বাসে প্রাপ্য অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে হায় আমি রুখেও দাঁড়ালাম। ‘একতাই বল’ এ নীতির প্রয়োগে আমরা বান্ধবীরা এ সব বিকৃত লোকজনকে হরহামেশাই জটিল মারা মেরেছি, এমনও হয়েছে বাসের সবাই একযোগে আমাদেরকে বলছে, অপরাধী লোকটাকে ছেড়ে দিতে, আমরা দিইনি। আমি জানলাম যে অপরাধ করেছে তাকে কাঁদতে হবে, অপরাধের শিকার আমার কান্নার কোনো কারণ ঘটেনি। তনা আমাদের মনোজগৎ এভাবে পাল্টে দিচ্ছিলেন নিজের লেখনী দিয়ে। ৯৪ এর বইমেলা, ৮-৯ জন বান্ধবী গিয়েছি, মাঝখান দিয়ে এক ফ্রেন্ড এর বুকে খামচি দিল চরম ভিড়ের মধ্যে একটি হাত, আমার বান্ধবী ধরে ফেলল সেই হাত, সেই লোক এবার আমার বান্ধবীর হাতে খামচাল ছাড়া পাওয়ার জন্য, আমরা ধরে ফেললাম, আমাদের ব্যাগ ভর্তি তসলিমার বই, মন ভরা তার দেওয়া সাহস, আমরা একমেলা মানুষের সামনে সেই লোককে গালে থাপ্পড় একের পর এক দিলাম, তারপর কান ধরে উঠ-বস করালাম। আমরা সবাই সেই সময় কাজেও তসলিমা হতে চাচ্ছিলাম। এভাবে গুডগার্ল ইমেজ একবারেই তিরোহিত হয়ে গেল, যা নিয়ে আজও আমি গর্বিত।
‘যায় যায় দিন’ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন তখন না পাক্ষিক?? স্মৃতি বলছে সাপ্তাহিক। হায় হায় কি সাংঘাতিক সব কলাম_ ‘মৌচাকে ঢিল’ নামক কলামে। ধ্যানের নিভৃতিতে, চরম হলাহলে আমরা একপাল কিশোরী ক্ষুরধার এক লিখনের মুখোমুখি। যে লিখন ল্যাটপেটে প্রেমের কথা বলছে না, বরং আমাদের প্রতিদিনের বঞ্চনাগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। মর্নিং শিফটে পড়া মেয়েরা নাকি ছেলেদের মতো জধম ডে যারা ডে শিফটে পড়ে করতে পারবে না। সবসময় আমাদের মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা নিয়ম। টিচারদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েরা ছেলেদের মতোই জধম ডে করলাম।
বাসায়, বাইরে সর্বত্র রক্তচক্ষু তার লেখা পড়া নাজায়েজ এ মর্মে। আরো পড়ছি, একজন কিনলে আরেকজনকে দিচ্ছি, টিফিনের ফাঁকে গোল হয়ে পড়ছি, বোরিং কোনো ক্লাসের মধ্যে মলাট দিয়ে পড়ছি, আমাদের বাসস্থান মীরপুরে এ লেখকের বই সহজলভ্য নয়, আমরা খোঁজ নিয়ে জানলাম নিউমার্কেট এবং বেইলি রোডে সব বই পাওয়া যায়। কী কষ্ট করে যে আমরা বেইলি রোড গেলাম সাগর পাবলিশার্সে, ‘তবুও বই পড়ুন’ দোকানে। পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম, সবাই আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখছে। আমরা ফিরলাম ‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’ নিয়ে।
‘লজ্জা’ বা ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা আমাদের কাছে মনে হতো না। তারচেয়ে আমরা গোগ্রাসে গিললাম ‘যাব না কেন যাব’, ‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’, ‘নির্বাচিত কলাম’, ‘বেহুলা একা ভাসিয়েছিলো ভেলা’, রুদ্রর বন্ধু রুদ্রর মতো না হলেও কবিতা ভালো লিখে আমরা একমত হলাম।
সারাদেশে আন্দোলনের জেরবার, সিলেটের কোনো এক হুজুর তসলিমাকে তওবা পড়তে বলেছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, তসলিমার ফাঁসি চাওয়া হচ্ছে। যে কোনোদিন কোনো লেখা তার পড়েনি সে-ও তসলিমাকে গালি দিচ্ছে। আমাদের সরকার ডুগডুগি বাজাচ্ছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আত্দতোষণে ব্যস্ত। একজন তসলিমাকে মুরতাদ ডাকলে কী হয়! একজন নষ্ট নারী দেশান্তরী হলে কী হয়! কিছু হয় না। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ করতাম। দিন যেতে যেতে বন্ধুরা তাকে ভুলে গেল। একজন তসলিমা গোটা দেশ অচল করে দিল, বহু বছর ধরে চলা সমাজ যেন থমকে দাঁড়াল একজন তসলিমার আশঙ্কায়। তসলিমা তখন আরও বেপরোয়া, তসলিমা তোমাদের আমি থোড়াই কেয়ার করি এ ভঙ্গি বোঝাতেই যেন টিভিতে সিগারেট পোড়ালেন। আমার মাথার ভেতর তিনি রয়ে গেলেন। সিগারেট হাতে তসলিমা, শার্ট পরা তসলিমা, ডোন্ট কেয়ার তসলিমা, কবিতার তসলিমা, দুঃখী তসলিমা, বেস্ট সেলার তসলিমা। নোংরা রাজনীতি আর মৌলবাদের হাতে হাত ধরে চলা সিম্ফনীর সরল শিকার তসলিমা আমার মস্তিষ্কের ধূসর কোষে রয়ে গেলেন। বন্ধুরা তাকে জীবনের অনেক ঘটে যাওয়া ঘটনার মতোই ভুলে গেল। আমি বইমেলা, বইয়ের দোকান, ইন্টারনেট সব খুঁজে আজো তাকে পাঠ করি। আউট অব দ্য বঙ্ কিছু করলেই আজো শুনি ‘তসলিমা নাসরিন’ হইছ! যারা আমাকে এ কথা বলে তাদের মুখের ওপর আমি মনে মনে হাসি এ ভেবে, তোমরা তো জান না এ আমার জন্য কত বড় কমপ্লিমেন্ট!
