হঠাৎ দেখলে মাকুন্দ বলে মনে হয়। কিন্তু হ্যান্ডশেক করার সময় হাতে সোনালি লোম লক্ষ করলাম।
সম্মেলনের অতিথিদের জন্য বক্তৃতার পর একটা বড় হলঘরে কফি ও কেক-বিস্কুটের ব্যবস্থা ছিল। ভিড় দেখে আমি একটা কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। মনটাও ভাল নেই, কারণ বক্তৃতার শেষে হাততালির বহর দেখে বুঝেছিলাম, আমার কথাগুলো শ্রোতাদের মনে ধরেনি। অর্থাৎ মানুষের হাতে প্রাণীর সৃষ্টি হতে পারে সেটা বৈজ্ঞানিকেরা মানতে চায়নি। তাই বক্তৃতার শেষে দু একজন ভদ্রতার খাতিরে প্রশংসা করলেও এগিয়ে এসে বিশেষ কেউই কথা বলছে না। এমন সময় প্রোফেসর হামবোল্ট হাসিমুখে এলেন আমার দিকে এগিয়ে। তাঁর হাতে দু পেয়ালা কফি দেখে বুঝলাম তার একটা আমারই জন্যে। কফি পেয়ে তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। জামান ভাষাতেই কথাবাত হল। হামবোল্ট তাঁর প্রথম কথাতেই আমাকে অবাক করে দিলেন
আমার পেপারটা আর পড়ার দরকার হল না।
তার মানে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তুমি যা বললে, আমারও সেই একই কথা।
আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম, তাতে ক্ষতি কী? এরা যখন আমার একার কথায় গা করছে। না, সেখানে দুজনে বললে হয়তো কিছুটা কাজ হবে।
হামবোল্ট মৃদু হেসে মৃদু স্বরে বললেন, এদের কিছু বলে বোঝাতে যাওয়াটা পণ্ডশ্ৰম। এসব ব্যাপারে কথায় কাজ হয় না, কাজ হয় একমাত্র কাজ দেখাতে পারলে। তুমি যা বললে, সেটা নিয়ে কিছু পরীক্ষা করেছ কি?
আমি বলতে বাধ্য হলাম যে আমার গিরিডির ল্যাবরেটরিতে যা সরঞ্জাম আছে তাই নিয়ে এই জটিল পরীক্ষায় নামা মুশকিল।
কোনও চিন্তা নেই? হামবোল্ট বললেন। তুমি চলে এসো আমার ওখানে।
কোথায়? হামবোল্ট কোথায় থাকতেন সেটা আমার জানা ছিল না।
সুইটজারল্যান্ড। আমি থাকি সেন্ট গালেন শহরে। আমার মতো ল্যাবরেটরি ইউরোপে আর পাবে না।
লোভ লাগল। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। ৫ই মার্চ অর্থাৎ ঠিক সাত দিন আগে সেন্ট গালেনে পৌঁছেছি। সুইটজারল্যান্ডের সব শহরের মতোই এটাও ছবির মতো সুন্দর। কনস্ট্যান্স হ্রদের ধারে রোরশাক শহর থেকে ট্রেনে ন মাইল। প্রায় আড়াই হাজার ফুট উচুতে। প্রথম দিন একটু ঘুরে দেখেছিলাম শহরটা, তারপর গবেষণার কাজ শুরু হয়ে যাওয়াতে আর বেরোতে পারিনি। হামবোল্টের ল্যাবরেটরি সত্যিই একটা আশ্চর্য জিনিস। এ ধরনের গবেষণা এখানে ছাড়া সম্ভব ছিল না। এখন এটা সফল হলেই হয়। আজ যে খানিকটা আশার আলো দেখা দিয়েছে, তার জন্য আমি অনেকটা দায়ী। প্রোটোভিট্রোমাফিজেনারাস সলিউশনে নিউট্র্যাল ইলেকট্রিক বমবার্ডমেন্টের কথাটা আমিই বলেছিলাম। আমার বিশ্বাস তার ফলেই আজ কয়েক মুহুর্তের জন্য ওই পারমাণবিক প্রাণীটির আবিভব হয়েছিল। কাল বমবার্ডমেন্টের মাত্ৰাটা আর একটু বাড়িয়ে দেব। দেখা যাক কী হয়।
