- বইয়ের নামঃ ডাইনীর বাঁশী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃগোয়েন্দা কাহিনী
০১. সরকার লজের সারদা সরকার
সরকার লজের সারদা সরকার নাকি নিহত হয়েছেন।
বিখ্যাত জুয়েলার সারদাচরণ সরকার ইদানীং বয়স হওয়ায় ব্যবসা আর দেখাশোনা করতেন না।
বীরভূম জেলাতেই একটি স্বাস্থ্যকর নির্জন স্থানে প্রায় এক বিঘে জমির উপর যে চমৎকার বাড়িটি সরকার-ভিলা, ইদানীং বৎসরখানেক যাবৎ সেইখানেই কর্মক্লান্ত জীবনের শেষকটা বছর শান্তিপূর্ণ বিশ্রামের অবসরে কাটাবেন বলে এসেছিলেন সারদাচরণ সরকার।
কলকাতায় বিরাট জুয়েলারী ফার্ম সরকার ব্রাদার্স এবং দিল্লী ও বোম্বাইয়ে তার ব্রাঞ্চ। ঐ অঞ্চলের সরকার-ভিলা ছাড়াও কলকাতায় ভবানীপুর অঞ্চলে বিরাট প্রাসাদোপম অট্টালিকা আছে।
কলকাতার বাড়িতে বর্তমানে সারদাবাবুর ভাইপো মৃতদার বৃন্দাবন সরকার সকন্যা বসবাস করছিলেন। তবে প্রায়ই তাঁকেও সপ্তাহে অন্ততঃ দুবার তো বটেই, সারদাবাবুর কাছে আসা-যাওয়া করতে হত ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতে ও পরামর্শ নিতে। এবং কখনও কখনও বৃন্দাবন সরকারকে এখানে এসে থাকতেও হত সরকার-ভিলায় ব্যবসাসংক্রান্ত ব্যাপারে দুচারদিন।
সারদাবাবুর স্ত্রী-বিয়োগ অনেক আগেই হয়েছিল এবং তাঁর কোন সন্তান-সন্ততি ছিল না।
ভাইপো বৃন্দাবন ও তাঁর একমাত্র কন্যা রেখাই যে হবেন অদূর ভবিষ্যতে সমস্ত সম্পত্তির মালিক সে কথা সকলেই জানত।
সারদাবাবু ভাইপো বৃন্দাবনকে স্নেহও করতেন খুব বেশী।
সারদাবাবুর বয়স ষাট উত্তীর্ণ হলেও কিন্তু শরীরের বাঁধুনি বেশ ভালই ছিল এবং মাথার চুলগুলো পেকে অধিকাংশই সাদা হয়ে গেলেও শরীরে যেন বার্ধক্য বা জরা দাঁত বসাতে পারেনি তখনও।
বৎসরখানেক ধরে সারদাবাবু সরকার ভিলায় বসবাস করছিলেন এবং সরকার-ভিলাতে তাঁকে ঐ বয়সে আত্মীয়পরিজনদের থেকে দূরে থাকতে হবে বলেই তাঁকে দেখাশোনা করবার জন্য প্রৌঢ় পুরাতন ভৃত্য দশরথ তো ছিলই, মাস আষ্টেক পূর্বে একটি মহিলাকেও নিযুক্ত করেছিলেন তিনি।
শুকুন্তলা ত্রিবেদী।
ইউনিভার্সিটির দরজাটা সায়েন্স ইন্টারমিডিয়েটের বেশী ডিঙোবার অবকাশ না হলেও সারদাবাবুর পড়াশুনা করবার কিন্তু একটা প্রচণ্ড নেশা ছিল।
সরকার-ভিলায় তাঁর নিজস্ব একটি গ্রন্থাগার ছিল এবং সেই গ্রন্থাগারে ইংরেজী ও বাংলা নানাবিধ পুস্তকের চমৎকার একটি সংগ্রহও ছিল।
আর ছিল তাঁর একটি নেশা বা শখ, ফুলগাছের। উক্ত দুটি নেশা নিয়েই প্রৌঢ় সারদা সরকারের অবসর যাপনের দিনগুলো একপ্রকার ভালই কেটে যাচ্ছিল।
শকুন্তলার কাজ ছিল দ্বিপ্রহরে ও রাত্রে সারদাবাবুকে বই পড়ে পড়ে শোনানো ও তাঁর নির্দেশমত মধ্যে মধ্যে হিসাবের টুকিটাকিগুলো দেখা এবং তাঁর চিঠিপত্র লিখে দেওয়া ও তাঁকে সঙ্গ দেওয়া।
কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনজন প্রার্থীর মধ্যে শকুন্তলাকেই মনোনীত করেছিলেন সারদা সরকার।
শকুন্তলা মানে মিস্ শকুন্তলা ত্রিবেদী।
বয়স শকুন্তলার ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে এবং বেঁটে রোগাটে ছিমছাম চেহারা। ঈষৎ মঙ্গোলিয়ান টাইপের মুখখানা ও গাত্রবর্ণ হরিদ্রাভ।
শকুন্তলার মুখেই শুনেছিলেন সারদা সরকার, প্রথমে অফানেজে ও পরে রেঙ্গুনের এক কনভেন্টে সে নাকি মানুষ হয়েছে ও লেখাপড়া শিক্ষা করেছে।
এক ইংরাজ মিলিটারী বাপের ঔরসে ও বর্মী মার গর্ভে তার জন্ম।
বরাবর রেঙ্গুন শহরেই সে ছিল, তারপর কিছুদিন এক বিলাতী জাহাজ কোম্পানীতে স্টুয়াড্রেসের কাজও করেছিল। তারপর সে চাকরি ভাল না লাগায় কলকাতায় এসে উঠেছিল অন্য কোন জীবিকার অন্বেষণে।
ঐসময় কাগজে সারদাবাবুর বিজ্ঞাপন দেখে সে একটা দরখাস্ত করে দেয়।
ইন্টারভিউর সময় শকুন্তলার চেহারা দেখে ও তার কথাবার্তা শুনে সারদা সরকার প্রীত হয়েই তাকে দুইশত টাকা মাহিনায় নিযুক্ত করেছিলেন আট মাস পূর্বে।
সেই থেকেই শকুন্তলা ত্রিবেদী সরকার-ভিলাতেই আছে।
ঘটনার সময় শকুন্তলা ত্রিবেদী ও ভৃত্য দশরথ ছাড়াও সরকার-ভিলাতে আরও ছয়জন প্রাণী ছিল।
ঠাকুর হরিদাস, দারোয়ান রামভজন, ভৃত্য নকুল, দাসী পিয়ারী ও মালী জগন্নাথ এবং সম্প্রতি নিযুক্ত বেয়ারা কেতু।
আগেই বলা হয়েছে বই পড়ার নেশা ছাড়াও সারদা সরকারের আর একটি নেশা ছিল, সেটা হচ্ছে ফুলগাছের।
সরকার-ভিলার চৌহদ্দির মধ্যে পশ্চাতের অংশে বিরাট একটি বাগান নিজ হাতেই প্রায় বলতে গেলে তৈরি করেছিলেন তিনি।
নানাজাতীয় দুষ্প্রাপ্য ফল ও ফুলের গাছ তো ছিলই, তবে বিশেষ করে তার মধ্যে বেশী ছিল নানাবিধ ফুলের গাছ এবং তার মধ্যে আবার বেশীর ভাগ হচ্ছে নানা জাতীয় গোলাপের
গাছ বাগানটির মধ্যে।
প্রত্যহ ভোরে উঠে বেলা আটটা পর্যন্ত প্রায় ঐ বাগানের মধ্যেই মালীকে নিয়ে কেটে যেত সারদা সরকারের এবং সঙ্গে শকুন্তলাও থাকত প্রায় ঐ সময়টা।
তারপর ঘরে এসে স্নান করে চা পান করতেন।
দ্বিপ্রহর ও রাতটা কাটত তাঁর পড়াশুনা নিয়ে, সে সময় সঙ্গে থাকত শকুন্তলা সর্বক্ষণই প্রায়।
সারদা সরকার বাড়ি থেকে কখনই বড় একটা বেরুতেন না। এবং স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিশতেন না।
সেই কারণেই গত এক বৎসর ধরে তিনি সরকার-ভিলায় থাকলেও স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে সারদা সরকার একপ্রকার অপরিচিতই যেন রয়ে গিয়েছিলেন।
তথাপি সারদা সরকারের আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারটা হাওয়ার বেগেই যেন ভোরবেলা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল ছোট শহরটির সর্বত্র।
০২. সময়টা পূজার ছুটির অব্যবহিত পরেই
সময়টা পূজার ছুটির অব্যবহিত পরেই। অর্থাৎ অগ্রহায়ণের শুরু সবে।
সুশান্ত, বিনয় ও ফ্যাটি গুপ্ত, দি ফেমাস্ ট্রায়ো জায়গাটা স্বাস্থ্যকর বলে এবং বিশেষ করে নির্জন ও নিরিবিলি বলে বিনয়ের বাবার যে ছোট বাড়িটি সরকার-ভিলার প্রায় কাছাকাছি ছিল সেই বাড়িতে এসে মাসখানেক ধরে বাস করছিল।
সুশাস্তর একটু বেলা করে ওঠাই অভ্যাস।
কিন্তু বিনয়ের ডাকাডাকিতে অসময়েই ঘুমজড়িত চক্ষু দুটি রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল সুশান্ত, কি হল, ডাকাত পড়েছে নাকি? ভোরবেলাতেই ষাঁড়ের মত চেঁচামেচি শুরু করেছিস কেন?
ব্যাপার শুনেছিস, ওদিকে যে হুঁলুস্থুল কাণ্ড!
কেন, কি আবার হল?
সরকার-ভিলার সেই যে বুড়ো সারদা সরকার, কাল রাতে কে নাকি তাকে শেষ করে দিয়েছে।
মানে?
মানে আর কি–খতম!
সে কি!
হ্যাঁ, একটু আগে দেখলাম বিমল দারোগা সরকার-ভিলার দিকে গেল। যাবি নাকি ব্যাপারটা দেখতে?
নিশ্চয়ই। উৎসাহে উঠে পড়ে সুশান্ত।
বিমল মানে ওদেরই কলেজের সহপাঠী ঐ জায়গার থানা ইনচার্জ বিমল সেন, ওদের ভাষায় বিমল দারোগা।
এখানে আসা অবধি প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে বিমল থাকলে ওরা থানায় তার কোয়ার্টারে গিয়ে আড্ডা জমাতো। কাজেই বিমল যখন এখানখার থানা ইনচার্জ, মানে সে-ই এখানকার হতাকা সরকার পক্ষের, তখন সরকার-ভিলাতে তাদের প্রবেশের ব্যাপারে কেউ বাধাদান করতে সাহস করবে না এটা ওরা জানত। এবং এমন একটা উত্তেজনার ব্যাপার যখন, তখন সুশান্ত আর বিনয় দেরি করে না। তারা সরকার-ভিলার উদ্দেশ্যে চটপট তৈরী হয়ে নিয়ে বের হয়ে পড়ল।
ফ্যাটি গুপ্তর ওসব সত্যিকারের খুনখারাপীর ব্যাপারে কোনদিনই কোন ইন্টারেস্ট নেই, বরং তার চাইতে তার গ্রন্থে বর্ণিত কল্পনার খুনখারাপীর ওপরেই বেশী আকর্ষণ বরাবর–অথাৎ ডিটেকটিভ সাহিত্যে।
অতএব সে ভৃত্য রামহরিকে আর এক দফা চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা রোমাঞ্চ সাহিত্য নিয়ে বসল।
সুশান্ত, বিনয় ও ফ্যাটি অভিন্নহৃদয় বন্ধু বহুদিনের।
যদিও তিনটি বন্ধুর প্রকৃতি ও আকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন একে অন্যের থেকে, তথাপি কি করে যে তিনজনের মধ্যে বিচিত্র একটি ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল সেটাই আশ্চর্য!
সুশান্তর বলিষ্ঠ পেশল উঁচু লম্বা চেহারা। একমাথা কটা চুল, চোখ দুটি নীল ও বুদ্ধির দীপ্তিতে ঝকঝক করে। এম. এ. পাস করে বর্তমানে কলকাতার কোন একটি বেসরকারী কলেজের অধ্যাপক। সংসারে এক বিধবা মা ব্যতীত অন্য কোন বন্ধন নেই।
বিনয় রোগাটে লম্বা, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল-শ্যাম, কবিজনোচিত ভাবুক প্রকৃতি এবং যেমন দিলখোলা তেমনি আমুদে। ব্যবসায়ী ধনী পিতার একমাত্র ছেলে। এম. এ. পাস করার পর কি একটা থিসিস্ নিয়ে ব্যস্ত বর্তমানে।
আর ফ্যাটি গুপ্ত-আসলে ওর নাম বিপিন গুপ্ত। বাপ-পিতামহের কেশতৈলের বিরাট একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সারাটা বৎসর ধরে সে ব্যবসা থেকে প্রচুর অথাগম হয়।
বৎসর দুই হল ডাক্তারী পাস করে কলকাতা শহরেই কোন এক বড় রাস্তার উপর বিরাট এক ডিসপেন্সরী করে শখের প্র্যাকটিস শুরু করেছে।
দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় সমান চেহারা, থলথলে চর্বিবহুল। মাথাটা ছোট, কুতকুতে চোখ। আবলুশ কাঠের মত গাত্রবর্ণ। ঐ বিচিত্র আকৃতির জন্যই বিনয় ওর নামকরণ একদা কলেজ লাইফেই করেছিল : ফ্যাটি গুপ্ত।
ক্রমে সেই নামটিই বন্ধুমহলে বিশেষরকম প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। আসল নামটি যেন পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের দল একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিল।
ফ্যাটির স্বভাবটি কিন্তু আমুদে ও হাসিখুশি।
তিন বন্ধুই অদ্যাবধি ব্যাচিলর অর্থাৎ অবিবাহিত। তবে মনোমত জীবনসঙ্গিনী পেলে বিবাহে তিনজনেই নাকি প্রস্তুত-ওরা তিনজনেই এই কথা বলে থাকে।
সুশান্ত ও বিনয় যখন সরকার-ভিলার গেটের সামনে এসে পৌঁছল, সেখানে তখন শহরবাসীর বেশ একটি ছোটখাটো ভিড় জমে উঠেছে। তবে প্রহরারত লালপাগড়ির রুলের গুতোর ভয়ে গেট থেকে একটা ব্যবধান রেখেই তারা দাঁড়িয়ে ছিল সরকার ভিলার সামনে। যে লালপাগড়ি প্রহরীটি গেটের পাশেই প্রহরারত ছিল, বিনয় ও সুশান্তকে সে চিনতে পেরে ভিতরে প্রবেশে বাধা দিল না।
দুজনে গেট দিয়ে সরকার-ভিলাতে প্রবেশ করল।
গত মাসখানেক ধরে এখানে আসা অবধি নিয়মিত যাতায়াতের পথে দুর থেকে সুন্দর ঝকঝকে সাদা রঙের দোতলা সরকার-ভিলাটি বহুবারই ওদের দৃষ্টিপথে পড়েছে ইতিপূর্বে।
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তার বেশী কিছু নয়। কারণ বিনয়ের মুখেই শুনেছিল সরকার-ভিলার মালিক সারদা সরকার কারও সঙ্গেই নাকি মেশেন না।
একটি বিচিত্র টাইপের ব্যক্তিবিশেষ নাকি।
এগিয়ে চলে দুজনে গেট থেকে যে কাঁকর-ঢালা রাস্তাটি বরাবর গিয়ে সরকার-ভিলার বারান্দার সামনে শেষ হয়েছে সেই রাস্তাটি অতিক্রম করে।
রাস্তার দুপাশে নানাজাতীয় স্যভুরক্ষিত ও বর্ধিত দেশী-বিলাতী পাতাবাহার ও ফুলের গাছ।
বারান্দাটির সামনে লোহার গ্রীল বসানো।
বারান্দায় পিতল, চীনা-মাটি ও সাধারণ মাটির টবের মধ্যে নানাজাতীয় মরশুমী ফুলের বর্ণ-বৈচিত্র্যের মনোরম সমারোহ।
একপাশে একটি খাঁচায় অনেকগুলো মনুয়া পাখী কিচিরমিচির শব্দ করছে।
বারান্দায় পা দিতেই আর একজন সমৃ লালপাগড়ির সঙ্গে ওদের চোখাচোখি হল, সেও ভাগ্যক্রমে ওদের অপরিচিত নয়।
সুশান্তই প্রশ্ন করে সেই লালপাগড়িকে, দারোগা সাব কাহা পাঁড়েজী?
জি অন্দরমে—
ভিতর যানে সেকতা?
কিউ নেই-যাইয়ে না! অভয় দিল লালপাগড়ি।
দুজনে আবার অগ্রসর হয়।
বারান্দার সামনেই পারলার।
দরজার ভারী পর্দা তুলে দুজনে ভিতরে পা দিল।
ঘরটি আধুনিক রুচিসম্মত আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। ঘরের মধ্যে কেউ তখন ছিল না।
কোন্ দিকে অগ্রসর হবে এরা ভাবছে, কারণ ঘরের দুদিকে দুটি দরজা ওদের নজরে পড়েছে। ঐসময় একজন ভৃত্য এসে ঘরে প্রবেশ করল।
কাকে চান?
দারোগা সাহেবের লোক আমরা। সুশান্ত বললে।
ও, ভিতরের ডানদিককার ঘরে যান, দাদাবাবুর ঘরে আছেন তিনি।
দুজনে আবার নির্দিষ্ট ঘরের দিকে অগ্রসর হল।
সে ঘরটিও আকারে বেশ প্রশস্তই। এবং রুচিমাফিক দামী আসবাবে সুসজ্জিত। বলা বাহুল্য বিমল ঐ ঘরের মধ্যেই ছিল।
তার অ্যাসিস্টেন্ট শ্ৰীমন্ত চৌধুরী এ. এস. আই-য়ের সঙ্গে নিম্নকণ্ঠে কি যেন আলোচনা করছিল ঐ সময়ে ঘরের মধ্যে।
বিমল ওদের ঐ সময় ঐখানে দেখে প্রশ্ন করে, এ কি, তোমরা! কি ব্যাপার?
এই এলাম।
বিমলই হেসে বলে, তোদর সাহস তো কম নয়, খুনখারাপীর ব্যাপার দেখতে এসেছিস।
সত্যি-সত্যিই তাহলে সারদাবাবু খুন হয়েছেন?
সঙ্গে সঙ্গে যেন বিমল দারোগা চাপাকণ্ঠে সুশান্তকে সতর্ক করে দিয়ে এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, সেই রকমই তো মনে হচ্ছে-সুইসাইড নয়, এ কেস অফ হোমিসাইড বা পয়েজনিং হবে।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সুশান্ত বিমলের দিকে।
পয়েজনিং হবে–বিষ!
তাই তো মনে হচ্ছে। তা দেখবি নাকি?
সেইজন্যই তো এলাম। সুশান্ত বলে।
দেখে আবার ভয় পাবি না তো?
সুশান্ত মৃদু হাসে প্রত্যুত্তরে।
০৩. নিছক যে একটা উত্তেজনা
নিছক যে একটা উত্তেজনা বা কৌতূহলের বশবর্তী হয়েই সুশান্ত সরকার-ভিলায় এসেছিল
তা নয়।
মাস-দুই পূর্বে একটা সুইসাইডের বিচিত্র রহস্যপূর্ণ মামলার ব্যাপারে ঘটনাচক্রে সুশান্ত ও বিনয়ের বিখ্যাত সত্যসন্ধানী কিরীটী রায়ের সঙ্গে আলাপের সৌভাগ্য হয়েছিল।
সেই সময় থেকেই উভয়ের মন, বিশেষ করে সুশান্তর এই ধরনের রহস্যপূর্ণ তদন্তের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড হয়ে ওঠে।
সেই ইন্টারেস্টেই ওরা সরকার-ভিলায় এসেছিল মূলত খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
বাড়িটা সর্বসমেত দোতলা, পূর্বেই বলা হয়েছে। একতলায় খানপাঁচেক ও দ্বিতলে চারিটি ঘর।
দ্বিতলেরই দক্ষিণ প্রান্তের ঘরে বিমলের সঙ্গে সঙ্গে ওরা এসে প্রবেশ করল। সেই ঘরের মধ্যেই মৃত অবস্থায় সারদাচরণ সরকারকে পাওয়া গিয়েছে ঐদিন প্রত্যুষে।
বেশ প্রশস্ত ঘরখানি।
মেঝেতে দামী কার্পেট বিস্তৃত।
দেওয়ালে চারিদিকে দক্ষ চিত্রকরের আঁকা বিচিত্র মনোরম সব জাপানী ল্যাণ্ডস্কেপ। একধারে একটি দামী পালঙ্কে তখনও বেডকভার দিয়ে ঢাকা শয্যা।
শয্যাটি একেবারে নিভাঁজ।
ঘরের অন্য ধারে একটি ছোট রাইটিং টেবিল।
একখানা মোটা কি ইংরাজি বই ভোলা রয়েছে টেবিলের উপরে এবং তার পাশেই একটা মোটা বাঁধানো খাতা ও মুখবন্ধ একটি পাকার ঝরনা-কলম রয়েছে। তার পাশে একটি নিঃশেষিত চায়ের কাপ ও প্লেট। এবং কোরামিনের একটা শিশি।
টেবিলের উপরে টেবিল ল্যাম্পটি তখনও জ্বলছে। তার পাশেই সুদৃশ্য একটি জার্মান টেবিল ক্লক টিকটিক শব্দ করে চলেছে অন্তহীন সময়-সমুদ্রের বক্ষে যেন।
ঘরের পূর্ব দিকে ও দক্ষিণ দিকে দুটি গরাদহীন পাল্লা খোলা জানলা।
পূবের জানলার পাশেই একটি গডরেজের ছোট লোহার সিন্দুক। পালঙ্কের শিয়রের দিকে একটি টিপয়। তার উপরে একটি কাঁচের গ্লাসভর্তি জল ঢাকনি দিয়ে ঢাকা।
সারদাবাবুর মৃতদেহটা সেই রাইটিং টেবিলটারই সামনে পড়ে রয়েছে দেখা গেল এবং অল্প দূরে একটি গদি-আঁটা চেয়ার উল্টে রয়েছে মেঝেতে মৃতদেহের সামনে।
মৃতের পরিধানে পায়জামা ও গেরুয়া বর্ণের মিহি খদ্দরের পাঞ্জাবি।
একটি হাত বুকের তলায় চাপা পড়েছে, মৃতের অন্য হাতটি প্রসারিত মুষ্টিবদ্ধ।
পায়ে রবারের চপ্পল ছিল। চপ্পলজোড়া পাশে পড়ে আছে।
মৃতের মুখটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল।
প্রাণ না থাকলেও সেই মুখের প্রতিটি পেশীতে মর্মান্তিক যাতনার একটা চিহ্ন যেন সুস্পষ্ট হয়ে ছিল তখনও।
শেষ মুহূর্তের মৃত্যু-যন্ত্রণার সুস্পষ্ট চিহ্ন।
সত্যিই সে মুখের দিকে যেন তাকানো যায় না।
বিকৃত বিস্ফারিত ওষ্ঠের কষ বেয়ে লালা ও গ্যাঁজলা বেরুচ্ছে তখনও।
মৃদুকণ্ঠে সুশান্ত বিমলকে সম্বোধন করে বললে, তোর কি সত্যিই মনে হয় এটা সুইসাইড নয়?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন? ভদ্রলোক সুইসাইডই যে করেননি বুঝলি কি করে? নিম্নকণ্ঠেই আবার প্রশ্ন করল সুশান্ত।
প্রত্যুত্তরে বিমল মৃদু পুলিসী হাসি হাসল।
চল, এখনও জবানবন্দি নেওয়া হয়নি, পাশের ঘরে বৃন্দাবনবাবু অপেক্ষা করছেন আমার জন্য।
বৃন্দাবনবাবু!
হ্যাঁ, সারদাবাবুর একমাত্র ভাইপো আর কলকাতা বোম্বাই ও দিল্লীর সরকার ব্রাদার্স বিরাট প্রতিষ্ঠানটির এবং কলকাতা ও এখানকার বাড়ির একমাত্র ওয়ারিশন ও বর্তমান মালিক।
কেন, আর কেউ ওয়ারিশন নেই বুঝি?
এখন পর্যন্ত তো তাই শুনছি। এখন দেখা যাক, জবানবন্দি থেকে কিছু জানা যায় কিনা।
চল চল! সুশান্ত বলে!
