প্রায় ৪৩ বছর আগে ছাপা হওয়া নইপলের ‘আ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ বইটির মান এ বছরের ম্যাজিক সিডস-এর চেয়ে উন্নত ছিল। লেখকের লেখার মান যদি দিন দিন ওপরে না উঠে নীচের দিকে নামে, নামতেই থাকে, তবে আশঙ্কা হয় লেখক হিসেবে তাঁর হয়তো দেওয়ার আর কিছু নেই। ম্যাজিক সিডস উপন্যাসটি আত্মপরিচয় এবং আদর্শ নিয়ে, যে দুটো বিষয় জীবনকে গড়ে তোলে বা ধ্বংস করে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র উইলি চন্দ্রনকে আমরা প্রথম দেখি ‘হাফ আ লাইফ’ উপন্যাসে, যেটি বছর তিন আগে প্রকাশ পেয়েছিল। নইপল অবশ্য অস্বীকার করেছেন, হাফ আ লাইফ বইটির সঙ্গে ম্যাজিক সিডস-এর কোনও সম্পর্ক নেই।
উইলির জন্ম ভারতে, তিরিশের দশকে। ভারত থেকে তিনি এক সময় লণ্ডন পাড়ি দেন। ওখানে গল্পের একটি বই বার করেন, আনা নামের এক মেয়েকে বিয়ে করে আফ্রিকায় চলে যান। যৌনজীবনের আকর্ষণই তাঁর কাছে তখন প্রধান ছিল। নিচু জাতের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য তাঁকে নানা ঝুটঝামেলা পোয়াতে হয়। নিজের পরিবেশ আর বাবার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া উইলি এখন বউ ছেড়ে আফ্রিকার জীবন ছেড়ে ইয়োরোপে চলে এসেছেন, ম্যাজিক সিডস-এ এসে বার্লিন শহরের রাস্তায় গোলাপ বিক্রি করছেন অস্ত্র কিনবেন বলে। বোন সরোজিনীই উইলিকে উদ্বুদ্ধ করেন ভারতের বিপ্লবী দল কান্দাপল্লীতে ভিড়তে। এ বইতে উইলিকে ইয়োরোপ থেকে ভারতে যেতে দেখি। ভারতের মাওবাদী সন্ত্রাসী দলে যোগ দিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতে দেখি। অস্পৃশ্যদের পক্ষে বিপ্লব করতে গিয়ে উইলি নানা রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কয়েক বছর জেলও খাটেন। এবং এক সময় তাঁর মনে হয়, এই বিপ্লব আসলে অর্থহীন। এই বিপ্লব গ্রামের নিম্নবিত্ত ও নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য, যাদের জন্য, আমরা বলি যে আমরা লড়াই করছি, সত্যিকার কিছুই করতে পারে না। বইয়ের শেষে এসে তিনি ঘোষণা দিয়ে দেন, ইট ইজ রং টু হ্যাভ অ্যান আইডিয়াল ভিউ অব দ্য ওয়ার্লড। কেন ভুল, কী কারণ, কিছুরই ব্যাখ্যা তিনি দেননি। বিপ্লবে আস্থাহীন উইলি ফিরে যান লণ্ডনে। ওখানেই তিনি জীবনের মানে খুঁজে পান। নইপলের ক্ষুদ্র খাঁচায় বন্দি উইলি, খুব বেশি দূর তিনি যেতে পারেন না। খুব বেশি কিছু ভাবতেও পারেন না। দেখেশুনে যে কারওর মনে হতে পারে সে-ও খাঁচায় বন্দি। থেকে থেকে বইটি বন্ধ করে শ্বাস নিতে হয় মুক্ত হাওয়ার। ম্যাজিক সিডস পুরনো সব দর্শনে ভরপুর। নইপলের বয়স এখন বাহাত্তর, সম্ভবত, বয়স হলে, চার দিক যখন ভেঙে পড়তে থাকে, দর্শনই ভরসা। জেলের দেওয়াললিখন পড়িয়ে তিনি তাঁর উইলিকে শেখান, ট্রুথ অলওয়েজ উইনস, অ্যাঙ্গার ইজ আ ম্যান’স গ্রেটেস্ট এনিমি, টু ডু গুড ইজ দ্য গ্রেটেস্ট রিলিজন, ওয়ার্ক ইজ ওয়রশিপ, নন-ভায়োলেন্স ইজ দ্য গ্রেটেস্ট অব অল রিলিজনস।
