চুরানব্বইয়ের শেষ দিকে আমি যখন অষ্ট্রিয়ার অতিথি হয়ে ভিয়েনায়, তুমি এসেছিলে, দ্য পিয়ানো টিচার বইটি দিয়েছিলে সই করে। তোমার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছিল কিনা মনে নেই। কিন্তু বইটি পড়তে পড়তে তোমার সঙ্গে দীর্ঘ কথা বলেছি মনে মনে। অনেকটাই তুমি তোমার নিজের গল্প বলেছ, তোমার শব্দ-বাক্য থেকে সঙ্গীতের আশ্চর্য মূর্চ্ছনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে, যতবারই তোমাকে পড়ি আমি। এরিকা কোহুট যে তুমি, সে আমি টের পাই। বইটির শেষে তুমি ছুরিকাঘাতে বেদনার্ত এরিকাকে জনকোলাহল থেকে বাড়ি ফেরাচ্ছ। ‘—- এরিকার পিঠ, যেখানে জামার বোতাম কিছুটা খোলা, উষ্ণ হয়ে আছে। তার পিঠ বরং আরও বেশি উষ্ণ হচ্ছে আরও বেশি উত্তাপ ছড়াতে যে পারে সেই সূর্যের তাপে। এরিকা হাঁটছে আর হাঁটছে। তার পিঠ উত্তপ্ত হচ্ছে সূর্যে। রক্ত ঝরছে। লোকের চোখ তার পিঠ থেকে সরে মুখের দিকে যাচ্ছে। কেউ কেউ পিছন ফিরছে। সবাই নয়। এরিকা জানে, কোন পথে তার এখন যেতে হবে। সে যায়, দ্রুত পা ফেলে সে বাড়ির দিকে যায়।’ তুমি কি এ ভাবেই অভিমান করে কদাকার পৃথিবীর পথ ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেছো এলফ্রিডা! তোমার নতুন নাটক ‘বাম্বিল্যাণ্ড’ পড়ে মুগ্ধ। আমেরিকার ধ্বংসাত্মক খেলা দেখেও অনেকে মুখ বুজে থাকে। তুমি থাকনি। ইরাকের অগুনতি মৃত্যু দেখে, আবু ঘ্রাইবের অমানবিক দৃশ্য দেখে তুমি চিৎকার করে ওঠো। এলফ্রিডা, তোমার সঙ্গে চিৎকার আমরাও করছি। আমাকে, আমাদেরও তুমি সঙ্গে নাও।
সুইডিশ অ্যাকাডেমি তার রক্ষণশীল নীতির কারণেই সিমোন দ্য বোভোয়ার মতো লেখিকাকে নির্বাচন করেনি। এখন তোমাকে নির্বাচন করে সম্ভবত ভাঙতে চাইছে নিজেদের পায়ে পরা নিজেদেরই শৃঙ্খল। সাহিত্যের নোবেল নিয়ে অনেককাল উদ্ভট কাণ্ড করেছে অ্যাকাডেমি। আজকের এই নোবেল তোমাকে দিয়ে, তোমাকে নয়, অ্যাকাডেমি নিজেকেই ধন্য করেছে। হীনম্মন্যতার নোংরা নর্দমা থেকে বেরিয়ে এসেছে এতকাল পর। অতীতের অনেক অন্যায়ের ওপর আলগোছে বিছিয়ে দিতে পেরেছে রঙিন রেশমি চাদর।
মনে পড়ছে আজ থেকে দশ বছর আগে, নারীকে যেখানে আর যা কিছুই ভাবা হয়, মানুষ ভাবা হয় না, নারীকে অত্যাচারিত, অবহেলিত, অপমানিত করাই যেখানে সংস্কৃতি, সেই তৃতীয় বিশ্বের মুসলিম সমাজ থেকে আসা এক নারীকে, এই আমাকে বলে দিল পুরুষ-লেখক গ্যাবি গ্লাসম্যান, সুইডিশ পেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, ‘সাবধান, তুমি কিন্তু নিজেকে ফেমিনিস্ট বলে পরিচয় দিও না।’
‘কেন?’ আমি আকাশ থেকে পড়ি।
গ্যাবি গলা নামিয়ে বলেছিল, ‘ফেমিনিস্টদের এখানে ভাল চোখে দেখা হয় না।’