সকলে এসে পাশের ঘরে ঢুকল। নাতিপ্ৰশস্ত ঘরটি। এবং ঐ ঘরটিই ছিল মৃত সারদাবাবুর প্রিয় লাইব্রেরী বা গ্রন্থাগার।
চারিদিকে সুদৃশ্য সোকেসে থাকে থাকে সব বই সাজানো। অসংখ্য বই।
এ ঘরেও সুদৃশ্য কার্পেট বিছানো এবং ঘরের মধ্যস্থলে খান-দুই আরামকেদারা ও একটি গোলাকার নিচু টেবিল।
একটি আরামকেদারার উপরেই বসেছিলেন বৃন্দাবন সরকার।
সকলে ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রলোক নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন।
বয়স ত্রিশ থেকে বত্রিশের মধ্যে হবে বলেই চেহারা দেখে মনে হয় ভদ্রলোকের।
তবে বেশ হৃষ্টপুষ্ট-যাকে বলে গোলগাল চেহারা।
গৌরবর্ণ। পরিধানে ধপধপে দামী কাঁচির ধুতি ও গায়ে দামী একটা শাল জড়ানো। পায়ে দামী চপ্পল।
মাথার চুল রুক্ষ এলোমেলো। মুখে একদিনের দাড়ি। বোঝা যায় তখনো ক্ষৌরকর্ম সমাধান হয়নি।
বসুন, বসুন বৃন্দাবনবাবু। আমাদের কথাবার্তা বসে বসেও চলতে পারে। বিমল বললে।
বৃন্দাবন আর দ্বিরুক্তি না করে পুনরায় সোফার উপরে বসে পড়লেন তখুনি।
এবং বিমলই অতঃপর প্রশ্ন করতে শুরু করে বৃন্দাবনবাবুকে।
আপনি কি এখানেই বরাবর থাকেন?
না। তবে প্রায় প্রতি হপ্তায়ই আসি। পরশু রাত্রে গাড়িতে এসেছিলাম, আজই সকালে আমার কলকাতায় ফিরে যাবার কথা ছিল।
ও। আচ্ছা আপনার কাকামশাইয়ের মৃত্যুটা আপনার কি বলে মনে হয় মিঃ সরকার?
কি বলব কিছুই বুঝতে পারছি না দারোগাবাবু! ব্যাপার যা দেখছি তাতে তো মনে হচ্ছে সুইসাইডই করেছেন। কিন্তু–
কি?
তাঁর মত লোক সুইসাইড করতে পারেন অ্যাটঅল, আমার চিন্তারও অতীত। তাছাড়া সুইসাইডই বা তিনি করতে যাবেন কেন এ বয়সে, কোন হেতুই তো ছিল না।
আপাতদৃষ্টিতে সেটা আমাদের চোখে না পড়লেও একেবারে যে থাকতে পারেই না তাও তো নয় মিঃ সরকার। গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিল বিমল।
তা অবিশ্যি ঠিক। তবে—
তাছাড়া উনি সুইসাইডই যে করেছেন, তাই বা আমরা ধরে নিচ্ছি কেন মিঃ সরকার।
কি বলতে চান আপনি? কথাটা বলে উৎকণ্ঠিত ভাবে তাকালেন বৃন্দাবন সরকার বিমলের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, এ কেস অফ হোমিসাইডও তো হতে পারে। তাঁকে কেউ হত্যাও তত করে থাকতে পারে।
০৪. বিমলের অতর্কিত প্রশ্নটা
বিমলের অতর্কিত প্রশ্নটায় যেন সহসা ভূত দেখার মতই চমকে উঠলেন বৃন্দাবন সরকার। এবং কয়েকটা মুহূর্ত তাঁর কণ্ঠ দিয়ে একটি শব্দও বের হল না।
তারপর যেন আত্মগতভাবেই বললেন বৃন্দাবন, এ–এ আপনি কি বলছেন দারোগাবাবু?
বলছিলাম ওঁকে কেউ হত্যাও তত করে থাকতে পারে!
হত্যা? হাউ অ্যাবসার্ড? হাউ ইমপসিবিল! না, না-হত্যা তাঁকে কে করবে আর করতেই যা যাবে কেন?
আরে মশাই, কে করতে পারে সে তো পরের কথা। আপাততঃ সেদিকটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে বৈকি। কিন্তু যাক সে কথা। তার আগে কতকগুলো কথা আমার জানা প্রয়োজন।
কিন্তু–
শুনুন মিঃ সরকার, জানেন তো আমাদের পুলিসের মন বড় সন্দিগ্ধ, তাই অসম্ভবকে আমরা সম্ভব বলেই ধরে নিই। যাক যা জিজ্ঞাসা করছিলাম, গতকাল যখন আপনি এখানে ছিলেন আপনার কাকামশাইয়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার কথাবার্তা হয়েছে?
হ্যাঁ, তা হয়েছে বৈকি।
কি বিষয়ে আপনাদের কথাবার্তা হয়েছিল বলতে যদি আপনার আপত্তি না থাকে—
আপত্তি থাকবে কেন? কথাবাতা গতকাল যা হয়েছে তা আমাদের ব্যবসা সম্পর্কেই। কারণ ঐ ব্যবসা সম্পর্কে কথাবার্তা বলতেই হপ্তায় অন্ততঃ দুবার করে এখানে আমাকে আসতে হচ্ছিল ইদানীং।
গতকাল আপনার কাকার কোন কথায় বা ব্যবহারে কোন চাঞ্চল্য ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন কি কোন সময়?
না কাকার প্রকৃতিই ছিল যেন সোবার, শান্ত। কখনও মনে পড়ে না, কোন কারণে কাকাকে জ্ঞানতঃ চঞ্চল বা উত্তেজিত হতে দেখেছি। অতি বড় আনন্দের ব্যাপারেও যেমন তাঁর উল্লাস ছিল না, তেমনি নিদারুণ ক্ষতি বা নিরানন্দের ব্যাপারেও তাঁকে কখনও তেমন ম্রিয়মাণ মুহ্যমান হতে দেখিনি বড় একটা।
হুঁ। আচ্ছা তার কোন শত্রু ছিল বলে জানেন?
শত্রু! না
এ বাড়িতে যেসব চাকরবাকর ও অন্যান্য যারা সব আছে তারাও কি, আপনি মনে করেন, বিয়ও অল সাসপিসন?
নিশ্চয়ই। সবাই তো অনেকদিনের পুরনো লোক, একমাত্র শকুন্তলা ছাড়া।
শকুন্তলা! হুঁ ইজ সি?
কাকার পার্সোন্যাল অ্যাটেনডেন্ট সে। কাকার লেখাপড়ার কাজ করে দেওয়া, তাঁকে বই পড়ে শোনানো ইত্যাদির ব্যাপারে মাস-আষ্টেক হল কাকা তাকে অ্যাপয়েন্ট করেছিলেন।
হুঁ। তাঁর সঙ্গেও কথাবার্তা বলতে চাই।
ডেকে আনব?
না, একটু পরে। একটা কথা মিঃ সরকার, কাল রাত্রে সর্বশেষ কখন আপনার কাকামশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হয়?
কাকা সাধারণতঃ একটু রাত করেই শুতেন, কারণ—
থামলেন কেন, বলুন?
অনেকদিন থেকে হার্টের প্যালপিটেশনে ভুগছিলেন, তারপর ইদানীং মাসকয়েক থেকে শুনছিলাম তিনি এক নতুন উপসর্গ ইনসমনিয়াতেও ভুগছিলেন নাকি।
নিদ্রাহীনতার আর হৃৎপিণ্ডের দৌর্বল্য?
হ্যাঁ।
সেজন্য কোন ঔষধপত্র খেতেন কি?
মধ্যে মধ্যে শুনেছি কোরামিন আর ইদানীং ডাক্তারের পরামর্শে ঘুমের জন্য লুমিনল ট্যাবলেট খেতেন। শকুন্তলা দেবীই একদিন আমাকে বলছিল কথাটা।
কোন ডাক্তার তাঁকে দেখতেন?
কলকাতার ডাঃ আর. এন. চৌধুরীই বরাবর তাঁকে দেখতেন। হপ্তায় একবার তিনি এখানে আসতেন।
হুঁ। আচ্ছা তারপর যা বলছিলেন বলুন গতরাত্রের কথা।
চিরদিনই আমার একটু সকাল সকাল সোওয়া অভ্যাস। রাত দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়ি আমি। কিন্তু কাকার সঙ্গে তাঁর ঘরেই বসে গতরাত্রে জরুরী ব্যবসা-সংক্রান্ত কতকগুলো আলোচনা করতে করতে কাল শুতে আমার প্রায় পৌনে এগারোটা হয়ে গিয়েছিল।
সারদাবাবুর ঘরে আপনি কাল কত রাত পর্যন্ত ছিলেন মনে আছে?
রাত এগারোটা বাজলে আমি উঠি।
হুঁ। তাহলে রাত এগারোটায় শেষ আপনি গতকাল তাঁকে জীবিত দেখেছিলেন?
হ্যাঁ। আজ সকালে কখন জানলেন যে উনি মৃত?
দশরথই এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে সংবাদটা দেয়।
ও, দশরথই তাহলে সর্বপ্রথম এ বাড়িতে আজ দেখেছে—জানতে পেরেছে যে আপনার কাকামশাই মৃত!
না।
তবে?
সর্বপ্রথম জানতে পারে ব্যাপারটা শকুন্তলাই।
শকুন্তলা? আই সি। তা তিনি কখন জানতে পারেন?
খুব ভোরে। শকুন্তলা কাকার ঘরে গিয়েই—
কিন্তু অত ভোরে সে ঘরে কেন তিনি গিয়েছিলেন?
কাকার বাগানে নানা জাতের সব রেয়ার গোলাপ আছে, সেই গোলাপের গাছেরই কি সব সার সম্পর্কে শকুন্তলা নাকি গতকাল দুপুরে কি একটা সারের সম্পর্কে বই থেকে পড়ে কাকাকে বলেছিল, তাই কাকা বলেছিলেন শকুন্তলাকে আজ খুব ভোরে তাঁর সঙ্গে বাগানে যাবার জন্যে যখন তিনি যাবেন। তাই বোধ হয় শকুন্তলা কাকার ঘরে গিয়েছিল তাঁকে ডাকতেই।
আই সি। আচ্ছা এই শকুন্তলা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা মিঃ সরকার?
নো নো-সি ইজ অ্যাবসলুটলি বিয়ও অল সাসপিসন। সি ইজ এ পারফেক্ট লেডি।
ঠিক আছে। আপনি এবারে অনুগ্রহ করে শকুন্তলা দেবীকে এ ঘরে যদি একটু পাঠিয়ে দেন মিঃ সরকার! তাঁকেও আমার কিছু প্রশ্ন করবার আছে।
নিশ্চয়ই, এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি-বলে বৃন্দাবন সরকার সোফা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তখুনি।
বৃন্দাবন সরকার ঘর ছেড়ে চলে যেতেই মৃদুকণ্ঠে এতক্ষণে সুশান্ত কথা বলে, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস বিমল?
কি? বিমল সুশান্তর মুখের দিকে তাকালো।
কাকার অ্যাটেনডেন্ট অথচ ভদ্রলোকের ভাইপোটি এমন অবলীলাক্রমে শকুন্তলা, শকুন্তলা বলে নামটা উচ্চারণ করছিলেন–
মৃদু হেসে বিমল বললে, অল্পবয়সে স্ত্রী-বিয়োগ ঘটেছে, তা একটু-আধটু–
হুঁ, তাই তো মনে হচ্ছে শকুন্তলার দুষ্মন্ত—
সহসা ঐসময় ঘরের বাইরে পদশব্দ শুনে বিমল বললে, চুপ-শকুন্তলা আসছে বোধ হয়!
শকুন্তলা এসে ঘরে প্রবেশ করল।
ছিপছিপে রোগা, একটু বেঁটে এবং মুখখানি মঙ্গোলিয়ান টাইপের হলেও অদ্ভুত একটা আলগা শ্ৰী আছে যেন শকুন্তলার চেহারায় ও মুখখানিতে।
দেখার সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মাথার পর্যাপ্ত চুল দুটি বিনুনীর আকারে বক্ষের দুপাশে লম্বমান।
সাধারণ একটি কালোপেড়ে তাঁতের শাড়ি যৌবনপুষ্ট দেহে চমৎকার মানিয়েছে।
হাতে একগাছি করে কঙ্কণ এবং দুকানে দুটি নীলার টাব। আর দেহে কোথাও কোন অলঙ্কার বা আভরণ নেই। পায়ে চপ্পল। কিন্তু ঐ সামান্য অনাড়ম্বর বেশেই যেন শকুন্তলার রূপ একেবারে ফুটে বের হচ্ছিল।
এ যেন সত্যিই সেই কবিমানসী বনবিহারিণী হরিণী শকুন্তলা।
নমস্কার, আপনিই শকুন্তলা দেবী? বিমল বললে।
প্রতি-নমস্কার জানিয়ে নিঃশব্দে মৃদুভাবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল শকুন্তলা।
বসুন।
শকুন্তলা উপবেশন করল।
০৫. কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই
কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে শকুন্তলা দেবী!
বলুন। মৃদুকণ্ঠে কথাটি বললে শকুন্তলা।
গলাটিও মিষ্টি।
মিঃ সরকারের মুখে শুনলাম আপনি সারদাবাবুকে বইটই পড়ে শোনাতেন, তাঁর লেখাপড়ার কাজও সব করে দিতেন?
হ্যাঁ।
তাহলে কতকটা তাঁর পার্সোন্যাল অ্যাসিস্টেন্টের মতই আপনি ছিলেন বলুন এখানে তাঁর কাছে? বিমল বলে।
তাই বলতে পারেন।
হুঁ। আচ্ছা কাল রাত্রের দিকে শেষ কখন তাঁর সঙ্গে আপনার কথাবার্তা হয়?
সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত এই লাইব্রেরীতেই তো আমরা ছিলাম। রাত নটার পর এখান থেকে আমি চলে যাই। রাত তখন সোয়া এগারোটা হবে, তিনি আবার আমাকে ডেকে পাঠান তাঁর ঘরে।
অত রাত্রে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন যে?
ওঁর ঘুমের ট্যাবলেটের শিশিটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেটা খুঁজে দেবার জন্য।
খুঁজে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কোথায় ছিল সেটা?
ওঁর ঘরে রাইটিং টেবিলের ড্রয়ারেই ছিল, কতকগুলো কাগজের তলায় চাপা পড়েছিল শিশিটা।
তারপর?
আমি যখন বের হয়ে আসছি, আমাকে বললেন দশরথকে বলে দেবার জন্যে, তাঁকে এক কাপ চা পাঠিয়ে দিতে।
অত রাত্রে চা!
হ্যাঁ, চা-পানের ব্যাপারে তাঁর কোন সময়-অসময় ছিল না। যখন-তখনই খেতেন। অতিরিক্ত চা-পানের জন্যই তো ডাক্তার চৌধুরী বলেছিলেন ওঁর ইনসমনিয়া হয়।
দিনে-রাতে কত কাপ চা খেতেন?
তা কুড়ি-পঁচিশ কাপ তো হবেই। আর খেতেনও অত্যন্ত স্ট্রং লিকারের চা।
আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, আপনি যখন সারদাবাবুর চিঠিপত্র লেখা ও হিসাবপত্র দেখার ব্যাপারে সাহায্য করতেন, তখন আশা করি নিশ্চয়ই আপনি কনফিডেন্সেই ছিলেন?
হ্যাঁ, উনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
স্বাভাবিক। আচ্ছা সারদাবাবু লোকটি কিরকম ছিলেন বলে আপনার ধারণা?
খুব শান্ত, ধীর ও বিবেচক প্রকৃতির লোক ছিলেন সারদাবাবু। ভেবেচিন্তে তবে কোন মতামত প্রকাশ করতেন।
আচ্ছা আপনি তো শুনলাম আট মাসের মত এখানে আছেন, তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কখনো আপনার সঙ্গে কোন আলোচনা হয়নি?
না। কখনো কোন কারণেই ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কারও সঙ্গে কোন আলোচনা করতেই তিনি ভালবাসতেন না। সে ব্যাপারে তাঁকে অত্যন্ত রিজার্ভই বরং মনে হয়েছে বরাবর।
বৃন্দাবনবাবুর প্রতি তাঁর মনোভাবটা কেমন ছিল?
ভালই। বৃন্দাবনবাবুকে অত্যন্ত তিনি ভালবাসতেন বলেই তো আমার মনে হয়।
অতঃপর বিমল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করল, এবারে আপনি কি করবেন ঠিক করেছেন কিছু?
ইট ইজ টু আর্লি টু থিঙ্ক দ্যাট! তাছাড়া যে কাজের জন্য এখানে আমি এসেছিলাম তার যখন আর প্রয়োজন হবে না, চলেই যাব।
আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, ধন্যবাদ, আপনি যেতে পারেন।
শকুন্তলার পরে ঘরে ডাকা হল পুরাতন ভৃত্য দশরথকে।
পূর্ববৎ বিমলই দশরথকে এবারে প্রশ্ন শুরু করে।
লোকটার চোখ দুটি মনে হল বেশ লাল ও ফোলা-ফোলা। লোকটা একটু আগেও কাঁদছিল বুঝতে কষ্ট হয় না।
চেহারাটা রোগাটে পাকানো দড়ির মত। মাথার চুলের এক-তৃতীয়াংশ প্রায় পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে।
পরিধানে একটি খাটো ধূতি ও ফতুয়া।
কতদিন এ বাড়িতে আছ দশরথ?
তা বাবু এককুড়ি বছরেরও বেশী।
বরাবর তুমি বুড়োবাবুর সঙ্গে সঙ্গেই ছিলে?
হ্যাঁ, বাবুর কাজ ছাড়া আর কোন কাজই কখনও আমাকে করতে হয়নি। বাবু আমাকে ছেলের মতই ভালবাসতেন। শেষের কথাগুলো বলতে বলতে দশরথের গলাটা ধরে এল, চোখের কোল ভিজে উঠল।
কোঁচার খুটে চোখ মুছতে মুছতে আবার দশরথ বললে, কি যে হয়ে গেল মাথামুণ্ড কিছু এখনও আমি বুঝে উঠতে পারছি না! বাবু যে কেন বিষ খেয়ে মরতে গেলেন!
তোমার বাবু বিষই খেয়েছেন বলে তাহলে তোমার ধারণা দশরথ? বিমল প্রশ্ন করে সহসা।
বিশ্বাস না হলেও তাই তো দেখছি বাবু!
তোমার বাবুকে কাল রাত্রে শেষবারের মত তুমিই তো চা দিয়ে এসেছিলে দশরথ, তাই না?
আজ্ঞে চা-টা আমি নিজে হাতে তৈরী করে দিলেও চা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কেতুর হাত দিয়ে।
কেতু! সে কে?
বুড়ো হয়েছি, খাটতে পারি না—তাই আমাকে সাহায্য করবার জন্যে বাবুরই আজ্ঞামত দিন পনের হল একজন নতুন বেয়ারা রাখা হয়েছিল। তারই নাম কেতুচরণ। সে-ই চা টা দিয়ে এসেছিল।
ও! তারপর?
কিন্তু কেতু ফিরে এসে বললে, চা নাকি খুব কড়া হয়নি, তাই আর এক কাপ কড়া করে চা বাবু চেয়েছেন। তাড়াতাড়ি আর এক কাপ চা কেতুই তৈরী করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসে।
তুমি তাহলে কাল রাত্রে যাওনি তোমার বাবুর ঘরে?
না। শরীরটাও কাল তেমন আমার জুত ছিল না, হাঁপানির টানটা বেড়েছিল। তাই সন্ধ্যা থেকে শুয়েই ছিলাম, তবে বাবুর খবর রেখেছি।
তোমার বাবু কি রকম প্রকৃতির লোক ছিলেন দশরথ?
খুব ঠাণ্ডা আর গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন।
বৃন্দাবনবাবুকে তোমার বাবু খুব ভালবাসতেন, তাই না?
হ্যাঁ, ঐ তো ভাইপোদের মধ্যে একমাত্র তাঁর কাছে ছিল, তাছাড়া বাবুর তো কোন ছেলেপিলেও ছিল না।
একমাত্র বৃন্দাবনবাবুই-বৃন্দাবনবাবুর আরও ভাই আছেন নাকি? ও কথা বলছ কেন দশরথ?
আছেন বৈকি, মধু দাদাবাবু-তা তিনি তো বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেননি অনেককাল হয়ে গেল।
কেন? তিনি কোথায়?
কে জানে, কেউ জানে না। দশ বছর আগে সেই যে বাবু তাঁকে বাড়ি থেকে দূর করে। কি কারণে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, আর বড় দাদাবাবু বাড়িমুখো হননি।
তাঁর বৌ, ছেলে-মেয়ে কিছু নেই?
না, তিনি তো বিয়েই তখনও করেননি।
ও, আচ্ছা বৃন্দাবনবাবু ও মধুবাবু-তোমার বাবুর বড় ভাইয়ের ছেলে, না?
হ্যাঁ বাবুরা দুই ভাই, রণদাবাবু ও বাবু। বড় ভাইয়ের দুই ছেলে, এক মেয়ে।
মেয়েটির বুঝি বিবাহ হয়ে গিয়েছে?
বিয়ে হয়েছিল, বছর দুই হল তিন মারা গেছেন। তাঁর এক ছেলে আছে বিজনবাবু।
আচ্ছা দশরথ, তুমি যেতে পার। হ্যাঁ ভাল কথা, তোমাদের কেতুচরণকে একটু পাঠিয়ে দাও তো এ ঘরে।
আজ্ঞে কেতু তো নেই বাবু!
কেতু নেই? কেন, কোথায় গিয়েছে?
জানি না, সকাল থেকেই বাড়িতে তাকে দেখছি না।
বাড়িতে নেই?
না।
হঠাৎ চলে যাবার মানে?
তা কেমন করে বলব বাবু, তবে দেখছি না তাকে সকাল থেকে—
অতঃপর বিমল কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবে।
তারপর আবার প্রশ্ন করে, তা লোকটা দেখতে ছিল কেমন?
বেশ লম্বা-চওড়া কালোমত, তবে বাঁ পাটা দুর্বল ছিল বলে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কুঁজো হয়ে চলত কেতু।
লোকটার স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল বলে তোমার মনে হয়? আর হঠাৎ এভাবে চলে গেলই বা কেন?
কেন চলে গেল বুঝতে পারছি না, লোকটা তো বেশ ভালই ছিল, কাজকর্মও দুদিনেই শিখে গিয়েছিল। কাবাবুর লোকটাকে পছন্দও হয়েছিল।
কোথায় তার বাড়ির ঠিকানা কিছু জান?
না বাবু, শুনেছিলাম সংসারে নাকি তার কেউ নেই, মেদিনীপুরে কোন্ গাঁয়ে নাকি বাড়ি বলেছিল।
অতঃপর ভৃত্য গোকুল, ঠাকুর হরিদাস, দারোয়ান রামভজন, দাসী পিয়ারী প্রভৃতিকে দু-চারটে প্রশ্নাদি করে, মৃতদেহ শহর হাসপাতালে ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়ে এবং সারদাচরণ সরকারের ঘরে টেবিলের উপর রক্ষিত তখনও অধসমাপ্ত চা সমেত চায়ের কাপটা সঙ্গে নিয়ে বিমল সেন সরকার-ভিলা থেকে বের হয়ে এল।
পথেই বিমলের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সুশান্ত ও বিনয় তাদের বাড়ির দিকে চলে গেল।
উক্ত ঘটনার দিনসাতেক বাদে বিকেলের দিকে সুশান্ত ও বিনয় বেড়াতে বেড়াতে থানায় গিয়ে হাজির হতেই বিমল সাদরে ওদের অভ্যর্থনা জানায়, আয়-বস!
সুশান্তই চেয়ারে বসতে বসতে প্রশ্ন করে, তারপর, তোর সরকার-ভিলার কেসটা কি দাঁড়াল? সুইসাইড না হোমিসাইড?
কে জানে, বুঝতে পারছি না। আজই ওপরওয়ালার কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলাম। বিচিত্র ব্যাপার!
কি রকম!
ময়দা তদন্তের রিপোর্ট বলছে, নিকোটিন পয়েজনিং নাকি মৃত্যুর কারণ—
নিকোটিন!
হ্যাঁ, কিন্তু কোথা থেকে যে ঐ মারাত্মক বিষটি এল কিছু ভেবেই পাচ্ছি না। আর সুইসাইডই যদি হয় তো, ঐ রেয়ার পয়েজনটাই বা সারদাবাবু কোথা থেকে যে যোগাড় করলেন, তাও তো মাথামুণ্ডু কিছু বোধগম্য হচ্ছে না।
তাহলে তোর ধারণা কি কেসটা সত্যি হোমিসাইডই?
