তসলিমাকে নিয়ে ভাবনা শেষ হয় না। এখনো কলম ধরলে তার কথা মনে পড়ে, কলাম লিখেছি যখন মনে পড়েছে তার কথা, ২০০৫-এ প্রথম ছোটগল্পের বই তাকেই উৎসর্গ করেছি, লিখেছি ‘মনের গুরু তনা’কে’।
কড়া কথা, সুগার কোটিং দিয়ে বলা শেখেনি মেয়ে, তাই তার এবেলা ওবেলা জাত গেল, উনিশ বছর দেশান্তরী, মাকে দেখতে পারেনি মরণকালে। আমার দেশ গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়, মাকে দেখার উসিলায় একাত্তরের পর জিয়ার আমলে গোলম আযম বাংলাদেশে এসে স্থান পেয়ে যায়, আর আমার খালেদা তাকে আদালত থেকে নাগরিকত্ব এনে দেন। আমার হাসিনা নির্বাচনের আগে গোলাম আযমের দোয়া নিতে যান, শুধু আমার তসলিমার এদেশে জায়গা হয় না।
আমাদের চুরচুর ধর্মানুভূতি। ধর্ষণ হলে আমাদের ধর্মবেত্তারা ফতোয়া দেন না, বালকের বলাৎকার হলে আমাদের ধর্মজীবীদের মাতম হয় না, এসিড মারা হলে আমরা সেই সন্ত্রাসীর ফাঁসি চাই না, ‘লজ্জা’ লিখিত হলে আমাদের লজ্জা লাগে, ‘লজ্জা’ যে কারণে লিখিত হয় তাতে আমাদের লজ্জা লাগে না। তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার, শুধু ধরা পড়া যাবে না_ এই হচ্ছে আমার দেশের নাগরিক সমাজের ঔচিত্যবোধ।
খুব মনে পড়ে তসলিমার সেই কথাটা “যুদ্ধের সকল ভাঙন, বুট ও বেয়নেটের নৃশংস অত্যাচার এবং মৃত্যুর মতো বীভৎসতা সবাই গ্রহণ করলেও ধর্ষণ দুর্ঘটনাটি গ্রহণ করেনি। বাইরে যখন মা-বোনের সম্মান নিয়ে চিৎকার করছে রাজনৈতিক নেতারা, তখন অসম্মান থেকে নিজেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হিসেবে ঘরের কড়িকাঠে আমার খালা যে মাসে ফাঁসি নিয়েছে সে মাস ডিসেম্বর মাস।” (নির্বাচিত কলম, তসলিমা নাসরিন, পৃষ্ঠা-২২)।
বীরাঙ্গনা শুধু মুখে মুখে, বীরাঙ্গনা নয় আসলে আমার দেশ বলতে চায় বারাঙ্গনা, বীর শব্দটি শুধুই আদমের গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ।
তসলিমা আজো আমার একার সম্পদ, আমি তাকে পাঠ করি সময়ে অসময়ে, মনে মনে কখনো মায়াবোধ করি, একজন নিঃসঙ্গ গ্রহচারীর জন্য, একজন দেশান্তরী মানুষের জন্য। লেখক হিসেবে তার সঙ্গে একাত্দতা বোধ করি, তার পক্ষে কথা বলে কটু কথা শুনি। এ শোনার কোনো শেষ নেই। আমাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি লাগে, আমরা অফিস আওয়ার শেষ হলেই বাসায় দৌড়াই, লেট সিটিং করতে চাই না_ এমন অভিযোগগুলো শুনে চুপ করে থাকি। আমরা নারীরা সমঅধিকার চাই, সমান সমান বেতন চাই কর্মস্থলে, নিজেদের পুরুষের সমকক্ষ মনে করি কিন্তু বাসে আমাদের জন্য আলাদা আসন লাগে, সংসদে আমাদের কোটা লাগে_ অভিযোগগুলো শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে সেদিন বলে ফেললাম, বাসে কেন আলাদা আসন লাগে বলেন তো!