নাঃ-আজ আর লেখা যাবে না। এইমাত্র হামবোল্টের চাকর ম্যাক্স বলে গেল, তার মনিব সুপার-চেসের যুঁটি সাজিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
১৪ই মার্চ
কাল ডায়েরি লিখতে পারিনি। লেখার মতো মনের অবস্থাও ছিল না। তার মানে মনমরা অবস্থা নয়—একেবারে উল্লাসের চরম শিখর। এখনও ঘটনাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। ঘড়িতে যদিও রাত আড়াইটা, চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। বার বার মন চলে যাচ্ছে হামবোল্টের ল্যাবরেটরির টেবিলের উপর রাখা ফ্লাস্কের ভিতরের আশ্চর্য প্রাণীটার দিকে। আমাদের যুগান্তকারী পরীক্ষার ফল। এই প্ৰাণী।
কাল সন্ধ্যা ছটা বেজে তেত্ৰিশ মিনিটে এই প্ৰাণী জন্ম নেয়। আমার বিশ্বাস আমার অনুমান অনুযায়ী বমবার্ডমেন্টের মাত্রােটা বাড়ানোর ফলেই এ প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে; যদিও এ বিষয়ে আমি হামবোল্টের কাছে কোনও বড়াই করিনি। তাই বোধ হয় তার মনটাও খুশিতে ভরে আছে। সে হয়তো ভাবছে তার কৃতিত্ব আমারই সমান। ভাবুক গিয়ে। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। আমাদের গবেষণা সফল হয়েছে এইটেই বড় কথা।
শুধু প্রাণীর জন্মটাই যে কালকের একমাত্র আশ্চর্য ঘটনা, তা নয়। জন্মের মুহুর্তে যে সব ব্যাপারগুলো ঘটল, তা এতই অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক যে, এখনও মনে পড়লে আমার শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ ঘণ্টা একটানা দুজনে ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে বসে ছিলাম। বরফ পড়ছে, নেপোলিয়ন এসে ল্যাবরেটরির কাপেটের উপর বসেছে, ম্যাক্স সবেমাত্র কফি দিয়ে গেছে, এমন সময় হঠাৎ একটা বাজ পড়ার মতো প্ৰচণ্ড শব্দে আমাদের দুজনেরই প্রায় হার্টফেল হবার অবস্থা। অথচ আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই; জানোলা দিয়ে বাইরে ঝলমলে রোদ দেখা যাচ্ছে। এই বজপাতের সঙ্গে সঙ্গে আবার অনুভব করলাম। একটা এক সেকেন্ডের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি। তার তেজ এত বেশি যে, ঘরের জানোলা আর টেবিলের কাচের জিনিসপত্রগুলো সব ঝনঝনি করে উঠল, আর আমরা দুজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম টেবিলের উপর। তারপর কোনও রকমে টাল সামলে নিয়ে ফ্লাস্কের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম একটা আশ্চর্য জিনিস।
ফ্লাস্কের অর্ধেকটা ছিল জলে ভর্তি। প্ৰথমে লক্ষ করলাম যে, সেই জলের উপরের স্তরে একটা যেন ঢেউ খেলছে। অত্যন্ত ছোট ছোট তরঙ্গের ফলে জলের উপরটা যেন একটা সমুদ্রের খুদে সংস্করণ।
তারপর দেখলাম ইঞ্চিখানেক নীচের দিকে জলের মধ্যে কী যেন একটা চরে বেড়াচ্ছে। সেটাকে খালি চোখে প্রায় দেখা যায় না, কিন্তু সেটা পরমাণুর চেয়ে আয়তনে অনেকখানি বড়। আর তার চলার ফলে জলের ভিতরে যে একটা মৃদু আলোড়নের সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়।