সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০২ মার্চ, ২০১৭
ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভাবনা
অদ্ভুত একটা দিন বটে। ছোটবেলায় এরকম দিনের নাম শুনিনি। হঠাৎ যেন উড়ে এসে জুড়ে বসলো। জুড়ে বসে ভালো কাজ যদি করতে পারে করুক। ভ্যালেন্টাইন ডে’র উৎস নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সবচেয়ে যেটা গ্রহণযোগ্য, সেটা হলো, লুপারকালিয়া বলে প্রাচীন রোমে এক উৎসব ছিলো, যেটি ফেব্রুয়ারির ১৩ থেকে ১৫ তারিখ অবধি হতো। যে উৎসবে নারী-পুরুষ প্রচুর মদ্যপান করতো, আর সঙ্গমের জন্য সঙ্গী বেছে নিতো। রোমের মানুষ তাদের প্রাচীন ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছিলো যত বেশি, প্রাচীন রোমের দেবীর নামে লুপারকালিয়া উৎসবকে তত তারা মানতে পারছিলো না। উৎসবটি খুব জনপ্রিয় ছিল বলে পুরো ছেড়েও দিতে পারছিলো না। শেষে এমন হলো, উৎসবটি করতে লাগলো, কিন্তু উৎসবটিকে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামে উৎসর্গ করে, তবে। সেই সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার কারণে রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তৃতীয় শতকে যার গর্দান কেটেছিলেন। ইতিহাসবিদ নোয়েল লেন্সকি বলেছেন লুপারকালিয়া উৎসবে পুরুষেরা দেবী লুপারকাসের উদ্দেশে একটি ছাগল আর একটি কুকুর বলি দিতো। তারপর মৃত ছাগল বা কুকুরের চামড়া দিয়ে উৎসবের মেয়েদের বেদম মারতো। তারা বিশ্বাস করতো, এই মার খেলে মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে। লুপারকালিয়া উৎসব ছিলো সকলের মদ খাওয়ার উৎসব, মদ খেতে খেতে মাতাল হওয়ার উৎসব, মাতাল হতে হতে ন্যাংটো হওয়ার উৎসব, ন্যাংটো হতে হতে লটারির উৎসব, লটারির কৌটো থেকে যে পুরুষ যে মেয়ের নাম ওঠাতো, তার সঙ্গে সেই পুরুষ সঙ্গম করতো সে রাতে। শুধু সে রাতে নয়, ইচ্ছে হলে আরও কিছু রাতে, কেউ কেউ বিয়ে করে নিতো। রোমের মানুষেরা খ্রিস্টান হওয়ার পর ওই উৎসবের নাম যেমন বদলে দিয়েছে, ন্যাংটো শরীরে কাপড়ও পরিয়েছে। পোপ প্রথম জেলাসিয়াস পঞ্চম শতাব্দীতে এটিকে খ্রিস্টানদের ছুটির দিন ঘোষণা করেছিলেন।
মধ্যযুগের ইংরেজ কবি জেফ্রি চশার, আর উইলিয়াম শেকসপিয়ার ভ্যালেন্টাইন ডে’কে রোমান্টিক দিন বলেছেন, এ নিয়ে পদ্য রচনাও করে গেছেন। চশার যদি ভ্যালেন্টাইন ডে’কে রোমান্টিক আখ্যা না দিতেন, যদি কাব্য করে না বলতেন সঙ্গী পছন্দ করার জন্য নানা রঙের পাখি ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসত, তাহলে দিনটির সঙ্গে হয়তো ভালোবাসা এসে মিশতো না এমন। ন্যাংটো হয়ে মেয়েদের ওপর নির্যাতন করার ওই প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক উৎসবটিকে ‘রোমান্টিক’ না বলা হলে আমার মনে হয় না দিনটি প্রেমের দিন হিসেবে এভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো। যে দুজন ভ্যালেন্টাইন নামের সন্তকে মেরে ফেলা হয়েছিল মধ্য ফেব্রুয়ারিতে, তাঁদের কেউই কিন্তু রোমান্টিক লোক ছিলেন না। রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াস রোমের সৈন্যদের বিয়ে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন, জানি না কেন, বিবাহিত পুরুষেরা ভালো সৈন্য হওয়ার উপযুক্ত নয়। রোমের এক পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন দাঁড়িয়েছিলেন সম্রাটের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে, গোপনে বিয়ে করেছিলেন তিনি, সৈন্যদের বিয়েও দিয়েছিলেন। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে তাঁর গর্দান কাটা যায়, গর্দান কাটার আগে নাকি জেলারের মেয়ের প্রেমে পড়েন তিনি, একটি চিঠির শেষ ছত্রে লিখেছিলেন, ফ্রম ইয়র ভ্যালেন্টাইন।
আজ একবিংশ শতাব্দীতেও সেই ভ্যালেন্টাইনের নামে দিবস পালন হচ্ছে। তবে দিবসটি এখন ব্যবসায়ীদের জন্য বিশাল দিন। আমেরিকায় এ বছর ১৮.২ বিলিয়ন ডলারের ভ্যালেন্টাইন ডে’র উপহার ক্যান্ডি, ফুল, কার্ড আর ডিনার বিক্রি হয়েছে। গত বছর হয়েছিল ১৭.৬ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা।
ভ্যালেন্টাইন ডে’র বিপক্ষে হিন্দু এবং মুসলমান মৌলবাদীরা বেশ সরব। তারা মনে করে এই দিবসটি আমাদের সংস্কৃতিবিরোধী। আশ্চর্য, প্রেম কি সংস্কৃতির অংশ নয়? যে সংস্কৃতিতে প্রেম নেই, সেই সংস্কৃতি অপসংস্কৃতি। যারা প্রেম দিবসের বিরুদ্ধে মিছিল করে, তারা কি কখনও ধর্ষণের বিরুদ্ধে, ঘৃণা আর বর্বরতার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে? নিশ্চিতই করেনি।
ভ্যালেন্টাইন ডে’র উৎস যত কুিসতই হোক, যত বর্বরই হোক, যত উদ্ভট হোক, দিনটি নিয়ে ব্যবসায়ীরা যত ব্যবসা করুক না কেন, দিনটির সঙ্গে ভালোবাসা জড়িয়ে আছে, ভালোবাসাটা জেফ্রি চশারের কারণেই জড়াক, জড়িয়েছে তো! মানুষ তো ইতিহাস জানে না, সে কারণেই দিনটিকে নিখাদ ভালোবাসার দিন হিসেবেই বিচার করছে। না হয় করুক। চারদিকে যখন ঘৃণা আর অবিশ্বাস, চারদিকে যখন স্বার্থপরতা আর হিংসে, চারদিকে যখন যুদ্ধ আর অশান্তি— তখন কোনও এক নামে কোনও এক দিবস যদি আসে, যে দিবস মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা-স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, এর চেয়ে সুখবর আর কী আছে পৃথিবীতে? মানুষ জন্মেই শিখে যাচ্ছে কী করে নিজের জন্য সব নিতে হয়, ছলে বলে কৌশলে মানুষ শুধু নিতে শিখে যায়, কিন্তু দিতে শেখে না, দিতে কেউ কাউকে শেখায় না, ভ্যালেন্টাইন নামের দিনটি এসে যদি শেখায়, ক্ষতি কী? ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিনই তো হিংসে বিদ্বেষ নিয়ে আছে, বছরের একটি দিনও যেন ভালোবাসা নিয়ে থাকে।