আমাদের সমাজ এখনও নারী আর পুরুষের ভাঙা-ভোঁতা সংজ্ঞা খাড়া করে। এও জোর গলায় বলে, যাদের শরীরে এক্স এক্স ক্রোমোজোম, তারা কেউ পুরুষ হতে পারে না, আর যাদের শরীরে এক্স ওয়াই, তারা কেউ নারী হতে পারে না! কেন হতে পারে না, শুনি? নিশ্চয়ই হতে পারে। কোনও ক্রোমোজোম আর কোনও জৈবলিঙ্গের ওপর মনোলিঙ্গ নির্ভর করে না। জেন্ডার বা মনোলিঙ্গ, সেক্স বা জৈবলিঙ্গের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেটে ছিঁড়ে মাড়িয়ে পুড়িয়ে আর যে লিঙ্গকেই দূর করা যাক, মনের লিঙ্গকে করা যায় না। জৈবলিঙ্গ থাকে শরীরে, মনোলিঙ্গের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আইডেন্টিটি, প্রেজেন্টেশন, সেল্ফ-এক্সপ্রেশন, ইন্টার-পার্সোনাল সম্পর্ক, সোশিয়ো-কালচারাল রোল।কোনও মেয়ে তার নিজের শরীরের দিকে তাকালেই যদি দেখে শরীরটা অন্য কারও, অচেনা, অদ্ভুত; শরীরটা পুরুষের, যে শরীরটা তার শরীর হলেও তার শরীর নয়, শরীরটাকে নিজের বলে ভাবতে তার অস্বস্তি হয়, কষ্ট হয়, এ শরীর তাকে শুধুই দুঃসহবাস দেয়, তবে কী করবে সে? গুমরে গুমরে একলা ঘরে কাঁদবে সারা জীবন? দরজা বন্ধ করে পুরুষের পোশাক খুলে নারীর পোশাক পরে চোরের মতো নিজেকে দেখবে আয়নায়, বছরের পর বছর? বন্ধ দরজাটা খুললেই বা সত্য উচ্চারণ করলেই লোকের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হবে তাকে! এ কার দোষ, তার? না, যারা বাস্তবকে মেনে নেয় না তাদের? এ তাদের দোষ, যারা প্রকৃতির এক রূপকে স্বীকার করে, আর এক রূপকে করে না; যারা মনে করে দুনিয়াতে অ-রূপান্তরকামীরাই সত্য, রূপান্তরকামীরা নয়, যারা মনে করে নারী ও পুরুষের যৌন আকর্ষণই ঠিক যৌন আকর্ষণ, বাকি সব যৌন আকর্ষণ ভুল, মিথ্যে।
তুমি ট্রান্স-নারী। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করেছ। তুমি সাজতে ভালবাসো, গয়না পরতে ভালবাসো, মেয়েদের পোশাক পরতে পছন্দ করো, পুরুষের সঙ্গে শুতে পছন্দ করো, কিন্তু শুধু সেই কারণগুলোর জন্যই যে তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করেছ তা নয়। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করেছ, কারণ তুমি মূলত নারী, তুমি তোমার মতো করে তোমার নারীত্বকে প্রকাশ করেছ। তোমার জেন্ডার নারীর, তোমার শরীরটা দেখতে আকাশ বাতাস হাতি ঘোড়া এক্স ওয়াই বা যা-কিছুই হোক না কেন, তুমি মনে প্রাণে, অন্তরে বিশ্বাসে নারী। যৌন সম্পর্কের জন্য পুরুষকে পছন্দ না করে, তুমি কোনও মেয়েকেও পছন্দ করতে পারতে। সম্ভবত তুমি মনে মনে ‘বিষমকামী নারী’ বলেই পুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করেছ। কিন্তু তোমার প্রেমিক পুরুষকে ‘বিষমকামিতা’-র সুখ দিতে নিজের লিঙ্গ বদলাওনি, লিঙ্গ বদলেছ কারণ তোমার ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছিল একটা পুরুষের শরীরকে বছরের পর বছর অকারণে বহন করতে, এ অনেকটা কাঁধে হিমালয় নিয়ে হাঁটার মতো। ভালুকের ছাল পরে প্রতিটা দিন যাপন করলে আমার ঠিক কেমন বোধ হবে, ভাবি। