আমার লড়াই সত্যের জন্য, সাম্যের জন্য, সুন্দরের জন্য। এই লড়াই করতে গেলে স্বেচ্ছাচারী আমাকে হতেই হবে। না হয়ে এই লড়াই করা যায় না। ব্যক্তিগত জীবনেও মাথা উঁচু করে থাকতে চাইলে স্বেচ্ছাচারী হতে হবে। অন্যের ইচ্ছেয় যদি চলি, তবে তো আমি পরনির্ভর। অন্যের দেওয়া বুদ্ধিতে, চিন্তায় যদি চলি, তবে মানসিকভাবে আমি নিশ্চয়ই পঙ্গু। অন্যের দেওয়া করুণায় আমার যদি জীবন যাপন করতে হয়, তবে আমি আর যাই হোক, স্বনির্ভর নই। স্বেচ্ছাচারের আনন্দ সেখানে নেই। মুক্ত চিন্তা নেই, মুক্তবুদ্ধি নেই, কেবলই যন্ত্রের মতো চালিত হবো। ভাবলে আমার শ্বাসকষ্ট হয়। এরকম দুঃসহ জীবন থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।
পুরুষেরা চিরকালই স্বেচ্ছাচার করে আসছে। সমাজটা তাদেরই অধীনে। স্বেচ্ছাচার দরকার নারীর। নারীর ইচ্ছের ঘরে নারীকে যে তালা দিতে হয়, তালা দিয়ে এই সমাজে তথাকথিত ভালো মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে, বুদ্ধি-আছে মেয়ে, ভদ্র মেয়ে, নম্র মেয়ে সাজতে হয়- সেই তালার চাবি নারী এখন তার অাঁচল থেকে বার করুক। তালা খুলে নিজের ইচ্ছেগুলোকে পাখির মতো উড়িয়ে দিক আকাশ জুড়ে। নারী স্বেচ্ছাচারী হোক সর্বত্র। না হলে তারা বুঝবে না স্বাধীনতা মানে কী, না হলে তারা দেখবে না জীবনের সৌন্দর্য।
স্বাধীনতা মানে কী, জানি আমি। স্বাধীনতার প্রয়োজন আমি অনুভব করি প্রতিটি মুহূর্তে। আমি একা থাকি, কী দোকা থাকি, কী হাজার মানুষের ভিড়ে থাকি, আমার স্বাধীনতা আমি কাউকে দান করি না বা কোথাও হারিয়ে ফেলি না। স্বাধীনতা এবং অধিকারের কথা লিখি আমি, যা লিখি তা বিশ্বাস করি, যা বিশ্বাস করি, তা যাপন করি। মানসিকভাবে আমি সবল, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর এবং নৈতিকভাবে স্বাধীন মানুষ। এটা পুরুষের সয় না। পুরুষেরা নারীর এত ক্ষমতা পছন্দ করে না। তারা নারীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে, পায়ের তলায় নিয়ে পিষতে চায়। পিষতে না দিলে নারী ভালো নয়। পিষতে না দিলে নারী মন্দ। পিষতে না দিলে নারী স্বেচ্ছাচারী। অনেকে মনে করে স্বেচ্ছাচারী মানে বুঝি যে কোনও পুরুষের সঙ্গে যখন তখন শুয়ে পড়া, যৌন সম্পর্ক করা, স্বেচ্ছাচার মানে একেবারেই তা নয়। পুরুষের সঙ্গে না শোয়াটাকে আমি স্বেচ্ছাচার বলে মনে করি। পুরুষের সঙ্গে নারী যেন শোয়, পুরুষ ডাকলেই নারী যেন যেখানেই থাকুক, দৌড়ে চলে যায় তার কাছে, সাধারণত এ রকমই নিয়ম। নারী যদি তার ইচ্ছে না হলে না শোয়, সেই নারী নিশ্চয়ই তবে স্বেচ্ছাচারী। এই স্বেচ্ছাচারী নারীকে পুরুষেরা পছন্দ করবে কেন! পুরুষের সুখভোগের জন্য, পুরুষের দেহের মনের তৃপ্তির জন্য, তার বিকৃতি, তার বিলাস মেটাতে নিজেকে যে নারী বিলিয়ে না দেয়, তাকে শুধু স্বেচ্ছাচারী বলে নয়, বেশ্যা বলেও অপমান করার জন্য পুরুষ প্রস্তুত।
