যে সমাজে শিক্ষিত, স্বনির্ভর, সচেতন মেয়ের সংখ্যা বেশি, সেই সমাজে বিচ্ছেদের সংখ্যাটা বেশি, বিয়ের সংখ্যাটা কম।
ভারতীয় উপমহাদেশে অবশ্য উপার্জনহীন পরনির্ভর মেয়েদের মতো পুরুষতন্ত্রের মন্ত্র মেনে চলা স্বনির্ভর শিক্ষিত মেয়েরাও অত্যাচারী বা বহুগামী স্বামীর সঙ্গে সংসার করছে মুখ বুজে। এধরণের সমাজে, বিয়েটা নিতান্তই পুরুষের ক্ষেত্রে অর্জন, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিসর্জন। বিয়ে কাউকে একাকীত্ব থেকে মুক্তি দেয়, কারও পায়ে পরায় নির্মম শেকল। এখনও সমাজে দেদার বর্বরতা চলে, চলে জাত বর্ণের হিসেব, পণের হিসেব, স্ত্রীকে নিতান্তই যৌনসামগ্রী, ক্রীতদাসী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা, সন্তান বিশেষ করে পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়ার চাপ, কন্যাভ্রুণকে জন্মাতে না দেওয়া, জন্মালেও পুঁতে ফেলা, পুত্র না জন্মালে তালাক, পুনর্বিবাহ।
নিয়ম মেনে চলার লোক যেমন প্রচুর আছে, নিয়ম ভাঙার লোকও কিন্তু আছে। মানুষ যত সভ্য হচ্ছে, বিয়ের পুরোনো নিয়মগুলো তত ভেঙে পড়ছে। সমাজ বদলায় হাতে গোনা কিছু লোক। সমাজের সব লোক দল বেঁধে সমাজ বদলায় না। বেশির ভাগ লোক বরং দল বেঁধে প্রাচীন নীতি রীতি শক্ত করে আকঁড়ে রাখে। বিয়ের পর মেয়েদের চাকরি বাকরি ব্যাবসা বাণিজ্য চলবে না, স্বামীর আদেশ নিষেধ অমান্য করা চলবে না, বিধবা বিবাহ চলবে না– এই নিয়মগুলো প্রাচ্যের কিছু সাহসী মেয়ে এখন আর মানে না।
বিয়ের বিবর্তন ঘটেছে। বিয়ের উদ্দেশ্য পাল্টেছে, ধরণ পাল্টেছে। পাশ্চাত্যে, যেখানে মেয়েদের স্বাধীনতা আর অধিকারের সংগ্রাম দীর্ঘকাল চলেছে, এবং শেষ পর্যন্ত মেয়েরা অনেকটাই সমানাধিকার ভোগ করছে, সেখানে বিয়েটা এখন আর সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের নিশ্চয়তার জন্য নয়, মেয়েদের দিয়ে সংসার আর সন্তান দেখাশোনার কাজ কৌশলে করিয়ে নেওয়া নয়। সন্তান না জন্মালেও ক্ষতি নেই। সম্পর্ক আর সংসার সুখময় করার জন্য যে জিনিসের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা বিয়ে নয়, তা হলো, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ। এ দুটো থাকলেই মানুষ পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। বিয়ে যদি বিশ্বস্ত রাখতে পারতো, তাহলে এত পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে উঠতো না।
বিয়ে না করে যারা সংসার করছে তাদের মধ্যেও পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ব থাকার একই অলিখিত শর্ত থাকে।