হোমিসাইডই যে বলব জোর গলায় তারও তো কোন ক্লু পাচ্ছি না।
মৃত্যু যে সারদাবাবুর নিকোটিন পয়জনিংয়েই হয়েছে স্থিরনিশ্চিত হলি কি করে?
সেই অর্ধসমাপ্ত চায়ের কাপের চাটা অ্যানালিসিসের জন্য পাঠিয়েছিলাম কলকাতায় কেমিক্যাল এগজামিনারের কাছে। তার মধ্যে কোন পয়জনের ট্রেসই মেলেনি। অথচ সিভিল সার্জেন বলছেন ময়না তদন্ত করে-এ কেস অফ ডেফিনিট নিকোটিন পয়েজনিং!
তাহলে?
যাক গে, বড়কর্তাদের জানিয়ে দিয়েছি। এখন তাঁদের যা করবার করুন। বড়ঘরের ব্যাপারেই সব আলাদা। বেটা বুড়োর তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তার পার্সোন্যাল অ্যাটেনডেন্টের খুপসুরৎ থেরা দেখলেই মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়!
বিনয় বললে, বৃন্দাবনবাবুকে আজও তো সকালে সরকার-ভিলার সামনে দেখেছিলাম। ভদ্রলোক এখানেই আছেন বুঝি এখনও?
শুধু তিনি কেন, শকুন্তলা দেবীটিও তো শুনলাম এখনও রয়েছেন এখানেই।
দেখ, বৃন্দাবন আর ঐ শকুন্তলা দেবীরই কাজ হয়তো! সুশান্ত এবারে বলে।
বিচিত্র নয়।
কিন্তু ব্যাপারটা যতই বিচিত্র হোক, স্থানীয় লোকেদের যে সে সম্পর্কে কোন দুশ্চিন্তা আছে সেরকম কিছু মনে হল না।
কারণ ব্যাপারটা যেন ক্রমশঃ ধামাচাপা পড়বারই যোগাড় হয়েছিল।
এমন সময় প্রায় আরও দিন সাতেক অর্থাৎ দুর্ঘটনার পক্ষকাল বাদে সন্ধ্যার সময় বিমলের থানার অফিসঘরের মধ্যেই বসে সুশান্ত, বিনয়, ফ্যাটি গুপ্ত ও বিমল সেন রীতিমত আড্ডার আসর যখন জমিয়ে তুলেছে, তখন বাইরের বারান্দায় অপরিচিত একটা জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
বেশ ভারী জুতোর শব্দ।
পরক্ষণেই ভারী, মোটা অপরিচিত গলা শোনা গেল দরজার ওপাশে, দারোগাবাবু আছেন?
কে? ভেতরে আসুন!
একটু পরেই ভারী জুতোর মশমশ শব্দ তুলে দীর্ঘকায় এক আগন্তুক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
ঘরের মধ্যে টেবিলের উপরে রক্ষিত প্রজ্বলিত টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিটা গিয়ে প্রায় যেন একই সঙ্গে আগন্তুকের উপর পড়ল।
আগন্তুক দু হাত তুলে নমস্কার জানালেন, নমস্কার। আমি আসছি সরকার-ভিলা থেকে। আমার নাম মধুসূদন সরকার।
চকিতে সকলের নামটা মনে পড়ে যায় যেন। মধুসূদন সরকার!
পক্ষকাল আগে সারদাবাবুর মৃত্যুর তদন্ত করতে গিয়ে ভৃত্য দশরথের মুখেই ঐ নামটি ওরা শুনেছিল।
অতএব নামটা তাদের অপরিচিত নয়—যদিও মানুষটা অপরিচিত।
০৬. মধুসূদন সরকার
মধুসূদন সরকার।
পরিধানে দামী সার্জের মভ কলারের লংস।
গায়ে গলাবন্ধ কালো ভেনিসিয়ান সার্জের লম্বা কোট।
পায়ে ডার্বী সু।
চেহারাটা বেশ লম্বা-চওড়া ও বলিষ্ঠ।
মাথার চুল পালিশ করা। রগের দুপাশে সামান্য পাক ধরেছে চুলে, বয়সের ইঙ্গিত।
মুখে ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি। পাকানো গোঁফ।
ছড়ানো চৌকো চোয়াল। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা।
বসুন, বিমল সেন বললে।
বিশেষ একটা ব্যাপারে সাহায্যপ্রার্থী হয়েই আমি এসেছি দারোগাবাবু।
খালি একটা চেয়ারে বসতে বসতে মধুসূদন সরকার বললেন।
বলুন।
আপনারা হয়তো জানেন না, মৃত সারদা সরকার আমার কাকা ছিলেন। অবিশ্যি কথাটা আপনাদের না জানবারই কথা। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় বছর দশেক আগে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। নানা জায়গায় ঘুরে শেষ দুটো বছর আমি রেঙ্গুনেই ছিলাম। মাত্র পরশু জাহাজ থেকে নেমেছি। সেখানেই আমাদের কলকাতার দোকানের ম্যানেজার মৃগাঙ্কবাবুর মুখে সব শুনলাম। প্রথমটায় ভেবেছিলাম ব্যাপারটা বুঝি একটা পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল সুইসাইডই। কিন্তু আজ সকালে এখানে এসে বৃন্দাবন ও শকুন্তলা দেবীর মুখে সব ব্যাপার আদ্যোপান্ত শুনে মনে হচ্ছে-দেয়ার মাস্ট বি সাম ফাউল প্লে সামহোয়ার। তাই আপনার কাছে সোজা চলে এলাম।
কিন্তু–
শুনুন দারোগাবাবু, কথাটা তাহলে খুলেই বলি, আমি চাই ব্যাপারটার একটি মীমাংসা হোক। কাকা যদি সত্যি-সত্যিই আত্মহত্যা করে থাকেন তো কথাই নেই, তা যদি না হয়, যদি সত্যিই তাঁকে কেউ হত্যা করে থাকে, তাহলে যেমন করেই হোক হত্যা-ব্যাপারটার একটা কিনারা করতে চাই আমরা দু ভাই-ই। একসময় কাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যতই তিক্ত হোক না কেন, কাকা আমাকে স্নেহ করতেন। এই দীর্ঘ দশটা বছর দুরে থাকলেও, নিজের ব্যবহারের জন্য অনুতাপের আমার অন্ত ছিল না। কতবার মনে হয়েছে ফিরে এসে ক্ষমা চেয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেব। হাজার হোক গুরুজন। তাছাড়া আমরাই তো তাঁর সব ছিলাম। বলতে বলতে একটু যেন দম নিয়ে পুনরায় শুরু করলেন, ক্ষমা চাইব বলে কত আশা করে ফিরে এসেছিলাম কিন্তু সে সুযোগটুকুও ভগবান দিলেন না। শেষের দিকে অশ্রুতে কণ্ঠস্বর মধুসূদনের রুদ্ধ হয়ে যায়।
বেশ। কিন্তু
না না, দারোগাবাবু, এ ব্যাপারে আপনার আমি সাহায্য চাই আর আপনাকে সাহায্য করতেই হবে। এমন কি এই অনুসন্ধানের ব্যাপারে খরচপত্র যাই হোক সব আমি দেব।
উপরওয়ালাকে অবিশ্যি সবই আমি জানিয়েছি–
সে আপনাদের আইনের দিক থেকে যা করবার আপনি করুন। কিন্তু শুধু ঐ আইনের উপরেই নির্ভর করে থাকতে আমি চাই না দারোগাবাবু। বেসরকারী ভাবে অনুসন্ধান করবারও যদি প্রয়োজন হয় তাও আমি করতে প্রস্তুত জানবেন।
বেসরকারী ভাবে তদন্ত?
হ্যাঁ, এদেশে ওসব ব্যাপার নেই বটে, তবে বইতে পড়েছি বিলেতে নাকি আছে। সেই রকম কিছু–
দেখুন মধুসূদনবাবু, এখানে আমি অবিশ্যি তৃতীয় ব্যক্তি-সম্পূর্ণ আউটসাইডার, কথা বললে এবারে সহসা সুশান্ত, কিন্তু ব্যাপারটা আমিও গোড়া থেকে অল্পবিস্তর জানি, তাই যদি একটা কথা বলি অন্যায় ধরবেন না, বিশেষ করে একটু আগে আপনি যা বললেন তার উত্তরে–
নিশ্চয়ই না। কিন্তু আপনি–
বিমলই অতঃপর সকলের পরিচয়টা করিয়ে দিল।
কিন্তু কি যেন বলছিলেন সুশান্তবাবু–
আপনার কাকার মৃত্যুর ব্যাপারটা হত্যাই বা ভাবছেন কেন?
দেখুন সুশান্তবাবু, কাকাকে খুব ভাল করে চিনবারই আমার সৌভাগ্য হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর মত আনস্ক্রপলাস, স্বার্থান্ধ, অর্থপিশাচ লোক ভীরুর মত আত্মহত্যা করবে, বিশেষ করে ঐ বয়সে-যখন মান সম্রম প্রতিপত্তি অর্থ সব তাঁর করায়ত্ত, আর যে-ই বিশ্বাস করুক কথাটা অন্ততঃ আমি করতে রাজী নই।
কথাগুলো বলতে বলতে মধুসূদন সরকার যেন বেশ একটু উত্তেজিতই হয়ে ওঠেন এবং ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলে বেশ একটু বিস্মিত ভাবেই ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই স্বর্গগত কাকা সম্পর্কে ভাইপোর শ্রদ্ধাটা যেন একটু বিসদৃশ বলেই ওদের মনে হয়।
কিন্তু মধুসূদনের বক্তব্য যে তখনও শেষ হয়নি পরক্ষণেই বোেঝা গেল। কারণ তিনি আবার তখনই বলতে শুরু করেছেন।
আমার কথাগুলো শুনে হয়তো আপনারা সকলেই একটু বিস্মিত হচ্ছেন। কিন্তু আমার একটা কি দোষ জানেন, সত্য চিরদিনই অপ্রিয় এবং যত অপ্রিয়ই হোক না কেন, সত্যভাষণে কখনও আমি পেছপাও হই না। আর স্পষ্টবক্তা ও চিরদিন সত্যাশ্রয়ী বলেই কাকার অপ্রিয়ভাজন আমাকে একদিন হতে হয়েছিল।
কি রকম?
বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর দশ বৎসর আগে কাকা অন্যায়ভাবে আমাদের ঠাকুরদামশাইয়ের এক উইল দেখিয়ে তাঁর সম্পত্তির সমান অংশ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন বলেই তার প্রতিবাদে আমার প্রতি তিনি একান্ত বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু যাক সেসব কথা। অতীত। তাছাড়া সেই কাকাও আজ আর বেঁচে নেই যখন, ঐসব পুরাতন কথা ভেবেও তখন আর কোন লাভ নেই। তবু কাকা আমাদের প্রতি যে ব্যবহারই করে থাকুন না কেন একদা, তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে সাহায্য করতে দারোগাবাবু আপনি যোগ্যতম ব্যক্তি জেনে আপনারই সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছি।
আমি আপনাকে একটা উপায় বলে দিতে পারি মিঃ সরকার। সহসা আবার সুশান্তই কথা বললে।
নিশ্চয়ই, বলুন?
আপনি কিরীটী রায়ের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন?
না।
শোনেননি?
না। শুনলেনই তো, দীর্ঘদিন বাইরেই আমার কেটেছে।
আপনি মিঃ রায়ের সাহায্য নিন। আমি হলফ করে বলতে পারি, সত্যিই যদি ব্যাপারটা, আমরা সকলেই যা অনুমান করছি-হত্যাই করা হয়ে থাকে সারদাবাবুকে, তাহলে সে হত্যার পিছনে যে রহস্যই থাকুক না কেন, জানবেন কিরীটী রায়ের সাহায্য নিলে নিশ্চয়ই সেটা আপনি জানতে পারবেন।
কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো আমার কোন পরিচয় নেই সুশান্তবাবু, আমার কথায় তিনি কি আসবেন! তাঁর পারিশ্রমিক অবশ্যই যা তিনি চান আমরা দিতে রাজি আছি। মধুসূদন সরকার বললেন।
বেশ, আমি লিখব তাঁকে। সুশান্ত বললে।
অতঃপর সেরাত্রের মত মধুসূদন সরকার সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
সেই রাত্রেই সুশান্ত কিরীটীকে চিঠি দিল।
প্রিয়বরেষু,
নিশ্চয়ই সুশান্ত ঘোষালকে ভুলে যাননি। বৎসরখানেক পূর্বে, মনে আছে বোধ হয় আপনার, সেই চেতলার অবিনাশ মল্লিকের কেসে আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হবার সৌভাগ্য হয়েছেল। যাহোক আজ তার চাইতেও বিচিত্র একটা মামলার রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে স্থানীয় একজন ভদ্রলোক আপনার সাহায্য চান। অবিশ্যি কেবল তিনিই নন—আমি এবং আমার বন্ধু, এখানকার থানা অফিসারও ব্যাপারটার একটা মীমাংসার জন্য ইনটারেস্টেড, তাই এই পত্র আপনাকে দিচ্ছি। কলকাতার বিখ্যাত জুয়েলারী ফার্ম সরকার ব্রাদার্সের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। তারই মালিক সুবিখ্যাত ধনী প্রৌঢ় সারদাচরণ সরকারকে দিন পনের পূর্বে একদিন সকালে তাঁর শয়নঘরে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিস্তারিত বিবরণ হয়তো সংবাদপত্রেই আপনার নজরে পড়ে থাকবে ইতিমধ্যে। ময়না তদন্তে জানা গিয়েছে।–ইট ইজ এ কেস অফ নিকোটিন পয়েজনিং। ব্যাপারটা কিন্তু আমাদের কারোরই সুইসাইড কেস বলে মনে হচ্ছে না, তার কারণ ঐ গৃহে মৃত সারদাচরণের পার্সোন্যাল অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন এক তন্বী সুন্দরী শকুন্তলা দেবী, যিনি এখনও সরকার ভিলা ছেড়ে যাননি। এখানে। এলে বাকি কথা সব জানতে পারবেন। যদি আসেন তা জানালে স্টেশনে উপস্থিত থাকব।
প্রীত্যর্থী
সুশান্ত ঘোষাল
তিন দিন পরেই চিঠির জবাব এল।
সুভাষণেষু,
কাল সন্ধ্যার গাড়িতে রওনা হচ্ছি। সাক্ষাতে বাকী কথা হবে। স্টেশনে থাকবেন আপনাদের বাসাতেই উঠব। নমস্কার।
ভবদীয়—কিরীটী রায়
সুশান্তর ইচ্ছা ছিল সংবাদটা পাওয়া মাত্রই মধূসুদন সরকারকে জানায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ভেবে আর জানালো না।
পরের দিন প্রত্যুষেই একেবারে কিরীটীকে সঙ্গে করে নিয়ে সরকার ভিলায় যাবে ঠিক করল।
কলকাতার ট্রেনটা আসে রাত প্রায় সাড়ে নটা নাগাদ। স্টেশনটি ঘোট। দুধারে বাঁধানো প্ল্যাটফরম।
একপাশে অ্যাসবেসটাসের সেডের নীচে স্টেশন মাস্টারের ঘর, যাত্রীদের ওয়েটিং রুম ও টিকিট ঘর পাশাপাশি।
নির্দিষ্ট সময়েই কলকাতার ট্রেনটা এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়াল। যাত্রী সামান্যই।
স্টেশনের টিমটিমে কেরোসিনের আলোয় সুশান্ত এদিক-ওদিক অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকায়।
কিন্তু আকাঙিক্ষত ব্যক্তিটি তার নজরে পড়ে না।
তবে কি মিঃ রায় এলেন না।
সহসা ঐ সময় পশ্চাৎ থেকে মৃদুকণ্ঠের সম্বোধন এল, এক্সকিউস মি, আপনিই বোধ হয় সুশান্তবাবু?
কে? মিঃ রায় নিশ্চয়ই—
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, নিঃসংশয়ে।
পরিধানে ধুতি, গায়ে কালো রংয়ের গ্রেট কোট, চোঁখে সেই কালো মোটা সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা।
মুখে পাইপ। সেই পরিচিত চেহারা।
কিন্তু কোন কম্পার্টমেন্ট থেকে নামলেন দেখতে পাইনি তো! গার্ডের ভ্যানের লাগোয়া থার্ড ক্লাস ও সেকেণ্ড ক্লাস কামরাগুলোর দিকে চেয়ে দেখে দেখে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।
চলুন, আপনাদের ডেরা কতদূর এখান থেকে?
তা মাইলখানেক হবে। মেঠো কাঁচা রাস্তা তবে ধুলো তেমন নেই।
তা হোক, খোলা হাওয়ায় তবু তো খানিকটা হাঁটতে হাঁটতে পিওর অক্সিজেন পাওয়া যাবে, শহরে তো সে বালাই আর নেই! খুশিভরা কণ্ঠে কিরীটী বলে।
তা যা বলেছেন।
রাত্রে বাসায় ফিরে আহারাদির পর গল্পে গল্পে সুশান্ত সংক্ষেপে কিরীটীকে সারদাচরণের মৃত্যুর ব্যাপারটা বললে।
কিরীটী পাইপটা মুখে লাগিয়ে সোফার উপর হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে সব শুনে গেল নিঃশব্দে, কোন মন্তব্যই প্রকাশ করল না।
আগাগোড়া সমস্ত কাহিনীটা বিবৃত করার পরও কিরীটীর দিক থেকে কোনরূপ সাড়ামাত্রও না পেয়ে অগত্যা সুশান্তই প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিঃ রায়, যা শুললেন তাকে কি আপনার মনে হয় কেসটা–
কি?
হ্যাঁ, মানে বলছিলাম-সুইসাইডই কিনা?
আপনার কি ধারণা?
আমার তো ধারণা, নট এ কেস অফ সুইসাইড!
ইউ আর রাইট! তবে-সারদাবাবুর মৃত্যু-সম্পর্কে যতটা শুনলাম তাতে সুইসাইড যে নয় এটা স্পষ্টই বোঝা যায়। তবে কেস অফ হোমিসাইড বললেই তো চলবে না প্রমাণ চাই!
বিমলেরও তাই ধারণা। কিন্তু বৃন্দাবনবাবুর ধারণা, কেসটা সিম্পল সুইসাইড-
মধুসূদনবাবুরও তাই ধারণা নাকি?
না। আর তাইতেই তো তিনি বিমলের কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলেন এবং তখনই আপনার কথা তাকে আমি সাজেস্ট করি।
শকুন্তলা কি বলে?
শকুন্তলা!
হ্যাঁ, আপনার চিঠির মধ্যে বর্ণিত সেই সুন্দরী তন্বীটি?
তা তো জানি না।
জানেন না! এত করে চিঠিতে বর্ণনা দিলেন, তার মনের কথাটাই এখনো জানেন না? তারপর মৃদু হেসে বললে, যাক চলুন তো, আগে কাল একবার সরেজমিন তদন্ত করি। তবে আর একটা কথা, শ্রীমান্ কেতুচরণের অনুসন্ধানটা করা আপনার দারোগা বন্ধুর কিন্তু উচিত ছিল সর্বাগ্রে।
কিন্তু তার তো সেইদিন সকাল থেকে কোন পাত্তাই নেই!
তারপর দশরথ। দশরথের কাছেও হয়তো অনেক কিছু জানা যেতে পারে!
দশরথ!
হ্যাঁ, কোন কু হয়তো সে আমাদের দিতে পারে। হ্যাঁ ভাল কথা, শকুন্তলা দেবী তো এখন সরকার ভিলাতেই অবস্থান করছেন, তাই না?
হ্যাঁ।
০৮. সকলে এসে লাইব্রেরী ঘরে
সকলে এসে লাইব্রেরী ঘরে প্রবেশ করল।
মধুসূদন ও বৃন্দাবন সরকার দুই ভাই দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসেছিলেন, ওদের পদশব্দে মুখ তুলে তাকালেন দুজনেই একসঙ্গে।
দেখলেন বিমলবাবু? প্রশ্নটা করলেন মধুসূদনই।
হ্যাঁ।
বৃন্দাবনবাবু মধুসূদনবাবু, মিঃ রায়কে তাহলে আপনারা এই ব্যাপারের মীমাংসা করতে–
সুশান্তর কথাটা শেষ হল না, মধুসূদন সরকার বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই। উনি যদি এ ব্যাপারের মীমাংসার ভারটা দয়া করে হাতে নেন, তাহলে আমরা সত্যিই ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব, কি বল বৃন্দাবন?
নিশ্চয়ই। আমার তো হাত-পা পেটে সেধিয়ে যাবার যোগাড় হয়েছে-পনের দিনের মধ্যে দু-দুটো মৃত্যু! আত্মহত্যাই হোক বা হত্যাই হোক, এর একটা বিহিত করা একান্ত প্রয়োজন বইকি। সমর্থন জানালেন ছোট ভাই বৃন্দাবন সরকার।
এবারে কথা বললে কিরীটী ওঁদের দুই ভাইকেই লক্ষ্য করে, দেখুন আপনাদের ঐ ভৃত্য দশরথের মৃত্যুর ব্যাপারটা যে সুইসাইড নয় সে বিষয়ে আমি হলফ করে বলতে পারি, আর ঐভাবে দশরথের হত্যার ব্যাপারটা থেকে আমার মনে হচ্ছে, আপনাদের কাকামশাইয়ের মৃত্যুর ব্যাপারটাও সুইসাইড নয়—হোমিসাইডই-হত্যা!
মিঃ রায়,-বৃন্দাবন সরকার যেন কি বলবার চেষ্টা করেন কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে আবার কিরীটী বলে, হ্যাঁ মিঃ সরকার, আপনার কাকামশাইকেও-া, সামবডি ডেলিবারেটলি কিড় হিম, নো ডাউট অফ ইট–
বৃন্দাবনবাবু এবারেও কিছু বুঝি বলবার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটীকে সমর্থন জানালেন এবারে মধুসূদন সরকার এবং বললেন, কেমন বৃন্দাবন, আমি সেদিন সব ব্যাপারটা শোনার পরই তোমাকে বলিনি! কোন্ দুঃখে আর কেনই বা আফটার অল কাকা অমনি করে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে যাবে! নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তাকে হত্যা করেছে।
কিন্তু দাদা, এ যে কেবল অসম্ভবই নয়-অবিশ্বাস্যও! বৃন্দাবন সরকার বললেন।
সে তুমি যাই বল বৃন্দাবন, ইট ইজ দি ফ্যাক্ট!
বুঝলাম কিন্তু তাই যদি হয় তো কে তাকে হত্যা করবে আর কেনই বা তাকে আফটার অল হত্যা করতে যাবে বলতে পার দাদা? বৃন্দাবন সরকার আবার তাঁর জ্যেষ্ঠকে প্রশ্ন করেন।
তা কি করে বলব? তবে সহজ বিচার-বুদ্ধিতে এক্ষেত্রে যা মনে হচ্ছে তাই বলছি।
বেশ, তাহলে বলতে হয় বাইরে থেকেই কেউ না কেউ এসে সেরাত্রে তার ঘরে ঢুকে তাকে অমন করে হত্যা করে গিয়েছে!
আমার মনে হয় তা নয় বৃন্দাবনবাবু। প্রতিবাদ জানায় এবারে কিরীটী।
তা নয়?
না। সেরাত্রে যারা এ বাড়িতে ছিল তাদেরই মধ্যে নিশ্চয়ই, আমার বিশ্বাস, কেউ না কেউ তাকে হত্যা করেছিল। শুধু তাই নয়, হত্যাকারী বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ও বেশ কিছু জ্ঞানগম্যিও তার ছিল। কিরীটী আবার বলে।
এ আপনি কি অসম্ভব কথা বলছেন মিঃ রায়। আবার প্রতিবাদ জানান বৃন্দাবন সরকার, সেরাত্রে এ বাড়িতে তো থাকার মধ্যে ছিলাম আমি, শকুন্তলা দেবী আর ছিল দশরথ, গোকুল, ঝি পেয়ারী, ঠাকুর হরিদাস, দারোয়ান রামভজন। এদের কি স্বার্থ থাকতে পারে কাকাকে হত্যা করার বলতে পারেন?
