সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
পতিতা প্রথা বন্ধ হোক
পতিতা প্রথা নির্মুল করার জন্য ফ্রান্সে চমৎকার একটা আইন পাস হয়ে গেল। মূল কথা হলো, শরীর বেচতে পারো তুমি, কিন্তু শরীর কিনতে পারো না। ধরা পড়লে পতিতার খদ্দেরকে পনেরোশ ইউরো জরিমানা দিতে হবে। পনেরোশ ইউরো বাংলাদেশের টাকায় এক লক্ষ আটান্ন হাজার আটশ তিপান্ন। পতিতাদের জন্য কোনো জরিমানা বা শাস্তির ব্যবস্থা নেই। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, দুঃখিতা, নির্যাতিতা মেয়েদের বাঁচাবার জন্য আসলে ‘শরীর বেচা অন্যায় নয়’,- পতিতাপ্রথা নির্মূল আইনে এই অংশটির অবতারণা। পতিতা প্রথা বন্ধ করার আইন অনেক দেশই করেছে, কিন্তু সুইডেনই প্রথম এই অভিনব আইনটি তৈরি করেছিল, ‘যৌন সম্পর্কের জন্য শরীর বিক্রি করা অন্যায় নয়, শরীর কেনা অন্যায়। কিন্তু এখানেই সবকিছুর শেষ নয়। পতিতাদের জন্য নতুন চাকরি বা ব্যবসার ব্যবস্থা করা দেওয়া তো আছেই, অন্যের যৌন পুতুল না হয়ে নিজের মান মর্যাদা নিয়ে নতুন জীবনযাপনে যাওয়ার পথও তাদের দেখিয়ে দেওয়া হয়। সুইডেনের আইনটি ইউরোপের অনেক দেশকেই প্রভাবিত করেছে এবং অনেক দেশই সুইডেনের এই আইনটি গ্রহণ করেছে। ফ্রান্সের প্রথম নারী-অধিকার মন্ত্রী নাজাত বেলকাসেম ফ্রান্সে এই পতিতাপ্রথা বিলুপ্তির আইনটি পাস করার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। পতিতাপ্রথা বিলুপ্তি নিয়ে সেদিন আমার একটা লেখা বের হয়েছে ‘লা মন্দ’ নামের ফরাসি পত্রিকায়। নাজাত খুব উচ্ছ্বসিত আমার লেখাটি নিয়ে। নাজাত কিন্তু জাতে ফরাসি নন, মরক্কোর মেয়ে, মুসলমান। কিন্তু ফ্রান্সেই লেখাপড়া করেছেন, বেড়ে উঠেছেন। তিরিশের কোঠায় বয়স, নারীবাদী, সংগ্রামী।
বাংলাদেশ থেকেও যেন অচিরে পতিতাপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। সমগ্র বিশ্ব থেকেই যেন নারীবিরোধী এই প্রথাটি নির্বংশ হয়। ব্যাপারটি সোজা নয়, পতিতাপ্রথা টিকিয়ে রাখার জন্য নানা মহল উদগ্রীব, এতে কিছু নারী সংগঠন যেমন আছে, স্বয়ং পতিতারাও আছে।
ক্রীতদাসপ্রথার সঙ্গে পতিতাপ্রথার মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ক্রীতদাসরা যখন তুলো ক্ষেতে চাষের কাজ করতো, দাসমালিকরা প্রায়ই সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু ক্রীতদাসীকে যৌনকর্মের জন্য তুলে নিয়ে যেতো। ত্বক যাদের একটু কম কালো, সাধারণত তাদেরকেই পছন্দ করতো। বাজারে নিয়ে যৌন ব্যবসার জন্য ভাড়া খাটাতো, নয়তো সরাসরি পতিতালয়েই তাদের নগদ টাকায় বিক্রি করে দিতো। আঠারো-উনিশ শতকে যে প্রথাটিকে বলা হতো ক্রীতদাসপ্রথা, বিংশ-একবিংশ শতকে সেই প্রথাকে বলা হচ্ছে পতিতা প্রথা।
উনিশ শতকে ক্রীতদাসপ্রথার বিলুপ্তির সময় মানুষের ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বিরাট বিতর্ক। ক্রীতদাসদের মুক্তির প্রশ্ন উঠলে সমাজের অনেক সাদা ভদ্রলোক মন্তব্য করেছিলো, ‘আফ্রিকার কালো মানুষগুলো আসলে ক্রীতদাস হিসেবেই ভালো আছে। স্বাধীনতা উপভোগ করার কোনো অধিকার বা যোগ্যতা তাদের নেই। সত্যি কথা বলতে কী, এই ক্রীতদাস-দাসীগুলোর সঙ্গে যত না মানুষের মিল, তারচেয়ে বেশি জন্তু-জানোয়ারের মিল।