তা ঠিক, ‘ফেমিনিস্ট’ দেখলে পুরুষের আন্তরাত্মা কাঁপে। এই বুঝি সংসার ভেঙে গেল, বাচ্চা কাচ্চার জন্ম হওয়া বন্ধ হল। এই বুঝি নারীকে দাসী করে রাখার আরামটা নষ্ট হয়ে গেল। এই বুঝি নারী সমকামী হয়ে পুরুষের বারোটা বাজাল। গ্যাবিকে আমি তার ঔদ্ধত্যের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পারিনি, কিন্তু আজ আমি তৃপ্ত। দশ বছর পর হলেও তাকে শিক্ষাটা দেওয়া হল, আমি দিতে না পারলেও সুইডিশ অ্যাকাডেমি দিয়েছে। তোমাকে অভিবাদন এলফ্রিডা। নোবেল পুরস্কার পেয়ে জগতের সকল নারীবাদীকে তুমি খুব উঁচু আসনে বসিয়ে দিলে, ডানপন্থী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে তুমি মহান করলে। মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইকে তুমি উজ্জ্বল করলে, গৌরবান্বিত করলে। দেশে দেশে নারীবাদী লেখকদের অফুরন্ত সাহস জোগালে তুমি। তারা আর নিন্দুকের কূটকচালে নেতিয়ে পড়বে না। ঈশ্বরের বুকে হাসতে হাসতে কোপ বসালে। তুমি এই মরে যেতে থাকা, সংকীর্ণতায় কুঁকড়ে যেতে থাকা মানবসভ্যতাকে বাঁচালে এলফ্রিডা। আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করো তুমি। কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করো। ভালবাসা নাও আমার, অজস্র, অকৃত্রিম ভালবাসা নাও এলফ্রিডা।
তোমার তসলিমা,
স্টকহলম, সুইডেন।
সৌজন্যে : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ আশ্বিন ১৪১১ বৃহস্পতিবার ১৪ অক্টোবর ২০০৪
বেলা যায় মেলা যায়
আমার ছোটবেলার ময়মনসিংহে রথ আর উল্টোরথের মেলা হত। স্বদেশি বাজারের ফুটপাথে অষ্টমীর মেলা। বাবা আমাকে অষ্টমীর মেলায় নিয়ে যেতেন। বাবার আঙুল ধরে সারা মেলা অগাধ সুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম।
বিন্নিধানের খই আর চিনির খেলনা কিনে দিতেন বাবা। আবদার করে মাটির পুতুল, বাঁশের বাঁশি আর রঙিন রঙিন হাতি-ঘোড়া কিনতাম। সে যে কী উত্তেজনা তখন, সেই মেলায়, সেই বেলায়, ছোটবেলায়!
কিশোর বয়সে যখন কবিতা লেখায় প্রাণ সঁপেছি, তখন রূপকথার গল্প শোনার মতো বইমেলার গল্প শুনতাম। ময়মনসিংহের ঘরবন্দি জীবন থেকে বেরিয়ে লাল-নীল বাতি জ্বলা ঢাকা শহরের বইমেলা দেখতে যাওয়া, সত্যি বলতে কী, স্বপ্নেরও অতীত ছিল। ‘স্বপ্নের অতীত’ ব্যাপারটি কবে যে কখন ‘স্বপ্ন’ হয়ে ঘাপটি মেরে হৃদয় জুড়ে বসে রইল!
দীর্ঘ দীর্ঘ বছর সাধনার পর এক দিন আমার এই বেয়াদপ, বেশরম স্বপ্নটি সত্যি সত্যিই সত্যি হল, আমার বইমেলা দেখা হল। সেই থেকে বইমেলা। বইয়ের সুগন্ধের মধ্যে ডুবে থাকার বেলা। চৈত্র থেকে মাঘ পার করি ফাল্গুনের অপেক্ষায়। এগারো মাস দুঃখ সই একটি মাস আনন্দ করব বলে।
স্বর্গের যত সুখের কথা শুনেছি, মনে হয়নি কোনও সুখই একুশের বইমেলার সুখের কাছে দাঁড়াতে পারে। প্রতি বছর বইমেলায় বই বেরোচ্ছে আমার, লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, পাঠকের সঙ্গে মত বিনিময়, মঞ্চে মঞ্চে কবিতা পাঠ, তুমুল সেই দিনগুলোর মধ্যে হঠাৎ বাংলাদেশের বাংলা অ্যাকাডেমির বিজ্ঞ, বিদগ্ধ বইমেলা কমিটির ফতোয়া— বইমেলায় আমার প্রবেশ নিষেধ। মেলায় আমার বই পোড়ানো হয় বলে, আমার ওপর হামলা হয় বলে মেলার পরিবেশ নাকি নষ্ট হয়— সেই কারণেই নিষেধ জারি। বছর আসে, বছর যায়, জাঁক করে বইমেলা হয়, বন্ধুরা মেলার উৎসবে মেতে থাকে, কেবল আমিই বসে থাকি ঘরবন্দি, একা। মন পড়ে থাকে মেলায়। এর পর মেলা দেখেছি অনেক। বিদেশের বইমেলা। কোনও মেলাতেই আমি নিষিদ্ধ নই, বরং আমন্ত্রিত।