সবাই থমকিয়ে যেতে জয়ন্ত বলল, আমার মায়ের দয়া হয়েছে। আজকের দিনেই তোমরা এলে?
এই দুঃসংবাদে সবাই হতচকিত হয়ে গেল, এই তত পরশু দিন শুক্রবারেই জয়ন্ত অফিস থেকে সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরেছে।
কিন্তু মায়ের দয়া মানে বসন্ত, মানে পক্স। এখন যদিও স্মল পক্স কদাচিৎ, চিকেন পক্স কম গোলমেলে নয়। বান্ধববৃন্দ খুব বেশি বাহাদুরি না দেখিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করল।
এর পরের ঘটনা আরও চমৎকার। বারাসত কলেজে পড়ার সময় জয়ন্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল অমলেশ। সেই অমলেশ সেলস ট্যাক্স ইনস্পক্টর হয়েছে। এখন কাজ করছে জিয়াগঞ্জে। সে কী কাজে একদিন কলকাতায় এসেছে, সেটা ছিল এক শনিবার, অফিস কাছারি বন্ধ। খুঁজে খুঁজে অমলেশ জয়ন্তের বাড়িতে সকালবেলায়। জয়ন্ত যখন অমলেশের কাছে শুনল সে দুদিন থাকবে, সে অমলেশকে বাসায় বসিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। ঘণ্টা খানেক পরে ঘামতে ঘামতে ফিরল। ফিরে এসে বলল, শনিবার পোস্ট অফিসে বড় ভিড় হয়।
অমলেশ জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ পোস্ট অফিসে কেন?
জয়ন্ত বলল, টাকা পয়সা ঘরে যা ছিল সব মানিঅর্ডার করে দিয়ে এলাম।
অমলেশ বলে, সব টাকা কাকে পাঠালে? কাকে আর পাঠাব? জয়ন্ত জবাব দেয় অফিসের ঠিকানায় আমার নামেই টাকাটা পাঠালাম।
অমলেশ অবাক। কিন্তু কেন?
জয়ন্ত বুঝিয়ে বলে, তুমি পুরনো বন্ধু। অনেকদিন পর এসেছ, দুদিন থাকবে। হঠাৎ যদি আবেগের মাথায় বেহিসেবি খরচ করে ফেলি। তিন-চার দিন পরে অফিসে তো টাকাটা পেয়েই যাব।
ইতিমধ্যে জয়ন্তের বিয়ে হয়েছে। নববধূ জয়ন্তী হাসিখুশি, দিলখোলা তন্বী তরুণী। জয়ন্তী স্বামীকে খুব একটা কাছে পায় না। শনিবার সন্ধ্যাবেলা সে স্বামীর কাছে বাগুইহাটিতে আসে। কিন্তু জয়ন্তের সেটা পছন্দ নয়। বাড়িতে বউ আসা মানেই সে বড় খরচের ব্যাপার। তার ইচ্ছে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো সে শ্বশুরবাড়িতেই কাটায়, শুক্রবার সন্ধ্যায় গিয়ে একেবারে সোমবার সকালে শ্বশুড়বাড়ি থেকে সরাসরি অফিস চলে আসবে। কিন্তু বাপের বাড়িতে জয়ন্তী লজ্জা পায়। তার ইচ্ছে নয় জয়ন্ত ঘনঘন আসে। পয়সা বাঁচবে তাই জয়ন্তর শ্বশুরবাড়ির ব্যাপারে কোনও সংকোচ নেই। তবে কোনও কোনও সপ্তাহে জয়ন্তী জোর করে স্বামীর ঘরে চলে আসে। এইভাবে চলে যায়। জয়ন্ত জয়ন্তীকে থাকতে মানা করে বলে, ছোটঘর, ছোট বিছানা। রান্না খাওয়ার জায়গা নেই। জয়ন্তী বলে, আমার কোনও অসুবিধে নেই। মাঝেমধ্যে সে আচমকা এসে জয়ন্তকে নিয়ে নিউমার্কেটে কিংবা সিনেমায় যাওয়ার চেষ্টা করে। সব সময়ে অবশ্য সফল হয় না। তখন ঘরদোর সাজায়, জানলার পর্দা টাঙায়, যাই হোক নিজের ঘর।
