আমার শৈশব-কৈশোরে আমি এমন বাংলাদেশ দেখিনি। এমনকি যৌবনেও দেখিনি। আমার আত্মীয়স্বজনও বদলে গেছে। আমাদের পরিবার ছিলো আদর্শবান পরিবার। নামাজ পড়া, হিজাব পরা, টুপি পরার কোনও চল ছিলো না, কিন্তু সৎ, সভ্য, শিক্ষিত, সংবেদনশীল, সহানুভূতিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছে সবাই। কিন্তু হঠাৎ আমার বড়দা’র ভেতরে অদ্ভুত সব পরিবর্তন লক্ষ করছি। আমার বড়দা’র এখন মুখভরা দাড়ি। গোঁফহীন দাড়ি। আমার চিরকালের ক্লিন-শেভড-স্যুটেড-বুটেড হ্যান্ডসাম বড়দা’র মাথায় এখন টুপি, পরনে লম্বা পাঞ্জাবি। বড়দা এখন পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে, সারা দিন তসবিহ জঁপে। ছেলেগুলোকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে ধর্মান্ধও বানিয়েছে। বড়দা কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করতো, কবিতা লিখতো, গান শুনতো, সিনেমা দেখতো, ঘুরে বেড়াতো, প্রেম করতো, ছবি তুলতো, ফ্যাশন করতো, ডিজাইন করতো। যেটুকু মানবিকতা, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ছিলো, সব বিসর্জন দিয়ে এখন সে ধর্মান্ধ। আগে আমাকে দেখতে, আমি যেখানেই থাকি, ছুটে ছুটে আসতো। এখন আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করে না। বাবার মৃত্যুর পর আমার ভাগে যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছিল, তার সবই বড়দা নিজে নিয়ে নিয়েছে। আমার আপত্তিতে তার কিছু যায় আসে না। ধর্মান্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত বোধহয় স্বার্থান্ধ হওয়া। এই অন্যায়টা সম্ভবত বড়দা করতে পেরেছে ধর্মান্ধ হয়েছে বলেই। সম্ভবত ভেবে নিয়েছে অপকর্মের ফল তাকে পরকালে ভোগ করতে হবে না, যেহেতু সে সুন্নত পালন করেছে, দাড়ি রেখেছে, টুপি পরেছে, নামাজ রোজা করেছে। অনেকে তো এও বিশ্বাস করে, গুনাহ করার পর একবার হজে গেলে সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়, তাই প্রচুর গুনাহ করার পর হজের জন্য উড়োজাহাজে ওঠে।
আমার মামারা মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। এই মামাদের মধ্যে কারো কারো একই হাল। যে মামাদের সঙ্গে শৈশব-কৈশোর কেটেছে, যে মামারা ধর্মের লেবাস নিয়ে মোটেও উৎসাহী ছিলো না, সেই মামারা আজ গোঁফহীন দাড়ি রাখছে, পাঁচবেলা নামাজ পড়ছে। একজন তো জঙ্গি-আস্তানা অভিযানকে বলেই দিয়েছে নাটক। বাংলাদেশে জঙ্গি আছে বলে সে মনে করে না। তার সঙ্গে বড় সখ্য ছিল আমার। মোষের গাড়ি করে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম আমরা। একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে নতুন পতাকা হাতে আমরা উল্লাস করেছিলাম। সেই মামা। আমার জন্য যত স্নেহ ভালোবাসা ছিলো, সব কর্পূরের মতো উবে গেছে।
