পাকিস্তান একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে চিহ্নিত। মালদ্বীপও শরিয়া আইনে বিশ্বাস করা খাঁটি মুসলমানের দেশ। ওই দুটো দেশের সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও যদি গণতন্ত্রে এবং বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তবে বাংলাদেশের মানুষের এ দুটোয় বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ তো জন্মেছেই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে। পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে। বাংলাদেশ কি এমনই একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে এখন চিহ্নিত হতে চাইছে, যে দেশ পাকিস্তানের চেয়েও বেশি মৌলবাদী? মালদ্বীপের চেয়েও বেশি অনাধুনিক?
এই কি আমার ফেলে আসা বাংলাদেশ? যে বাংলাদেশে নিজের চোখে দেখেছি ’৬৯-এর গণ আন্দোলন, একাত্তরের যুদ্ধ? একটি সেকুলার বাংলাদেশ গড়বো বলে মৌলবাদী পাকিস্তান থেকে আমরা নিজেদের সরিয়ে নিয়েছি, সেই পাকিস্তানের চেয়েও বেশি ধর্মান্ধ হয়েছি মাত্র কয়েক দশকে। আজ মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে শুধু ভিন্নমত থাকার অপরাধে খুন হয়ে যেতে হচ্ছে। আজ ধর্মই বড় পরিচয় হয়ে উঠেছে সবার, শিক্ষা আর সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে গৌণ।
সন্ত্রাসী, মৌলবাদী অনেক দেশেই আছে। ধর্ম থাকলে মৌলবাদ থাকেই। মৌলবাদ থাকলে সন্ত্রাসের জন্ম হতেই পারে। কিন্তু বাক স্বাধীনতার জন্য বা মত প্রকাশের অধিকারের জন্য সরকারকে সরব হতে হয়। দেশের রাজনীতিকদের, শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদেরও সরব হতে হয়, যেহেতু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তারা। মৌলবাদী বা সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি সমাজে থাকলে সমাজ নষ্ট হয় না। সমাজ নষ্ট হয়েছে তখনই বুঝবো, যখন মানুষকে তার ভিন্নমতের জন্য সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মারলেও সরকার চুপ থাকে, বুদ্ধিজীবীরা চুপ থাকে, কবি সাহিত্যিকরা চুপ থাকে। বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়া উচিত পাকিস্তানের কাছ থেকে। পাকিস্তানের সরকার, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী সকলে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন মাশাল খানের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। মাশাল খান ধর্মের সমালোচনা করতেন, এ কথা জানার পরও কিন্তু সন্ত্রাসী ছাড়া আর কেউ মনে করেননি তাকে খুন করা মোটেও উচিত হয়েছে।
আজ যদি বাংলাদেশ না হয়ে দেশটি পূর্ব পাকিস্তান থাকতো, তাহলে আমি নিশ্চিত দেশজুড়ে ব্লগার হত্যার প্রতিবাদ হতো। ধর্মান্ধতাকে সরিয়ে আমরা আসলে দ্বিগুণ ধর্মান্ধ হয়েছি। অত্যাচারী বৃটিশদের তাড়িয়ে নিজেরাই যেমন নিজেদের শোষণ করছি, নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে আরো বড় অত্যাচারী হয়েছি।
জুলহাজ মান্নান আর তার বন্ধুর মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হলো, অথচ সারা দেশ চুপ। যেন কিছুই ঘটেনি এক বছর আগে। মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবিরোধী মানুষ যদি এখনও একজোট না হয়, তবে দেশ ছেয়ে যাবে সন্ত্রাসীতে। দেশ ছেয়ে যাবে আপসকামীতে। দেশকে বাঁচাতে হলে এখনও সময় আছে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যেন দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। দেশের শত্রু এখন দেশের বাইরে থেকে আসে না, দেশের ভেতরেই তাদের বসবাস। এখনও সময় আছে দেশটিকে যেন সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্লগার হত্যার দেশ হিসেবে চিহ্নিত না হতে দিয়ে, সবচেয়ে উত্কৃষ্ট প্রতিবাদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। সেই প্রতিবাদী বাংলাদেশ নিয়ে আমি গর্ব করতে চাই।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭
শেখ হাসিনার জন্য দুশ্চিন্তা
শেখ হাসিনা আমার বই নিষিদ্ধ করেছেন, আমার দেশে প্রবেশে অন্যায়ভাবে বাধা দিচ্ছেন আজ বহু বছর, তারপরও দেশের কোনও রাজনীতিককে যদি সমর্থন করতে হয়, আমি শেখ হাসিনাকেই করি। কোনও দলের পক্ষে যদি দাঁড়াতে হয়, আমি শেখ হাসিনার দলের পক্ষেই দাঁড়াই। কারণ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং হাসিনা ছাড়া আমি আর কোনও রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিক দেখি না যাদের ওপর সামান্যও আস্থা রাখা যায়। হাসিনা আমার বিরুদ্ধে যত অন্যায়ই করুন, আমি বিশ্বাস করি তিনি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে কোনও অন্যায় করবেন না। বিশ্বাস করি ক্রমশ অসুস্থ হতে থাকা সমাজটাকে সুস্থ করার দায়িত্ব তিনি নেবেন। দেশের মঙ্গল করার জন্য জীবন বাজি রাখতে হাসিনা ছাড়া আর কেউ পারবেন বলে আমি মনে করি না। হাসিনা প্রগতিশীল মানুষের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করেছেন। তিনি দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন। জঙ্গি দমন করছেন। তাঁকে গ্রেনেড ছুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা হত্যা করতে চেয়েছিল, সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি, কিন্তু হাল ছাড়েননি। ভয় পেয়ে রাজনীতি ছেড়ে পালাননি।
কিন্তু এক পাল নারীবিদ্বেষী ধর্মান্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মৌলবাদীদের গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের যেভাবে সেদিন সংবর্ধনা এবং সম্মান জানিয়েছেন হাসিনা, দেখে আমি, সত্যি বলতে কী, চমকে উঠেছি। আসলে আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মৌলবাদীদের সঙ্গে একই মঞ্চে আর যাকেই মানাক, হাসিনাকে মানায় না। কে শত্রু, কে মিত্র তা বোঝার বুদ্ধি হাসিনার নেই, তা আমি বিশ্বাস করি না। হেফাজতিরা এমন ক্ষুদ্র শত্রু নয় যাদের বশ করা যায়। তারা এখন হাসিনাকে ফাঁদে ফেলে দাবি আদায় করে নেবে। কিন্তু হাসিনা যদি ভেবে থাকেন, এই মৌলবাদীরা হাসিনাকে ভোটে জেতাবে, তাহলে তিনি ভুল করছেন। বঙ্গবন্ধু নিজের শত্রুদের বন্ধু ভেবে ভুল করেছিলেন, হাসিনাও কি তাই করতে যাচ্ছেন? হাসিনা নিজের আততায়ীদেরই দুধ-কলা দিয়ে পুষছেন না তো! সত্যি বলছি, হাসিনার জন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।