অর্ণববাবুর তিন ভাই নীচতলায় সপরিবারে থাকেন। ভাইয়েরা বিশেষ কোনও উপার্জন করেন।। তাদের সংসার বলতে গেলে অর্ণববাবুই প্রতিপালন করেন। তার বিনিময়ে এঁরা তার দেখাশোনা করেন। খাওয়া পরার ব্যবস্থা করেন। অসুখ হলে ডাক্তার ডেকে আনেন। তাঁর লেখার সময়ে টেলিফোন এলে বলেন, বাথরুমে আছেন।
অনেকের ধারণা অর্ণব দত্ত চিরকুমার, কোনও কালে দার পরিগ্রহ করেননি। কথাটা ঠিক নয়।
এখন অর্ণববাবুর বয়স প্রায় পঞ্চাশ। পঁচিশ বছর আগে একটি চলনসই সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। অর্ণব দত্ত তখনই বেশ খ্যাতনামা, নবোদিত গল্পকার। আর সেই মহিলা, যাঁর ডাক নাম ছিল মালতী, ভাল নাম ছিল সরমা আর যিনি পদ্য লিখতেন শ্রীমতী অমলিনা এই ছদ্মনামে, তখন উদীয়মতী কবি।
.
আজ এই ঘন বর্ষার সকালবেলা আদিগন্ত হ্যাং ওভার মাথায় এবং একটি বাতিল পাণ্ডুলিপি চোখের সামনে নিয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন স্মৃতিচর্চা করছিলেন অর্ণব দত্ত।
সামনের লেখার টেবিলে গতকাল রাতের আধবোতল মদ নির্বিকার পড়ে আছে, অর্ণববাবুর যত রাগ গিয়ে পড়ছে ডাক্তারসাহেবের ওপর। এ কী রকম ডাক্তার, রোগীকে মদ খাওয়ার তাল দেয়। মেডিকাল কাউন্সিল কিংবা কনজিউমার্স কোর্টে গিয়ে ডাক্তারের ভিটেতে ঘুঘু চরিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু পরক্ষণেই তার খেয়াল হয় ডাক্তারসাহেব তো লিখিতভাবে মদ খাওয়ার পরামর্শ দেননি, শুধু মুখের কথা ধোপে টিকবে না। তখন মানহানির মামলায় অর্ণব নিজেই জেলে যাবেন।
হ্যাং ওভারের ব্যাপারটা হ্যাং পার্লামেন্টের মতোই গোলমেলে। পোড় খাওয়া মাতালেরা হ্যাং ওভারটা মোটামুটি ম্যানেজ করে নেন কিন্তু অর্ণব দত্তের এটা নতুন অভিজ্ঞতা, তিনি ক্রমাগত দোল খেতে লাগলেন, ডাক্তারসাহেব জেলে যাচ্ছেন, আমি জেলে যাচ্ছি।
এরই পাশাপাশি একটা স্মৃতিচারণ কাজ করছিল অর্ণববাবুর মনে। এসব কথা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি, সেই পঁচিশ বছর আগের কথা।
গতকাল রাতে মদ খেয়ে গল্প লিখতে লিখতে কাহিনির প্রধান স্ত্রী চরিত্রের যে তিনটি নামকরণ তিনি করেছেন সেটা কোনও কাল্পনিক ব্যাপার নয়, পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে অবচেতন মনের দৌলতে। অর্ণববাবুর সেই উদীয়মতী কবিপত্নীর যে যে নাম ছিল সেগুলি ওই স্ত্রী চরিত্রে আরোপিত হয়েছে।
বিয়ের পরে মাস ছয়েক সুখে, তারপরে বছর খানেক সুখ-দুঃখে কেটেছিল অর্ণববাবুর। তবে বিবাহিত জীবনের দুর্ভোগ তার পরে আর খুব বেশি সইতে হয়নি তাকে। শ্রীমতী অমলিনা পৌনে দু বছরের মাথায় কেটে পড়েছিলেন।
অর্ণববাবুর সেই প্রথম যুগের একটা ছোট গল্প নিয়ে তখন সিনেমা করবেন ঠিক করেছিলেন এক পরিচালক। সেই পরিচালকের উপদেষ্টা তথা অভিভাবক ছিলেন নেলোদা নামে এক ব্যক্তি। খদ্দরের পাজামা, পাঞ্জাবি, পকেটে নস্যির কৌটো মুখময় বসন্তের দাগ। সব সময়ে হাসি হাসি ভাব, ডাইনে-বাঁয়ে সত্যি-মিথ্যে বলেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সবাইকে কথা দেন। একদা টালিগঞ্জের ভরাডুবি হয়েছিল যাদের জন্যে নেতোদা তার অন্যতম।