আমার যা ইচ্ছে হয় আমি তাই করি। কারও ধ্বংস ঘটিয়ে করি না কিছু। স্বেচ্ছাচারী বলে জীবনের অর্থ এবং মূল্য দুটোই আমি ভালো অনুধাবন করতে পারি। স্বেচ্ছাচারী না হলে, অন্যের ইচ্ছের যূপকাষ্ঠে বলি হলে, আমার বোঝার সাধ্য ছিল না আমি কে, আমি কেন। মানুষ যদি নিজেকেই চিনতে না পারলো, চিনবে তবে কাকে! আজ যদি স্বেচ্ছাচারী না হতাম আমি, হয়তো এই লেখাটি, যে লেখাটি লিখছি, তার একটি বাক্যও আমি লিখতে পারতাম না।
সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ মার্চ, ২০১৪
দেশ আর দেশ নেই
বাংলাদেশে আমি নেই আজ কুড়ি বছর। এই কুড়ি বছরে দেশটা অনেক পাল্টে গেছে। বিটিভি নামে একটাই টিভি চ্যানেল ছিল, এখন শুনি প্রচুর চ্যানেল। কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ তখন ছিল না, এখন শুনি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে ওসব। ট্যাক্স বলতে কিছু ছিল না রাস্তায়। তিন চাকার ‘বেবি ট্যাক্সি ছিল। এখন নাকি প্রচুর ট্যাক্সি ভিড়ও বেশি রাস্তায়। সবকিছু বেড়েছে। টাকা পয়সা, জনসংখ্যা, অজ্ঞতা, মূর্খতা, সহিংসতা, সংঘর্ষ, ধন, দৌলত, চাকরি, ব্যবসা, দারিদ্র, দরিদ্র, দুঃশাসন, দুর্নীতি, হরতাল, ধর্মঘট, নাস্তিকতা, ধর্মান্ধতা, হিজাব, ধর্ষণ- সব। বেড়েছে হত্যাকাণ্ড।
নির্বাচন হল বাংলাদেশে। নির্বাচন যেভাবে হওয়ার সেভাবেই হয়েছে, অথবা নির্বাচনের নামে এ প্রহসন ছাড়া কিছু নয়, দু’রকম কথাই শুনছি। প্রতিদিন এক দলের লোক আরেক দলের লোককে হত্যা করছে। ক্ষমতার লোভ রাজনীতিকদের উন্মাদ করে তুলেছে। খালেদা জিয়ার দলের সঙ্গে জামায়াতি সন্ত্রাসীদের আঁতাত অনেককালের। জামায়াতিরা অবাধে খুন-খারাবি করছে, দেশকে আস্ত একটা তালেবানি আফগানিস্তান বানানোর জন্য যা যা করার সবই করছে, এসব জেনেও খালেদা জিয়ার কোনও দ্বিধা নেই জামায়াতের সঙ্গে শুতে বসতে। শেখ হাসিনার দু’নৌকোয় পা দেওয়ার অভ্যেসও নতুন নয়। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি চেয়ে যারা শাহবাগে আন্দোলন করেছিলেন, তাদের পক্ষে ছিলেন আবার হেফাজতে ইসলাম নামের এক মৌলবাদী সংগঠনের দাবিতে শাহবাগের নেতাদের বিরুদ্ধেও গিয়েছিলেন, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিয়েছিলেন, নাস্তিকদের ধরে ধরে জেলেও ভরেছিলেন। পরে এই হেফাজত হাসিনাকে না মানতে চাইলে এই হেফাজতকেও এক হাত নিয়েছেন। আবার শাহবাগের আন্দোলনকারীদের সমর্থন ফিরে পেতে ফাঁসি দিয়েছেন কাদের মোল্লাকে। দেশের ভালোর জন্য নয়, এই দুই নেত্রী প্রথম থেকে শেষ অবধি এ পর্যন্ত যা করেছেন, তা নিজের ভালোর জন্য, এতে সাধারণ জনগণের ভালো কিছু হয়নি। গদির জন্য পুরুষ রাজনীতিকের যত লোভ, তার চেয়ে কিছু কম লোভ নয় হাসিনার এবং খালেদার। ক্ষমতার জন্য দেশকে বধ্যভূমি বানাতে, দেশের সম্পদের সর্বনাশ করতে, মানুষের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে, মানুষের গলা কাটতে তাদের কোনও আপত্তি নেই।