দিনটি যদি ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্তি পেতো, সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু আপাতত মুক্তি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ব্যবসায়ীরা দিবসটির নামে ব্যবসা করে নিচ্ছে বলে গোটা দিবসটিকে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তার চেয়ে দিবসটিকে আর কী কী উপায়ে সুন্দর এবং সমৃদ্ধ করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। দিবসটির বিবর্তন সেই আদিকাল থেকে হচ্ছে। আজ মানুষ শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাকে নয়, বাবা মা ভাই বন্ধু এবং পোষা কুকুর বেড়ালকেও হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন জানাচ্ছে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করার আর তো সময় সুযোগ নেই কারোর। যদিও আমি মনে করি, ভালোবাসা এক দিনের জন্য নয়, ভালোবাসা নিত্যদিনের জন্য, যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন করি না, কিন্তু সমাজটা যেহেতু স্বার্থান্ধ, এই সমাজটাকে চাই ভালোবাসা শিখুক, ভালোবাসার চর্চা করুক। ঘৃণা প্রদর্শন নিয়ে জড়তা নেই, কিন্তু ভালোবাসা নিয়ে যেহেতু জড়তা আছে, চাই আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষের জন্য মানুষ ভালোবাসা প্রকাশ করুক। মানুষ প্রকাশ্যে মানুষকে চড় নয়, কিল নয়, লাথি নয়, বরং চুমু খাক। একটি দিন ভালোবাসার চর্চা করলে মানুষ প্রকাশ্যে প্রেম করাকে আর চুমু খাওয়াকে মন্দ বলে ভাববে না, নিষিদ্ধ বলে ভয় পাবে না, মানুষের দ্বিধা কেটে যাক। আজ এই দিনে ভায়োলেন্স নিষিদ্ধ হোক।
নারীর ওপর নির্যাতন অন্তত একটি দিনের জন্য বন্ধ করবে কি পুরুষ? ভায়োলেন্স অন্তত বছরের একটি দিনে না করুক পুরুষ। ভ্যালেন্টাইন দিবসে যদি ভায়োলেন্স বন্ধ না হয়, তা হলে কোনও মানে নেই এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের। তুমি ভালোবাসতে না পারো, অন্তত ঘৃণা করো না। তুমি ফুল দিতে না পারো, অন্তত কাঁটা দিও না। তুমি চুমু খেতে না পারো, অন্তত চড় মেরো না। ভায়োলেন্স বন্ধ না করলে ভ্যালেন্টাইন দিবস পালন করার অধিকারই হয়তো পুরুষের থাকা উচিত নয়! ভ্যালেন্টাইন ডে’তে যেন একটি মেয়েকেও যৌন দাসী হতে না হয়, একটি মেয়েকেও যেন পুরুষের নির্যাতন সইতে না হয়, একটি মেয়েকেও যেন মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর স্বনির্ভরতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হতে হয়। রাজি?
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
মেয়েদের পোশাক নিয়ে লোকের এত মাথাব্যথা কেন?
সেদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বললেন, হোয়াইট হাউসে যে মেয়েরা কাজ করবে, তাদের সবাইকে ‘মেয়েদের মতো পোশাক’ পরতে হবে। মেয়েদের মতো পোশাক বলতে ট্রাম্প বুঝিয়েছেন যে পোশাক পরলে মেয়েদের যৌনাবেদন বাড়ে। এদিকে উল্টো ঘটনা ঘটেছে ভারতে। মুম্বাই-এর গভরমেন্ট পলিটেকনিক কলেজের প্রিন্সিপাল স্বাতী দেশপান্ডে বলেছেন, ‘আমি শুনেছি কেন মেয়েরা অল্প বয়সে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান রোগে ভোগে। পুরুষের পোশাক পরলে মেয়েরা পুরুষের মতো চিন্তা করে, পুরুষের মতো আচার ব্যবহার করে। নিজেকে পুরুষ বলেই মনে করতে থাকে। এ কারণেই, অল্প বয়স থেকেই তাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার স্বাভাবিক ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে যায়, তারা ভুগতে থাকে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান রোগে। ’ স্বাতী দেশপাণ্ডে এর মধ্যে ‘ইভ টিজিং’ বন্ধ করার নামে কলেজ ক্যান্টিনে ছাত্র আর ছাত্রীদের আলাদা বসার ব্যবস্থা করেছেন। ছাত্রীদের ‘সুইটেবল’ পোশাক পরার অর্থাৎ সালোয়ার কামিজ পরার আদেশ দিয়েছেন। পুরুষের পোশাক পরলে কী ক্ষতি হয় তা তো বলেই দিয়েছেন। এখন, আমার প্রশ্ন, এত অজ্ঞতা নিয়ে কী করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন, আর কী করে স্বাতী দেশপান্ডে একটি কলেজের প্রিন্সিপাল হন? প্রিন্সিপালের উদ্ভট মন্তব্যের প্রতিবাদে টুইটারে আর ফেসবুকে মানুষ নানা রকম পোশাক পরা মেয়েদের ছবি পোস্ট করছে। ভারতীয় মেয়ে— যারা বিজ্ঞানী, বৈমানিক, সাঁতারু, ফুটবলার, রেসলার, রানার, হাইকার, পুলিশ, মিলিটারি তাদের ছবি। মেয়েদের এসব পোশাক পুরুষের পোশাকের চেয়ে পৃথক নয়। ড্রেসলাইকএনইন্ডিয়ানউওম্যান হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে মেয়েরা শর্টস আর টিশার্ট পরা নিজেদের ছবিও প্রচুর পোস্ট করছে। এসব পোশাক পরা মেয়েরা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান রোগে ভুগছে না। সন্তান জন্ম দেওয়ার কোনও ইচ্ছে এই রোগের কারণে নষ্ট হয়ে যায় না। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম বলে একটি রোগ আছে, এই রোগে মেয়েদের হরমোনের গণ্ডগোল দেখা দেয়। পরীক্ষা করলে দেখা যায় জরায়ুর পাশে যে ডিমের থলি থাকে, সেখানকার ডিমগুলো বেশ ফুলে উঠেছে। এই সিন্ড্রোমটা কী কারণে হয়, তা এখনও সঠিক জানা যায়নি, তবে দেখা গেছে ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপ থাকলে, প্রচুর ইনসুলিন নিলে, ওজন খুব বেড়ে গেলে, জরায়ুতে ক্যান্সার হলে এটি হয়। হলে ঋতুচক্র স্বাভাবিক থাকে না, গোঁফ দাড়ি গজাতে থাকে, ব্রণও। গর্ভবতী হওয়াও কঠিন হয়ে ওঠে। এটির চিকিৎসা আছে। অনেক মেয়েই এই রোগে ভোগে, আবার সেরেও ওঠে। এই রোগের সঙ্গে কিন্তু মেয়েরা কী পোশাক পরলো, কী চিন্তা করলো, কী ভাবলো— তার সম্পর্ক নেই। একেবারেই নেই।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কলেজের প্রিন্সিপালের এমন অদ্ভুত বিশ্বাস কী করে এলো যে, মেয়েরা পুরুষের পোশাক পরলে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোমে ভুগবে এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা হারাবে! সম্ভবত তিনি কোনও মেয়েকে ওই রোগে ভুগতে দেখেছিলেন, যে মেয়ের পরনে পুরুষের পোশাক ছিল। তাই তিনি ভেবে নিয়েছেন, পুরুষের পোশাক পরলে ওই রোগ হয়। যে মেয়েকে ওই রোগে ভুগতে দেখেছিলেন, সেই মেয়ে যদি মার্সিডিজ গাড়ি চালাতো, তাহলে জানি না বলতেন কিনা, মেয়েরা মার্সিডিজ গাড়ি চালালে ওই রোগ হয়। আসলে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম কোনও বিষয় নয়, মেয়েদের পোশাক নিয়েই প্রিন্সিপালের আপত্তি। আপত্তিটার কারণ তাঁর মানসিক সমস্যা অথবা তাঁর মূর্খতা।