স্বার্থের কথা যদি বলেন বৃন্দাবনবাবু, কিরীটী বলে, তো অত জোরগলায় একেবারে ডেফিনিটলি কিছুই হলফ করে বলা যায় না। কারণ কিসে যে কার স্বার্থ থাকতে পারে আর কিসে যে কার স্বার্থ থাকতে পারে না, তা কি সর্বদা সকলের পক্ষে জানা সম্ভব। তাছাড়া বৃন্দাবনবাবু, একটু আগে যে লিস্ট বললেন, তার মধ্যে একজন কিন্তু বাদ গিয়েছে।
বাদ গিয়েছে? বৃন্দাবন শুধান।
হ্যাঁ, কেতু না রাহু কে একজন আপনার কাকার নতুন বেয়ারা নিযুক্ত হয়েছিল তার মৃত্যুর মাত্র দিন পনের আগে এবং যাকে ঘটনার দিন সকাল থেকেই আর ট্রেস করা আজ পর্যন্ত যায়নি—তাই না বিমলবাবু?
হ্যাঁ। বিমল সমর্থন জানায়।
কেতু-রাহু, কি ব্যাপার বৃন্দাবন? প্রশ্নটা এবারে করলেন মধুসূদনই তার ভাইকে।
হ্যাঁ শুনেছি বটে, কেতু নামে একটা নতুন লোককে কিছুদিন আগে রাখা হয়েছিল, কিন্তু লোকটাকে বিশেষ তেমন আমিও দেখিনি দাদা।
আই সি! তা লোকটা বুঝি উধাও?
হ্যাঁ। তবে তার যথাসম্ভব ডেসক্রিপশন দিয়ে প্রায় সর্বত্রই পুলিস স্টেশনে স্টেশনে ইনফরমেশন পাঠিয়ে দিয়েছি ঐদিনই। বাছাধন যাবেন কোথায়! বললে বিমল কতকটা যেন আত্মপ্রত্যয়ের কণ্ঠে ঐসময়।
তা এতগুলো লোক তো বাড়িতে রয়েছে, আবার একজন নতুন লোকই বা আমদানি করবার কি প্রয়োজন হয়েছিল, বিশেষ করে অজ্ঞাতকুলশীল? কথাটা বললেন মধুসূদন সরকার।
দশরথ বুড়ো হয়ে গিয়েছে, কাকার দেখাশুনা তেমন আর করে উঠতে পারছিল না, তাই নাকি লোকটাকে কাজে বহাল করা হয়েছিল। শকুন্তলা দেবী কথাটা আমাকে বলেছিলেন। মধুসূদন সরকারের প্রশ্নের জবাব দিলেন বৃন্দাবনবাবু।
কাকা এত বড় কাঁচা কাজটা কি করে যে করলেন বুঝলাম না! অজ্ঞাতকুলশীল একটা লোককে হুট করে কি করে যে তিনি এ বাড়ির কাজে বহাল করলেন, বিশেষ করে তার মত একজন সতর্ক ও বিচক্ষণ প্রকৃতির লোক, এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। মধুসূদন আবার মৃদুকণ্ঠে কথাটা বললেন।
কিন্তু সে যাই হোক মধুসূদনবাবু, লোকটা দুর্ঘটনার সময় এ বাড়িতে উপস্থিত ছিল যখন, তখন সন্দেহের তালিকায় সেই কেতুকেও আমাদের ধরতে হবে। বললে কিরীটী।
ধরাধরি আর কি মিঃ রায়, এ তো অত্যন্ত সহজ ব্যাপার! আপনার কথা যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে সবচাইতে বেশী সন্দেহ তো ঐ লোকটার উপরেই পড়ে! বললেন মধুসূদন।
তারপরই একটু থেমে আবার মৃদুকণ্ঠে বললেন, কিন্তু বর্তমানে তো সে হাতের কাছে আমাদের নেই–
মধুসূদনের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে কিরীটী বললে, না থাকলেও আমাদের তদন্তের ব্যাপারে অগ্রসর হতে বিশেষ কোন অসুবিধা হবে না মিঃ সরকার। কারণ আপাতত যাঁরা আমাদের চোখের সামনেই আছেন বা আছে, তাদের সম্পর্কেই তো আমরা এখনো সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হতে পারিনি। কিন্তু তারও পূর্বে আমি একটা বিষয়, মধুসূদনবাবু ও বৃন্দাবনবাবু, আপনাদের কাছে জানতে চাই–
বলুন! দুজনেই তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
সারদাবাবু-আপনাদের কাকা কোনরকম উইল কিছু করে গিয়েছেন কিনা জানেন?
উইল!
হ্যাঁ, মধুসুদনবাবু। কারণ শুনেছি আপনাদের সরকার জুয়েলারী বিরাট একটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এত বড় সম্পত্তির একটা কিছু বিলি-ব্যবস্থা ভবিষ্যতের জন্যে ভেবে নিশ্চয় তিনি করে রেখেছিলেন, স্বাভাবিক বলেই মনে হয় না কি! কিরীটী বললে ওঁদের দিকে তাকিয়ে।
তা তো নিশ্চয়ই। তবে আমি তো এখানে দীর্ঘদিন ছিলাম না, কাকার সঙ্গে কোন চিঠিপত্রের যোগাযোগও ছিল না-বৃন্দাবনই কাকার কাছে ছিল। সেরকম কিছু থাকলে ও-ই হয়ত ভাল বলতে পারবে। বললেন মধুসূদন সরকার ভাইয়ের দিকে চেয়ে।
আমিও সঠিক কিছু বলতে পারব না বর্তমানে মিঃ রায়, এসব ব্যাপার জানেন সব কিছুই হয়তো আমাদের সলিসিটার বোস ও চৌধুরী ফার্মের মিঃ শচীবিলাস বোস। তিনিই আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইসার ছিলেন। কিন্তু কাকার মৃত্যুর পর থেকে আর তো ইতিমধ্যে আমি কলকাতাতেই যাইনি—তাঁর সঙ্গে এর মধ্যে দেখাসাক্ষাৎও হয়নি।
আপনার কাকার মুখেও কখনও কি ঐ সম্পর্কে কিছু শোনেননি বৃন্দাবনবাবু?
না, প্রয়োজন হয়নি। তাছাড়া বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে কাকা কখনও কিছু আলোচনা পছন্দ করতেন না।
কিন্তু মানুষের একটা কৌতূহলও তো হয় বৃন্দাবনবাবু!
তা হয়তো হয়, কিন্তু আমার বেলায় তো তার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ কাকার তো কোন সন্তানাদি ছিল না—যা কিছু সব তো আমরাই পাব জানতাম।
কিন্তু মানুষের মনের কথা তো কিছু বলা যায় না বৃন্দাবনবাবু! কিরীটী আবার বলে।
তা হয়তো যায় না, তবে কাকার দিক থেকে সেরকম কিছু ঘটবার সম্ভাবনা হলে অন্তত
আমি জানতে পারতাম বৈকি!
ইতিমধ্যে একসময় বিমল সেন ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল দশরথের মৃতদেহটা ময়না। তদন্তের জন্য পাঠাবার ব্যবস্থা করতে।
সত্যি কথা বলতে কি, থানা অফিসার বিমল সেন দশরথের মৃত্যুর ব্যাপারে বেশ একটু বিচলিতই হয়ে পড়েছিল।
ঘটনার পরিস্থিতিতে এখন মনে হচ্ছে তারও যে সারদা সরকার ও দশরথের মৃত্যুর ব্যাপার দুটো সাধারণ আত্মহত্যা নয়—দুটোই হত্যা!
দুজনকেই হত্যা করা হয়েছে।
আর ব্যাপারটা রীতিমত জটিলই বলে তার এখন মনে হচ্ছে।
বিমল সেন যখন পুনরায় ঘরের মধ্যে ফিরে এল, কিরীটী তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, সমস্ত বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলে কেমন হত বিমলবাবু?
বেশ তো, দেখুন না!
» ০৯. যে লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে
যে লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে সকলে তখন উপস্থিত ছিল, সেই ঘরেরই পশ্চিম কোণে একটা বদ্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বৃন্দাবনবাবুর দিকে সহসা চোখের ইঙ্গিত করে কিরীটী প্রশ্ন করল একসময়, ঘরের ঐ দরজাটা কিসের বৃন্দাবনবাবু? ঐ দরজা-পথে কোথায় যাওয়া যায়?
এই ঘরের সঙ্গেই ছোট একটা অ্যান্টিরুম মত আছে। সেই অ্যান্টিরুমে যাবারই দরজা ওটা। মধুসূদন সরকারই কথাটার জবাব দিলেন।
আই সি! ওটা কি ব্যবহৃত হত?
কাকাই ওটা ব্যবহার করতেন। এবার জবাব দিলেন বৃন্দাবনবাবু।
সারদাবাবু!
হ্যাঁ। কাকার বাগান ও ফুলগাছের—বিশেষ করে নানাজাতীয় গোলাপের খুব শখ ছিল। ঐ ঘরটার মধ্যে সেই সব গোলাপ গাছে কি সব সার-টার কাকার থাকত।
কৌতূহলী কিরীটী আর দ্বিতীয় প্রশ্ন না করে নিঃশব্দে সেই অ্যান্টিরুমের দরজার দিকে এবার এগিয়ে গেল সোফা থেকে উঠে।
ঘরের দরজা বরাবর গিয়েছে কিরীটী, সহসা পশ্চাৎ দিক থেকে বিমল সেন বলল, মিঃ রায়, আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো আমি থানায় এবারে ফিরে যেতে চাই। সেখানে আমার অনেক কাজ জমা হয়ে আছে।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
সন্ধ্যাবেলা ওদিকে আসবেন নাকি?
যাব।
তাহলে একটু না হয় বেলাবেলিই আসবেন, ওখানেই চা খাবেন। বিমল সেন বলে।
বেশ তো।
সুশান্ত, তাহলে কিরীটীবাবুকে আমার ওখানে নিয়ে এস।
যাব। সুশান্ত বললে।
বিমল সেন অতঃপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী এবারে বন্ধ দরজাটা ঠেলে অ্যান্টিরুমের মধ্যে প্রবেশ করল।
সুশান্তও তাকে অনুসরণ করল।
বাকি সব লাইব্রেরী ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল।
অ্যান্টিরুমটা আকারে একেবারে খুব ছোট নয়।
লম্বায় প্রায় আট ফুট ও পাশে চার ফুট। এবং ঘরটার মধ্যে প্রবেশ করে পূর্বদিকের জানলাটা খুলে দিতেই পর্যাপ্ত আলোয় ঘরটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
সেই সঙ্গে কিরীটীর অনুসন্ধানী ও সজাগ দৃষ্টির সামনে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে সমগ্র ঘরের পরিবেশটা।
একটি দেওয়াল-সংলগ্ন কাঁচের দেওয়াল-আলমারি। ঘরের মধ্যে তার সামনে একটি লম্বা ধরনের উঁচু টেবিল।
টেবিলের সামনে একটা বসবার টুল। টেবিলটার উপরে ওয়েয়িং অ্যাপারেটাস, ফানেল, র্যাকে টেস্ট-টিউব, স্পিরিট ল্যাম্প ইত্যাদি নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক টুকিটাকি যন্ত্রপাতি রয়েছে দেখা গেল।
কাঁচের আলমারির মধ্যে নানা আকারের বেঁটে, গোল, মোটা, লম্বা অনেকগুলো শিশি সাজানো।
তার মধ্যে কোনটায় তরল পদার্থ, কোনটায় চূর্ণ প্রভৃতি নানাজাতীয় দ্রব্য দেখা যাচ্ছে।
ঘরের চারিদিকে আর একবার দৃষ্টিপাত করে কিরীটী এগিয়ে গিয়ে এবার দেওয়াল-আলমারির পিতলের কড়া লাগানো পাল্লাটা টানতেই পাল্লা দুটো খুলে গেল।
সামনেই একটা বড় বোতল নজরে পড়ে কিরীটীর।
কালো রঙের বোতলটা। বোতলের গায়ে লেবেল আঁটা। এবং লেবেলের গায়ে বড় বড় অক্ষরে ইংরাজীতে লেখা–রোজ স্প্রেয়িং সলুশন।
কি খেয়াল হল কিরীটীর, বোতলটা একবার হাতে তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো।
তার পাশেই আর একটা বোতলে সাদা চুর্ণ ভর্তি। তার গায়ে লেখা আছে বোন মিল। অর্থাৎ হাড়ের গুঁড়ো। সে বোতলটাও একবার নেড়েচেড়ে দেখে রেখে দিল কিরীটী যথাস্থানে।
তার পাশের শিশিটার গায়ে অ্যামোনিয়াম সালফেট লেবেল আঁটা।
সহসা ঐসময় পশ্চাতে বৃন্দাবন সরকারের কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালো কিরীটী তার দিকে।
এই ঘরটা কাকার নিজস্ব ল্যাবরেটারী ছিল। বৃন্দাবন সরকার বললেন।
ল্যাবরেটারী!
হ্যাঁ, ঐরকমই খানিকটা। এ বাড়ির পিছনে মস্ত বড় একটা নিজের হাতে তৈরী ফুলের বাগান আছে মিঃ রায়, আপনি দেখেননি। আর ঐ বাগানে বেশীর ভাগই হচ্ছে নানাজাতীয় গোলাপের গাছ। অনেক টাকা খরচ করে দেশ-দেশান্তর থেকে নানা জাতের গোলাপ গাছ বহুদিন ধরে সংগ্রহ করে ঐ বাগানে লাগিয়েছিলেন।
হুঁ। তাহলে দেখছি আপনার কাকা সারদাবাবুর গোলাপ গাছের একটা রীতিমত নেশা ছিল বলুন? কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
হ্যাঁ, ঐ একটি ও বই পড়া—এ দুটি নেশাই তাঁর ছিল। তার মধ্যে আবার গোলাপ গাছের নেশাটা ছিল একটু বেশী। নানা বই পড়ে পড়ে নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে, নিজেই তাঁর এই ল্যাবরেটারী ঘরে বসে, গোলাপ গাছের সার তৈরী করে সেই সব সার তার সব গাছের গোড়ায় দিতেন।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে, তাই দেখছি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সার তৈরী করে তিনি কাজে লাগাতেন। হ্যাঁ ভাল কথা বৃন্দাবনবাবু, আপনার কাকা লেখাপড়া কতদূর করেছিলেন?
ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স।
অতঃপর কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন এ ঘরটা আমার দেখা হয়ে গিয়েছে।
পুনরায় হলঘরেই অর্থাৎ পূর্বেকার লাইব্রেরী ঘরেই সকলে ফিরে এল।
মধুসূদন সরকার ঐসময় লাইব্রেরী ঘরে ছিলেন না।
বৃন্দাবনবাবুর দিকে তাকিয়েই কিরীটী বললে, শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই যে বৃন্দাবনবাবু, তিনি তো শুনেছি এখানেই আছেন
হ্যাঁ, তবে কাকার মৃত্যুর পর থেকে তিনি ঘর থেকে বড় একটা বেরও হন না, কারও সঙ্গে কথাবার্তাও বলেন না। ডেকে পাঠাব কি এ ঘরে?
কোন্ ঘরে আছেন তিনি?
এ ঘরেরই পাশের ঘরে তিনি থাকেন।
বেশ, একটিবার খবর পাঠান যে আমি তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই, তার অসুবিধা না হলে।
বৃন্দাবন সরকার ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
মিনিট দশেকের মধ্যেই বৃন্দাবন সরকার ফিরে এলেন, চলুন মিঃ রায়।
কিরীটী ঐসময় দাঁড়িয়ে খোলা জানলার সামনে বাইরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে পাইপ টানছিল, বৃন্দাবন সরকারের ডাকে ফিরে তাকালো।
তাঁর ঘরেই তিনি আছেন, সেখানেই চলুন।
চলুন। বলে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে বৃন্দাবন সরকারের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, একটি কথা বৃন্দাবনবাবু–
বলুন?
ওঁর সঙ্গে যখন আমি কথা বলব, তখন একমাত্র সুশান্তবাবু ছাড়া সেখানে অন্য কেউ থাকেন আমার ইচ্ছা নয়।
মুহূর্তকাল বৃন্দাবন সরকার চুপ করে রইলেন। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, বেশ তাই হবে, তবে একটা রিকোয়েস্ট জানাব আপনাকে।
নিশ্চয়ই, বলুন!
কাকার মৃত্যুতে উনি বড় শক পেয়েছেন, সেই কারণেই আজ পর্যন্ত ওঁকে আমরা কেউই এখান থেকে যাবার কথা পর্যন্ত বলিনি…
ও!
হ্যাঁ, উনি নিজে থেকে যেদিন যাবেন যাবেন—তাই বলছিলাম এমন কোন কথা ওঁকে জিজ্ঞাসা করবেন না যাতে করে উনি মনে ব্যথা পান বা ওঁর কোনরূপ বিরক্তির কারণ ঘটে।
মুহূর্তকাল বৃন্দাবন সরকারের মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে মৃদকণ্ঠে কিরীটী বললে, তাই হবে। চলুন।
১০. লাইব্রেরী ঘর থেকে বের হয়ে
লাইব্রেরী ঘর থেকে বের হয়ে তারই লাগোয়া ঘরটির পর্দা-ফেলা-দরজার সামনে এসে সকলে দাঁড়াল।
চলুন। বৃন্দাবনবাবুই সর্বাগ্রে দরজার পর্দাটা হাত দিয়ে সরিয়ে ওঁদের আহ্বান জানালেন ভিতরে প্রবেশের।
প্রথমে বৃন্দাবনবাবু ও তার পশ্চাতে কিরীটী ও সর্বশেষে সুশান্ত ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে।
মাঝারি আকারের ঘরটি।
ঝকঝকে মোজেইক টাইলের ঠাণ্ডা মেঝে।
ঘরের একটিমাত্র জানলা খোলা ছিল, তবে জানলার পর্দা টেনে রাখার জন্য ঘরের মধ্যে দিনের বেলাতেও পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করতে পারেনি।
ঘরের একধারে একটি সিংগল খাটের উপরে বেডকভারে ঢাকা শয্যা।
অন্যদিকে একটি প্রমাণসাইজের আরশি-বসানো আলমারি। তার পাশে বড় একটি কালো ট্রাঙ্ক ও তার ওপরে একটি চামড়ার সুটকেস।
ঘরের অন্য কোণে ত্রিপয়ের উপরে সুদৃশ্য একটি টাইমপিস ও তার পাশে কারুকার্যখচিত একটি জয়পুরী ফ্লাওয়ার ভাসে একগুচ্ছ টাটকা বড় বড় ব্ল্যাকপ্রিন্স গোলাপফুল।
ফ্লাওয়ার ভাসটার সামনেই ধূপদানিতে প্রজ্বলিত একটি মোটা ধূপকাঠি।
গোলাপের ও চন্দন ধূপের সুমিষ্ট মিশ্র গন্ধ ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীকে আকৃষ্ট করেছিল।
আলমারিটার পাশেই আলনায় কয়েকখানি শাড়ি পাট করে রাখা।
ঘরের পশ্চিম কোণে একটি গোল টেবিলের চারপাশে খানতিনেক সোফা। তারই একটায় দরজার দিকে পিছন ফিরে বোধ হয় শকুন্তলা দেবী বসেছিলেন।
কারণ ঘরে ঢুকে তাকে না দেখা গেলেও তার মাথার কালো কেশ কিরীটীর চোখে পড়েছিল।
শকুন্তলা, মিঃ রায় এসেছেন!
বৃন্দাবনবাবুর গলার সাড়া পেয়ে শকুন্তলা উঠে দাঁড়াল সোফা থেকে।
ঈষৎ হরিদ্রাভ গাত্রবর্ণ।
লম্বায় পাঁচ ফুটের একটু বোধ হয় কমই হবে শকুন্তলা।
মুখখানা মঙ্গোলিয়ান টাইপের হলেও এবং ছোট চোখ ও নাকটা একটু চাপা হলেও মুখখানির মধ্যে চমৎকার আলগা একটি শ্ৰী আছে।
পরিধানে জরিপাড় ঈষৎ নীলাভ একটি তাঁতের দামী শাড়ি।
মাথায় পর্যাপ্ত কেশ। এলোমেলো হয়ে রয়েছে।
হাতে দুগাছি করে সোনার চুড়ি।
কানে নীলার টাব।
পায়ে চপ্পল।
না, না—আপনাকে উঠতে হবে না শকুন্তলা দেবী, আপনি বসুন বসুন-কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে।
শকুন্তলা দ্বিরুক্তি না করে কিরীটীর অনুরোধে যে সোফাটার উপর বসেছিল, সেই সোফাতেই পুনরায় বসে পড়ল।
তাহলে আপনি কথা বলুন ওঁর সঙ্গে মিঃ রায়। আমি লাইব্রেরী ঘরে আছি। বৃন্দাবন সরকার ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী আর সুশান্ত দুজনে অন্য দুটি খালি সোফায় পাশাপাশি বসল।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত শকুন্তলা দেবী, তবে বেশীক্ষণ আপনাকে বিরক্ত আমি করব না। দুচারটে কথা আপনাকে আমার জিজ্ঞাস্য আছে মাত্র।
শকুন্তলা কিরীটীর কথায় বারেকের জন্য মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল নিঃশব্দে, পুনরায় নিঃশব্দেই মুখটা নামিয়ে নিল।
আমার পরিচয়টা সর্বাগ্রে আপনাকে বোধ হয় দেওয়া কর্তব্য মিস ত্রিবেদী। কিরীটী বললে।
বৃন্দাবনবাবুর মুখেই শুনলাম, আপনি মিঃ সরকারের হত্যারহস্যের তদন্তের জন্যই এসেছেন!
ও, তাহলে বোধ হয় আমার বক্তব্য আমি শুরু করতে পারি?
বলুন, কি জানতে চান?
সহজ সতেজ কণ্ঠস্বর শকুন্তলার।
সারদাবাবুকে নিয়মিত বই পড়ে শোনানো ও তার লেখাপড়ার টুকটাক কাজগুলো করে দেবার জন্যই তো আপনি নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাই না? কিরীটী এবার প্রশ্ন শুরু করে।
হ্যাঁ।
আচ্ছা, সারদাবাবুর মেজাজ কি রকম ছিল শকুন্তলা দেবী?
খুব ঠাণ্ডা ও ধীর মেজাজ ছিল তার, কচিৎ কখনো হয়তো রেগে উঠতেন—
নিজের মতের সঙ্গে না মিললেই, এই তো?
হ্যাঁ।
আপনি তো এখানে প্রায় মাস আষ্টেক আছেন, তাই না?
হ্যাঁ।
এই সময়ের মধ্যে বৃন্দাবনবাবু এখানে কি রকম আসা-যাওয়া করতেন?
হপ্তায় দুবার বা মাঝে মাঝে তিনবারও এসেছেন।
এই কমাসে আপনার তার সঙ্গে নিশ্চয়ই বেশ আলাপ হয়েছে! কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে তাকায়।
কেন বলুন তো মিঃ রায়? আপনার জিজ্ঞাস্যটা ঠিক কি জানতে পারি কি? পালটা প্রশ্ন করে শকুন্তলা ড়ু উত্তোলিত করে তাকালো কিরীটীর মুখের দিকে সুস্পষ্ট দৃষ্টিতে প্রায় যেন সঙ্গে সঙ্গেই।
না, না-আপনি অন্য রকম কিছু ভাববেন না শকুন্তলা দেবী, বৃন্দাবনবাবু সম্পর্কে আপনার ধারণাটাই জিজ্ঞাস্য শুধু।
ওঃ! তা ভদ্রলোক পারফেক্ট জেটেলম্যান বলেই তো আমার মনে হয়।
আর মধুসূদনবাবু?
কিরীটীর শেষের কথায় চমকে যেন শকুন্তলা দেবী তাকালো তার মুখের দিকে মুহূর্তের জন্য। এবং ক্ষণেকের সেই চমকটা কিরীটীর দৃষ্টিকে তো এড়ায়নিই, সুশান্তর দৃষ্টিকেও ফাকি দিতে পারে না।
কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যই। পরক্ষণেই শান্ত স্থির দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, I am sorry! ভদ্রলোকের সঙ্গে বিশেষ কোন আলাপের এখনও কোন সুযোগই আমার হয়নি। কাজেই তার সম্পর্কে কোন কথা আমি বলতে পারবও না।
প্রত্যুত্তরে কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর আবার তার প্রশ্ন শুরু করে, আপনি শুনলাম অনেক দিন নাকি বর্ষায় ছিলেন, তাই কি শকুন্তলা দেবী?
হ্যাঁ।
বর্মায় কোথায় ছিলেন?
দ্বিতীয়বার তখনি শকুন্তলা আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করল, বর্মায় আপনি গিয়েছেন নাকি কখনও মিঃ রায়?