_ কোনো উত্তর নেই চুপ। আমি বললাম, কারণ আমাদের দেশের পুরুষরা জানে না নারী বা পুরুষ কোনো মানুষের শরীরেই নিজের শরীর ছোঁয়ানোর অধিকার কারও নেই অনুমতি ছাড়া। আমাদের পুং রা এখনো অশোভন আচরণের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি বলেই নারীদের জন্য এখনো অনেক কিছুই আলাদা রাখতে হয়, সে বাসের আসনই হোক আর সংসদের আসনই হোক। প্রতিউত্তরে শুনলাম আমি তসলিমা নাসরিনের মতো কথা বলছি। তারপরও পুরুষের মুখে, নারীর মুখে যখন মেয়ে তোমার নাম উচ্চারিত হয় বিরক্তিতে ক্রোধে অথবা গালি হিসেবে তখন আমি খুশি হই_ তুমি ফেলে দেওয়ার বিষয় নয়, তুমি এখনো মানুষকে ভাবাচ্ছ, তুমি থাকবে, ছিলে আছ, এ প্রমাণ এভাবে দৈনন্দিনতায় উঠে আসে আজো। তাকে দেশে ফিরতে বলতে মন চায়, মন চায় বলি অনেক আগুন হলো, এবার উপশমের কথা বল মেয়ে; তারপর ভাবি দেশে এলেইবা কি, না এলেইবা কি_ তোমার কলম যেন না থামে। তোমার কলম তোমাকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে, তোমাকে নিয়ে গবেষণা হবে এদেশেই একদিন আমি জানি নিশ্চয় করে। সত্যি তা কুৎসিত হোক বা সুন্দর সত্যকে সত্য হিসেবে বলার শক্তি তোমার আছে, তোমার শক্তি আছে নষ্ট কথা বলার অবলীলায়, তাই তুমি তসলিমা, এটাই তসলিমা, এ ই-ই তুমি আমাদের তসলিমা। আমাদের কৈশোরের আইডল, প্রাত্যহিকতার সঙ্গী।
তসলিমাকে মনে পড়ে ‘আমার মেয়েবেলা’তে দ্বিখণ্ডিত ক, ফরাসি প্রেমিক, শোধ, খালি খালি লাগে, উতাল হাওয়া সব পঠনে। অনেক নাম হয়েছে, অনেক খ্যাতি শুধু এদেশে তসলিমার কোনো স্থান নেই_ খুনি, যুদ্ধাপরাধী, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, নষ্ট রাজনীতিক সবার এদেশে থাকার অধিকার আছে। যে নারী প্রথা ভাঙবে এদেশ তার নয়, সরকার তার নয়, রাষ্ট্র তার নয়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র অনায়াসে তার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে যাবে, তথাকথিত নারী আন্দোলনের পুরোধারা একটি শব্দও উচ্চারণ করবে না।
আমাদের ১৫-২০ বছর বয়সী অনেকেই জানে না তসলিমা জমানার কথা, উত্তাল বইমেলার কথা, আমাদের লেখক সমাজের অনৈক্যের কথা। সব মনে পড়ে, আজ বিজন ঘরে তসলিমাকে খুব বেশি মনে পড়ে… মনে পড়তে পড়তে তসলিমার কবিতায় বিষণ্ন হই :
আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর নেত্রকোনা
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব। ফিরব ভীড় হট্টগোলে, খরায় বন্যায়
অপেক্ষা করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা, গোল্লাছুটের মাঠ
আমি ফিরব। পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে, ছিপ ফেলতে বাঁশবনের পুুকুরে_
অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন, খায়রুন্নেসা, অপেক্ষা করো ঈদুল আরা,
আমি ফিরব। ফিরব ভালোবাসতে, হাসতে জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে_
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারি বইমেলা
আমি ফিরব।
মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে কফোঁটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের,
যেন গোলপুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালের বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষ্যায়, বঙ্গোপসাগরে।
ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুণ্ড পাহাড়_ আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।
(আমি ভালো নেই তুমি ভালো থেক প্রিয় দেশ, তসলিমা নাসরিন, পৃ:-২৮৮)
আমি তোমার মানুষ হিসেবে ফেরার অপেক্ষা করি আজো…’।