নোবেল পুরস্কারের একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে সুইডেনের স্টকহোল্ম শহরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠান হয় ২০০১ সালের শেষ দিকে। গুন্টার গ্রাস, নাদিন গর্ডিমার, সিমুস হিনেয়ের সঙ্গে আমাদের বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নইপলও ছিলেন। তিনিই একমাত্র সাহিত্যিক, যিনি আফগানিস্তানে আমেরিকার বোমা ফেলার পক্ষে ভয়াবহ সমর্থন জানিয়েছিলেন। নইপল চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত নেওয়ায় বিষম বিশ্বাসী। কোনও সুস্থ মানুষকে এমন ভাবে সন্ত্রাসের পক্ষ নিতে আমি দেখিনি আগে। তিনি তাঁর ‘অ্যামঙ্গ দ্য বিলিভারস: অ্যান ইসলামিক জার্নি’ (১৯৮১) আর ‘বিয়ণ্ড বিলিফ: ইসলামিক এক্সকারসান অ্যামঙ্গ দ্য কনভারটেড পিপলস’ (১৯৯৮) বই দুটোতে ইসলাম সম্পর্কে বালখিল্য সব মন্তব্য করতে দ্বিধা তো করেনইনি, এমনকী এমনও বলেছেন, দেয়ার প্রবাবলি হ্যাজ বিন নো ইম্পিরিয়ালিজম লাইক দ্যাট অব ইসলাম অ্যাণ্ড অ্যারাবস। মধ্যপ্রাচ্যের শিরদাঁড়া গুঁড়িয়ে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা, দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে নির্বিচারে শোষণ চালিয়ে গেছে, তেলের লোভে কামড়ে ধরেছে অন্য দেশের মাটি, যে কোনও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শরীরে আগুন ধরিয়েছে, সেকুলার মুভমেন্টকে নস্যাৎ করেছে, তা এডওয়ার্ড সাইদের চোখে পড়ে, নইপলের চোখে পড়ে না। দুই লেখকের মধ্যে পুরো এক ভুবন তফাত। নাইপল ভাল লেখক হতে পারেন, তাঁর লেখার ধরন আকর্ষক হতে পারে, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি খুব গভীরে খুব দূরে যেতে পারে না। তিনি যথেষ্ট যুক্তি না দেখিয়েই কটু মন্তব্যে পারদর্শী। এমনকী ভয়ঙ্কর সব কথা দিব্যি উচ্চারণ করতে পারেন। এই তো সে দিন সেপ্টেম্বরে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বললেন, পৃথিবীর কিছু দেশকে ধ্বংস করে দেওয়া উচিত। সৌদি আরব। ইরান।
উন্নাসিকতা তাঁকে বিবেকবুদ্ধিহীন করে তোলে। যে দেশে গুজরাতের মতো দুর্ঘটনা ঘটে, সে দেশে বেড়াতে এসে তিনি অনায়াসে সংখ্যালঘু মুসলমানের বিরুদ্ধে মন্দ কথা বলতে দ্বিধা করেন না। ইংল্যাণ্ডে, যেখানে বর্ণবাদ, জাতপাত নির্মম ভাবে বিরাজ করছে, বাদামি আর কালো রঙের মানুষদের জীবন নাশ করে দিচ্ছে, সেখানে বসে তিনি সাদা বর্ণবাদীদের মতোই মাল্টিকালচারালিজমের বিরুদ্ধে মন্দ কথা বলেন। ইংল্যাণ্ডে অভিবাসীদের সম্পর্কে নইপলের কথা: ওদের কোনও অধিকার নেই বলার যে আমি এই দেশ চাই, আমি এই দেশের আইন এবং নিরাপত্তা চাই, কিন্তু আমি অামার মতো করে বাঁচতে চাই। গুজরাতি, মাদ্রাজি, বিহারি সংস্কৃতির চর্চা ওখানে