তা এই নেলোদার সঙ্গে একদিন কেটে পড়লেন শ্রীমতী অমলিনা। রাজকাপুর না দেবানন্দ কে যেন নতুন নায়িকা খুঁজছেন; কবিত্বের বদলে রূপালি পর্দার মায়াজালে আকৃষ্ট হয়ে ঘর ছাড়লেন অমলিনা।
তারপর আর অমলিনার কোনও খোঁজ নেননি অর্ণব দত্ত। এবং স্বস্তি পেয়েছিলেন এত তাড়াতাড়ি ঘাড় থেকে নেমেছে বলে। অমলিনার অবশেষে কী হয়েছিল সেটাও আর খোঁজ করেননি অর্ণব, সে স্পৃহাও ছিল না।
মধ্য দিয়ে ঝড়ের মতো বিশ-পঁচিশ বছর কেটে গেছে। প্রথম দিকে ছোটখাটো একটা টুকটাক চাকরি করেছিলেন, তারপর শুধু লেখা। সোজা গল্পে খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি, তখন বাঁকা গল্পের দিকে বেঁকেন। ব্যঙ্গ-কৌতুক, টীকা-টিপ্পনি। ফাঁকে ফাঁকে দুয়েকটা করে রস ও রহস্যের উপন্যাস। পাবলিক তার লেখা পড়ে, সেটা তাঁর রচনার চাহিদা এবং বইয়ের কাটতি দেখে টের পান অর্ণব দত্ত। তবে তিনি এটাও বুঝতে পারেন, তার যতটা নাম হয়েছে ততটা খ্যাতি-প্রতিপত্তি হয়নি।
আজকাল খ্যাতি-প্রতিপত্তি, প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি পেতে গেলে কিছুটা ভেক লাগে, কিছুটা বোলচাল লাগে। গল্পে কাহিনিতে সমাজচিন্তা, আর্থ-রাজনীতিক মশলা দিতে হয়। অর্ণব দত্তের সেসব আসে না।
সেসব চুলোয় যাক। অর্ণববাবু এসব নিয়ে আর মাথা ঘামান না। এখন তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন, রামলগনবাবুকে কী বলবেন তাই নিয়ে।
রামলগনবাবু বোধহয় এসে গেছেন। এই মাত্র নীচে কলিং বেলের আওয়াজ শোনা গেছে।
দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে বড় ভাইপো অলক উঠে এল, এসে ঘোষণা করল, রামবাবু এসেছেন। ঠিক তার পিছনেই রামলগন ছিলেন, তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন, অলক নীচে নেমে গেল।
রামলগন তেওয়ারি হৃষ্টপুষ্ট লোক। সব সময় হাসিখুশি। তার নাম শুনে যে ছবি মনে আসে তিনি মোটেই তা নন। শৌখিন মানুষ, ঘিয়ে রঙের সাফারি স্যুট পরে এসেছেন আজ, পায়ে সাদা রঙের চামড়ার চপ্পল কাম-কাবুলি।
অর্ণববাবু বসতে বলার আগেই রামলগন চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন। কপালটা বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে মুখ ব্যাজার করে অর্ণব দত্ত বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন। তিনি ইঙ্গিতে রামলগনকে চেয়ারটা বিছানার কাছে টেনে নিয়ে আসতে বললেন।
রামলগন চেয়ারটা নিয়ে অর্ণববাবুর কাছে এসে বসলেন। ঘুরে বসার সময় তার চোখ পড়ল টেবিলের ওপরে অর্ধশূন্য পানীয়ের বোতলের দিকে। একটু মৃদু হেসে বোতলটির দিকে অর্থবহ। দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রামলগন জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে আপনার?