বড়বেলায় উৎস নিয়ে ভেবেছি। ধর্ম যদি উৎস হয়, বর্বরতা যদি উৎস হয়, তবে সেই উৎসের উৎসব আমি সানন্দে বর্জন করব। তাই করি। তাই বলে আমি কিন্তু মন্দির মসজিদ গির্জা ভেঙে দিয়ে হিংসে ছড়াতে বলছি না। পৃথিবীর পথে চলতে ফিরতে আমি অনেক গির্জা অনেক মসজিদ অনেক মন্দির মুগ্ধ নয়নে দেখেছি, দেখেছি স্থাপত্যশিল্পের অকল্পনীয় সৌন্দর্য। ভগবান আল্লাহ বা ঈশ্বরকে নয়, বাহবা দিয়েছি সেই সব প্রতিভাবান শিল্পীদের, যাঁদের কলা-কল্পনা এ সব নির্মাণ করেছে।
এখন বিদেশ বিভুঁইয়ের নির্বাসিত জীবনে কখন পুজো আসে পুজো যায়, ঈদ আসে ঈদ যায় তার কিছুই জানা হয় না আমার। ঈদ চলে গেলে, পুজো চলে গেলে শুনি যে, চলে গেছে। ঈদ-পুজোর প্রয়োজন জীবনে নেই, তার পরও নির্বাসনের মৃত্যুময় নিঃস্তব্ধতা আমায় আকুল বসিয়ে রাখে এক বার শুধু স্পর্শ করার জন্য বালিকাবেলার সেই সব উৎসবের সেই সব কোলাহল, আলোয় ঝলমল পাড়া, হাসিখুশির ঘরবাড়ি, একশো রকম গানের শব্দ, উত্তাল চার দিক। আমার নাস্তিকতা আমাকে কেবল এক তাল যুক্তির মধ্যে বন্দি করে রাখে না। আমি ভালবাসি। আমি কাঁদি। অর্থহীন অযৌক্তিক জিনিস নিয়ে মাঝেমাঝেই মেতে উঠি। অমল আনন্দে ডুবে ভেসে পার করি অনন্ত বেলা। যুক্তিবাদের সুঠাম শরীরে পরিয়ে দিই আবেগের অলোল অলঙ্কার। তার পরও চাই মানুষের বোধ হোক, বুদ্ধি হোক, ধড়িবাজের ধর্ম থেকে, কুৎসিত কুসংস্কার থেকে মানুষ বাঁচুক। হিংসে থেকে, বিদ্বেষ থেকে, বর্বরতা থেকে বাঁচুক। মানুষ বেঁচে আছে, সুখে আছে, এই বিশাল বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের এক কোণে একটি বিন্দুতে হলেও মানুষ-প্রজাতি তার অস্তিত্ব দীর্ঘ দীর্ঘ কাল টিকিয়ে রেখেছে— এই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি সুন্দরের। স্বপ্ন দেখে যাই। আমার তো স্বপ্নই সম্পদ।
সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ১৭ আশ্বিন ১৪১১ রবিবার ৩ অক্টোবর ২০০৪
আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
আকাশ ভাঙা বৃষ্টি আর বজ্রপাত। এর মধ্যেই সেদিন বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে।
কী, বৃষ্টিতে ভিজবো।
কেন ভিজবে?
ইচ্ছে করেছে।
ইচ্ছে?
হ্যাঁ ইচ্ছে।
লোকে কী ভাববে বলো!
কী ভাববে? ভাববে মাথা খারাপ। ভাবুক।
বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে তো!
কী অসুখ? সর্দি জ্বর। করুক।
এই বয়সে এসব মানায় না।
কোন বয়সে এসব মানায়?
ষোলো সতেরো বছর বয়স হলে ঠিক হতো। অনেকের চোখে তাও ঠিক নয়।
কে বানিয়েছে কোন বয়সে কী করা উচিত কী উচিত নয়, তার লিস্ট?
সোসাইটি।
সোসাইটির জন্য আমরা, নাকি আমাদের জন্য সোসাইটি?
