সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯ জানুয়ারি, ২০১৪
নারীর যৌন কামনা থাকতে নেই
নারী শরীর নিয়ে এতকাল পুরুষেরা লিখেছেন, একেছেন, গড়েছেন তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে। নারীর অধিকার ছিল না নারীর শরীর নিয়ে লেখার। মন নিয়ে লিখতে পারে, কিন্তু শরীর নিয়ে নয়। কিন্তু নারী-লেখক-কবিরা এখন পুরুষের তৈরি করা গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। তারা তাদের শরীর নিয়ে তাদের মতো করে লিখেছেন। নারী শরীর যে পুরুষের সম্পত্তি নয়, অথবা পুরুষ-লেখক-কবিরা যদি অনুধাবন করতে পারেন, তবে সাহিত্য জগতে খুব বড় একটি পরিবর্তন দেখা দেবে।
বাঙালি সমাজ কুৎসিত পুরুষতন্ত্র দ্বারা এখনও আক্রান্ত, কিন্তু বাংলা সাহিত্য পুরুষতান্ত্রিক নিয়মনীতিগুলো ভাঙ্গার চেষ্টা সামান্য হলেও চলছে, সম্ভবত বাঙালি নারী-লেখক-কবিদের অনেকেই সুশিক্ষিত এবং স্বনির্ভর এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন বলেই। কিন্তু সমাজে এখনও নারী অসহায়, এখনও নারী পণ্য, ভোগ্যপণ্য, যৌনসামগ্রী হিসেবেই চিহ্নিত। নারী সর্বচ্চ বিদ্যাপিঠে পড়ছে, কিন্তু সত্যিকার শিক্ষিত হচ্ছে না। নারী উপার্জন করেছে, কিন্তু পুরুষের ওপর নির্ভরশীলই থেকে যাচ্ছে। বেশির ভাগ নারীই পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক। বেশির ভাগ নারীই জানেনা যে তারা নির্যাতিত। বেশিরভাগ নারীই ভয় পায় বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেতে। নারীর জন্য এই অসহায় অবস্থাটি সৃষ্টি করেছে এই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা। নারী এই সমাজে পুরুষের দাসী। খালি চোখে দাসীকে দাসী বলে মনে হয় না যদিও সম্পর্কের গভীরে গেলেই বোঝা যায় যে দাসী। নারী যখন প্রেমিকা। সে দাসী, নারী যখন স্ত্রী, তখনও সে দাসী। উন্নতমানের দাসী। পুরুষ প্রেমিক বা স্বামীর আদেশ নির্দেশ মেনে চলতে হয় তাকে। পুরুষ যেভাবে চায়, নারীর সেভাবে নিজেকে গড়তে হয়। সাজসজ্জা, আচার ব্যাবহার, দোষগুণ সবকিছু ধারনাই পুরুষের তৈরি করা। প্রেম ভালবাসা পুরুষের জন্য তরবারি, নারীকে দুর্বল করার। প্রভু এবং দাসীতে প্রেম হয় না। পন্যের সঙ্গে আর যাইহোক, প্রেম হতে পারে না।
নারী নিজের যৌনইচ্ছের কথা প্রকাশ করলে তাকে ছিঃ ছিঃ করে সমাজের সকলে। নারীর যৌন কামনা থাকতে নেই, থাকলে সে নির্লজ্জ, সে নষ্ট, সে বেশ্যা। নারী তার শরীর সাজাবে পুরুষের জন্য, নিজের জন্য নয়। নারী বেঁচে থাকবে পুরুষের জন্য নয়। এরকমই তো নিয়ম। ক’জন নারী জানে সঙ্গমে শীর্ষসুখ বলে একটি ব্যাপার আছে! খুব কম নারীই জানে! বেশির ভাগই মনে করে যৌনতা পুরুষের জিনিস। শরীর নারীর, কিন্তু এতে অধিকার পুরুষের। নারী এক হাত থেকে আরেক হাতে সমর্পিত হয় সারাজীবনই! তার মালিক বদলায়। পিতা থেকে প্রেমিক, প্রেমিক থেকে স্বামীতে, স্বামী থেকে পুত্রতে। নারীর জীবন তো নারীর নয়। বিভিন্ন সম্পর্কের পুরুষের কাছে নারী বাঁধা, শৃঙ্খলিত। এই যখন অবস্থা আমাদের সমাজের, তখন নারী-লেখক-কবিরা যখন শরীরের ওপর নিজের অধিকারের কথা লেখেন, স্বাধীনতার কথা লেখেন, তা হয়ত সমাজের সত্তিকারের রুপকে তুলে ধরে না, কিন্তু এক ধরনের বিপ্লব, সেটি ছোটখাটো হলেও, কাগজে কলমে হলেও, ঘটায়।
সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ আগস্ট, ২০১৩
পুরুষ নিয়ে মেয়েদের কাড়াকাড়ি বাড়াবাড়ি
মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে এক চলচ্চিত্র প্রযোজক আমাকে চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লিখতে অনুরোধ করেছিলেন এবং বেশ করে বলে দিয়েছিলেন, গল্পটা যেন খুব জুসি হয়, যেন পুরোটা গল্পজুড়ে থাকে হিরোকে পাওয়ার জন্য দুটো মেয়ের মধ্যে কাড়াকাড়ি মারামারি কামড়াকামড়ি। প্রযোজকের আমন্ত্রণ আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, মুখের ওপর বলে দিয়েছিলাম, ‘এ ধরনের বিচ্ছিরি গল্প আমার দ্বারা সম্ভব নয় লেখা। আপনি অন্য লেখক দেখুন’।
আমি পছন্দ না করলেও এ ধরনের বিচ্ছিরি গল্প বাস্তবে অহরহই ঘটে। পুরুষ প্রেম করে বা ফষ্টিনষ্টি করে একাধিক মেয়ের সঙ্গে, আর পুরুষকে দোষ না দিয়ে মেয়েরা একে অপরকে দোষারূপ করে। শুধু দোষারূপই নয়, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-লড়াই এমন পর্যায়ে ওঠে যে খুনোখুনি পর্যন্ত ঘটে, আত্দহত্যা তো আছেই। আর পুরুষ, ধোয়া তুলসী পাতা, দূরে দাঁড়িয়ে মজা লোটে। এই সেদিন ভারতের বিশাল মঞ্চেই ঘটে গেল এরকম ঘটনা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদর্শন শশী থারুর পাকিস্তানি সাংবাদিক মেহর তারারের সঙ্গে প্রেম করেছেন লুকিয়ে, এর প্রমাণ পেয়ে তার স্ত্রী সুনন্দা পুশকার স্বামী শশীকে দোষ না দিয়ে দোষ দিলেন মেহর তারারকে। উত্তেজিত, ক্রোধান্বিত সুনন্দা মেহর তারারকে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী দলের দূত বলেও ঘোষণা করেছেন। মেহর তারারও সুনন্দা পুশকারকে কটাক্ষ করেছেন। শুধু মুখটি খোলেননি শশী থারুর। পুরুষেরা চুপ থাকে। মেয়েরা চুলোচুলি চালিয়ে যায়। আর এরকম ঘটনায় যদি প্রাণ যায় কারুর, সে মেয়েদের। পরকীয়া করলেন শশী থারুর, মৃত্যু হলো তার স্ত্রীর।
আত্দহত্যা নাকি হত্যা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে এসব ঘটনায় দুঃখ হলো, দোষী বা অভিযুক্ত নয়, রীতিমত নির্দোষ ব্যক্তিকে প্রাণ হারাতে হয়। এসব ঘটনা আসলে কোনও বয়স মানে না। ষোল বছরের নবীনা যা করে, ষাটের প্রবীণাও তাই করে। এমনিতে হিংসে দ্বেষ ঘৃণা মেয়েদের তুলনায় পুরুষের মধ্যে অনেক বেশি, কিন্তু পুরুষের পরকীয়ায় বা দ্বিচারিতায় প্রকাশ হয় মেয়েদের হিংসেমি। তাও আবার অনর্থক আরেক মেয়ের বিরুদ্ধে। পুরুষের এক শিকার আরেক শিকারের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লাগে, আর শিকারী পুরুষ, আগেই বলেছি, বসে বসে উপভোগ করে গোটা ঘটনা। জনগণ হাসাহাসি করে মেয়েদের নিয়ে, ছি ছি করে মেয়েদের, লেখকরা গল্প উপন্যাস লিখে ফেলে মেয়েদের অতি আবেগ, অতি নির্বুদ্ধিতা আর অতি কুট-কচাল নিয়ে। মেয়েরা হয়ে ওঠে কৌতুকের বস্তু। একে যৌনবস্তু, তার ওপর কৌতুকের বস্তু। সমাজে মেয়েদের স্থান নিচে নামতে নামতে তলায় গিয়ে ঠেকেছে। এ থেকে কে তাদের উদ্ধার করবে কে জানে। নিজেদের বোধোদয় না ঘটলে অবশ্য উদ্ধার করা দুরূহ।