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, হ্যাঁ, সেইজন্য বর্মা দেশের প্রায় সব কিছুই মোটামুটি আমার জানা।
রেঙ্গুনে। মাথাটা নিচু করে শকুন্তলা অতঃপর বললে।
প্রপার রেঙ্গুন শহরেই বরাবর ছিলেন?
হ্যাঁ।
ভাল কথা শকুন্তলা দেবী, সারদাবাবুর যে হার্টের ট্রাবলস ছিল, আপনি তো তা জানতেন?
জানতাম।
মধ্যে মধ্যে তিনি ইনসমনিয়ার জন্য আবার ঘুমের ঔষধ খেতেন, তাও আপনি জানতেন?
জানতাম।
আচ্ছা যে রাত্রে সারদাবাবু মারা যান, সেরাত্রে কখন আপনার সঙ্গে সারদাবাবুর শেষ দেখা হয় ও তার সঙ্গে আপনার শেষ কথাবার্তা হয়?
ঠিক মনে নেই, তবে রাত প্রায় সাড়ে নটা পর্যন্ত আমরা লাইব্রেরী ঘরেই ছিলাম। ওঁকে আমি বই পড়ে শোনাচ্ছিলাম। ঐসময় বৃন্দাবনবাবু ওঁর সঙ্গে কি জরুরী কথাবার্তা বলতে আসায় আমাকে ছুটি দিয়ে ওঁরা মিঃ সরকারের ঘরের দিকেই যান।
তাদের মধ্যে তাহলে সেরাত্রে কি ধরনের কথাবার্তা হয়, আপনি কিছুই জানেন না? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না।
কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি, আপনি নাকি ঐ রাত্রেই রাত এগারোটা নাগাদ আবার সারদাবাবুর ঘরে গিয়েছিলেন, কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ঐ সময় তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন আবার তার ঘরে।
অত রাত্রে?
হ্যাঁ, লুমিনলের ফাইলটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
আপনি বুঝি মধ্যে মধ্যে তাকে ঔষধপত্রও দিতেন?
দিতাম।
হুঁ, তারপর আপনি কি করলেন?
ঔষধের ফাইলটা খুঁজে দিয়ে যখন চলে আসছি আমাকে বললেন, দশরথকে এক কাপ চা তাকে দিয়ে যেতে বলবার জন্য।
বলেছিলেন আপনি সেকথা দশরথকে?
হুঁ–আমি বলিনি, তবে গোকুলকে দিয়ে বলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
আচ্ছা সে সময় সারদাবাবুর মুড আপনার কি রকম লেগেছিল?
কেন, হি ওয়াজ পারফেক্টলি অল রাইট, নাথিং অ্যাবনরমাল আই ফাউণ্ড দেয়ার!
আই সি! আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, এ বাড়িতে সারদাবাবুর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে কেতু নামে কে একজন লোককে কাজে বহাল করা হয়েছিল এবং যার আজ পর্যন্ত সেইদিন সকাল থেকে কোন সন্ধানই আর পাওয়া যায়নি, কথাটা জানেন বোধ হয়?
জানি। একটু যেন ভেবে সময় নিয়ে ধীরে কথাটা উচ্চারণ করল শকুন্তলা।
লোকটার চেহারা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে?
য়্যাঁ! একটু যেন চমকেই ওঠে শকুন্তলা, তারপর সেই ভাবটা সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, তা মনে আছে বৈকি।
লোকটাকে আবার দেখলে বা তার কোন ফটো দেখলে চিনতে পারবেন আশা করি।
বোধ হয় পারব। কারণ তার চেহারা বেশ ঢ্যাঙা ছিল এবং বাঁ পা-টা ডিফেকটিভ থাকার দরুণ সামান্য একটু পা-টা টেনে কুঁজো হয়ে লোকটা চলত লক্ষ্য করেছিলাম।
আর একটি কথা শকুন্তলা দেবী, আপনি বোধ হয় এখন কিছুদিন এখানেই থাকবেন, তাই না?
তা ঠিক এখনো কিছু বলতে পারছি না। তারপর একটু থেমে বললে, ওরা যদি আমাকে রাখেন তো থাকতেও পারি।
সেরকম কোন কথা আজ পর্যন্ত-মানে বৃন্দাবনবাবুর সঙ্গে আপনার হয়নি?
না।
আচ্ছা, আর আপনাকে বিরক্ত করব না, উঠি-নমস্কার। কথাটা বলে ঘুরে তাকালো কিরীটী সুশান্তর দিকে এবং বললে, চলুন সুশান্তবাবু!
চলুন। সুশান্তও উঠে দাঁড়ায়।
১১. শকুন্তলার ঘর থেকে বের হয়ে
শকুন্তলার ঘর থেকে বের হয়ে উভয়ে আবার লাইব্রেরী ঘরেই ফিরে এসে প্রবেশ করল।
লাইব্রেরী ঘরের মধ্যে দুটো সোফায় মুখোমুখি বসে তখন বৃন্দাবন সরকার ও মধুসুদন। সরকার দুই ভাই নিম্নকণ্ঠে কি সব কথাবার্তা বলছিলেন। ওদের পদশব্দে দুজনাই মুখ তুলে তাকালেন।
বৃন্দাবনবাবু, আপনার কাকা সারদাবাবু যে ঘরে মারা গিয়েছিলেন সেই ঘরটা যে একটিবার দেখতে চাই! কিরীটী ঘরে ঢুকেই বৃন্দাবনবাবুকে লক্ষ্য করে কথাটা বললে।
বেশ তো চলুন—উঠে দাঁড়ালেন সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবন সরকার।
সারদাবাবুর মৃত্যুর পর থেকে এযাবৎকাল তার নিজস্ব ঘরটা তালা দেওয়াই ছিল! বৃন্দাবন সরকার তার নিজের ঘর থেকে চাবিটা নিয়ে এসে ঘরের তালা খুলে ওদের নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন।
ঘরের জানলাগুলো বন্ধ ছিল।
কিরীটীর নির্দেশে বৃন্দাবন সরকার ঘরের জানলাগুলো খুলে দিলেন।
সুশান্তর মনে পড়ল, মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বে এই ঘরে প্রথম যেদিন সে এসে পদার্পণ করেছিল, সামনেই ঐ মেঝেতে সারদাচরণ সরকারের নিপ্রাণ দেহটা পড়েছিল সেদিন।
সেই একই বাড়িতে গতরাত্রে আবার একজন নিহত হয়েছে। এবং সম্ভবত তারও মৃত্যুর কারণ একই।
বিষপ্রয়োগ!
একজন এই বাড়ির মালিক, অন্যজন তার বিশ্বস্ত পুরাতন ভৃত্য।
প্রভু সারদাচরণ সরকার ও তার ভৃত্য দশরথ।
ঘরের আসবাবপত্র সেদিন যেমনটি সে দেখেছিল আজও ঠিক তেমনটিই রয়েছে, মনে হল সুশান্তর।
সেই পালঙ্ক, সেই টেবিল, চেয়ার—
সহসা কিরীটীর ডাকে সুশান্ত তার দিকে ফিরে তাকালো।
সুশান্তবাবু?
বলুন।
সেদিন তো, মানে সারদাবাবুর মৃতদেহ যেদিন আবিষ্কৃত হয়, আপনি এ ঘরে এসেছিলেন? কিরীটীর প্রশ্নে মৃদুকণ্ঠে সুশান্ত জবাব দেয়, হ্যাঁ।
সেদিন ঘরের মধ্যে সব কিছু যেমন ছিল, আজও কি ঠিক তেমনিই অ্যাজ ইট ওয়াজ আছে বলে মনে হচ্ছে?
সুশান্ত বারেকের জন্য আবার ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে বললে, তাই তো মনে হচ্ছে।
কিরীটী অতঃপর লিখবার টেবিলের সামনেই সর্বপ্রথম এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ও টেবিলের সাইডে যে ড্রয়ার ছিল তার সবার উপরের ড্রয়ারটা টানতেই সেটা বের হয়ে এল।
ড্রয়ারটা ভর্তি নানা টুকিটাকি জিনিসপত্রে। একটা মোটা ডাইরী কালো রংয়ের মলাটের, গোটা দুই ঝর্ণা কলম, একটা শেফিল্ডের ছুরি, একটা জেমস পকেট ডিক্সনারী, কোরামিনের একটা ফাইল ও একটা লুমিনল ট্যাবলেটের টিউব।
এটা-ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে কিরীটী লুমিনল ট্যাবেলেটের টিউবটা তুলে নিল ড্রয়ার থেকে।
একেবারে আনকোরা টিউব। মুখ খোলাই হয়নি তখনও। কুড়িটা ট্যাবলেটই রয়েছে।
কি ভেবে কিরীটী টিউবটা নিজের পরিধেয় কোটের পকেটে রেখে দিল।
তারপর কালো মলাটের ডাইরীটা তুলে নিল ড্রয়ার থেকে।
অন্যমনস্ক ভাবে ডাইরীর পাতা উল্টে উল্টে দেখতে লাগল। কিছু নাম ও ঠিকানা লেখা। মধ্যে মধ্যে টাকার হিসাব লেখা এবং শেষের দিকে এক জায়গায় দেখল লেখা আছে-গাছের নানা প্রকারের সারের কথা।
তারই এক জায়গায় বিশেষভাবে তার দৃষ্টি যেন আকৃষ্ট হল। সেখানে লেখা : এককালে আমেরিকায় একপ্রকার স্থানীয় উদ্ভিদের নাম ছিল নিকোটিয়ানা, এখন অবিশ্যি ভারতবর্ষে নাকি ঐজাতীয় উদ্ভিদ প্রচুর আছে। নিকোটিয়ানা থেকে দুই প্রকারের অ্যালকলয়েড পাওয়া। যায়। নিকোটিন ও নিকোটিনাইন। ঐ নিকোটিনে খুব ভাল গাছের সার হয় যদিও ওটা তীব্র বিষ। মাত্র দুতিন ফেঁটা নিকোটিন বিষই মারাত্মক—মাত্র দুতিন মিনিটের মধ্যে মৃত্যুই ঘটতে পারে। পিওর বা খাঁটি নিকোটিন অ্যালকলয়েডের কোন রং নেই, জলের মতই সাদা।
ঐ পর্যন্তই। আর কিছু লেখা নেই ঐ পৃষ্ঠায়।
আবার কিরীটী পাতা উল্টে যায় ডাইরীর।
সহসা আবার এক পাতায় দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ হয় একটি লাইনের উপর।
নতুন সারটার নাম দিলাম : রোজ প্রেয়িং সলুশন।
সুশান্তবাবু?
সুশান্তর দিকে ফিরে সহসা কিরীটী ডাকল।
কিছু বলছিলেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ, শুনুন—বলে সুশান্তর কানের কাছে মুখ নিয়ে কিরীটী নিম্নকণ্ঠে যেন কি বললে তাকে। পরমুহূর্তেই সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী ডাইরীটাও পকেটস্থ করল।
এবারে কিরীটী দ্বিতীয় ড্রয়ারটা টেনে খুলল। কিন্তু দ্বিতীয় ড্রয়ারটি টেনে খুলেই যেন কিরীটীর মনে বিস্ময়ের একটা চমক লাগে।
টুকিটাকি সব প্রসাধন দ্রব্য ড্রয়ারের মধ্যে রয়েছে। পাউডার, সেন্ট,-দামী ইভনিং প্যারি সেন্ট, ছোট একটি সুদৃশ্য আয়না। একটি চিরুনি, একটি চুল ভোলার সন্না, ছোট একটি কাঁচি, একটি দামী কলপের শিশি। ঐসব ছাড়াও এক টিন ৯৯৯ সিগারেট ও একটি দেশলাই। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে ঐ জিনিসগুলোর দিকে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে একসময় আবার কিরীটী নিঃশব্দে ড্রয়ারটা বন্ধ করে দিল। এবং অদূরে নিঃশব্দে দণ্ডায়মান বৃন্দাবনবাবুর দিকে ফিরে তাকাল।
বৃন্দাবনবাবু!
বলুন?
আপনার কাকাবাবু একটু বেশ শৌখীন প্রকৃতির ছিলেন, তাই না?
না তো! তবে ইদানীং—বলতে গিয়েও থেমে যান বৃন্দাবন সরকার, যেন কেমন একটু ইতস্ততঃ করেন।
কি? থামলেন যে?
না, তেমন বিশেষ কিছু নয়। তবে ইদানীং মাসখানেক ধরে যেন একটু মনে হয়েছে নিজের সাজসজ্জার প্রতি তার একটু নজর পড়েছিল। নচেৎ বরাবরই তো জ্ঞান হওয়া অবধি দেখে এসেছি অত্যন্ত সিম্পল, বিলাসিতাকে ঘৃণাই করতেন। বেশভূষা কিছুতেই কোন নজর কোনদিনই ছিল না।
হুঁ। আচ্ছা আপনার কি মনে হয় বৃন্দাবনবাবু, ইদানীং তার ঐ পরিবর্তনের কোন কারণ ঘটেছিল?
প্রশ্নটা করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবার তাকাল কিরীটী বৃন্দাবন সরকারের মুখের দিকে। এবং কিরীটীর ঐ স্পষ্টাস্পষ্টি প্রশ্নে বৃন্দাবন সরকার যে সহসা একটু বিব্রত হয়ে পড়েছেন সেটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে কিরীটীর কষ্ট হয় না। মনে মনে তার অতি দুঃখে হাসি এলেও, বাইরে কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না।
না, মানে, আমি ঠিক বলতে পারব না মিঃ রায়! একটু যেন থেমে থেমে কথাগুলো কোনমতে উচ্চারণ করেন বৃন্দাবন সরকার। ( ঠিক ঐ মুহূর্তে সুশান্ত এসে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করলে। এবং কিরীটীর দিকে তাকাতেই
পরস্পরের চোখে চোখে কি যেন কথা হল নিঃশব্দে।
কিরীটী এবারে সর্বশেষ ড্রয়ারটি টেনে খুললে। কিন্তু তার মধ্যে বিশেষ কোন দ্রষ্টব্য বস্তু তার চোখে পড়ল না।
বেলাও ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে দশটা হয়ে গিয়েছিল।
বৃন্দাবন সরকারের দিকে চেয়ে কিরীটী বললে, চলুন মিঃ সরকার, এ-ঘরে আর আমার দেখবার কিছু নেই।
অন্য ঘরগুলো দেখবেন না? বৃন্দাবন সরকার প্রশ্ন করেন।
এখন আর নয়। বিকেলের দিকে এসে আপনাদের বাগানটা একবার দেখব, কিরীটী বলে।
বেশ তো আসবেন। তবে আজই আমি কলকাতায় চলে যাচ্ছি দুপুরের ট্রেনে মিঃ রায়। আজই যাবেন?
হ্যাঁ, দাদা বোধ হয় এখানেই থাকছেন। আপনার যা প্রয়োজন ওঁকেই বলবেন। কাকার মৃত্যুর পর কলকাতায় তো আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দোকানের হিসাবপত্রও সব একবার দেখা দরকার।
তা তো নিশ্চয়ই। তা কবে ফিরছেন?
তা ঠিক বলতে পারছি না। তবে হপ্তাখানেকের আগে ফিরতে পারব মনে হয় না।
১২. একটা কথা জিজ্ঞাসা করব
একটা কথা জিজ্ঞাসা করব মিঃ রায়? সুশান্ত সহসা প্রশ্ন করে।
নিশ্চয়ই।
আপনার সন্দেহের তালিকার মধ্যে–
সুশান্তর কথাটা তাকে শেষ না করতে দিয়ে কিরীটী বলে ওঠে, শকুন্তলাও আছেন কিনা, এই তো আপনার প্রশ্ন সুশান্তবাবু? দুঃখের বিষয়, আছেন। কি জানেন সুশান্তবাবু, ক্রিমিন্যাল মাইনডেড়দের মুখের একটা-না-একটা বিশেষত্ব নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন যদি সেই মুখগুলোর দিকে একটু ভাল করে চেয়ে দেখেন!
আপনার কথাটা কিন্তু ঠিক আমি বুঝতে পারলাম না মিঃ রায়!
পারলেন না? আচ্ছা আবার যখন ওদের মানে বৃন্দাবনবাবু, মধুসূদনবাবু ও শকুন্তলা দেবীকে দেখবেনওদের মুখের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখবেন তো, তাদের কারও মুখের কোন বিশেষ পিকিউলিয়রিটি আপনার চোখে পড়ে কিনা?
দেখব। কিন্তু—
এটা তো বিশ্বাস করেন, মুখই হচ্ছে মানুষের মনের আয়না?
সর্বত্র না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে অ্যাপলিকেবল কথাটা কিছু অতিশয়োক্তি নয়। কিন্তু যাক যে কথা। একটা কাজ আপনাকে করতে হবে যে!
বলুন?
শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে আপনাকে আলাপ জমাতে হবে।
তার মানে?
আপনার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে, কাজটা যেন আপনার কাছে অত্যন্ত দুরূহ বলে ঠেকছে! কাজটা অবিশ্যি আমিই চেষ্টা করতাম কিন্তু সেটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে, কারণ তিনিও যখন আপনার প্রতি মুগ্ধ–
মিঃ রায়, আমি মানে—
উঁহু, আপনি ভুল করছেন সুশান্তবাবু। স্রেফ আড্ডা দেওয়া বা শকুন্তলার সঙ্গে আপনাকে আমি সাধারণ আলাপ জমাতে বলছি না। উদ্দেশ্য আমার অন্য–
উদ্দেশ্য—
হ্যাঁ, তবে সেটা এখন বলব না, ক্রমশ জানতে পারবেন।
কিন্তু–
ভাবছেন সুযোগের কথা? বিমুগ্ধমনেরা পরস্পর সুযোগ আপনা থেকেই করে নেয়। সেজন্য আপনি চিন্তা করবেন না।
কিরীটী বৃন্দাবন সরকারকে বলে এসেছিল, বিকেলের দিকে আবার সে সরকার ভিলায় আসবে। কিন্তু ঐদিন বেরুতে বেশ দেরিই হয়ে গেল।
ফ্যাটি গুপ্তর জরুরী একটা চিঠি এসেছে কলকাতা থেকে, তাকে ঐদিনই বিকেলের ট্রেনে কলকাতা ফিরতে হবে, বিনয় ও সুশান্ত তাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে গেল, কাজেই ওদের স্টেশন থেকে না ফিরে আসা পর্যন্ত অনুরোধ জানিয়ে গেল কিরীটীকে সে যেন না বের হয়, অপেক্ষা করে।
ডাইনীর বাশী।
প্রায় সন্ধ্যার মুখোমুখি সুশান্ত ও বিনয় স্টেশন থেকে ফিরে এল।
কিরীটী বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়েই একটা সোফার উপর বসে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা উল্টেপাল্টে দেখছিল। সুশান্ত ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে, মিঃ রায়, বেরুনো যাক!
চলুন। কিরীটী উঠে দাঁড়ায়।
সরকার-ভিলার বাইরের ঘরে প্রবেশ করতেই ভৃত্য গোকুলের সঙ্গে ওদের দেখা হয়ে গেল।
এ বাড়িতেই তো তুমি কাজ কর? কিরীটী গোকুলকে শুধায়।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তোমার নাম কি?
কিরীটীর প্রশ্নে গোকুল জবাব দেয়, গোকুল।
বাবুদের কাউকে একবার খবর দিতে পার গোকুল, বলগে কিরীটীবাবু আর সুশান্তবাবু এসেছেন।
ছোটবাবু তো নেই, বড়বাবু আছেন। গোকুল বলে।
তাঁকেই তাহলে খবর দাও।
যান না, বড়বাবু তো বাগানেই আছেন। ঐ বারান্দার পশ্চিম দিক দিয়ে নেমে যান। গোকুল বাগানে যাবার পথটা দেখিয়ে দিল।
কিরীটী আর সুশান্ত নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যায়।
বারান্দার শেষপ্রান্তে পশ্চিম দিকে ছোটমত একটা গেট। গেট খুললেই তিন ধাপ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। এবং সিঁড়ি অতিক্রম করে পঞ্চাশ গজ গেলেই পুরোপুরি সমস্ত বাগানটা দৃষ্টির সামনে ভেসে ওঠে।
উদ্যানে যে কত প্রকারের ফল, ফুল ও পাতাবাহারের গাছ তার যেন কোন সংখ্যা নেই। ছোট বড় মাঝারি নানা আকারের সব গাছ। কোথাও গাছের নিবিড়তা ঝোপের সৃষ্টি করেছে, কোথাও দীর্ঘ ইউক্যালিপটাস গাছ, কোথাও আনারসের ঝাড়, কোথাও ক্রোটন ও পাতাবাহারের ঝোপ, কোথাও চীনা বাঁশের ঝাড়, কোথাও শুধু সারি সারি গোলাপ আর গোলাপ গাছ। লাল সাদা হলদে গোলাপী নানা রঙের নানা আকারের অজস্র গোলাপ ফুটে রয়েছে।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে গেল কিরীটী। আর তাকে ধীরপদে অনুসরণ করে চলে সুশান্ত।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মৃদুকণ্ঠে একসময় কিরীটী বলে, অনেক সময় শ্রম ও অধ্যবসায়ই দিয়েছিলেন দেখছি মৃত সারদাবাবু তার এই উদ্যানের পিছনে, কি বলেন সুশান্তবাবু?
তাই। সত্যিই চমৎকার। ওদিকটা একটু ঘুরে দেখে আসি, বলে ডানদিকে গোলাপ বাগিচার দিকে এগিয়ে গেল সুশান্ত।
সামনেই একটা চীনা বাঁশের ঝাড়।
নাতিদীর্ঘ সরু সরু বাঁশগুলো সামান্য একদিকে যেন গুচ্ছে গুচ্ছে হেলে পড়েছে। এবং সরু চিকন পাতাগুলো হাওয়ায় সিপ সিপ শব্দ করে চলেছে একটানা। দিনান্তের শেষ বিষণ্ণ আলোয় হঠাৎ বাঁশগুচ্ছের ফাঁকে ফাঁকে ঝাড়ের উল্টোদিকে বিশেষ একটি দৃশ্য কিরীটীর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
সবুজ চিকন চিকন পাতাগুলোর ফাকে পাকে পর্যপ্ত কেশের একটি অগোছাল খোঁপা ও বাসন্তীরঙের শাড়ি জড়ানো একটি পৃষ্ঠের উর্ধাংশ চোখে পড়ে।
সামনে ওদের পায়ে চলার পথটা বাঁশের ঝাড়টাকে বাঁয়ে রেখে আরও সামান্য একটু এগিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে।
কিরীটী মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে যেন কি ভাবে, তারপরই পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেল, দূরে হাত দশেক তফাতে সুশান্ত গোলাপ বাগিচার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিরীটী নিঃশব্দে বাঁয়ের পথ ধরে এগিয়ে চলল।
কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়।
চীনা বাঁশঝাড়ের একেবারে কোল ঘেঁষে সবুজ ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে সামনের দিকে একাকিনী বসে শকুন্তলা।
শকুন্তলা ত্রিবেদী।
পরিধানে বাসন্তীরঙের কালো চওড়াপাড় একটি শাড়ি।
গায়ে লাল ভেলভেটের কনুই পর্যন্ত হাতা একটি ব্লাউজ।
ঠিক যেন অরণ্য দেবী বনছায়াতলে আঁচল বিছিয়ে বসে বিশ্রাম করছেন অলস শিথিল ভঙ্গীতে।
একটা কড়া উগ্র তামাকের গন্ধ কিরীটীর অভ্যস্ত ও পরিচিত নাসারন্ধ্রে এসে প্রবেশ করে। সহসা যেন আত্মচিন্তায় নিমগ্ন উপবিষ্ট শকুন্তলার কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এবং ঐদিকে আরও একটু অগ্রসর হতেই গন্ধটা আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
বর্মা চুরুটের পরিচিত গন্ধ। কিরীটীর ভুল হবার নয়।
এদিক ওদিক তাকাতেই অল্প দূরে ঘাসের ওপর একটি নিঃশেষিত-প্রায় বর্মা চুরুট এবারে ওর নজর পড়ে।
মৃদু হেসে মুহূর্তকাল কিরীটী আপন মনে যেন কি ভাবে। তারপর মৃদুকণ্ঠে ডাকে, শকুন্তলা দেবী।
কে?
চমকে ফিরে তাকাতেই শকুন্তলা সামনেই দণ্ডায়মান কিরীটীকে দেখতে পেয়ে একটু যেন বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করে, এ কি, আপনি!
