দিনের বেলায় কলকাতা ঘুরে শনিপুজোর বাহার দেখেছি। মানুষ কি সত্যিই বিশ্বাস করে যে, শনি দেবতাকে পুজো দিলে কোনও অমঙ্গল বা দুর্ঘটনা ঘটবে না জীবনে! কেবল কি শনিপুজোই? কত হাজার রকম পুজো যে করছে মানুষ! হাতে হাতে গ্রহরত্ন। বিয়ে হওয়ার, মন-মেজাজ ঠাণ্ডা থাকার, শৌর্যবীর্য বৃদ্ধি পাওয়ার, মামলা-মোকদ্দমা থেকে রেহাই পাওয়ার। হাতে হাতে মোবাইল। একই সঙ্গে বিজ্ঞান এবং অবিজ্ঞানের এমন সহবাস ঘটাতে আমি বোধহয় অন্য কোনও জাতিকে দেখিনি। বেশির ভাগ মানুষ অবশ্য বিজ্ঞান আর অবিজ্ঞানের গভীরে না ঢুকে দুটোকে নিজের আরাম আয়েসের জন্য ব্যবহার করছে। ধর্ম নিয়ে যা হচ্ছে চার দিকে, এ ঠিক যে, সবই বাণিজ্য। সবই হচ্ছে ওই কাঁঠাল ভাঙার মতো। ধর্মের শুরু থেকে তাই-ই ছিল। কিছু লোক অন্যের ঘাড়ে চিরকালই কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছে। যারা কাঁঠাল ভাঙে, ধর্মে তারা বিশ্বাস করে না। যাদের ঘাড়ে ভাঙা হয়, তারা কিন্তু বিশ্বাস করে আদ্যোপান্ত। আগে কাঁঠাল ভাঙার লোকের সংখ্যা কম ছিল, এখন সংখ্যাটা বেড়েছে। ধর্মকে নিজের ছোট বড় মাঝারি নানা স্বার্থে ব্যবহার করাটা এখন কারও কাছে কোনও শরমের কাজ নয়। আমি কিন্তু বলতে চাচ্ছি না যে, ধর্ম নিতান্তই ভাল জিনিস, ধর্মের অপব্যবহারটাই কেবল মন্দ। ভাল বা মন্দ, কোনও কাজে ব্যবহার হোক বা না হোক, ধর্ম জিনিসটা কিন্তু ভাল নয়। ব্যক্তির জন্য নয়, সমাজ বা রাষ্ট্র কোনও কিছুর জন্যই নয়।
পুজো নিয়ে কথা। সেকুলার মানুষেরা কি পুজোর পাট চোকানোর কিছু কথা বলে? আমার প্রশ্ন ছিল। উত্তর পেলাম, বলে না। কেন বলে না, তা জানার জন্য ব্যাকুল আমি। আমার ব্যাকুলতার দিকে কেউ ভাল চোখে তাকায়নি। ধর্মান্ধতা বাড়লে পুজোআচ্চা বাড়ে— এ কথাটিকেই আমি একটু কঠিন করে বলি, ধর্ম বাড়লেই পুজোআচ্চা বাড়ে। কিন্তু দিন দিন যে ধর্মকে এখানে দুধকলা খাইয়ে পোষা হচ্ছে, এর পরিণতি কী! একশো দুশো বছর পরও কি এমন পুজোর উৎসব হবে! সিঁড়ি বেয়ে সভ্যতার দিকে উঠতে গেলে, যে সিঁড়িটি প্রথম ডিঙোতে হয়, তার নাম তো ধর্ম, প্রাচীন কালের পুরুষ-রচিত প্রচণ্ড নারীবিরোধী পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। অন্তত আমি তা মনে করি। সেকুলার যাদের ভাবি, তারা যে সত্যিই সেকুলার নয়, তা আমাকে চোখে আঙুল তুলে কেউ কেউ বুঝিয়ে দিল। এ রাজ্যের কমিউনিস্টরাই যদি সেকুলার না হয়, তবে সাধারণের আর অপরাধ কী! সেকুলার শব্দের আসল অর্থ কিন্তু ‘ধর্মহীন’, ধর্মনিরপেক্ষ নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সকল ধর্মের সামনেই দেখি মাথা নত করছেন আজকালকার কমিউনিস্ট নেতাগণ। ধর্মকে ব্যক্তিগত না করে, রাজ্যগত এবং রাষ্ট্রগত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন শাসকদল। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে, সে ব্যাপারে তাঁরা এমনই সচেতন যে, লেখকের লেখার স্বাধীনতা রোধ করতেও পিছপা হন না। নামী দামি কমিউনিস্ট হীরেন মুখোপাধ্যায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পৈতে পরেছেন শুনে আমি অনেক ক্ষণ বাকরুদ্ধ বসেছিলাম। বাকরুদ্ধ বসে থাকি কমিউনিস্টদের যখন তারাপীঠে আর দক্ষিণেশ্বরে দৌড়তে দেখি।
