নারীবাদীদের আন্দোলনের ফলে ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাদের দায়ী করাটা সভ্য এবং শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এখন অনেকটা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু যারা এখনও বন্ধ করছে না, তাদের নিশ্চিতই চক্ষুলজ্জা বলতে যে জিনিসটা প্রায় সবার থাকে, নেই।
আবার এক শ্রেণির মানুষ মনে করেন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিলেই সমাজে আর ধর্ষণ হবে না। এটা অনেকটা ধর্ষকদের দোষ দিয়ে ধর্ষণের মূল কারণকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা। ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মায় না। এই পুরুষতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, সমাজের কুশিক্ষা, ভুল শিক্ষা, নারী-বিদ্বেষ, নারী-ঘৃণা পুরুষকে ধর্ষক বানায়। ধর্ষিতাকে দোষ দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ করা যায় না। ধর্ষককে ফাঁসি দিয়েও ধর্ষণ বন্ধ করা যায় না। ধর্ষণের মূল কারণগুলোকে নির্মূল করতে পারলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে।
নারীবাদীদের শত বছরের আন্দোলনের ফলে পৃথিবীতে নারী শিক্ষা শুরু হয়েছে, নারীরা ভোটের অধিকার পেয়েছে, বাইরে বেরোবার এবং স্বনির্ভর হওয়ার অধিকার পেয়েছে, কিন্তু এই অধিকারই সব নয়, নারীর যে অধিকারটি নেই এবং যে অধিকারটি সবচেয়ে মূল্যবান, সেটি নারীর শরীরের ওপর নারীর অধিকার। নারীর শরীরকে সমাজের এবং পরিবারের দাসত্ব থেকে মুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। নারীর শরীর কোনও সমাজের সম্পত্তি বা কোনও পরিবারের সম্মানের বস্তু নয়। যতদিন নারী তার শরীরের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা না পাচ্ছে, নারীর শরীর নিয়ে নারী কী করবে, সেই সিদ্ধান্ত নারীর না হবে, যতদিন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পুরুষের, আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের, ততদিন নারীর সত্যিকার মুক্তি সম্ভব নয়। আর যতদিন এই মুক্তি সম্ভব নয়, ততদিন নারীর পরিচয় পুরুষের ‘ভোগের বস্তু’ হয়েই থাকবে ঘরে, পতিতালয়ে, রাস্তায়, অফিসে, বাসে, ট্রেনে— সবখানে। ভোগের বস্তু নারীকে ভাবা হয় বলেই যৌন হেনস্তা বা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ ঘটাতে পুরুষের কোনও অসুবিধে হয় না। পুরুষাঙ্গ মেয়েদের ধর্ষণ করে না, ধর্ষণ করে ঘৃণ্য পুরুষিক মানসিকতা। পুরুষাঙ্গ নিতান্তই একটা ক্ষুদ্র নিরীহ অঙ্গ। পুরুষিক মানসিকতা দূর করলে পুরুষেরা নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে না দেখে একই প্রজাতির সহযাত্রী স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে দেখবে। পুরুষের যৌনইচ্ছের চেয়ে নারীর যৌনইচ্ছে কিছু কম নয়। নারী যদি নিজের যৌনইচ্ছে সংযত করতে পারে, পুরুষের বিনা অনুমতিতে পুরুষকে স্পর্শ না করে থাকতে পারে, পুরুষ কেন পারবে না, পুরুষ কেন চাইলে নারীর বিনা অনুমতিতে নারীকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে পারবে না? মানুষ মাত্রই এই ইচ্ছেকে সংযত করতে পারে, কিন্তু ধর্ষকদের মধ্যে সংযত করার এই চেষ্টাটা নেই, কারণ ধর্ষকদের মস্তিষ্কের গভীরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিক্ষাটা অনেক আগেই ঢুকে গেছে যে নারী যৌনবস্তু আর পুরুষের জন্মগত অধিকার যখন খুশি যেভাবে খুশি যৌনবস্তুকে ভোগ করা। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে যে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক যদি খাদ্য ও খাদকের বা শিকার ও শিকারির হয়, তবে এ কোনও সুস্থ সম্পর্ক নয়! কোনও বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে কখনও সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। নারী তার সমানাধিকার না পাওয়া পর্যন্ত নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনও সত্যিকার সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। সমানাধিকার কে দেবে নারীকে? যারা ছিনিয়ে নিয়েছে, তাদের দায়িত্ব নারীর অধিকার নারীকে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে দেওয়া।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ মে, ২০১৭
ওরা কেন আমাদের চেয়েও ভালো
পাকিস্তান তো আছেই, মালদ্বীপও বাংলাদেশ দ্বারা সংক্রামিত। ওখানেও মুক্তচিন্তক ব্লগারদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাশাল খানকে খুন করেছে একপাল ধর্মান্ধ। মালদ্বীপেও একই ঘটনা, ব্লগার ইয়ামিন রশিদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের যে বদ হাওয়াটা এখনো পাকিস্তানে আর মালদ্বীপে পৌঁছায়নি, তা হলো চুপ করে থাকা, মেনে নেওয়া, ব্লগারদের মৃত্যুর জন্য ব্লগারদের দোষ দেওয়া। মালদ্বীপেও ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে, পাকিস্তানেও হয়েছে। প্রতিবাদ শুধু বুদ্ধিজীবীরাই করেননি, রাজনীতিকরাও করেছেন।
মাশাল খানের হত্যাকাণ্ড ভিডিওতে দেখার পর হাজারো মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদ করেছেন। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। দু’দিনের মধ্যেই ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজারো মানুষ মালদ্বীপেও প্রতিবাদ করেছেন। ইয়ামিন রশিদকে হত্যার বিরুদ্ধে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ লিখেছেন, ‘একটা সাহসী কণ্ঠস্বরকে নৃশংসভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া হলো। আন্তর্জাতিক দক্ষদের উপস্থিতিতে কোনরকম পক্ষপাতহীন নিরপেক্ষ তদন্তই একমাত্র ইয়ামিনের সুবিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। ’ মুসলিম হয়েও ইসলামি সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে কারও অসুবিধে হয়নি মালদ্বীপে।
কিন্তু বাংলাদেশে অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে জুলহাজ মান্নানসহ প্রতিভাবান লেখক সাহিত্যিক ব্লগার অ্যাক্টিভিস্টদের যে কুপিয়ে মারা হলো, এর বিরুদ্ধে পাকিস্তান বা মালদ্বীপের মতো হাজারো মানুষকে পথে নামতে কিন্তু দেখিনি। বরং ওঁরা কোথায় কী লিখেছেন, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে সরকার শাসিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও ব্লগারদের পাশে দাঁড়াননি। তিনি বলেছেন, তিনিও মুসলমান, ইসলামের বিরুদ্ধে লিখলে তার অনুভূতিতেও আঘাত লাগে। এরকম কথা পাকিস্তানের বা মালদ্বীপের কোনও প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট বলেননি। দেখে শুনে তো মনে হয় বাংলাদেশ ওসব দেশ থেকে অনেক বেশি পিছিয়ে আছে। ওসব দেশে দেশজুড়ে খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়, বাংলাদেশে হয় না। বাংলাদেশে প্রতিবাদ না হওয়ার কারণ দুটো, এক দল ভয় পায়, মৌলবাদীদের হাতে যদি হেনস্থা হতে হয়, আরেক দল বিশ্বাস করে, কোনো মুসলমানের অধিকার নেই ইসলামের সমালোচনা করার, সুতরাং মরেছে বেশ হয়েছে।