চলবে না। যারা বাঙালি, তাদের বাঙালিত্ব বিসর্জন দিয়ে তিনি ইংরেজের সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বলছেন। নইপল ভুলে যান পৃথিবীর ইতিহাসই এমন, খাদ্যের খোঁজে জীবিকার খোঁজে উন্নততর জীবনলাভের আশায় মানুষ চিরকালই পরস্পরের সঙ্গে মিলেছে মিশেছে। সংস্কৃতির যে বিবর্তন ঘটেছে, প্রতিনিয়ত ঘটছেই এবং এটিকে যে দাবিয়ে রাখার কোনও উপায় নেই, তা শুধু নির্বোধরাই মানে না। নইপল হয়তো ভুলে যান যে নিজে তিনি ত্রিনিদাদ থেকে ইংলণ্ডে আসা ইমিগ্রান্ট। এত দিনে ইংরেজের চেয়ে বেশি ইংরেজ হয়েছেন, কিন্তু সকলে তা হয় না বা হতে চায় না। নইপলের জেদ দেখে মনে হয়, স্বৈরাচারে বিশ্বাস তাঁর, গণতন্ত্রে নয়। মানুষের ইচ্ছের শরীরে শিকল পরিয়ে দিতে তিনি মোটেও কুণ্ঠিত হন না, দেখে বিস্ময় জাগে। সম্ভবত দাসপ্রথাতেও তাঁর খুব একটা আপত্তি নেই।
কালো আফ্রিকানদের কোনও সংস্কৃতি নেই, বলেছেন নইপল। তাঁর এই অগভীর এবং অশালীন মন্তব্য বড় অশ্লীল শোনায়। কেবল আফ্রিকানদের ক্ষেত্রে নয়, জঙ্গল বা জংলি শব্দটি তিনি পুরো তৃতীয় বিশ্বের জন্য ব্যবহার করেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ক্যারিবিয়ান কবি ডেরেক ওয়ালকট বলেছেন, কালোদের সম্পর্কে নাইপল যে কুৎসিত মন্তব্য করেছেন তা যদি তিনি ইহুদিদের সম্পর্কে করতেন তবে ক’জন লোক তাঁর এই বাকস্বাধীনতা সহ্য করত? নইপলের দীর্ঘ কালের বন্ধু পল থেরো তাঁর বইয়ে নইপল সম্পর্কে লিখেছেন, আমি তাঁর ট্যালেন্টকে খুব অ্যাডমায়ার করতাম, আফটার আ হোয়াইল আই অ্যাডমায়ার্ড নাথিং এলস। ফাইনালি আই বিগ্যান টু ওয়াণ্ডার অ্যাবাউট হিজ ট্যালেন্ট, সিরিয়াসলি টু ওয়াণ্ডার, এবং সন্দেহ শুরু হল যখন তাঁর শেষ বইটি পড়তে গিয়ে পৃষ্ঠা কেবল বাদ দিয়ে গিয়েছি। আগে হলে, মনে করতাম, এ আমার দোষ। নাউ আই নিউ দ্যাট কুড বি মনোম্যানিয়াক ইন প্রিন্ট দ্যাট হি ওয়জ ইন পারসন।
পুঁজিবাদে বিশ্বাসী মানুষ আমি অনেক দেখেছি, কিন্তু নইপলের মতো এত কঠোর পুঁজিবাদী কাউকে দেখিনি। তিনি ইয়োরোপের ওয়েলফেয়ার স্টেটের তীব্র নিন্দা করেছেন। প্রতিটি নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রের বিনা পয়সায় শিক্ষা স্বাস্থ্য ইত্যাদির ব্যবস্থা, বেকার ভাতা, তাঁর বিশ্বাস, মানুষ নয়, দৈত্য তৈরি করছে। নতুন প্রজন্ম হাত পা গুটিয়ে এখন ওই সুবিধে পাওয়ার আশায় বসে থাকবে বলে তিনি মনে করেন। যার টাকা আছে, সে অন্ন বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্যের সুবিধে পাবে, সুখ শান্তি স্বস্তি পাবে, আর যার টাকা নেই, সে কিছুই পাবে না, উদ্বাস্তু উন্মূল হয়ে জীবনযাপন করবে, ভুগে মরবে, পচে মরবে— এই হল আমাদের নোবেল বিজয়ীর বিশাল মস্তিষ্ক থেকে প্রসূত প্রণম্য প্রস্তাব!