উৎসবের যদি প্রয়োজনই হয়, তবে কি পয়লা বৈশাখ, বর্ষা-বরণ, নবান্ন— উৎসবের উপলক্ষ হতে পারে না? শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নানা রকম উৎসব চালু করেছেন, সে সব এখন মহা সমারোহে উদ্যাপিত হয়। উৎসবগুলোর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। এ রকমও তো হতে পারে যে, উৎসবগুলো ছড়াতে ছড়াতে পুরো পশ্চিমবঙ্গে, এমনকী পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে গেছে! আমি বোধহয় স্বপ্ন বেশি দেখি, স্বপ্ন আমি আসলে বেশিই দেখি।
এ রকম কি কেউ কখনও বলে যে, এ বারের পুজোয় খরচের টাকাটা উন্মূল উদ্বাস্তু মানুষের জন্য ব্যয় করব? অথবা, খরচ হতে যাচ্ছে যে কয়েক হাজার কোটি টাকা, সেই টাকার দু’ভাগ কী তিন ভাগ খরচ হবে অন্য খাতে, ইস্কুলে পড়তে না-পারা বালক-বালিকাদের লেখাপড়ায়! এ বছর বাজি পোড়ানোর খাতে যে টাকা বরাদ্দ ছিল, সে টাকাটা ছাই করে না দিয়ে বরং অন্য কিছু হোক, যাতে কিছুটা থাকে, থেকে যায়, বৃক্ষ বা বাগান, দেখে শুঁকে স্পর্শ করে যেন সারা বছর সুখ পাওয়া যায়। অন্ন চাই বলে যে গোলাপ চাইব না, এমন তো কোনও কথা নেই। আমাদের দুটোই চাই।
পুজো বেশ কয়েক বারই এসেছিল আমার জীবনে। পুজো না বলে, পুজোর উৎসব বলাই ভাল। পাড়ায় অনেকগুলো বারোয়ারি পুজো হত, মাইকে গান বাজত সারা দিন। একশোটা মাইকে একশো রকম গান। হেমন্ত, মান্না দে, সতীনাথ, জগন্ময় মিত্রের সেই সব অতুলনীয় সুর এবং কথার সংগীত আমাকে দিনমান সুখের সমুদ্রে স্নান করাত। কানের পর্দা ফাটিয়ে চার দিক থেকে আমাদের গান শোনাবার মহান দায়িত্ব কে নিত, তা জানি না। তবে, গানগুলো শুনতাম, গানগুলো গাইতাম ভোরবেলা থেকে মধ্যরাত অবধি। ছাদে বসে, রকে বসে, মাঠে, বারান্দায়, ঘরের জানালায় বসে। ইস্কুলের বই সামনে নিয়ে চেয়ার টেবিলে ঠায় বসে থাকার যে নিয়ম ছিল বাড়িতে, সেটি যে কয়েক দিনের জন্য শনি দূর হওয়ার মতো দূর হত, সেই আনন্দে আমার দিশেহারা লাগত। পুজো শেষ হয়ে গেলেও, মাইক বন্ধ হয়ে গেলেও কানে কেমন জঁ জঁ শব্দ হত। শব্দের তলে ক্ষীণ স্বরের সতীনাথ।
কেবল যে গানই ছিল আমার পুজোর সব কিছু, তা নয়। মণ্ডপে মণ্ডপে গিয়ে মূর্তি দেখার উত্তেজনায় আমি নাচতাম। বড়দের অনুমতি পেলে বড়দেরই হাত ধরে সন্ধেবেলায় ঘরের বাহির হতাম। পুজো কী, পুজো কেন— এ সবের দিকে মন আমার যায়নি তখন, মন পড়ে থাকত দুর্গা প্রতিমায়, পড়ে থাকত শিল্পীর হাতের জাদুতে।