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী মানুষদের বোধ হয় ঠিক সে রকমই অসহ্য অস্বস্তি হয় আর ওই ওপরের আবরণটা খোলসটা ঝামেলাটা উপদ্রবটা খুলে ফেলতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। লিঙ্গ বদল সব ট্রান্সরা করে না। কেউ কেউ করে। করুক বা না করুক, করার অধিকার সবারই আছে। মানবাধিকার সবার জন্যই।
জীবন একটাই, এই একটা মাত্র জীবনকে যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার সবার। লিঙ্গ যারা অক্ষত রাখতে চায় রাখুক, যারা কেটে বাদ দিতে চায় দিক, যে লিঙ্গকে তাদের মন এবং মস্তিষ্ক নিজের লিঙ্গ বলে বিশ্বাস করে তাকে যদি শরীরে লাগাতে চায় লাগাক। নারীর শরীরটাকে পুরুষের শরীর করে ফেলা, অথবা পুরুষের শরীরকে নারীর করে ফেলা যদি সম্ভব হয়, তবে করবে না কেন? আমার শরীর নিয়ে আমি যা খুশি করব, এতে অন্যের আপত্তি হবে কেন? শরীরটা আমার না অন্যের?পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ অথবা পুরুষ ও নারী, এ নিয়েই যদি মানুষের দুনিয়াটা হত, তা হলে তা নিতান্তই বেরসিক, বিদঘুটে, বোরিং হত। ভাল যে দুনিয়াটা বিচিত্র। ভাল যে দুনিয়াতে দুটো লিঙ্গের বাইরেও তৃতীয় লিঙ্গ আছে। উভলিঙ্গের কথাই ধরি না কেন, পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ এক শরীরেই জড়াজড়ি করে থাকে। প্রকৃতি যদি সবাইকে নারী ও পুরুষ হিসেবে চাইত, তা হলে উভলিঙ্গ বলে কিছু থাকত না দুনিয়ায়।বিচিত্র সব কাম চার দিকে।
সমকাম, বিষমকাম, উভকাম, রূপান্তরকাম, বহুকাম, সর্বকাম, নিষ্কাম। কোনওটিই অপ্রাকৃতিক নয়। সব কামই, সব যৌন আচরণই যত কম সংখ্যক লোকই সে আচরণ করুক না কেন প্রাকৃতিক; যেহেতু প্রকৃতিতেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। বেশি সংখ্যক লোক যে আচরণটা করে, সেটাকেই ‘ন্যাচারাল’ বা ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরা হয়। তা ধরলেও ভিন্নতাকে আর বৈচিত্রকে স্বাভাবিক বলে না মানার কোনও যুক্তি নেই। সংখ্যালঘুরা প্রকৃতির বাইরের কোনও ঘটনা নয়।প্রকৃতির শত শত প্রজাতির মধ্যে আছে বিচিত্র যৌন প্রবৃত্তি। ভেড়া, শিম্পাঞ্জি, হাতি, জিরাফ, সিংহ, ডলফিন, পেঙ্গুইন, হাঁস ফাঁক পেলেই সমকামে মেতে ওঠে। মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়, ‘বনোবো’, যাদের ডিএনএ-র সঙ্গে আমাদের ডিএনএ-র মিল ৯৮%, ভীষণই উভকামী। প্রকৃতি শুধু ‘প্রজনন করো, প্রজাতি টেকাও’ মন্ত্র জপে না। প্রকৃতি আরও অনেক কিছুর হিসেব করে। বিবর্তনের তত্ত্ব দিয়ে বিচার করলেও সমকামীরা সমাজে অপ্রয়োজনীয় নয়।