শুধু সাদারা নয়, অনেক ক্রীতদাসীও এই প্রথার বিলুপ্তি চায়নি। বিশেষ করে সেই ক্রীতদাসীরা, যারা মালিকদের বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা দেখাশোনা, রান্নাবান্না আর ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ করতো। তাদের অবস্থা হাড়ভাঙা খাটুনি খাটা চাষের ক্ষেতের ক্রীতদাসীদের চেয়ে ভালো ছিলো। মালিকদের বাড়ির খাবার খেয়ে, যদিও উচ্ছিষ্ট, তৃপ্তই ছিলো বাড়ির ক্রীতদাসীরা। আসলে ক্রীতদাসীর জীবন ছাড়া অন্য কোনো জীবনের কথা তারা নিজেদের জন্য ঠিক কল্পনাও করতে পারতো না। বাড়ির ক্রীতদাসীরা না চাইলেও ক্ষেতের ক্রীতদাসীরা কিন্তু ক্রীতদাসপ্রথার বিলুপ্তি চেয়েছিলো।
আমরা আজ সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করছি। পতিতাপ্রথার পক্ষে সাধারণত যারা মুখর তারা নিজেরা কখনো পতিতা ছিলো না বা যৌন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলো না, পতিতালয়ের বা পতিতাপ্রথার নির্যাতন তাদের সইতে হয়নি। যৌন ব্যবসায় জড়িত এমন অনেক মেয়েও পতিতাপ্রথার পক্ষে বলছে। তারা বলছে, ‘অন্য যে কোনো শ্রমের মতো পতিতাবৃত্তিও শ্রম’। আগ বাড়িয়ে এও কেউ কেউ বলছে যে এই শ্রম নাকি সমাজে মেয়েদের ক্ষমতায়নে সাহায্য করছে।
কলগার্ল হিসেবে যারা কাজ করে, ম্যাডামের ভূমিকায় যারা, তাদের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে রাস্তার পতিতাদের চেয়ে ভিন্ন। তাই পতিতাদের উঁচু শ্রেণী, মাঝারি শ্রেণী, আর নিচু শ্রেণীতে ভাগ করার একটা প্রবণতা দেখা দেয়। এ কিন্তু অনেকটা সেই ক্রীতদাসীর শ্রেণীভাগের মতো। বাড়ির ক্রীতদাসীরা উঁচু শ্রেণীর ক্রীতদাসী, আর ক্ষেতে খাটা ক্রীতদাসীরা নিচু শ্রেণীর ক্রীতদাসী। তা ঠিক, তবে সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্য হলো, তারা সবাই ক্রীতদাসী। এক মালিকের অধীনেই তাদের দাসত্ব করতে হয়েছে। দাসত্ব চকচক করলেই দাসত্বের সংজ্ঞা পাল্টে যায় না। যে মেয়েরা আজ এই পতিতাপ্রথার ভেতরে থেকে এই প্রথার পক্ষে কথা বলছে, এই প্রথা থেকে তারা না বেরিয়ে এলে তাদের পক্ষেও বোঝা সম্ভব নয় প্রথাটি ঠিক কী। ‘বাড়ির ক্রীতদাসী’দেরও ক্রীতদাসপ্রথার বাইরে এসে বুঝতে হয়েছে ক্রীতদাসপ্রথাটা ঠিক কী ছিল। ক্রীতদাসপ্রথা আর পতিতাপ্রথার মূলে আছে খাঁটি দাসত্ব। শুধু পরিচয়টা দুই ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে হয়। পতিতাপ্রথার জন্য দরকার যৌন পরিচয়, ক্রীতদাসপ্রথার জন্য দরকার বর্ণ পরিচয়। এই দুই প্রথা ও প্রতিষ্ঠান একই প্রকৃতির। একই প্রক্রিয়ায় মানুষের ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালানো হয়। মানুষকে অসম্মানিত, অপমাণিত, নির্যাতিত ও নিগ্রীহিত করা হয়।