নিরুপদ্রব জীবন কাটাতে আমি কলকাতায় আসি। দীর্ঘ দিন পথ হারিয়ে এ দেশে ও দেশে ঘুরে ঘুরে অবসন্ন শরীর আর মন নিয়ে মানুষ যেমন ঘরে ফেরে, তেমন করে কলকাতায় ফিরি আমি। কলকাতার শীতল স্বচ্ছ জল সঞ্জীবনী সুধার মতো আমি প্রাণ ভরে পান করি। জীবন ফিরে পাই।
বড় স্বপ্ন ছিল কলকাতায় বাস করব। শহরের এক কোণে ছোট একটি ঘর থাকবে আমার। সে হল না। আমি নাকি ‘বিদেশি’, সে কারণে পাকাপাকি ভাবে একটি ঘরের বাসিন্দা হওয়া আমার সম্ভব নয়। বছর ধরে অনুমতি নেওয়ার কাজ চলছে, এখনও কোনও অনুমতি আমার ভাগ্যে জোটেনি।
আমার একটি ‘স্বপ্ন’ আছে, স্বপ্নটি কলকাতায় পা দেওয়ার পর থেকেই আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এই কলকাতায় আমি যেন আর দশটি সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করার স্বাধীনতা পেতে পারি, যে কেউ চাইলেই যেন আমার কাছে পৌঁছতে পারে, আমাকে স্পর্শ করতে পারে, আমি যেন দুর্লভ কিছু, দূরের কিছু না হই, আমি যে সবারই স্বজন, সবারই যে আত্মীয় আমি, তা যেন বোঝাতে পারি। আমার এই হাতদুটো, দুটো কাঁধ এক জন দুঃখিতারও দুঃখ মোচন করে যেন ধন্য হতে পারে।
এই প্রাণের প্রিয় কলকাতা শহরে কোনও প্যাঁ-পুঁ শব্দের গাড়ি নিয়ে যেন পথ চলার লজ্জা আমাকে আর পেতে না হয়, বইমেলার মাঠে যেন যে কোনও দর্শকের মতো অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারি, আমার সীমানা যেন মেপে দেওয়া না হয়, আমার নিরাপত্তার জন্য যেন কোনও প্রহরীর প্রয়োজন না হয়। মানুষের ভালবাসাই যেন আমার নিরাপত্তা হয়।
সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ১৭ মাঘ ১৪১০ রবিবার ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৪
ধর্মে নেই, উৎসবে আছি
আমার কোনও ঈদ নেই, পুজো নেই, ক্রিসমাস নেই। আমার কোনও বুদ্ধপূর্ণিমা নেই। হানুকা নেই, সাবাত নেই। ঈশ্বরে, ভগবানে, আল্লায় আমার বিশ্বাস নেই। আমি ধর্মহীন মানুষ। যুক্তিবাদে, মুক্তিবাদে বিশ্বাসী। বিশ্বাসী লৌকিকে, ইহলৌকিকে, সাম্যবাদে, মনুষ্যবাদে, বিবাদ-বিতণ্ডা-বৈষম্যের প্রতিবাদে। ধর্মহীন, তাই বলে কি আমি অসৎ? তাই বলে কি আমি অনুদার একটুও! শত্রুরও এ কথা বলতে বাধবে। আজ যখন আমি সেকুলার ভারতে বসে, প্রিয় শহর কলকাতায় বসে, চার দিকে ধর্মীয় উৎসবের প্রস্তুতি দেখছি, বিশাল করে, বিরাট করে, আগের চেয়ে আরও জাঁক করে উৎসবটি হতে যাচ্ছে— মনে পড়ছে, ঈদের আগে আগে বাংলাদেশের উন্মাদনা। কে কত বড় আর কত দামি ষাঁড় কিনতে পারে, তার প্রতিযোগিতা হত পয়সাওয়ালাদের মধ্যে। ঈদের দিন তো দেশ ভেসে যেত রক্তে। সে কী বীভৎস উৎসব! পশ্চিমবঙ্গের উৎসব আমি দেখিনি কখনও নিজ চোখে, তবে শুনেছি। আমার ধার্মিক অধার্মিক দুরকম বন্ধুই বলেছে পুজোর কথা। বলেছে, এ হচ্ছে নিতান্তই বাঙালির উৎসব, এর সঙ্গে এখন আর ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। এর সঙ্গে কি জাতপাতেরও সম্পর্ক নেই? না নেই। সর্বজনীন পুজোয় যে কেউ অংশ নিতে পারেন। মুসলমানও তো আজকাল হচ্ছেন পুজো কমিটির সভাপতি। তাই নাকি? চোখে চমক আমার। আচ্ছা, শূদ্র কি পুরোহিত হতে পারে? মেয়েরা কি ঠাকুর ছুঁতে