সুতরাং, আর অত্যাচার সহ্য করা যায় না। এর একটা বিহিত করতেই হবে। আমি মরিয়া হয়ে উঠি।
যথাসময়ে মধ্যাহ্নকাল এল, আমাকে উঠতে হল, বাণীর ছোট জনাচারেক দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাকে নিয়ে যেতে। ভাল করে স্নান করলাম, মাথাটি এই গুরুতর সংকটে কিঞ্চিৎ ঠান্ডা থাকা দরকার। তারপর পায়ে পায়ে গুটি গুটি এগুনো গেল ওদের বাড়ির দিকে।
গিয়ে দেখি ত্র্যহস্পর্শ যোগ। মণিও এসেছে, বলল, দিদি এসেছে খবর পেয়ে চলে এলাম।আমি বললাম, তা বেশ। তুমিও রান্না করলে নাকি? না সবই বাণী? মণি বললে, আমি একটা মাত্র তৈরি করেছি, শুধু মশল্লা দিয়ে, শুধুই মশল্লা আর কিছু নয়, একটা মশল্লা চচ্চড়ি।মশল্লার সঙ্গে জিনিসটা। কী দিলে, কী দিয়ে চচ্চড়িটা হল? আমি একটা ছোট প্রশ্ন করি। মণি জানায়, আরে বলছি তো, শুধু মশল্লা দিয়ে আর কিছু নেই, ধনে-মৌরি চচ্চড়ি। শুধু ধনে-মৌরি? তবুও আমার সংশয় দূর না হওয়ায় মণি অসম্ভব ধমকে ওঠে। আগে খাও, খেয়ে বলো। ইতিমধ্যে বাণী এসে উপস্থিত। কপালে কালি, হাতে হলুদের দাগ, শাড়ির আঁচলেও, বিশেষ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। এসেই প্রশ্ন করল, কাঁচকলার মধ্যে নুন থাকে, জানো খোকনদা? আমি কাতর-কণ্ঠে জানাই, থাকা স্বাভাবিক। সেই কঁচকলা গরম জলে কুচি কুচি করে সেদ্ধ করে তার থেকে নুন বের করে নিয়েছি। তারপর সেই জল দিয়ে আর সব রান্না করেছি, আলাদা করে নুন দেওয়ার দরকার করেনি। বাণীর কথা শুনে আমি অভিভূত এবং মণি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে, রাণীও এসে যোগ দেয়। ওরা এরকম কোনওদিন ভাবতেই পারেনি বাণী এই পনেরোতেই যেটা করে ফেলল। ওরা বোনের জন্যে বিশেষ গর্বিতও হতে থাকে। সবচেয়ে ছোট একটি বাচ্চা ঘরের কোণে বসে পুতুলের রান্না-বান্না করছিল খুব মন দিয়ে। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে মণি বলল, দেখছ, কেমন মনোযোগী। ও বাণীর চেয়েও সরেস হবে।
ইতিমধ্যে ওদের মা চলে আসেন। এসেই হাঁকডাক শুরু করে দেন। এখনি জায়গা করে দাও, আর দেরি করো না। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে সে আর খাবারই থাকে না।
সুতরাং খেতে বসতে হল। বিচিত্র বর্ণগন্ধসমন্বিত অপূর্ব খাদ্যদ্রব্য আমার চতুর্দিকে। তাকালেই চোখে জল আসে জিভ শুকিয়ে যায়। অনুমান করি, এত প্রয়োজন ছিল না, এর যেকোনও একটিই কালান্তক হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মুখেও তাই বলি, এত করার কী ছিল, অল্প দু-একটা রান্না করতে পারতে। তোমরা এত পরিশ্রম করলে। বলতে বলতে একসঙ্গে সবগুলি তরকারি ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে মেশাতে থাকি। এই নীল রঙের পটলের ডালনাটার সঙ্গে ওই সাদা ধবধবে দুধ দিয়ে রাঁধা মাংসের ঝোলটা, তার সঙ্গে লাল টকটকে মুগের ডাল মেশাতেই একটা আশ্চর্য নতুন রং দেখা দিল। যেমন খাবারটায় তেমনি বোনেদের ও মায়ের মুখে। এবার আমি এগুলো সব চটকে মাখি, ভাত মেশাই দলা পাকাই। এই দলাটা রাণী খাবে মণি খাবে, এই দলাটা। এইভাবে এক একজনের নামে এক-একটা দলা পাকিয়ে আলাদা করে রাখতে থাকি। ওরা এক-একজনের নাম হতেই আঁতকে আঁতকে উঠতে থাকে।