গত সপ্তাহে জয়ন্তের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা। সপ্তাহান্তে সোমবার দোল। নতুন জামাই দোল খেলে মঙ্গলবার শ্বশুরালয় থেকে অফিসে চলে যাবে। কিন্তু এ যাত্রায় ভাগ্য জয়ন্তীর সহায়, মধ্য সপ্তাহে বুধবার ভোরে আচমকা ঝড়ে কাটাখালি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরনো টিনের চালা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, ভাগ্যিস তখন ক্লাস হচ্ছিল না। সোমবারের আগে স্কুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এদিকে শুক্রবার বিকেলেই জয়ন্ত চলে আসবে। অনেক ভেবেচিন্তে জয়ন্তী বৃহস্পতিবার সকালে জয়ন্ত অফিস বেরোনোর আগেই নিজের বাড়িতে প্রবেশ করল।
আর মাত্র আজকের রাত। জয়ন্ত সপ্তাহশেষের খরচ বাঁচানোর আনন্দে গুনগুন করে আমার পরান যাহা চায় গাইতে গাইতে গেঞ্জি গায়ে দিচ্ছিল এমন সময় জয়ন্তীকে কাঁধে একটি ঝোলা ব্যাগ নিয়ে বারান্দায় উঠতে দেখে আঁতকিয়ে উঠল।
জয়ন্তী বলল, ভয় পেলে চলবে না। আমি এসে গেছি। দোল কাটিয়ে যাবাস্তম্ভিত জয়ন্ত বলল, এ কদিন খাবে কী, চাল-ডাল সঙ্গে কিছু এনেছ।
জয়ন্ত কিছু বোঝার আগে জয়ন্তী তাকে অচকিতে দুই বাহুতে জড়িয়ে দুদিনের না কামানো গালে চুমু খেতে খেতে বলল, আমার চাল-ডাল কিছু লাগবে না, আমি শুধু এই খাব। ছাড়ো, ছাড়ো বলে জয়ন্ত ছাড়াতে গিয়ে আরও জড়িয়ে পড়ল, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে যে। আমার দেরি হচ্ছে না, জয়ন্তী আরও জাপটিয়ে ধরল জয়ন্তকে। পুনশ্চঃ এক কৃপণের গল্প এভাবে শেষ করা উচিত নয়। আগের গল্পটায় আরও একটু জাপটা-জাপটি ছিল। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। জয়ন্ত-জয়ন্তী সুখেই আছে, দুজনেই বাগুইহাটিতে আছে।
একটি পুস্তক সমালোচনা
০১.
শ্রীমতী সুকুমারী পালদত্ত প্রণীত যত দেখি, যত জানি, যত ভাবিবইটি সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। এই একটি বইই তাঁকে বিখ্যাত করে দিয়েছে। গত বইমেলায় এই বই নিয়ে হইচই পড়ে যায়।
এ কালের যেকোনও হেঁদো সমালোচকের মতো ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের, প্রকাশক ও লেখকের মুখরক্ষা করে অথচ বেশি প্রশংসা না করে, ছাপা বাঁধাই-প্রচ্ছদ ভাল গোছের আলোচনা করার পাত্র আমি নই।
তা ছাড়া সুকুমারী দেবীকে আমি ভালই চিনি। এই বই রচনা সম্পর্কে তাঁর কাছে বিস্তর শুনেছি। এই বইয়ের প্রসঙ্গে তারই কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য।
সে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। সুকুমারী তখন অবিবাহিতা, সদ্য এম এ পাস করে একটি কনসালট্যান্ট কোম্পানিতে সাময়িক একটা সমীক্ষার কাজ করছেন। বোধহয় কোনও খবরের কাগজের ব্যাপার হবে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে লোকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, তাঁরা কী কাগজ পড়েন, কেন পড়েন ইত্যাদি ইত্যাদি।