এমন এক দেশে তোমার জন্ম মেয়ে যেখানে বেগম রোকেয়াকে চাওয়া হয় না, চাওয়া হয় মানুষ নামক ছায়া, যারা কোনো কিছুতেই না বলবে না। তুমি ডাক্তার না লেখক, তুমি গুণী না নির্গুণ, তুমি ভাবুক না সংসারী এ সবের কোনো মূল্য এখানে নেই। তুমি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তুমি লেখক বা শিল্পী নও মহিলা কবি, নারী লেখক, লেডি ডাক্তার_ এখানে কমন জেন্ডার বলে কিছু নেই। স্বাধীনতার চলি্লশ বছর, আর অধীনতার শত বছর ধরে এখানে কোনো নারী আন্দোলন, মানুষের অধিকার আদায়ের অধিকার দানা বাঁধেনি। তুমি সেখানে কলম দিয়ে বিপ্লব চেয়েছ। আর কিছু সুবিধাবাদীর মুনাফা করার জন্য পণ্য করেছে নিজেকে নিজের অজান্তেই। তোমার ছবি দিয়ে বইয়ের মলাট দিয়ে এখনো ব্যবসা করছে এদেশের প্রকাশকরা। এখানে মনোবিজ্ঞানের নামে বই লিখে কাঁচা যৌনতা যখন কিশোর-কিশোরীর হাতে তুলে দেওয়া হয়, প্রকাশকরা তা বাজারজাত করেন, তখন কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলে না, কারণ সে পুরুষ লেখক, নারী কোনো যৌনতার কথা বললেই তা শ্লীল কি অশ্লীল_ বলা ঠিক হয়েছে কি-না তার জন্য পাল্লা মাপা শুরু হয়। এখানে চাঁদকে ফালি ফালি করে কাটার কথা বলতে গিয়ে বারবার সঙ্গমের কথা বললে সেই বইয়ের কাটতি হয়, সেই লেখক জাতে উঠেন, তারা নিষিদ্ধ হন না_ কারণ তারা একে তো পুরুষ লেখক, তার ওপর বুদ্ধিজীবীর তক্মা অাঁটা এবং আমাদের বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক আহ্লাদীপনা চালু রাখতে ভীষণ রকম সংঘবদ্ধ। এ নারী যেহেতু প্রচলিত সব ট্যাবু ভেঙে চুরমার করেছে তাকে সমর্থন দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না, এ নারীর লেখা কেউ ভালোবেসে পড়ছে, কেউ ঘৃণা থেকে পড়ছে, কেউ নিতান্ত কৌতূহলে পড়ছে, মেলায় তখন পুরুষ লেখকদের বই কোণঠাসা, তসলিমার বই উঠে এলো তিন নম্বর বেস্ট সেলার হিসেবে, একে আটকাও, আমাদের বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদসহ আরও অনেকে নিজেদের প্রথম পরিচয় লেখক ভুলে ভীষণ পুরুষ হয়ে উঠলেন_ তসলিমার সেই সংকটে তাকে রক্তাক্ত করতে আরও ভয়ঙ্কর সব কথা বলা শুরু করলেন পত্রিকায়। আমাদের তসলিমার বই বিক্রি তাতে কমল না, বরং আরও বাড়ল। দেশে দেশে আজো আমাদের তসলিমা পঠিত_ একজন ছফা কিংবা একজন আজাদ বিশ্বের অর্ধশত ভাষায় অনূদিতও হলো না, তাদের নামও শুধু ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে ছাপান্ন হাজার মানুষের ভেতরই সীমাবদ্ধ থাকল।