কলেজের বন্ধুদের প্রায় সবাই ধর্মান্ধ। বান্ধবীদের প্রায় সবার মাথায় হিজাব। অচেনা দেখায় সবাইকে। মনে হয় গত চব্বিশ বছরে কিছু একটা ঘটে গেছে দেশে। বেহেস্তের লোভের ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেশের সবখানে, ভাইরাসে আক্রান্ত সবাই। ভুতুড়ে বানিয়ে দিয়ে গেছে কেউ গোটা দেশটাকে। দেশটাকে এখন চিনতে পারি না। মানুষগুলো আর মানুষ নেই, সব জঙ্গি হয়ে গেছে। বাঙালি সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে আরবের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি ভেবে নিচ্ছে, যে আরবেরা বাঙালিদের অবলীলায় শিরশ্ছেদ করছে আরবের মাটিতে। বাঙালিদের মিশকিন বলে ঘৃণা করতে সংকোচ করে না।
যে ধর্ম নিজের আরাম-আয়েশের লোভের জন্য মানুষ করে, সে ধর্ম ধর্ম নয়। ধর্ম হলো মানবতা। জঙ্গিরা যে ধর্ম পালন করছে, সে ধর্ম অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা। যে ধর্ম আমার মা পালন করতো, পাড়ার সবার বিপদে-আপদে সাহায্য করতো, সে হলো ধর্ম। যে ধর্ম আমার বাবা পালন করতো, গরিবকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা করতো, সে হলো ধর্ম।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ মার্চ, ২০১৭
নেপাল থেকে বলছি
নেপালের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি। দারিদ্র্যটা বড় চোখে পড়ে। দেশের প্রেসিডেন্ট মহিলা। মেয়েরা ঘরের বাইরে; ইস্কুলে যাচ্ছে, চাকরি বাকরি করছে, ব্যবসা বাণিজ্য করছে। দেখে ভালো লাগে। খারাপ লাগে যখন দেখি ধর্মে আর কুসংস্কারে ছেয়ে আছে দেশ। অধিকাংশ নেপালি হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী, কিছু বৌদ্ধ ধর্মে, সামান্য ইসলামে আর ক্রিশ্চান ধর্মে। সংবিধান আর আইনের সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে নেই। কিন্তু সমাজে কুসংস্কারের যেরকম জাঁকালো উৎসব পালন হয়, দেখে গা শিউরে ওঠে।
গান্ধিমাই উৎসবে ক্ষমতার দেবী গান্ধিমাইকে তিন লক্ষ মোষ আর ছাগল উৎসর্গ করে মানুষ তুষ্ট করতে চায়, তুষ্ট হলে ভক্তদের সুখ শান্তি দেবে দেবী। কী ভয়ঙ্কর, কী নৃশংস সেই হত্যাযজ্ঞ। শুধু ছবি দেখলেই দিন রাত মন খারাপ থাকে। চোখের সামনে মোষদের কাতরানো দেখলে নিশ্চয়ই বুক ফেটে যায়। শুধু যে পশু বলি দেওয়া হয় নেপালে, তা নয়, মানুষও বলি দেওয়া হয়। বাবা মা’ই নিজেদের ছেলে মেয়েকে কোনো শুভ কাজে বলি দিয়ে দেবতাদের সুখী করতে চান। এই সেদিন সেতু তৈরি হলো, একটা বাচ্চা ছেলেকে বলি দিয়ে দেওয়া হলো।
৯৩ বছর আগেও সতীদাহ প্রথাকে নেপালে পবিত্র প্রথা বলে ঘোষণা করা হতো। ১৯২০ সাল অবধি ডাইনি-হত্যা প্রথাকেও পবিত্র বলে মনে করা হতো। এই ডাইনি-হত্যা এখনো চলছে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও। এখনো চলছে দেউকি প্রথা, যে প্রথায় মেয়েদের উৎসর্গ করা হয় মন্দিরে, দেবতাদের উদ্দেশে। এখনো চলছে চৌপাড়ি প্রথা। মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়, অস্পৃশ্য অবস্থায় দিন রাত কাটায় মেয়েরা ছোট্ট কুড়েঘরে। তাদের তখন নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় যাওয়ারও অধিকার থাকে না। তাদের অধিকার থাকে না মাছ মাংস ডিম দুধ, অথবা কোনো পুষ্টিকর খাবার। শুধু শুকনো ফল, শুকনো ভাত খেয়ে থাকতে হবে। শীতেও তাদের অধিকার নেই শীতের কম্বল ব্যবহার করার। বড়জোর ছোট কোনো চট ব্যবহার করতে পারে, ব্যস। স্নান করার অধিকার নেই। চৌপাড়ির সময় অনেক মেয়েই কিন্তু মারা যায়।