মানুষই নিয়ম তৈরি করে। মানুষই নিয়ম ভাঙে। কোনও নিয়মই দীর্ঘকাল বিরাজ করে না।
আমাদের কথোপকথন এরপর আরও অনেক এগিয়ে শেষে স্বেচ্ছাচারে গিয়ে থেমেছে। স্বেচ্ছাচার শব্দের অর্থ যদি নিজের খেয়ালখুশিতে করা কাজ (সংসদ বাংলা অভিধান) হয় তবে অবশ্যই আমি স্বেচ্ছাচারী। একশ ভাগ। এ আমার জীবন। আমি সিদ্ধান্ত নেব আমার জীবনে আমি কী করবো না করবো। অন্যে কেন নেবে? জীবন যার যার তার তার। নিজের জীবনে কার কী করার ইচ্ছে, তা মানুষের নিজেরই জানা উচিত। যার এখনও নিজস্ব ইচ্ছে গড়ে ওঠেনি, তাকে আমি প্রাপ্তবয়স্ক বলি না। যে এখনও নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী চলে না বা চলতে ভয় পায়, তাকে আমি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষও মনে করি না।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কারও যদি ইচ্ছে করে কাউকে খুন করতে, তবে? কারও যদি ইচ্ছে করে কাউকে ধর্ষণ করতে, তবে? আমার ব্যক্তিগত মত, যে স্বেচ্ছাচার অন্যের ক্ষতি করে, সেই স্বেচ্ছাচারে আমি বিশ্বাসী নই। এখন ক্ষতিরও রকম ফের আছে। কেউ যদি বলে ‘তুমি ওই ধর্মের নিন্দা করতে পারো না, কারণ তোমার নিন্দা আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে’, তবে?
কারও শরীরে আঘাত দেওয়ার অর্থ যদি অন্যের ক্ষতি করা হয়ে থাকে, তবে মনে আঘাত দেওয়ার অর্থ কেন অন্যের ক্ষতি করা হবে না! এক্ষেত্রে আমার মত হচ্ছে যে মানুষের মনে নানা রকম কুসংস্কার এবং অজ্ঞানতা বাসা বেঁধে থাকে, এসব দূর করা উচিত। দূর করার দায়িত্ব সচেতন মানুষের। এখন আরেকটি প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কেন নিজেকে সচেতন মনে করছি এবং একজন মৌলবাদীকে করছি না? করছি না, এর পেছনে কিন্তু আমার একশ যুক্তি আছে। মৌলবাদীও তার নিজের যুক্তি খাড়া করতে পারে। কিন্তু যে বিচারবুদ্ধি আমার আছে, যে মূল্যবোধ আমার গড়ে উঠেছে, তাতে আমি মৌলবাদীদের যুক্তিকে অবৈজ্ঞানিক এবং অযৌক্তিক বলে খন্ডন করে নিজের মতে স্থির থাকতে পারি। আমি জ্ঞানত কারও শরীরে আঘাত করি না। কোনও সৎ মানুষের আর্থিক ক্ষতির কারণ হই না। আমার স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে আমি কোনও অনুতাপ করি না। আজ অবধি অনুতাপ করতে হয়নি। সমাজের অনেক টাবু আমি ভেঙেছি। লোকে বলেছে স্বেচ্ছাচার, আমি বলেছি স্বাধীনতা। আমার বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার। আমি যা করছি, আমার দৃষ্টিতে কোনও অন্যায় করছি না। নিজের কাছে সৎ থাকা, নিজের কাছে নিরপরাধ থাকার মূল্য অনেক।
যখন কিশোরী ছিলাম, পায়ে পায়ে নিষেধাজ্ঞা। ঘরবার হবি না। খেলাধুলা করবি না। সিনেমা থিয়েটারে যাবি না। ছাদে উঠবি না। গাছে চড়বি না। কোনও ছেলে ছোকরার দিকে তাকাবি না। কারও সঙ্গে প্রেম করবি না। আমি কিন্তু সবই করেছি। করেছি, কারণ আমার ইচ্ছে হয়েছে করতে। নিষেধ ছিল বলে যে ইচ্ছে হয়েছে তা নয়। বাবা তো আমাকে আরও অনেক কিছুই নিষেধ করতেন, যেমন পুকুরে নাববি না, আমি পুকুরে নাবিনি, কারণ আমি সাঁতার জানি না, আর এ কারণে আমার আশঙ্কা হত সাঁতার না জেনে পুকুরে নামলে আনন্দ তো হবেই না বরং অসাবধানে ডুবে মরতে পারি। বাবা বলতেন, ছাদের রেলিংএ চড়বি না। আমি চড়িনি। কারণ আমার মনে হতো রেলিং যেহেতু সরু ছিল, পা পিছলে নিচে পড়লেই সব্বনাশ। যে কোনও কাজ করতে গিয়ে অন্য কেউ কী বললো না বললো তা না দেখে বরং নিজে কী বলছি, নিজে কী যুক্তি দিচ্ছি সেটি দেখি। নিজের ইচ্ছের সামনে আমি অত্যন্ত সততা নিয়ে দাঁড়াই। মেয়েদের পক্ষে, যাদের ইচ্ছের দাম এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনও দেয় না, নিজের ইচ্ছেকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ নয়। কিন্তু আমি কোনও কারণ দেখিনি প্রতিষ্ঠিত না করার। নিজের কাছে নিজের ভীতু, হেরে যাওয়া, নত মস্তক, নতজানু রূপ আমার সইবে না আমি জানি।