রমণ করেছে ‘রাজপুত কারনি সেনা’ নামের একটি দল। ছবিতে পদ্মাবতীর সঙ্গে আলাউদ্দিন খিলজির ঘনিষ্ঠতা দেখানো হচ্ছে, এটা তাদের পছন্দ হচ্ছে না। সঞ্জয় ইতিহাস বদলে দিচ্ছেন, অভিযোগ এখানেই। ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে বই লিখতে গেলে, বা ছবি আঁকতে গেলে, বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে লেখক, শিল্পী, চিত্রপরিচালকরা খানিকটা নিজের কল্পনা মেশানই। এ নতুন কিছু নয়। দোষ সঞ্জয় লীলার নয়। শিল্পীর স্বাধীনতা হরণ করে নিলে আর যাই তৈরি হোক, শিল্প তৈরি হয় না। পদ্মাবতীর কথা ইতিহাসে আছে, কিন্তু পদ্মাবতী নামে বাস্তবে আদৌ কেউ ছিল কি না এ নিয়ে অনেক ইতিহাসবিদেরই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কয়েক মাস আগে চিত্র পরিচালক করন জহরের ওপরও হামলা হয়েছে। কেন তাঁর ‘এ দিল হ্যায় মুশকিল’ ছবিতে ফওহাদ খান নামের এক পাকিস্তানি অভিনেতাকে নেওয়া হলো, এ নিয়ে আপত্তি ‘মহারাষ্ট্র নভনির্মাণ সেনা’ নামের একটি দলের। দেশি অভিনেতা থাকতে পাকিস্তানের মতো শত্রু দেশ থেকে কেন অভিনেতা আনতে হয়, যখন পাকিস্তানের হামলায় ভারতের সেনারা মরছে? করন জহরের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ওরা। করন জহর প্রতিজ্ঞা করেছেন তাঁর ছবিতে তিনি আর পাকিস্তানি অভিনেতা নেবেন না। জানি না সঞ্জয় লীলা ভান্সালিও আতঙ্কে ডুবে আছেন কিনা, তিনিও তাঁর ছবির গল্প বদলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন কিনা।