পারে ভাসানের দিন ছাড়া? বন্ধুদের কপালে তখন দেব না দেব না-করেও দেখা দেয় বিরক্তির ভাঁজ। নাস্তিক এক বন্ধু পুজোর মন্দ দিক নিয়ে বলতে গিয়ে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য যে প্রকট হয়ে ওঠে পুজোর সময়, তার নিখুঁত বর্ণনা করল। পুজোর উৎসবের কথা মনে করে নাক সিঁটকে বলল, ‘এর নাম উৎসব নাকি? পুজোর ফেলে দেওয়া খাবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কুকুর আর মানুষ।’ আমি মলিন হেসে বলি, ‘সেও তো উৎসব, কুকুর আর দরিদ্রের উৎসব।’
ষাটোর্ধ্ব কিছু বন্ধু পুরনো দিনের কথা স্মরণ করে দুঃখ করলেন, তাঁদের দিনে পুজোর উৎসব বড় আন্তরিক ছিল। এখন বহুজাতিক কোম্পানি কোটি কোটি টাকা ঢালছে। এখন চমক আছে, জমক আছে, কিন্তু হৃদয় নেই। অন্তর ঢেলে পুজো করাটা আর কোথাও তেমন দেখা যায় না। হই-হুল্লোড়, দৌড়ঝাঁপ, শো-টাই বেশি। মন্দ আর একটি দিক হল উগ্রতা। ছেলেরা মদফদ খাচ্ছে, মেয়েদের টিজফিজ করছে। মন্দ দিক নিয়ে আর একজন বলল, ট্রাফিক জ্যাম।
মন্দ খুব বেশি নেই, ভালর দিকেই পাল্লাটা ভারী হল। ফ্যামিলি গেট টুগেদার ভাল। খাওয়াদাওয়া ভাল। ছুটি-ছুটি ভাল। শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া ভাল। আরতি ভাল। অঞ্জলি ভাল। মণ্ডপ ভাল। আলো ভাল। মূর্তি ভাল। ভালর শেষ নেই। পুজো এলে গরিবের কাজ জোটে, সারা বছরই পুজোর অপেক্ষায় বসে থাকেন ওঁরা। পুজোর সময় যে টাকা কটা উপার্জন করেন, সে টাকাতেই তো ওঁদের বছর চালাতে হয়। ভাল-মন্দের ফিরিস্তির দিকে আমার তখন আর নজর নেই, যখন জিজ্ঞেস করলাম, পুজোটা কী? পুজোটা কেন?
পুজোটা পুজো। পুজোটা প্রয়োজন।
নাস্তিক বন্ধুও বলল, পুজোটা প্রয়োজন।
কেন প্রয়োজন? উৎসবের প্রয়োজন। কিছু একটা উৎসব থাকা তো চাই।
থাকা কি চাইই?
হ্যাঁ, চাই।
যে দেশে মানুষের বিশুদ্ধ খাবার জলই জোটে না, সবার জন্য শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই, সেখানে উৎসব চাই-ই। এশিয়ার দরিদ্রতম মানুষের তিরানব্বই ভাগই যে দেশে বাস করে, যে দেশে চল্লিশ কোটি মানুষ বাস করে দারিদ্রসীমার নীচে, শতকরা চল্লিশ জন লিখতে পড়তে জানে না— সে দেশে উৎসব চাই, যে উৎসবে কোটি কোটি টাকা ভাসিয়ে দেওয়া হবে অর্থহীন আমোদে। সে দিন রাতের কলকাতাকে দেখেছি, বড় বড় ক্লাবে, ধনীর বাড়িতে বাড়িতে উৎসব উপচে পড়ছে, দামি মদে স্নান করছে মানুষ। বুদ্ধিজীবী, যাঁরা অহর্নিশি রাজনীতি, সমাজনীতি, শিল্পসাহিত্যনীতি নিয়ে চমৎকার সব বাক্য আওড়ান, তাঁদের ঝলমলে জীবনযাপন থেকে দু’পা বেরোলেই দেখি, অন্ধকারে অসংখ্য অগুনতি অনাহারী ক্লিন্ন ক্লিষ্ট মানুষ, ফুটপাত জুড়ে শুয়ে আছে। আমি লজ্জায় ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকেছি। ভয়, মানুষের কাছে এই ভয়ংকর বৈষম্য ভয়ংকর মনে হচ্ছে না বলে। লজ্জা, ফুটপাতের মানুষ ডিঙিয়ে আমি যে যাচ্ছি পাঁচ তলা কোনও দালানবাড়ির নরম বিছানায় ঘুমোতে। বিস্ময়, লক্ষ কোটি বঞ্চিত মুখ বুজে সব বৈষম্য মেনে নিচ্ছে কেন! কেন মেনে নিচ্ছে, কেন তাদের মেনে নেওয়ানো হচ্ছে, তা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়, চিরকালই হয়।