হ্যাঁ। সারদাবাবুর বাগানটা ঘুরে দেখতে দেখতে এদিকে আসতেই লক্ষ্য করলাম, আপনি চুপচাপ বসে আছেন।
হ্যাঁ, এই নির্জন জায়গাটি বাগানের মধ্যে আমার খুব ভাল লাগে, তাই বিকেলের দিকে এখানে এসে প্রায়ই বসি।
যা বলেছেন, সত্যই চমৎকার জায়গাটি! কিন্তু মধুসূদনবাবুকে দেখছি না যে? তিনি কোথায়?
কিরীটীর শেষের কথায় যেন একটু চমকেই শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল এবং অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে উচ্চারণ করল, মধুসুদনবাবু।
হ্যাঁ, ঐ যে গোকুল বলল, তিনি নাকি বাগানেই আছেন?
তা—তা হবে। আমি তো দেখিনি।
তাহলে বোধ হয় অন্যদিকে কোথাও আছেন! হা ভাল কথা, বৃন্দাবনবাবুর আজ কলকাতায় ফিরে যাবার কথা ছিল, গেছেন নাকি চলে তিনি কলকাতায়?
হ্যাঁ, বিকেলের ট্রেনেই চলে গেলেন।
আপনার নির্জন বিশ্রামে ব্যাঘাত করছি না তো শকুন্তলা দেবী?
না, না-ব্যাঘাত কিসের আবার! আপনি বুঝি একলাই এসেছেন?
কেন বলুন তো?
না—এমনিই জিজ্ঞাসা করছিলাম।
১২. সরকার-ভিলা থেকে বের হয়ে
সরকার-ভিলা থেকে বের হয়ে কিরীটী আর সুশান্ত দুজনে মণি লজের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
বাইরে রৌদ্রের তাপ বেশ প্রখর হয়ে উঠেছে তখন।
পথে দুজনার মধ্যে আর বিশেষ কোন কথাবার্তা হয় না।
দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর পাশাপাশি বিনয় ও সুশান্ত একটা সোফায় বসে এবং কিরীটী তাদের অল্প ব্যবধানে অন্য একটি সোফায় বসে সরকার-ভিলার হত্যা-ব্যাপার সম্পর্কেই পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছিল।
সহসা একসময় সুশান্ত প্রশ্ন করে, আপনার কথায় মনে হচ্ছে মিঃ রায়, বৃন্দাবন সরকারকেই আপনি যেন একটু বেশী সন্দেহ করছেন।
সন্দেহ কাউকেই ও-বাড়ির আমি কম বেশী করছি না সুশান্তবাবু, কিরীটী হস্তধৃত পাইপটায় মৃদু একটা টান দিয়ে খানিকটা পীতাভ ধোঁয়া উদগিরণ করে বলতে থাকে, আপনাকে তো একটু আগেই বললাম, সারদাচরণ সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারটা রীতিমত জটিল। জানবেন, কবি আমাদের মিথ্যে বলেননি, পঞ্চশরে দন্ধ করে করেছে এ কি সন্ন্যাসী, বিশ্বময় দিয়েছো তারে ছড়ায়ে। পঞ্চশরের এমনই প্রতাপ যে কোন গতিই সে মানতে রাজী নয়। এই দেখুন না-আপনার কথাটাই ধরুন।
বিস্ময়ে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সুশান্ত প্রশ্ন করে, আমার কথা?
হ্যাঁ, শকুন্তলার প্রতি আপনার দুটি চক্ষুর নীরব মুগ্ধ দৃষ্টি আপনার মনশ্চক্ষে ধরা পড়ার কথা নয় অবিশ্যি, কিন্তু আমার ও শকুন্তলা দেবীর দৃষ্টিকে এড়ায়নি। মৃদু রহস্য-তরল কণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো বলে।
কিরীটীর অতর্কিত আক্রমণে সুশান্তর মুখখানা সহসা রক্তিম হয়ে ওঠে এবং মৃদু লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলে, কি যে আপনি বলেন মিঃ রায়!
মৃদু হেসে সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী জবাব দেয়, না, না—এতে তো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। সুশান্তবাবু। শকুন্তলার ইতিহাস যাই হোক না কেন, মুখখানি তার সত্যিই সুন্দর। আর সুন্দর বস্তুর প্রতি বিশেষ করে সে যদি আবার সজীব হয় তো তার প্রতি মানুষ মাত্রের আকর্ষণ তো একান্তই স্বাভাবিক।
বিনয় হো হো করে হেসে ওঠে, কিরীটীর কথায়।
সুশান্ত ঐসময় তাড়াতাড়ি কথার মোড়টা ঘুরিয়ে দেবার জন্য বলে ওঠে, কিন্তু সরকারভিলার ল্যাবরেটারী থেকে ঐসময় আমাকে রোজ স্পেয়িং সলুশন-এর শিশিটা সরিয়ে আনতে বললেন কেন মিঃ রায় এখনও বুঝতে পারছি না।
ব্যস্ত কি, সময়ে সব জানতে পারবেন। কিন্তু শিশিটা কোথায় রেখেছেন?
রেখে দিয়েছি আমার ঘরে। সাবধানে রেখেছেন তো?
হ্যাঁ।
দেখবেন সাংঘাতিক বিষ!
বিষ!
হ্যাঁ, কিন্তু যাক এখন নিশ্চিন্ত। ভাল কথা, শিশিটা যখন সরিয়ে নিয়ে আসেন কেউ আপনাকে দেখেনি তো?
না।
মধুসূদনবাবু তখন কোথায় ছিলেন?
দেখিনি।
শকুন্তলা দেবী?
জানি না, লক্ষ্য করিনি।
তার ঘরের দরজার দিকে যাবার সময় বারান্দা দিয়ে তাকানও নি?
না।
১৪. শকুন্তলার মুখের দিকে তাকিয়ে
শকুন্তলার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী এবারে বলে, না, একা আসিনি, আমার সকালের সেই বন্ধুটিও এসেছেন। ওদিককার গোলাপ বাগিচার দিকে গেলেন গোলাপ দেখতে এইমাত্র।
নিজের অনুমানটা যে মিথ্যা নয় বুঝতে পেরে কিরীটী মনে মনে একটু যেন উল্লসিতই হয়। কিন্তু চোখেমুখে তার সে ভাবটা প্রকাশ পায় না।
কিন্তু পরক্ষণেই শকুন্তলার কণ্ঠস্বরে কিরীটীর চিন্তায় ছেদ পড়ে। .
দাঁড়িয়ে কেন মিঃ রায়, জায়গাটা বেশ পরিষ্কার-বসুন না!
কিরীটী আর দ্বিধামাত্রও না করে শকুন্তলার অল্প ব্যবধানে ঘাসের উপরেই বসে পড়ল।
ক্রমশ অস্পষ্ট আলোয় চারিদিক আরও বিষণ্ণ আরও ধূসর হয়ে আসছে যেন তখন।
কিরীটীই অতঃপর একসময় কথা শুরু করে, সারদাবাবুর মৃত্যুতে আপনি শোক পেয়েছেন শকুন্তলা দেবী, তাই না?
উনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাত্র আট মাস তার কাছে কাজ করেছি, কিন্তু তার ব্যবহার কখনও ভুলতে পারব না বোধ হয় মিঃ রায় এ জীবনে।
স্বাভাবিক। এক-একজন আছেন যারা খুব সামান্য সময়ের মধ্যেই দূরের জনকে কাছে টেনে নেন। আর তাইতেই নিশ্চয়ই আপনি এ জায়গার মায়া এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
সত্যিই তাই। কে যেন সর্বক্ষণ এখানে চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরছে আমাকে।
আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, সকালে তখন একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করব-করব করে করা হয়ে ওঠেনি!
কি?
সারদাবাবু বেশ সৌখীন প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাই না?
কেন বলুন তো? হঠাৎ এ কথা আপনার মনে উদয় হল কেন?
উদয় হল কেন সে কথা নাই বা শুনলেন, কথাটা সত্য কি মিথ্যা সেটাই শুধু জিজ্ঞাসা করছি।
মুহূর্তকাল শকুন্তলা চুপ করে যেন কি ভাবতে থাকে।
অস্পষ্ট আলো-ছায়ায় কিরীটী শকুন্তলার মুখের কোন ভাবান্তর বুঝতে পারে না।
তৎসত্ত্বেও সে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে শকুলার মুখের দিকে।
মৃদুকণ্ঠে শকুন্তলা বলে, আপনার অনুমান সত্যি কি মিথ্যা তা জানি না মিঃ রায়, কারণ এখানে আসা অবধি দু মাস পর্যন্ত যাঁকে অত্যন্ত সংযমী ও কোন বিলাস-ব্যসন যাঁর নেই। বলেই মনে হয়েছিল এবং ব্যবহারেও দেখেছি, সেই লোক বলেন, আসা অবধি দু মাল আপনার অনুমন সন্ত মুখে–
ধীরে ধীরে যেন বদলে গিয়েছিলেন, তাই না? কিরীটাই শকুন্তলার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে শেষ করে।
হ্যাঁ।
কিন্তু তার কোন কারণই আপনি বুঝতে পারেননি?
না।
তাঁর কথায়বার্তায় হাবভাবে কখনও কিছু প্রকাশ হতেও দেখেননি যাতে করে তার ঐ পরিবর্তনটা—কারণ আপনি তো সব সময়ই প্রায় তার কাছে-কাছেই থাকতেন–
না, তবে একটা ব্যাপার ইদানীং মাস দুই থেকে লক্ষ্য করছিলাম—
কি?
আগে আগে ইতিহাস ও ধর্মগ্রন্থই বেশীর ভাগ তাঁকে পড়ে শোনাতে হত আমাকে, কিন্তু ইদানীং প্রায় বৈষ্ণব কাব্য থেকেই কেবল আমাকে পড়ে শোনাতে বলতেন।
তাতেও বোঝেননি ব্যাপারটা? মৃদু হেসে কিরীটী কথা বললে।
কিরীটীর কথায় যেন একটু বিস্মিত হয়েই তাকায় শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে, তারপরই হঠাৎ বলে, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! ইজ ইট পসি?
ঠিক তাই শকুন্তলা দেবী। আপনার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের আগেই কিন্তু ব্যাপারটা বোঝ উচিত ছিল তার ড্রয়ারের ভিতরকার বিশেষ দ্রব্যগুলো দেখে।
বিশেষ দ্রব্যগুলো?
হ্যাঁ, পাউডার, সেন্ট, কলপ ইত্যাদি-সৌখীন দ্রব্যগুলি নিশ্চয়ই আপনার চোখের দৃষ্টি এড়ায়নি—কারণ আপনি যখন তার ড্রয়ার খুলতেন মধ্যে মধ্যে। আমার তো মনে হয় তার ইদানীং ইনসমনিয়াটা যে বেড়ে গিয়েছিল তারও কারণ ঐ–
শকুন্তলা এবারে আর কোন জবাব দেয় না।
চুপ করেই থাকে।
মানুষের মন এমনিই বিচিত্র বটে শকুন্তলা দেবী! কিরীটী আবার বলতে থাকে, নইলে সারদাবাবুর যে বয়স ছিল সে বয়সে তো অমনটা ঘটা উচিত ছিল না। আর আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তো খুব সম্ভব–
কিরীটী তার কথা শেষ করতে পারে না।
তার আগেই যেন চমকে শকুন্তলা প্রদোষের অন্ধকারে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি, কি মিঃ রায়?
যা শকুন্তলা দেবী, পঞ্চশরের ঐ অকাল শরক্ষেপই সম্ভবত তার আকস্মিক মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।
তার মানে?
মানেটা মনে মনে চিন্তা করে দেখলে আপনিও হয়তো বুঝতে পারবেন, আমার ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া—
কিরীটীর কথাটা শেষ হল না, অদুরে পদশব্দ পাওয়া গেল এবং সুশান্তর গলা শোনা
গেল, মিঃ রায়?
কে! সুশান্তবাবু, আসুন—আমরা এখানে। শকুন্তলা দেবী, সুশান্তবাবু এসেছেন।
শকুন্তলা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলে, চলুন ঘরে যাওয়া যাক। বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।
কোথায় ছিলেন এতক্ষণ সুশান্তবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।
আমার সঙ্গে গল্প করছিলেন। জবাব এল সুশান্তর ঠিক পশ্চাতেই মধুসূদনের কণ্ঠ থেকে অন্ধকারে।
কে, মধুসূদনবাবু! কিরীটী ঘুরে দাঁড়ালো যেন সঙ্গে সঙ্গেই।
কাকার বাগানটা দেখলেন? মদুসূদন আবার প্রশ্ন করলেন একটু এগিয়ে এসে।
হ্যাঁ, দেখলাম। সত্যিই চমৎকার।
কত টাকা যে এর পিছনে ঢেলেছেন কাকা। কিন্তু এখানে আর নয়। চলুন ঘরে যাওয়া যাক।
কিন্তু এখন আর ঘরে যাব না মিঃ সরকার। একবার বিমলবাবুর ওখানে যেতে হবে, কিরীটী বলে।
বেশ তো যাবেনখন। এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।
তা মন্দ নয়, চলুন—
সকলেই অন্ধকারেই অগ্রসর হয়।
১৫. আমাকে অনুসরণ করে আসুন
আমাকে অনুসরণ করে আসুন মিঃ রায়। মদুসূদন সরকার বললেন, আপনারা পথ ঠিক হয়তো চিনতে পারবেন না। আর একটু সাবধানে আসবেন, যা চারিদিকে ঝোপ-ঝাড় বলা যায় না কিছু!
কেন, এখানে সাপ আছে নাকি? কিরীটী প্রশ্ন করে চলতে চলতেই অন্ধকারে।
খুব কি বিচিত্র নাকি কথাটা! মৃদু হেসে মধুসূদন সরকার কথাটা বললেন, চারিদিকে যা বনজঙ্গল করে গিয়েছেন এখানে কাকা, তা আচমকা একটা বাঘ বেরুলেও আশ্চর্য হবে না বোধ হয় কেউ।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, কথাটা কিন্তু একটু অতিশয়োক্তিই হল মধুসূদনবাবু আপনার।
কেন বলুন তো?
তা বৈকি। এরকম জায়গায় সাপই অতর্কিতে ছোবল বসাতে পারে, কিন্তু এখানে বাঘের আসাতে তার রক্তের আভিজাত্যে বাধবে। কিরীটী চলতে চলতেই হেসে জবাব দেয়।
শকুন্তলা আর সুশান্ত কিন্তু নিঃশব্দেই পথ অতিক্রম করছিল।
এবং কিরীটী লক্ষ্য করে তারা যেন পরস্পরের সঙ্গে একটু ঘেঁষাঘেঁষি করেই পথ চলছিল।
বারান্দার গেটের কাছাকাছি এসে সহসা আবার কিরীটী বলে, মিথ্যে বলেননি আপনি মিঃ সরকার। সত্যি আপনি সঙ্গে না থাকলে এমন অবলীলাক্রমে কিন্তু এখানে এসে পৌঁছতে পারতাম না এখন বুঝতে পারছি। তা আপনারও বুঝি শকুন্তলা দেবীর মত কাকার বাগানটা ভাল লেগে গিয়েছে?
ক্ষেপেছেন মশাই! বনজঙ্গল আমার একদম ধাতে সয় না। তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ জানিয়ে বলে ওঠেন মধুসূদন সরকার।
কিন্তু আবার অমন নিরিবিলি জায়গাও সময় বিশেষে চট করে পাওয়া যায় না, এও নিশ্চয়ই মানবেন মিঃ সরকার?
অগ্রবর্তী মদুসূদন সরকার ততক্ষণে সিঁড়ির শেষ ধাপটি অতিক্রম করে বাইরের আলোকিত বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়েছেন।
বারান্দার আলোয় মধুসূদন সরকার পরমূহুর্তেই কিরীটীর শেষের কথায় চকিতে তার দিকে ফিরে তাকাতেই মুখে প্রতিটি রেখা তাঁর স্পষ্ট দেখতে পায় কিরীটী।
কিন্তু সেও মুহূর্তের জন্য।
কিরীটীর মুখের দিকে পলকের জন্য তাকিয়েই ততক্ষণে মধুসূদন সরকার আবার মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন।
দুজনে এসে নিচের সুসজ্জিত বৈঠকখানায় মধুসূদন সরকারের নিদের্শেই সোফা অধিকার করে বসল।
মধুসূদন চা দেবার জন্য ভৃত্যকে ডেকে আদেশ দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু শকুন্তলা দেবী তাকে বাধা দিয়ে বললে, আপনি বসুন। আমি দেখছি।
কথাটা বলে উত্তরের আর অপেক্ষা না করে শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিন্তু কি জানি কেন, পরস্পরের আলাপের মধ্যে সহসা একটা ছেদ পড়ে গিয়েছিল।
বাগান থেকে ফিরবার পথে অন্ধকারে যে সহজ কথাবার্তা পরস্পরের মধ্যে চলছিল, সেটা হঠাৎই যেন ফুরিয়ে গিয়েছে।
সোফায় যে যার মুখোমুখি চুপচাপ বসে।
কারও মুখেই কোন কথা নেই।
বাইরের বারান্দায় ঐ সময় ভারী একটা জুতোর মচমচ শব্দ শোনা গেল।
কে যেন আসছে! কিরীটীই প্রথমে কথা বলে।
মধুসূদন সরকার কিরীটীর প্রশ্নের কোন জবাব দেবার পূর্বেই চব্বিশ-পঁচিশ বৎসরের একটি হৃষ্টপুষ্ট সুশ্রী যুবক ঘরে প্রবেশ করল।
এ কি! বিজন, তুমি এ সময়?
আগন্তুক যুবকটিকে সম্বোধন করে মধুসূদনই প্রথমে কথা বললেন।
হ্যাঁ–কেন, ছোটমামাই তো আমাকে তাড়াতাড়ি আসবার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন।
কে? বৃন্দাবন?
হ্যাঁ, যোধপুরে একটা বড় অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে দিল্লীতে ফিরেই মামা জরুরী চিঠি পেয়ে চলে আসছি।
বলতে বলতে আগন্তুক একটা খালি সোফায় বসে পড়ল। এবং বললে, কিন্তু এ সব কি ব্যাপার?
কিরীটী যুবকটির দিকে তাকিয়ে দেখছিল।
মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ব্যাক-ব্রাশ করা।
দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।
মুখখানি একটু লম্বাটে ধরনের।
নাকটা উঁচু, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।
ধারালো চিবুক।
পরিধানে দামী গরম সুট।
তা ছোটমামা কোথায়? বিজন আবার প্রশ্ন করল।
আজই তো বিকালের ট্রেনে কলকাতায় চলে গেল। তা বৃন্দাবন সব কথা তোমাকে জানিয়েছে নাকি?
হ্যাঁ, বিনু মামার চিঠিতেই সব জানালাম। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি সত্যি—মানে ছোট দাদুকে সামবডি হত্যাই করেছে?
তাই তো মনে হচ্ছে।
এমন সময় ভৃত্যের হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে শকুন্তলা ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
কিন্তু এঁদের তো চিনলাম না! বিজন কিরীটী ও সুশান্তকে লক্ষ্য করে মধুসূদনকেই পুনরায় প্রশ্নটা করে ঐ সময়।
হ্যাঁ, পরিচয় নেই তোমার-ইনি কিরীটী রায়—ওঁর বন্ধু সুশান্তবাবু। আর মিঃ রায়, এই আমার ভাগ্নে মানে দিদির একমাত্র ছেলে বিজন বোস।
পরস্পর পরস্পরকে নমস্কার ও প্রতিনমস্কার জানায়।
অতঃপর সংক্ষেপে কিরীটীর আগমনের হেতুটাও মধুসূদন সরকার বিজনকে জানিয়ে দেন।
শকুন্তলা সকলকে চা পরিবেশন করে।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটীই একসময় বিজনকে প্রশ্ন করে, আপনি বুঝি দিল্লীতেই থাকেন বিজনবাবু?
য়্যাঁ! না—আমি তো কলকাতাতেই থাকি।
ও! আচ্ছা, ঐ যে কি সব অর্ডার সাপ্লাইয়ের কথা একটু আগে বলছিলেন?
ও, কলকাতায় সিং অ্যাও সিং যে অর্ডার সাপ্লাইয়ের ফার্ম আছে সেখানেই আমি চাকরি করি। তাদেরই কাজে মাঝে মাঝে আমাকে সারা ভারতবর্ষে টহল দিয়ে বেড়াতে হয়।
তা আপনি যে যোধপুর গিয়েছিলেন এবং দিল্লীতে ফিরে যাবেন, বৃন্দাবনবাবু সে কথাটা জানতেন বুঝি?
না। ছোটমামা আমার ফার্মের ঠিকানায় চিঠি দিয়েছিলেন, তারাই চিঠিটা আমাকে রিডাইরেক্ট করে দেয় দিল্লীর ঠিকানায়, তারা জানত যে যোধপুর থেকে আমি দিল্লীতেই আবার ফিরব।
সহসা ঐ সময় মধুসূদন সরকার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং বলেন, এক্সকিউজ মি মিঃ রায় ফর এ ফিউ মিনিটস!
মধুসূদন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
মধুসূদন উঠে চলে যেতে কিরীটী বিজনবাবুর দিকে তাকিয়ে সহসা আবার প্রশ্ন করে, আপনি তাহলে আপনার মামা বৃন্দাবনবাবুর চিঠিতেই আপনার দাদুর মৃত্যুর সংবাদটা প্রথম জানতে পারেন বিজনবাবু?
হ্যাঁ, আমি তো চিঠি পেয়ে একেবারে ন যযৌ ন তস্ত্রেী!
তা তো হবারই কথা। তা চিঠিতে তিনি কি লিখেছিলেন?
লিখেছেন তার আকস্মিক মৃত্যুর কথা, তারপর আরও লিখেছেন, পুলিসের এবং তারও ধারণা নাকি দাদুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক বা আত্মহত্যা নয়, তীব্র নিকোটিন বিষ-প্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কথাটা বলেই বিজনবাবু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে এবারে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, আপনারও কি ধারণা তাই মিঃ রায়?
হ্যাঁ। শুধু তাকেই নয়, দশরথকেও সেই বিষ-প্রয়োগেই হত্যা করা হয়েছে বলেই আমার ধারণা বিজনবাবু। শাস্তকণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো বললে।
দশরথ। দশরথও মারা গেছে নাকি? বিজন চমকে প্রশ্ন করে পরক্ষণেই।
হ্যাঁ।
কবে?
গতকাল সকালে।
কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর স্তব্ধ হয়ে রইল বিজন, তারপর কেমন যেন অসহায় দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটা এখনও যেন কেমন আমার শুনে অবধি অবিশ্বাস্য বলেই মনে হচ্ছে মিঃ রায়, মামারবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক আমার না থাকলেও ঐ ছোটদাদুর স্নেহ থেকে কোনদিনই আমি বঞ্চিত হইনি। খুব ছোটবেলায় মাকে ও বাবাকে হারিয়ে ঐ দাদুর কাছেই মানুষ হয়েছিলাম একপ্রকার বলতে গেলে আমি। নিজের দাদুকে দেখিনি কখনও, কিন্তু নিজের দাদুও যে আমাকে আমার ঐ ছোটদাদুর চাইতে বেশী স্নেহ করতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না।
কিছু যদি মনে করেন বিজনবাবু তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম। সহসা কিরীটী বাধা দিল বিজনবাবুকে।
বলুন।
মামারবাড়ি ছেড়েছেন আপনি কতদিন?
তা খুব বেশী দিন নয়, কলকাতা থেকে দাদু এখানে চলে আসার বছরখানেক আগেই।
হঠাৎ মামারবাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন যে?
উত্তরে নিঃশব্দে বিজন মাথাটা নিচু করল।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, থাক বলতে হবে না–
, জানতে চেয়েছেন যখন বলছি। মামীমা—মানে ছোটমামার স্ত্রীর ব্যবহারটা—
বুঝতে পেরেছি। থাক আর কিছু বলতে হবে না। কিন্তু সে মামীমাও তো শুনেছি মারা গিয়েছেন। তা ছাড়া ছোট মামা নিশ্চয়ই আপনাকে ভালবাসতেন।
মিথ্যে বলব না, তা বাসতেন। কিন্তু—
আচ্ছা আপনার ছোট মামীমা কতদিন হবে গত হয়েছেন?