সব দম্পতিই যে একগামিতা বা বিশ্বস্ততা চায়, তা নয়। কিছু স্বামী-স্ত্রী পরষ্পরকে ভালোবেসেও একঘেয়েমি দূর করতে ভিন্ন নারী ও পুরুষকে নিজেদের যৌনসঙ্গমে সঙ্গী হতে আমণ্ত্রণ জানায়। কোনও লুকোচুরি নেই, নিজেদের শোবার ঘরে, নিজেদের বিছানায়, দুজনের সঙ্গে যোগ হয় এক দুই তিন বা চার বা তারও চেয়ে বেশি। এই দলবদ্ধ যৌনতা দাম্পত্যজীবনে বৈচিত্র আনে, সম্পর্ককে তাজা রাখে। কিছু দার্শনিক গুচ্ছ-বিয়েকে বেশ জোরেসোরে সমর্থন করেছেন। বিয়ের বিচ্ছেদ না ঘটিয়ে সন্তানের সুবিধের কথা ভেবে গুচ্ছ-বিয়েই নাকি মেনে নেওয়াই নাকি বুদ্ধিমানের কাজ। গুচ্ছ-বিয়েটা অনেকগুলো নারী পুরুষেরা সমাহার, যারা সকলেই সকলের স্ত্রী বা স্বামী। গুচ্ছপ্রেম বা ‘পলিয়ামোরি’ বলেও একধরণের সম্পর্ক আছে। একাধিক নারী পুরুষ, প্রত্যেকে পরস্পরেরর প্রেমিক বা প্রেমিকা। বহুবিবাহ তো দীর্ঘকাল প্রচলিত ছিলই, এক স্বামীর বহু স্ত্রী। আবার আরেক ধরনেরও বহুবিবাহও কিছু কিছু সমাজে চলে, এক স্ত্রীর বহু স্বামী। দুনিয়াতে সবকিছুরই চর্চা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে এক-স্বামী-এক-স্ত্রীর বিয়েই এখন পর্যন্ত রাজত্ব করছে। ছড়ি ঘোরানোটা এই সম্পর্কে বড় সুবিধে বটে।
বিয়েটা মূলত যৌন সঙ্গমের লাইসেন্স। এই লাইসেন্সটাই ঢাক ঢোল পিটিয়ে নেওয়া হয়। নিতান্তই প্রাচীন, পিতৃতান্ত্রিক, অযৌক্তিক একটি প্রথা। এই প্রথাটির জীবিত থাকার কোনও কারণ নেই। অনেক প্রথাই মরে গেছে বা যাচ্ছে, যেমন সতীদাহ, যেমন ডাইনি-হত্যা, যেমন অগুনতি বিয়ে, আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে। অর্থহীন অনেক প্রথাই ভয় দেখিয়ে, বোধবুদ্ধির লোপ পাইয়ে দিয়ে চালু রাখা হচ্ছে বটে, তবে বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথার ব্যবহার না হতে থাকলে, প্রথা ধীরে ধীরে মরে যেতে বাধ্য। যেহেতু শতাব্দী ধরে প্রমাণ হচ্ছে বিয়ে কোনও নির্ণায়ক বিষয় নয় সম্পর্ক টেকানোর, তাই এটিরও ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল নয়। বিবর্তন আমাদের পূর্ব-পুরুষের লেজ খসিয়েছে প্রয়োজন নেই বলে। বিবর্তন আমাদের সমাজ থেকে বিয়ে নামক একটি অপ্রয়োজনীয় সংস্কার দূর করবে না, এ কোনও কথা? এককালের দার্শনিক নিৎসে, কান্ট, হেগেল প্রবল নারীবিরোধী ছিলেন। দর্শনেরও বিবর্তন ঘটেছে, নারীর প্রতি অমন তীব্র ঘৃণা নিয়ে আজকাল দার্শনিক বনার কোনও উপায় নেই।
নারীর প্রতি ঘৃণার কারণে জন্ম নিয়েছে পুরুষতন্ত্র। পুরুষতন্ত্র জন্ম দিয়েছে অনেক নারীবিরোধী প্রথা, এর মধ্যে বিয়ে একটি। পুরুষতন্ত্র যত পরাজিত হবে, যত পর্যুদস্ত হবে, নারী যত তার স্বাধীনতা ফিরে পাবে, যত সে আত্মবিশ্বাসী হবে, যত সে নারীবিরোধী ধর্ম আর সংস্কারকে সমাজ থেকে ঠেলে সরাতে পারবে, বর্বরতাকে যত দূর করতে পারবে সমাজ, যত সভ্য হবে সমাজ, যত সভ্য হবে পুরুষ, পুরুষতান্ত্রিক প্রথার গায়েও তত মরচে ধরবে। আমরা এর মধ্যেই দেখছি সভ্য সমাজে বিয়ে কমে যাচ্ছে। অসভ্য-অশিক্ষিত-সমাজে বিয়ে প্রথা চলছে। কিন্তু একটি সমাজ তো চিরকাল অসভ্য আর অশিক্ষিত থেকে যায় না! সমাজও বিবর্তিত হয়। সমাজ সভ্য হয়েছে কখন বুঝবো? যখন দেখবো নারী আর ধর্ষিতা হচ্ছে না, নির্যাতিতা হচ্ছে না, পুরুষের দাসী বা ক্রীতদাসী বা যৌনদাসী কোনওটাই নয় নারী, তুমুল প্রেমে পড়ে একত্রবাস করছে কিন্তু বিয়ে নৈব নৈব চ, অথবা বিয়ে নামক জিনিসটিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তখন।