একটু ইতস্তত করে বলল—আমাকে ছাড়া মাসীমা আর কোথাও গয়না গড়ান। তা ছাড়া, এই নেকলেসটা তাঁর বড় পছন্দ ছিল। একটা কাজ করবেন, আমার সঙ্গে একবার কানাবাঞ্ছার ডেরায় যাবে?
ভয়ে বুক ধুকধুক করে উঠল। একবার পুলিশের আড্ডায় গিয়ে মোক্ষম শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। এখন আবার চোরের ডেরায়?
চোর তো নয়, একবারে খোদ গুণ্ডারাজের আড্ডায়।
তবু স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে গোরবে সঙ্গে চেনার একটা ঘিঞ্চি বস্তিতে একটা আলাদা ঝকঝকে পাকাবাড়িতে গেলাম। একজন খবরদার এসে আমাদের (আমাদের নয়, গোরার শুধু নামটা জেনে চলে গেল। একটুক্ষণ পরে এসে বলল—যান, ভিতরে।
ভিতরে একটা এয়ারকণ্ডিশন করা মস্ত ঘর। চার দিকে সোফা কেঁচ, মেঝেতে একটা পার্সিয়ান গালিচা। সাত-আটটা বদখদ দেখতে লোক সব গালিচাতে বসে। সোফাগুলি খালি। আমরা ঢুক, সবাই কটমট করে দেখছিল। মাঝখানে একটা ডিভানে শুয়ে দুটি পা টেবিনে তুলে সিগারেট টানছিল অত্যন্ত কদাকার একটা লোক। সারা মুখে তার বসন্তে দাগ, একটা চোখ আবার কানা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গলায় একটা সোনার চেন। খালি গায়ে লুঙ্গি পরনে।
আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে গোরাকে বলল—কি গোরা সাহেব? কি মোতলব?
সে রীতিমত কুর্নিশ করে আমার পরিচয় দিয়ে বলল কয়েকদিন আগে রাত্রিতে ওঁর স্ত্রীর গলা থেকে লেকের ষ্টেশনের নিচে নেকলেসটা গায়েব। আমারই তৈরি নেকলেসটা। আর ইনি আমার মেসোমশাই।
চোখবুজে কানা বাঞ্ছা বলল—দে ওখানে যেদিন কেকে ডিউটিতে ছিল।
তারপর আমাকে খেকিয়ে উঠলকত রাত বললেন? দশটা নাগাদ? অত রাতে ওখানে কি গীতাপাঠ করছিলেন?
একজন খাতা খুলে গম্ভীর হয়ে বলল–৭ নং সেক্টরে ডিউটিতে ঐ সময়ে থাকবার কথা আবদুল বারি আর হারুর।
এবার কানা বাঞ্ছ উঠে বসল, অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল-কতবার বলেছি হিন্দু এলাকায় মুছলমান দিবি না। তবে ঐ হারামজাদা বদমাইশ ভারি দপ্তরি থাকে কি বলে?
তারপর প্রসন্ন দৃষ্টিতে আমাকে দেখে বলল, ঘাবড়াবেন না। রিপোর্টারদের আমি যাস্তি খাত্রি করি। আপনার কাগজে খবরটা বেরোনর পর বেশ ভাল বিজনেস হচ্ছে। আপনি বেফিকির চলে যান। আজ রাত্রির ৭টা নাগাদ আমার ছেলে গিয়ে আপনার মাল ফের দিয়ে আসবে। আমদের কাছে কোন তঞ্চকতা পাবেন না। ঠিক সাতটার সময়ে মাল পাবেন। তবে ওদের একটু পানিটানি খেতে দেবেন ধরুন, গোটা পঞ্চাশেক টাকা। কত পরিশ্রম ওরা করবে তা তো জানেন না।
ঠিকানা বলতে গেলাম, যে বলল–আপনার এলাকার সব বাড়ি আমি চিনি। তিনতলার সামনের ফ্ল্যাটটাতে তো, সামনে বারান্দা আছে একফালি।
ঠিক সাতটার সময়ে বাড়ির সামনে একটা মোটর সাইকেল থামল, দুটি সুদর্শন ছোঁকরা নেমে এসে আমাদের সেলাম করে বলল, সাহেব পঠিয়েছেন।
একজন পকেট থেকে প্লাস্টিকে মোড়া জিনিসটা দিল। আমার স্ত্রীতো নাচতে লেগেছে—এই তো আমার সেই নেকলেস। এই তো গোরার নাম মনোগ্রাম করা আছে পেছনে।
আমি টাকাটা দিতে গেলে ওরা হেসে বলল-স্যার ঠাট্টা করেছিলেন। আপনার। কাছ থেকে কিছু নিতে বারণ করে দিয়েছেন।
তারা নিঃশব্দে চলে গেল।
গোলমালটা বাধাল আমার স্ত্রী। আনন্দে আত্মহারার হয়ে যে সমস্ত, ফ্ল্যাটবাড়ি, পাড়া, আত্মীয়স্বজন সবাইকে জনে জনে দেখিয়ে বেড়াতে লাগল, ওরা নিজেরাই ফেরত দিয়েছে। কেউ বিশ্বাস করল না, নিশ্চয়ই উনি ওটা বেশ কয়েকদিন লুকিয়ে রেখে আবার খুঁজে পেয়েছেন বলে লাফাচ্ছেন। এও কি কখনও সম্ভব? চোর এসে গৃহস্থের কাছে চোরাই মাল ফিরিয়ে দেয়।
শিবুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—আবার সেই দাম্পত্য কলহ, আমার সম্পর্ক তোদের বউদি একেবারে ত্যাগ করেছে। বলছে, কাগজে ফলাও করে মিছামিছি এত হৈ চৈ করেছি, এখন কেউ বিশ্বাস করতেই চাইছে না যে, হারটা আমার ছিনতাই হয়েছিল। গোরার কাছে আর মুখ দেখানোর উপায় রইল না।
বললাম—গোরা মানে আপনার সেই স্যাকরা ছেলেটা? শিবুদা মুখ গম্ভীর করে বলল—সে সত্যিই খুব বিরক্ত। বলল, আপনি কি আমার নাম কাউকে বলেছেন? এ পাড়ায় গগন পিরখ নামে একজন ব্যবসাদার স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে পাটি থেকে ফিরছিল গভীর রাতে। পথে একদল লোক গাড়ি থামিয়ে তাদের সব অলঙ্কার কেড়ে নিয়েছে। এখন আমাকে এসে ধরেছে সেগুলো উদ্ধার করে দিতে। আমি অবশ্য স্রেফ বলে দিয়েছি, আপনার নেকলেস আমি উদ্ধার করে দিই নি। কি জানি আমাকে আবার কোন গণ্ডগোলে না ফাসায়, শুনলাম বিজেপির লোক সে।
শিবুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে স্ত্রীর সেই সাধের নেকলেসটি লকারে বন্ধ করে রেখেছি।