আমি মামারবাড়ি ছেড়ে চলে আসার মাসখানেক পরেই।
হুঁ। আচ্ছা তারপর আপনি ফিরে যাননি কেন? মামীমার জন্যই যখন—
বা, তা আর হয়ে ওঠেনি।
১৬. কিরীটী বিজনের সঙ্গে
কিরীটী বিজনের সঙ্গে এত তন্ময় হয়ে কথাবার্তা বলছিল যে অদূরে সোফার উপর উপবিষ্ট
সুশান্ত ও শকুন্তলার দিকে তেমন নজরই দিতে পারেনি।
তারর হঠাৎ একসময় বিজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওদের দিকে নজর পড়তেই কিরীটীর ওপ্রান্তে চাপা একটা হাসির বিদ্যুৎ যেন খেলে গেল।
সুশান্ত ও শকুন্তলা পরস্পরের মধ্যে গল্পে তখন একেবারে তন্ময় হয়ে গিয়েছে।
চাপাকণ্ঠে তারা পরস্পরের সঙ্গে কি যেন সব গল্প করে চলেছে। পরস্পরের প্রতি পরস্পরের মুগ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছে কখনও চকিতের জন্য, আবার সংকোচে সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিচ্ছে পরস্পর পরস্পর থেকে।
নিঃশব্দে কিরীটী সুশান্ত ও শকুন্তলার দিক থেকে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিয়ে বিজনের মুখের দিকে চেয়েই আবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা বিজনবাবু, আপনার ছোটমামা বৃন্দাবনবাবু আপনাকে চিঠিতে আর কিছু লেখেননি?
হ্যাঁ, আগামী পরশু অর্থাৎ শুক্রবার ছোটদাদুর উইল নাকি সলিসিটার বোস-চৌধুরীর শচীবিলাসবাবু এখানে এসে পড়বেন, সেইদিন বিশেষ করে উপস্থিত থাকবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
ও, সামনের শুক্রবারেই তাহলে উইল পড়া হচ্ছে?
হ্যাঁ, বোস-চৌধুরীর ফার্ম নাকি সেইমত তাঁকে জানিয়েছে এবং তাদেরই নির্দেশে তিনি আমাকে এখানে উপস্থিত থাকবার জন্য লিখেছেন।
নিশ্চয়ই তাহলে আপনার দাদু আপনাকেও কিছু সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন তার উইলে? নচেৎ বোস-চৌধুরী আপনাকে উইল পড়বার সময় উপস্থিত থাকতেই বা বলবেন কেন?
হতে পারে, তবে দাদুর সম্পত্তির কানাকড়ি না পেলেও কোন ক্ষোভ ছিল না।
আপনি তাহলে এ কদিন এখানেই আছেন?
হ্যাঁ, শুক্রবার পর্যন্ত তো আছিই।
আচ্ছা আজ তাহলে উঠি। কিন্তু মধুসূদনবাবু এখনও ফিরলেন না তো!
ডেকে দেব বড়মামাকে?
না, প্রয়োজন নেই। বলবেন, পরে আবার দেখা হবে। কি সুশান্তবাবু, উঠবেন তো?
কিরীটীর ডাকে সুশান্ত যেন চমকে ওঠে। য়্যাঁ! হ্যাঁ–চলুন।
সুশান্ত ও কিরীটী সরকার ভিলা থেকে বের হয়ে এল।
রাস্তায় নেমে কিরীটী বললে, চলুন বিমলবাবুর ওখান থেকে একবার ঘুরে যাওয়া যাক।
হ্যাঁ চলুন, চা খাবার জন্য বিকেলে আজ অনুরোধ জানিয়ে গিয়েছিল সে অনেকবার। হয়তো খাপ্পা হয়ে আছে–
তা তো হওয়াই উচিত। আপনি তাকে যাবো বলে কথা দিয়ে গল্পে মেতে বেমালুম সব ভুলে বসে থাকবেন
না, না—এমন কিছু নয়। এমনিই সাহিত্যের ব্যাপার নিয়ে গল্প হচ্ছিল ওঁর সঙ্গে সামান্য। ভদ্রমহিলার দেখলাম খুব পড়াশুনা আছে।
তাই বুঝি! তা সাহিত্যের কোন বিষয় নিয়ে গল্প হচ্ছিল আপনাদের? কাব্য, গল্প, উপন্যাস, নাটক? কিরীটী প্রশ্ন করে।
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে।
ও। আমি ভাবলাম বুঝি নাটক।
মানে?
না, কিছু নয়। তারপর হঠাৎ একসময় আবার চলতে চলতে কিরীটী বলে, তাস খেলতে নিশ্চয়ই আপনি জানেন সুশান্তবাবু?
তাস! মানে কার্ডস?
হ্যাঁ। সাহেব, বিবি, গোলাম, ছক্কা, পাঞ্জা, দুরি, তিরি, টেক্কা-চেনেন নিশ্চয় এগুলো?
চিনি, কিন্তু কতকটা বিস্ময়ই প্রকাশ পায় সুশান্তর কণ্ঠস্বরে।
আচ্ছা বলুন তো, সাহেব বিবি গোলামের মধ্যে কোনটা আপনার বেশী পছন্দ-মানে চেহারার ও নামের দিক দিয়ে বেশ, দেখতেও সুন্দর বা মনে ধরে?
কেন, সাহেব বিবি!
ঠিক বলেছেন। সাহেব বিবি–তবে একটা কথা মনে রাখবেন, সাহেবদের মেজাজ বুঝতে পারা গেলেও বিবিদের মেজাজ কিন্তু সত্যিই অনেক সময় দুর্বোধ্য!
কথাটা একটু স্পষ্ট করে বললে বাধিত হতাম। সবই কি স্পষ্ট করে সব সময় বলা যায়। এই বোধ হয় সামনে থানা, তাই না?
হ্যাঁ।
কিন্তু থানায় গিয়ে বিমল সেনের পাত্তা পাওয়া গেল না।
কি একটা জরুরী তদন্তের ব্যাপারে ঐদিন বিকেলের দিকে সে নাকি মাইল দশেক দূরে একটা গ্রামে গিয়েছে।
কখন ফিরবে কিছু স্থির নেই।
অগত্যা দুজনকে ফিরতেই হল।
১৭. সুশান্তদের বাড়ি থেকে
সুশান্তদের বাড়ি থেকে স্থানীয় থানার দূরত্বটা একেবারে কম নয়। বেশ কিছুটা পথ। ঘোট শহর।
মিউনিসিপ্যালিটির আলোর ব্যবস্থাও রাস্তায় তেমন যথেষ্ট নয়। তার উপরে রাতটাও ছিল কৃষ্ণপক্ষ।
দূরে দূরে রাস্তার দুপাশে যে কেরেসিনের আলোর ব্যবস্থা, তাতে করে আলোর চাইতে অন্ধকারটাই যেন বেশী জমাট বেঁধে ছিল।
সেই অন্ধকার পথ ধরে দুজনে বাড়ির দিকে মন্থর পদবিক্ষেপে হেঁটে চলেছিল পাশাপাশি।
সহসা কিরীটীই একসময় প্রশ্ন করে, থানা-ইনচার্জ বিমলবাবু তো আপনাদের বন্ধু, তাই সুশান্তবাবু?
হ্যাঁ, একই কলেজে আমরা থার্ড ইয়ারে ও ফোর্থ ইয়ারে পড়েছি।
আচ্ছা সরকার ভিলার দুর্ঘটনা সম্পর্কে আপনাদের বন্ধুর সঙ্গে আপনাদের খোলাখুলি আলাপ কখনও হয়েছে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
তা হয়েছে বৈকি।
সারদাচরণের হত্যার ব্যাপারটা সম্পর্কে ওঁর মানে আপনাদের বন্ধুর ঠিক কি ধারণা জানেন কিছু বা বুঝতে পেরেছেন?
কথাটা ঠিক বুঝলাম না। মানে ঠিক আপনি কি জানতে চাইছেন মিঃ রায়?
বলছিলাম হত্যাকারী কে হতে পারে বলে তার ধারণা? জানেন তো, এসব ডিটেকশনের ব্যাপারে প্রবাবিলিটি বলে একটা কথা আছে সেটার কথাই বলছিলাম।
সে সম্পর্কে একদিন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলামকরেছিলেন?
তা উনি কি জবাব দিলেন?
ওর ধারণা ঐ বৃন্দাবনবাবুই নাকি তার কাকাকে হত্যা করেছেন।
কিরীটী কথাটা শুনে কিছুক্ষণ কোন জবাবই দিল না, যেমন চলছিল হেঁটে তেমনিই হাঁটতে লাগল। এবং কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর বললে, হুঁ। তা কেন উনি বৃন্দাবনবাবুকে সন্দেহ করছেন কিছু বলেছেন? তার যুক্তি কি?
না, সেরকম কিছু বলেনি।
অবিশ্যি প্রবাবিলিটির দিক দিয়ে বৃন্দাবনবাবুকে যে তার কাকার হত্যাকারী একেবারে ভাবা যায় না তা নয়, কিন্তু কথা হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে শুধু সন্দেহটাই তো সব নয়, প্রমাণ এবং উদ্দেশ্য দুই থাকা চাই।
আচ্ছা মিঃ রায়?
বলুন!
এমনও তো হতে পারে, বৃন্দাবনবাবু কৃতদার ছিলেন এবং বয়সও তার এখনও এমন কিছু বেশী নয়
হ্যাঁ হ্যাঁ-বলুন, বলুন? প্রত্যেকেরই চিন্তার একটা মূল্য আছে জানবেন। আপনি কোন পথে চিন্তা করছেন ব্যাপারটা শোনাই যাক না, বলুন?
বলছিলাম শকুন্তলা দেবীর কথা।
খুব স্বাভাবিক সুশান্তবাবু। এই হত্যার ব্যাপারে শকুন্তলা দেবীর উপস্থিতি সরকার ভিলায় বিশেষ একটি সূত্র বা বলতে পারেন পয়েন্ট। কিরীটী বললে।
কিন্তু, কিরীটী একটু থেমে আবার বলে, কি আপনি সঠিক বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন তো সুশান্তবাবু?
বলছিলাম শকুন্তলা দেবী ও বৃন্দাবনবাবুর ঐ ব্যাপারে একটা যোগসাজস তো পরস্পরের মধ্যে থাকতে পারে! সুশান্ত বললে।
আশ্চর্য নয়। তাহলে আপনার ধারণা—
ধারণা আমার কিছুই নয় মিঃ রায়, সব কিছু দেখেশুনে যা মনে হয়েছে তাই বললাম। সুশান্ত কিরীটীকে একপ্রকার বাধা দিয়েই বলে।
তাহলে তো আপনারও সাবধান হওয়া উচিত ছিল সুশান্তবাবু?
আমার সাবধান হওয়া উচিত!
নিশ্চয়। শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বৃন্দাবনবাবু যদি আপনার সঙ্গেই ধরুন ড়ুয়েল লড়বার জন্য আবার আস্তিন গুটিয়ে এগিয়ে আসেন–
যাঃ, কি যে বলেন! লজ্জিত কণ্ঠে সুশান্ত প্রতিবাদ জানিয়ে ওঠে।
সাধে কি আর বলি—অপর পক্ষও যে আপনার প্রতি মুগ্ধ বলে মনে হল সামান্য সাক্ষাতেই।
কিরীটী হাসতে হাসতে শেষের কথাটা বলে।
না, না—আপনার ওটা ভুল মিঃ রায়!
ভুল! তা হবে। কিন্তু একটা কথা কি জানেন, এক ধরণের নারী আছে যাদের নিজেদের আকর্ষণ দিয়ে পুরুষকে টেনে এনে তাদের নিয়ে খেলাটাই একটা নেশা।
না, আমি কিন্তু ওঁর সম্পর্কে আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না মিঃ রায়।
পারবেন না জানি, কারণ আপনি যে সেই অপর পক্ষ!
সত্যি বলুন তো মিঃ রায়, শকুন্তলা দেবীকে আপনি এখুনি যা বললেন—তাকে কি ঠিক তাই মনে হয়?
পালটা প্রশ্ন করল সুশান্ত পরক্ষণেই কিরীটীকে।
সে কথা যাক, কিরীটী বললে, আপনি আমার একটা প্রশ্নের আগে জবাব দিন।
কি?
আপনার পরামর্শেই হোক বা যাই হোক, মধুসূদনবাবু ও তস্য ভ্রাতা বৃন্দাবনবাবু যে তাদের কাকার হত্যার ব্যাপারে আমাকে নিযুক্ত করেছেন, এতে কি ওঁদের উভয়েরই পূর্ণ সমর্থন আছে বলে মনে হয় আপনার?
নিশ্চয়ই।
কিসে বুঝলেন?
এটা তো আপনি স্বীকার করেন, নিজের আত্মীয়ের এভাবে রহস্যজনক মৃত্যু সম্পর্কে সত্যটা জানতে মানুষ মাত্রেরই ইচ্ছা হয়!
তা হয়তো হয়—কিন্তু সেটা কি সর্বক্ষেত্রেই হয়।
তবে কি আপনার ধারণা ধারণা—
আপাততঃ কিছুই নয় আমার সুশান্তবাবু। তবে আমার মনে হয়—
কি?
যাক সে কথা। এখন বলুন শুনি, ঐ কেতু সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
কেতু?
হ্যাঁ-লোকটি মধুসূদনবাবুর মতে অজ্ঞাতকুলশীল এবং যে সারদাচরণের মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন পূর্বে সরকার ভিলায় রহস্যজনক ভাবে আবির্ভূত হয়ে আবার মৃত্যুর পরদিন সকাল থেকে রহস্যজনক ভাবে নিরুদ্দিষ্ট!
কি বলতে চান আপনি মিঃ রায়?
বলছি সে কি সারদাচরণকে মৃত জেনেই গা-ঢাকা দিয়েছে, না ব্যাপারটা না জেনেই নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে?
তা কি করে হবে? মৃত্যুর ব্যাপারটা তো পরদিন সকালে শকুন্তলাই প্রথমে জানতে পেরেছে?
এমনও তো হতে পারে, তারও আগে জেনেছিল কেতু? তা কি করে বলি বলুন!
তা বটে। তবে এটা ঠিকই জানবেন, সরকার ভিলার হত্যা-রহস্যের ব্যাপারে শ্রীমান কেতু দ্বিতীয় এবং প্রয়োজনীয় সূত্র। অর্থাৎ প্রথম সূত্র শ্রীমতী শকুন্তলা দেবী, দ্বিতীয় সূত্র শ্রীমান কেতু। আর–
আর?
আর ঐ শকুন্তলা ও কেতু–
কি?
ঐ দুজনের সরকার ভিলায় আবির্ভাবের মূলেই রয়েছে সারদাচরণের মৃত্যুবীজটি নিহিত।
না, না—তা কেমন করে হবে? শকুন্তলার মত একটি মেয়ে-highly cultured–কেতুর মত একটা চাকরের সঙ্গে
কেন, ড্রাইভার বা ভৃত্যের সঙ্গে মনিব-কন্যা গৃহত্যাগিনী হয়েছে এমন নজিরের তো অভাব নেই। পঞ্চাশের ব্যাপার-কে কখন কানা হয় কিছু কি বলা যায় সুশান্তবাবু!
না, কিরীটীবাবু–you are going too far!
সুশান্তবাবু, পৃথিবীটা বড় বিচিত্র। আপনার অভিজ্ঞতা কতটুকু? কিন্তু আমি এই অল্প বয়সেই দেখেছি অনেক।
তাই বলে একটা খোঁড়া কুৎসিত চাকর–
চাকরই বটে। যাক সে কথা। তবে একটা ব্যাপার, আপনার চোখ স্বচ্ছ থাকলে আপনিও দেখতে পেতেন কিছু।
কি?
আজ সকালে শকুন্তলা দেবীর ঘরে—
শকুন্তলা দেবীর ঘরে—কি?
সদ্য-প্রস্ফুটিত গোলাপের গুচ্ছ ও ধূপের প্রজ্বলন্ত কাঠি।
মানে?
মানে সব-সবটাই অভিনয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, কার সঙ্গে অভিনয় এবং কেনই বা ঐ অভিনয়টা করলেন শ্ৰীমতী?
মিঃ রায়!
তাই বলছিলাম সুশান্তবাবু, আপনার বয়েসটা বড় risky! ও কেয়ার ঝোপ-গন্ধে মাতাল হয়ে হুট করে হাত বাড়াবেন না-জানেন তো কেয়ার ঝোপের আশেপাশেই আত্মগোপন করে থাকে কালনাগ!
বিস্মিত দৃষ্টি তুলে সুশান্ত আবার অন্ধকারেই পথ চলতে চলতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিন্তু অন্ধকারে কিরীটীর মুখটা ভাল করে তার নজরে পড়ে না।
সুশান্তর মনে হয়, কিরীটী যেন রীতিমত হেঁয়ালি করে কথা বলছে। তাই একসময় সে প্রশ্ন করে, আপনি যেন বড্ড হেঁয়ালি করে কথা বলছেন মিঃ রায়।
হেঁয়ালি নয়, সুশান্তবাবু। সহজ সত্যি কথাগুলোই বলছি। এবং আজকের এই হত্যারহস্যের আসল সত্যটা যেদিন আপনার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, দেখবেন মিলিয়ে—আজ যা বলছি মিথ্যা বা অতিশয়োক্তি নয় এর কিছুই। কিন্তু বাড়ির কাছে এসে পড়েছি—চলুন চায়ের পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে। এক কাপ চায়ের প্রয়োজন বর্তমানে সবচাইতে বেশী।
রাত্রে খাবার টেবিলে বসেও আবার সরকার ভিলার মৃত্যু-রহস্যের আলোচনাতেই ফিরে যায় ওরা।
কিরীটী একসময় কথায় কথায় বলে, সারদাবাবুর উইলটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে।
জানবেন। তার এই রহস্যজনক হত্যার ব্যাপারে আমার যতদূর ধারণা
উইল তোবোধ হয় কাল-পরশুর মধ্যেই পড়া হবে!
হ্যাঁ—আর উইলের মর্মকথাটা একান্তভাবেই জানা দরকার।
উইল খোলা হলেই তা জানতে পারবেন।
তা জানতে পারব, তবে সে সময় আমি উপস্থিত থাকতে চাই–
সে আর এমন কঠিন ব্যাপার কি? মধুসূদনবাবুকে আপনি বললেই হয়তো রাজী হবেন তিনি।
কাল সকালেই সরকার ভিলায় একবার গিয়ে অনুরোধটা তাকে জানাব ভাবছি।
বেশ তো।
পরের দিন সকালেই কিরীটী সরকার ভিলায় গেল।
বাইরের ঘরে মধুসূদনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কিরীটীর।
মধুসূদন ও শকুন্তলা বসে প্রভাতী চা-পান করছিলেন।
এই যে মিঃ রায়, আসুন আসুন-একেবারে সকালেই যে! কোন মীমাংসায় পৌঁছতে পারলেন নাকি? মধুসূদন আহ্বান জানালেন।
না, ব্যাপারটা বড় জটিল বলে মনে হচ্ছে-বলতে বলতে তির্যক দৃষ্টিতে একবার তাকালো কিরীটী মধুসূদনের মুখোমুখি উপবিষ্ট শকুন্তলার দিকে।
তাহলে এখনও কিছু বুঝতে পারেননি?
না। কিন্তু একটা request ছিল—
বলুন?
আপনার কাকার উইল কবে পড়া হচ্ছে?
বোধ হয় তো কালই, কিন্তু কেন বলুন তো?
আমি যদি সে-সময় উপস্থিত থাকি, আপত্তি হবে আপনার?
বিলক্ষণ, আপত্তি কিসের! নিশ্চয়ই থাকবেন।
তাহলে সেই কথাই রইল। আপনি আমাকে একটা খবর পাঠাবেন।
নিশ্চয়ই। কিন্তু এক কাপ চা খাবেন না?
না, এখন একবার থানায় বিমলবাবুর ওখানে যাব ভাবছি। কাল তার ওখানে গিয়ে দেখি উনি থানায় নেই!
বেশ।
কিরীটী সরকার ভিলা থেকে অতঃপর বের হয়ে এল।
১৮. বৃন্দাবন সরকার ইচ্ছা করে
বৃন্দাবন সরকার ইচ্ছা করে ভাগ্নে বিজনকে সরকার ভিলায় আমন্ত্রণ করে আনেননি জরুরী চিঠি দিয়ে।
মৃত সারদাচরণের নির্দেশমতই বিজনকে আসার জন্য তাঁকে চিঠি দিতে হয়েছিল। এবং শুধু বিজনকেই নয়, আরও দুজন ভদ্রলোকও পরের দিন বৃন্দাবন সরকারের সঙ্গে কলকাতা হতে এলেন ঐ উইলের নির্দেশমতই।
একজন সারদাচরণের বিশেষ পরিচিত বাল্যবন্ধু ডাঃ বাসুদেব অধিকারী, অন্যজন সারদাচরণের আত্মীয় অর্থাৎ সারদাচরণের ভগ্নীপতি রতিকান্ত মল্লিক।
ডাঃ অধিকারী ও রতিকান্ত মল্লিক দুজনেরই বয়স হয়েছে, প্রৌঢ়।
সলিসিটার শচীবিলাস বসুও এলেন ওঁদের সঙ্গে।
চল্লিশের ঊর্ধ্বে বয়স হয়েছে শচীবিলাসের।
পরের দিন শুক্রবার সকলে এসে বিকেল পাঁচটা নাগাদ সরকার ভিলার লাইব্রেরী ঘরে জমায়েত হলেন।
মধুসূদন সরকার, বৃন্দাবন সরকার, বিজন, ডাঃ বাসুদেব অধিকারী, রতিকান্ত মল্লিক ও কিরীটী রায়।
মাঝখানে বসলেন সলিসিটার শচীবিলাস এবং তাকে ঘিরে বসলেন অন্যান্য সকলে।
সকলের উপস্থিতিতেই শচীবিলাস তাঁর ফোলিও থেকে একটি সিল-করা পুরু লেপাফা বের করলেন ও সিল ভেঙে সারদাচরণের শেষ উইলটি বের করলেন।
উইলের সারমর্ম শুনে কিরীটী রীতিমত অবাক হয়ে যায়।
বিরাট সম্পত্তির মালিক ছিলেন সারদাচরণ সরকার।
স্থাবর, অস্থাবর, ব্যবসা ও নানা ধরনের সম্পত্তি মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি।
এবং সেই সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারার যে নির্দেশ তিনি দিয়ে গিয়েছেন তা হচ্ছে এইরূপঃ
কলকাতা, বোম্বাই ও দিল্লীর জুয়েলারী ব্যবসার দুইয়ের তিন অংশ দিয়ে গিয়েছেন তিনি বৃন্দাবন সরকারকে এবং বাকি একের তিন অংশ নিরুদ্দিষ্ট মধুসূদন সরকারকে।
কলকাতার বাড়িটা দিয়েছেন বিজনকে। সরকার ভিলা দিয়েছেন শকুন্তলা দেবীকে জীবনস্বত্বে। ব্যাঙ্কের নগদ এক লক্ষ টাকা সমান ভাগে অর্ধেক দিয়েছেন ডাঃ বাসুদেব অধিকারী ও রতিকান্ত মল্লিকের হাতে একটি দাতব্য হাসপাতাল তৈরীর জন্য—তার মৃত জ্যেষ্ঠ রণদাচরণের স্মৃতিরক্ষার্থে এবং বাকী অর্ধেক সমান ভাগে বৃন্দাবনের কন্যাকে এবং বিজনকে। মধুসূদন যদি জীবিত না থাকে, তার অংশ সব পাবে বৃন্দাবন।
উইল পড়া শেষ করে শচীবিলাস উইলটা ভাঁজ করছেন, ভৃত্য ট্রে-তে করে গরম চা নিয়ে এল ঘরে।
ট্রে-টি ছোট এবং তাতে মাত্র চারটি কাপই সাজানো।
মধুসূদন ভূত্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কি, চার কাপ আনলি কেন?
ট্রে-টা ছোট, তাই আনতে পারিনি, এখুনি আনছি। বললে ভৃত্য।
কেন, দুটো ট্রেতে সাজিয়ে দুজনে নিয়ে আসতে পারনি? যত বেটা উজবুক এসে এবাড়িতে জুটেছে! বলে মধুসূদন নিজেই সোফা থেকে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বৃন্দাবন বাধা দিলেন, তুমি ব্যস্ত হচ্ছ কেন দাদা, ও এখুনি নিয়ে আসবে, তুমি বোস।
ভৃত্য তখনও বকুনি খেয়ে ট্রে-টা হাতে করেই দাঁড়িয়ে আছে।
আবার হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখ! কোণের ঐ টেবিলে ট্রে-টা নামিয়ে কাপগুলো হাতে হাতে দে না!