খোকনদা, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ নাকি! আমরা রান্না করেছি, আমরা তো খাবই। তুমি খাও।
এইবার আমি উঠে দাঁড়াই। আজ আর আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়।
কেন? কী হল? ওরা সবাই বড় হতাশ হয়ে পড়ে, কেমন ক্লান্ত করুণ দেখায় ওদের। আমি অনেকটা থিয়েটারের অভিনেতার মতো উদাত্ত কণ্ঠে বলে যাই, আজ তোমাদের বাণীর এই সব রান্না দেখতে দেখতে আবার আমার মণির রান্নার কথা, রাণীর রান্নার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল সব কতদিন আগের কথা, সেই কবে ছোটবেলায় পুরী গিয়েছিলাম।…
পুরীর সঙ্গে, তোমার পুরী যাওয়ার সঙ্গে আমাদের রান্নার সম্পর্ক কী?মণি প্রশ্ন করে। এতক্ষণে আমি আমার জুতোজোড়ার মধ্যে পা গলিয়ে দরজার কাছে গিয়ে ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, তোমাদের রান্না, তোমাদের প্রত্যেক বোনের রান্না খেতে খেতে আমার আবার পুরীর সমুদ্রতীরের কথা বারবার মনে পড়ে। আহা, সেই শৈশব, নীল সমুদ্র, বনরাজিনীলা। বিয়োগান্ত নাটকের নায়কের মতো আমার কণ্ঠস্বর ওদের মুগ্ধ করে ফেলে, বুঝি আমার প্রাক্তন কণ্ঠের কোমলতা আবার ফিরে আসে আমার স্বরে, আমি বলে যাই তোমাদের প্রত্যেকটি খাবারে সেই পুরীর সমুদ্রতীরের স্বাদ আবার ফিরে পাই। ঠিক তেমনই লবণাক্ত, তেমনই বালুকাকীর্ণ তোমাদের প্রত্যেকটি রান্না যেমন লোনা তেমন বালি কিচকিচে। এর উপরে ভ্রমণ করা যায় কিন্তু গলাধঃকরণ করা যায় না। পুরীর সমুদ্রতীরের সেই ভ্রমণের এত সহজ আনন্দ থেকে কলকাতার লোকদের আমি বঞ্চিত করতে চাই না। এই বলতে বলতে সমস্ত খাবারগুলো আমি দ্রুতবেগে রাস্তার দিকে হাত বাড়িয়ে ছুঁড়ে দিই, নিজেকেও ছুঁড়ে দিই রাস্তায়। ছুটে যাই সেই খাবারগুলোর উপর দিয়ে লবণাক্ত বালুকাকীর্ণ রাস্তার উপর দিয়ে দৌড়ে যেতে যেতে পুরীর সমুদ্রতীরে ভ্রমণের আস্বাদ ফিরে পাই।
একটি আদ্যোপান্ত দুর্ঘটনা
এ বাসটায় খুব ভিড়। অবশ্য সব বাসেই খুব ভিড় আজকাল। শনিবার রবিবার, সকাল-বিকেল কিছু নেই, সব সময়েই লোক উপছিয়ে পড়ছে; বাসে, রাস্তায়, বাজারে, সিনেমায়। এত লোক কোথা থেকে আসে, কেন আসে, কোথায় যায়, কেন যায়, রাতে কোথায় ঘুমায়?
নির্মলা লেডিস সিটের এক প্রান্তে বসে এই সব ভাবছিলেন, ক্রমশ বাসটা যত ধর্মতলার দিকে এগোচ্ছিল, বাসে ভিড় বেড়েই যেতে লাগল। নির্মলা বসে বসে আরও ভাবছিলেন, এই রবিবারের সন্ধ্যাবেলায় এত লোক ধর্মতলায় কী করতে যাচ্ছে? এরা সবাই কি ময়দানে বেড়াতে যাচ্ছে, অথবা চৌরঙ্গিতে ফুর্তি করতে চলেছে? কিন্তু এদের দেখে তো সেরকম মনে হয় না, বেড়ানোর বা ফুর্তি করার লোকের চেহারা, সাজ-পোশাক, এমনকী মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায়।