বইয়ের দীর্ঘ দীর্ঘ সংলাপ পড়তে পড়তে মনে হয় বুঝি বাচালের রাজ্যে এসে পড়েছি। কী জানি, স্ত্রী নাদিরার বেশি কথা বলার রোগ দেখতে দেখতেই বোধহয় নইপল তাঁর চরিত্রদের বাচাল বানিয়েছেন। তাঁর আগের বইগুলোয় যা আছে, যা পড়ে তাঁকে পাঠক বাহবা দিত, সে সব নেই এই বইয়ে, শ্লেষ নেই, ধারালো ছুরির মতো শব্দ নেই, বাক্য নেই। তাঁর গদ্যে এখন পুনরাবৃত্তি, অতিকথন, তাঁর গদ্য এখন ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলেই নইপল যদি ভেবে থাকেন যা ইচ্ছে তা-ই লিখেই পাঠককে তুষ্ট করতে পারবেন, তবে ভুল। জীবন নিয়ে এখন যদি তিনি সিরিজের তৃতীয় উপন্যাসটি লেখেন, আমার মনে হয় না পাঠক খুব জানতে আগ্রহী হবে উইলি কেমন আছে, কী করছে। উইলি এমন একটি চরিত্র যে পাঠককে আকর্ষণ করে না, পাঠকের মনে কোনও কৌতূহল জাগায় না। সে সহজেই অনুমান করে নিতে পারে যে সত্তরোর্ধ উইলি এখন লণ্ডনের কাছে কোনও ছোট শহরের কোনও ছোট বাড়িতে বসে ছোট ছোট গল্প উপন্যাস লিখছেন, আর নিজের ছোটখাটো ভারী শরীরটিকে লাঠিতে ভর করিয়ে এনে লনের চেয়ারে বসিয়ে দিচ্ছেন বিকেলে, চা খেতে খেতে প্রায় বোজা চোখে কাউকে দেখছেন তিনি, কথা বলছেন অসাম্যের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদের বিপক্ষে, গালাগালি দিচ্ছেন পৃথিবীর সব বিপ্লবকে, ধনী এবং শক্তিমানের গুণগান গাইছেন, সন্ধে নেমে এলে স্ত্রী পাশে এসে বলছেন, উইলি, ঘরে চল, এখন বিশ্রাম না নিলে শরীর খারাপ করবে। উইলি ওঠেন, স্ত্রীকে ক্রাচের মতো ব্যবহার করে তিনি ঘরের দিকে হেঁটে যান।
সৌজন্যে : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ আশ্বিন ১৪১১ রবিবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৪
তোমাকে অভিবাদন, এলফ্রিডা
দশ বছর আগে মৌলবাদীদের হুমকি এবং রাষ্ট্রের গ্রেফতারি পরোয়ানার যৌথ তাড়নায় বিপন্ন তসলিমা নাসরিনের সমর্থনে চিঠি লিখেছিলেন বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট লেখকরা। চিঠিগুলি নানা দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখকদের অন্যতম ছিলেন এলফ্রিডা ইয়েলিনেক, নোবেল-বিজয়ী অষ্ট্রীয় সাহিত্যিক। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর তাঁকে ‘জবাবি চিঠি’ লিখেছেন তসলিমা নাসরিন।
প্রিয় তসলিমা নাসরিন
শোনা যাচ্ছে এক সুন্দর মহান ধর্মকে আবার ভয় দেখানো হয়েছে। এবং শুনেছি, তসলিমা, আপনিই কাজটির জন্য দায়ী। ছোট ছেলেদের মতো ঝোপের আড়াল থেকেহঠাৎ লাফিয়ে পড়ে ‘হাঁউ মাউ খাঁউ’ বলে চিৎকার করে একে ভয় দেখানো তো চলে না —ধর্ম যে বড়ই ভিতু! আবার বহু শিশু এখনও তার সঙ্গে খেলা করতে চায়। অবশ্য আমি নিজেও আমার পূর্বতন ধর্মকে অর্থাৎ রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্ট ধর্মকে অনেক বার ভয় দেখিয়েছি!…