মধুসূদন আবার ঝাজিয়ে উঠলেন ভৃত্যকে।
ভৃত্য এধারে ঘরের কোণে যে বড় টেবিলটা ছিল, সেটার উপর নিয়ে গিয়ে ট্রে-টা নামিয়ে রাখল।
মধুসূদন তখন সেই টেবিলের কাছে এগিয়ে যান।
যা, বাকি কাপগুলো নিয়ে আয়। মধুসূদন আবার বললেন ভৃত্যকে।
ভূত্য বাইরে চলে গেল।
এবং একটু পরে বাকি তিন কাপ চা নিয়ে এসে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল।
সকলের হাতেই অতঃপর মধুসূদনের নির্দেশে এক কাপ করে চা এগিয়ে দিল ভৃত্য।
তোমরা শুরু কর, আমি আসছি এখুনি। বলে মধুসূদন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন পুনরায়।
সকলেই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিতে উদ্যত। এবং সর্বাগ্রে বোধ হয় বিজনই চায়ের কাপে চুমুক দিল।
কিন্তু দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার আগেই বিজনের কম্পিত হাত থেকে কাপটা নিচের মেঝের কার্পেটের উপর সশব্দে পড়ে গেল।
এবং সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট একটা কাতরোক্তি করে বিজন যে সোফার উপরে বসেছিল সেই সোফার উপরেই এলিয়ে পড়ল।
কি-কি হল? ব্যাপার কি, বিজনবাবু? বলতে বলতে সকলেই ততক্ষণে যে যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং বিজনের দিকে এগিয়ে আসে।
কিরীটীর এগিয়ে আসে ক্ষিপ্রপদে।
নিদারুণ যন্ত্রণায় বিজনের সমস্ত মুখের পেশীগুলো তখন কুঞ্চিত ও প্রসারিত হচ্ছে।
দুটি চক্ষু বিস্ফারিত। কি যেন বলবার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না বিজন, কথা জড়িয়ে। যায়।
সকলের উৎকণ্ঠিত চোখের দৃষ্টির সামনেই সহসা বিজনের মাথাটা একপাশে কাত হয়ে পড়ল পরক্ষণেই।
অভাবিত আকস্মিক পরিস্থিতি।
সকলেই শুধু নিস্পন্দ বাক্যহারা নয়, বিমূঢ়।
কিরীটী সর্বাগ্রে বিজনের স্থির-নিস্পন্দ দেহটা বারেকের জন্য স্পর্শ করে ডাঃ অধিকারীর দিকে তাকিয়ে বললে, দেখুন তো ডাঃ অধিকারী—
বিমূঢ় ডাঃ অধিকারী কেমন যেন শ্লথ পায়ে এগিয়ে এলেন কিরীটীর নির্দেশে এবং নিস্পন্দ বিজনের পাল্টা একবার দেখেই তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে, বিষণ্ণ কাতর দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন কেবল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মধুসূদন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, বিজনকে ঘিরে সকলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করলেন, কি–ব্যাপার কি?
বিজন ইজ ডেড মধুসূদন! ডাঃ অধিকারী বললেন।
সে কি!
হ্যাঁ, হি ইজ নো মোর! ইন্সট্যানটেনিয়াস ডেথ হয়েছে বিজনের!
কিরীটীও যেন ডাঃ বাসুদেব অধিকারীর কথায় স্তব্ধবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল ক্ষণেকের জন্য, কিন্তু পরক্ষণেই সে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু হয়ে মেঝের কার্পেট থেকে কাপটা তুলে নিতে গিয়ে দেখল, কিছুক্ষণ পূর্বে তাদের সকলের দৃষ্টির সামনে মেঝেতে বিজনের হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল যে কাপটা-ইতিমধ্যে বিজনের সোফার তলায় চলে গিয়েছে। কোন্ এক সময়।
কারও পায়ের ধাক্কায় বোধ হয় কাপটা সোফার নিচে চলে গিয়েছিল।
কিরীটী সোফার নিচে হাত ঢুকিয়ে কাপটা তুলে নিল।
কাঁচের কাপের গায়ে তখন চা লেগে রয়েছে।
ডাঃ অধিকারীর উচ্চারিত কথাটা যেন ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলকেই একেবারে বোবা করে দিয়েছিল।
মৃদুকণ্ঠে কিরীটী যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই বললে, এমন আকস্মিক মৃত্যু—
শচীবিলাস বললেন, হঠাৎ এভাবে হার্টফেল করলেন, কোন অসুখ-বিসুখ ছিল নাকি ভদ্রলোকের মিঃ সরকার?
বৃন্দাবন অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, কই, সেরকম কিছু রোগ ওর ছিল বলে তো শুনিনি!
আকস্মিক হার্টফেল বলেই কি আপনার মনে হয়, ডাঃ অধিকারী? সহসা কিরীটী ডাঃ অধিকারীর দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করল।
য়্যাঁ!
বলছিলাম পয়েজনিং নয় তো? কিরীটী আবার বলে।
পয়েজনিং! বিস্মিত ডাঃ অধিকারী এবারে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, নিকোটিন পয়েজনিং নয় তো?
নিকোটিন পয়েজনিং!
একটা অভিশপ্ত চাপা কান্নার মতই যেন মৃদুচ্চারিত বৃন্দাবনবাবুর কথাটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলকে একটা বৈদ্যুতিক শক দেয় অকস্মাৎ।
হ্যাঁ, একান্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি, এটাও বোধ হয় হত্যা। কিরীটী আবার বললে।
হত্যা! কি বলছেন মিঃ রায়? প্রশ্নটা করলেন মধুসূদন সরকার এবারে।
মনে তো হচ্ছে তাই। তবে ময়না তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত অবিশ্যি কিছু ডেফিনিট বলা যাচ্ছে না। তবু মধুসূদনবাবু, আপনি এখুনি একবার থানার বিমলবাবুকে খবর দিন।
আরও ঘণ্টাখানেক পরে। সংবাদ পেয়েই বিমলবাবু ছুটে এসেছে।
বিমল সব শুনে বলে, তাহলে আপনার ধারণা মিঃ রায়, ইটস এ সিমিলার কেস!
আমার তো তাই বলেই মনে হচ্ছে। এই কাপটা একবার অ্যানালিসিস করতে পাঠাতে পারেন?
তবে আমার মনে হয়—
কি?
এবারও হয়ত পূর্বের মতই অ্যানালিসিস করেও কিছুই পাবেন না ওতে।
হুঁ। আচ্ছা মধুসূদনবাবু, চা তৈরী করেছিল কে? বিমল সহসা প্রশ্ন করে।
তা তো জানি না। তবে চাকরদের মধ্যেই কেউ হবে।
কিরীটী ঐ সময়ে বলে, যে ভৃত্যটি এ ঘরে চা ট্রে-তে করে নিয়ে এসেছিল তার নাম গোকুল না, বৃন্দাবনবাবু?
হ্যাঁ।
তাকে একবার ডাকুন তো! কিরীটী বলে।
তখুনি গোকুলকে ডাকানো হল ঐ ঘরে।
ভৃত্যদের মহলেও দুঃসংবাদটা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে।
বেচারী কাঁপতে কাঁপতে ঘরে এসে ঢুকল।
গোকুল, চা কে তৈরি করেছিল আজ? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে দিদিমনি করেছেন, আর আমি সব যোগাড় করে দিয়েছি।
দিদিমণি অর্থাৎ শকুন্তলা দেবী।
আর সেখানে কেউ ছিল? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে। কি
আজ্ঞে না।
চা করতে করতে তুমি বা দিদিমণি একবারও গিয়েছিলে বাইরে ঘর থেকে?
আজ্ঞে আমি একবার গিয়েছিলাম, দিদিমণিও বার-দুই গিয়েছিলেন বোধ হয়।
সেসময় কেউ সে-ঘরে ঢুকেছিল কি?
তা তো জানি না।
হুঁ। আচ্ছা তুমি যেতে পার।
গোকুল কাঁপতে কাঁপতেই আবার চলে গেল।
তাহলে মিঃ রায়–
মধুসূদন সরকারের প্রশ্নে তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, এমনও তো হতে পারে মধুবাবু, এ ঘরে ট্রে-তে করে চা আসবার পর কেউ কিছু কাপে মিশিয়ে দিয়েছে সবার অলক্ষ্যে, বিশেষ করে আমরা তো সবাই তখন কথাবার্তায় অন্যমনস্ক ছিলাম!
কথা বললেন এবারে বৃন্দাবন সরকার, কিন্তু তাই যদি হয়ে থাকে তো এতগুলো কাপের মধ্যে মাত্র একটা চায়েই বিষ মেশানো হল! এবং সেক্ষেত্রেও কেবল ইচ্ছা করেই যদি কেউ কাউকে হত্যা করবার জন্য আপনার ধারণামতই কাপে বিষ মিশিয়ে থাকে, তাহলে যাকে হত্যা করবার জন্য ঠিক বিষ মেশানো হয়েছিল, সেই বিশেষজন সে কাপটা না নিয়ে যদি এ-ঘরের মধ্যে অন্য কেউ সে কাপটা নিত, তবে কি
নিঃসন্দেহে সে-ই ঐ কাপটার চা পান করত তারই মৃত্যু হত বৃন্দাবনবাবু। সেদিক দিয়ে হয়ত হত্যাকারী একটা চান্সই নিয়েছিল!
চান্স?
হ্যাঁ, কিন্তু কেবল বিজনবাবুর কথাই ভাবছেন কেন? হত্যাকারী হয়ত আপনি, মধুবাবু ও বিজনবাবু-তিনজনের উপরেই অ্যাটেম্পট নিয়েছিল আজ।
সে কি?
আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো তাই বৃন্দাবনবাবু। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে।
কিন্তু শকুন্তলা দেবীকে একবার ডাকলে হত না মিঃ রায়? বিমল বললে।
ডাকিয়েও কোন কিনারা করতে পারবেন বলে তো আমার মনে হয় না বিমলবাবু আজকের এই রহস্যের! কিরীটী শাস্তকণ্ঠে বললে।
তাহলে?
আপাততঃ ঐ মৃতদেহটা এখান থেকে সরিয়ে ময়নাতদন্তে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আর যতক্ষণ না এই হত্যা-রহস্যের তদন্ত শেষ হয়, কেউ যেন এ বাড়ি থেকে না যান সেই নির্দেশই সকলকে আপনি দিন।
কিরীটীর কথায় সকলেই চমকে তার মুখের দিকে তাকাল।
কিন্তু যাকে কথাটা বলা হল সেই বিমলবাবু কারও দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বললে, তাহলে কেউ আমার পারমিশন ব্যতীত এ বাড়ি ছেড়ে যাবেন না—এই কথাই রইল।
কেউ কোন সাড়া দিল না।
সবাই নির্বাক নিস্পন্দ যেন।
কিরীটী যে তখনকার মত সরকার ভিলা থেকে সকলের যাওয়াই বন্ধ করল তাই নয়, নিজেও সে রাত্রের মত সরকার ভিলা থেকে যাবে না বলেই সুশান্তকে একটা সংবাদ তখুনি বিমলের এক সেপাইয়ের সাহায্যে পাঠিয়ে দিতে বলল।
এবং শুধু সে রাত্রেই নয়।
পর পর আরও চারিটি দিন ও রাত সরকার ভিলার চৌহদ্দির মধ্যে ঐ লোকগুলোকে খাঁচায় আবদ্ধ জানোয়ারের মতই যেন বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল।
একমাত্র ছুটি পেয়েছিলেন পরের দিন ঐ দল থেকে সারদাচরণের সলিসিটার শচীবিলাসবাবু।
আর কেউ বাইরে পা বাড়াবার হুকুম পাননি দারোগা বিমল সেনের কাছ থেকে কিরীটীরই নির্দেশে।
সত্যি, সে এক বিচিত্র পরিস্থিতি।
বিশেষ করে কথার ছলে সেই রাত্রেই যখন সকলের সামনে দাঁড়িয়ে কিরীটী বলেছিল, সারদাচরণ, দশরথ ও বিজনবাবুর হত্যাকারী একজনই—এবং সে হত্যাকারী তখনও তাদের মধ্যে ঐ সরকার ভিলাতেই উপস্থিত আছে, তখন কিরীটীর কথায় সেরাত্রে উপস্থিত সকলেই মুহূর্তের জন্য পরস্পরের প্রতি অপাঙ্গে দৃষ্টিপাত করে অজানিত এক দুর্বোধ্য আশঙ্কায় মনে মনে শিউরে উঠেছিল বুঝি।
একটা সত্য কথা উচ্চারণের মধ্যে যে এমন একটা ভয় আতঙ্ক থাকতে পারে, সেটা যেন সকলেই সেদিন মর্মে মর্মে অনুভব করেছিল।
অথচ কেউ সেদিন এতটুকু প্রতিবাদও জানাতে পারেনি।
একটা দুর্বোধ্য আতঙ্কে কেমন যেন সব বোবা হয়ে ছিল।
থানা-অফিসার বিমল সেন তো তার চরম নির্দেশটা শুনিয়ে দিয়ে সরকার ভিলার চারিদিকে সর্বদা সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা করে সে রাত্রের মত বিদায় হল, কিন্তু যারা সেই খাঁচার মধ্যে বন্দী রইল তাদের তো একটা থাকবার ও খাবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
সরকার ভিলাতে অবিশ্যি থাকবার জায়গার অভাব ছিল না।
কিরীটীর নির্দেশে তখুনি মধুসূদন সরকার সকলের ব্যবস্থা করবার জন্য চলে গেলেন।
এবং ঘণ্টাখানেক বাদেই মৃতদেহ ঐ লাইব্রেরী ঘর থেকে সরিয়ে বাড়ির বাইরে উদ্যানের মধ্যে যে মালীদের ঘরটা ছিল সেই ঘরে রেখে আসা হল রাত্রের মত।
সকলে এসে নিচের পারলারে জমায়েত হলেন আবার।
প্রৌঢ় ডাক্তার অধিকারী একসময় কিরীটীকে বললেন, এ কি বিশ্রী ঝাটে পড়া গেল বলুন তো মিঃ রায়!
আমি বুঝতে পারছি ডাঃ অধিকারী আপনার মনের অবস্থাটা, কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনি, এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন পথ সত্যিই ছিল না।
কিন্তু সত্যিই কি আপনি মনে করেন মিঃ রায়, আজ যারা এখানে এ বাড়িতে উপস্থিত তাদের মধ্যে সামবডি
তাই আমার ধারণা ডাঃ অধিকারী। এর আগে এই বাড়িতেই দুটি নৃশংস হত্যার ব্যাপার আপনি তো শুনেছেন–
হ্যাঁ, শুনেছি।
একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন, পর পর এই তিনটি মৃত্যুই আকস্মিক ও রহস্যজনক হলেও একই সূত্রে গাঁথা।
কিন্তু–
বুঝতে পারছি ডাঃ অধিকারী, আপনি কি বলতে চান। প্রথম দুটো হত্যার সময় অকুস্থানে তৃতীয় কোন ব্যক্তি ছিল কিনা আপাততঃ সেটা যদিও আমরা জানি না বা জানতে পারিনি বটে, কিন্তু ভেবে দেখুন তৃতীয় মৃত্যুর সময় আমরা এতগুলো লোক সজ্ঞানে অকুস্থানে উপস্থিত ছিলাম!
তাই তো ব্যাপারটা এখন আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।
তা না হলেও এটা তো আপনি স্বীকার করবেন, প্রথম ও দ্বিতীয় দুটো হত্যাই হয়েছে। তীব্র নিকোটিন বিষপ্রয়োগে?
তাহলে দশরথের মৃত্যুর কারণও আপনার ধারণা মিঃ রায় ঐ একই? ধারণা নয়, তাই। কারণ আজ একটু আগে বিমলবাবু আমাকে সেকথা বলে গেলেন। তাহলেই ভেবে দেখুন, বিষপ্রয়োগের কোন প্রমাণ—অর্থাৎ কে কার দ্বারা, কি উপায়ে তাদের বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল সেটার কোন প্রমাণ এখনও পর্যন্ত না পাওয়া গেলেও ময়নাতদন্তে তাদের দেহে বিষ পাওয়া গিয়েছে,-যার দ্বারা তাদের যে বিষের ক্রিয়াতেই মৃত্যু ঘটেছে সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত। তারপর দেখুন, তিন-তিনটে মৃত্যু একই বাড়ির বিভিন্ন ঘরে হয়েছে এবং একই বাড়ির লোক তারা!
কিন্তু এটাই তো আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, আপনার কথা যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায়ই, তাহলে এই ধরনের ডায়বলিক্যাল মার্ডারের কি উদ্দেশ্য কার থাকতে পারে?
সেটা তো পরের কথা। কিন্তু একটা কথা কি জানেন ডাঃ অধিকারী, এসব ব্যাপারে বরাবরই আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার দ্বারা দেখেছি, সরলভাবে বিচার করে দেখতে গেলে প্রত্যেকটি এই ধরনের হত্যার ব্যাপারেই মোটিভ বা উদ্দেশ্য, অপরচুনিটি বা সুযোগ এবং প্রবাবিলিটি বা সম্ভাবনা তিনটি জিনিসই থাকবে। অবিশ্যি এর মধ্যে মোটিভই হচ্ছে সর্বপ্রধান-মুখ্য। অন্য দুটি গৌণ। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে প্রথম ও তৃতীয় হত্যার মোটিভ আমাদের চোখের সামনে থাকলেও, দ্বিতীয় হত্যার মোটিভটি অবিশ্যি তত স্পষ্ট নয়।
কি মোটিভ? ডাঃ অধিকারী আবার প্রশ্ন করলেন।
কেন? সেই চিরাচরিত মোটিভ–অর্থ!
অর্থ?
হ্যাঁ, অর্থম্ অনর্থম্! সারদাচরণ সরকারের সুবিপুল সম্পত্তি, যার হদিস আজই আমরা শচীবিলাসবাবুর কাছ থেকে কিছুক্ষণ মাত্র আগে পেয়েছি–
তাই যদি হয় তো দশরথ কেন নিহত হল?
দশরথ বেচারী প্রথম হত্যার ব্যাপারে এমনভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল,-যে কারণে হত্যাকারীর চোখে তার মৃত্যুটা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল।
মধুসূদনবাবু অবিশ্যি সেরাত্রে সকলের আহারের ভাল ব্যবস্থাই করেছিলেন। কিন্তু আহারের এতটুকু রুচিও কারো ছিল না বুঝি, তাই সকলেই গিয়ে নিয়মরক্ষার জন্য খাবার টেবিলে বসলেন মাত্র।
এবং একসময় সকলে আবার টেবিল ছেড়ে উঠে যে যাঁর নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে যেন শ্লথপায়ে প্রবেশ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
সেরাত্রে নিদ্রা যে কারও চোখে আসবে না বা আসতে পারে না, সকলেই অবিশ্যি সেটা জানতেন—তবু কেউ যেন আর বসে থাকতে পারছিলেন না।
যে যার নির্দিষ্ট শয়নঘরে প্রবেশ করে যেন সন্ধ্যা থেকেই সেই একটানা দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সে রাতের মত নিশ্চিন্ত হলেন কতকটা।
মধুসূদন সরকারের পাশের ঘরেই কিরীটীর শয়নের ব্যবস্থা হয়েছিল সে রাত্রে।
রাত্রি গভীর।
সরকার ভিলার ঘরে ঘরে একে একে আলো নিভে গিয়েছে।
কিরীটী তার ঘরের খোলা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বাইরের অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি মেলে ধূমপান করছিল।
ঘর অন্ধকার।
সরকার ভিলার মৃত্যু-রহস্যের সমাধান করে ওখান থেকে চলে আসবার পূর্বে সুশান্ত প্রশ্ন করেছিল কিরীটীকে, ওভাবে সেদিন সকলকে সরকার ভিলায় আটকে রেখেছিলেন কেন মিঃ রায়?
জবাবে কিরীটী বলেছিল, তা না করলে হয়ত হত্যাকারীকে অত সহজে আমি ধরতে পারতাম না সুশান্তবাবু।
তাহলে বলুন, হত্যাকারীকে আপনি মনে মনে চিনতে পেরেছিলেন ঐদিনই?
তা পেরেছিলাম বইকি! মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দিয়েছিল।
১৯. কিন্তু যাক সে কথা
কিন্তু যাক সে কথা।
সেই রাত্রির কথায়ই ফিরে আসা যাক।
অন্ধকার ঘর।
কাঁচ করে মৃদু শব্দ হতেই চকিতে কিরীটী ঘুরে দাঁড়ালো।
কিরীটীর ঘরের দরজা ভেজানোই ছিল।
নিঃশব্দে সেই দরজার ভেজানো কপাট দুটো যেন ধীরে ধীরে একটু একটু খুলে যাচ্ছে।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কিরীটী সেই দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
দরজাটা খুলছে।
একটু একটু করে খুলছে।
তারপরই দীর্ঘ একটা ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল অন্ধকারে।
কে?
মিঃ রায় জেগে আছেন? আমি—
আসুন। কিন্তু কি ব্যাপার বৃন্দাবনবাবু, এত রাত্রে? ঘুমোননি?
না মিঃ রায়, ঘুম আসছে না।
দাঁড়িয়ে কেন বৃন্দাবনবাবু, বসুন ঐ চেয়ারটায়।
বৃন্দাবন সরকার কিন্তু বসলেন না। দাঁড়িয়েই রইলেন।
মিঃ রায়! একসময় মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন।
বলুন?
আপনি আজ সন্ধ্যার সময় যা বললেন, সত্যিই কি আপনি তাই বিশ্বাস করেন?
কি?
এই বাড়িরই একজন—
আমার ধারণা তাই বৃন্দাবনবাবু। শান্তকণ্ঠে কিরীটী বলে কথাটা।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনি মিঃ রায়, আমি–
একটা কথার জবাব দেবেন বৃন্দাবনবাবু?
কি?
শকুন্তলা দেবী সম্পর্কে আপনার সত্যি কি ধারণা?
না-সি-সি ইজ বিয় অল ডাউটস!
কিন্তু একটা কথা কি আপনি জানেন বৃন্দাবনবাবু, বৃদ্ধ বয়সে আপনার কাকা সারদাবাবুর ঐ শকুন্তলার প্রতি তীব্র একটা আকর্ষণ জম্মেছিল?
আমি-আমি তা জানতে পেরেছিলাম মিঃ রায়—
জানতে পেরেছিলেন?
হ্যাঁ।
তাহলে কি আপনারও শকুন্তলার প্রতি মনে মনে–
না, আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়—
সেই বিশ্বাসের জোরেই তো বলছি–
এবার আর কোন প্রতিবাদই জানাতে পারেন না বৃন্দাবন সরকার। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
রাত অনেক হল, যান এবার ঘুমোবার চেষ্টা করুনগে বৃন্দাবনবাবু।
চোরের মতই যেন মাথা নীচু করে ঘর থেকে অতঃপর বৃন্দাবন সরকার বের হয়ে গেলেন।
অন্ধকারে নিঃশব্দে একবার হাসল কিরীটী।
তারপর আধ ঘণ্টাও অতিবাহিত হয়নি, কিরীটীর ঘরের ভেজানো দরজার কবাট দুটো পুনরায় নিঃশব্দে খুলে গেল।
কে?
আমি—
আসুন মধুসূদনবাবু। ঘুম হল না বুঝি? কিন্তু দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।
মধুসূদন চেয়ারটার উপর উপবেশন করলেন।
মিঃ রায়।
বলুন?
এ কি হল মিঃ রায়! সত্যি আমার মত হতভাগ্য বুঝি এ জগতে আর কেউ নেই। দীর্ঘ দশ বছর পরে কত আশা নিয়েই না ঘরে ফিরেছিলাম, কিন্তু কোথা থেকে কি সব হয়ে গেল! ঐ বিজন-দিদি যখন মারা যায় ওর বয়স মাত্র আট কি দশ-ওকে আমিই বুকেপিঠে করে মানুষ করেছি। বাড়িতে ফিরে ও বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে শুনে ভেবেছিলাম আবার ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব। নিজে বিয়ে-থা করিনি, ও আমার সন্তানের মতই ছিল—কথাগুলো বলতে বলতে মধুসূদন সরকারের গলাটা ভারী হয়ে আসে, চোখের কোল দুটো অশ্রুতে সজল হয়ে ওঠে।
কি করবেন বলুন মধুসূদনবাবু, যা হবার হয়ে গিয়েছে।
না, না মিঃ রায়, এখনও আমি ভাবতেই পারছি না, বিজন নেই—হি ইজ ডেড, এ যেন এখনও স্বপ্নের মতই বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। এখানে আর একটি মুহূর্ত আমি টিকতে পারছি না মিঃ রায়, অনুগ্রহ করে আমাকে এখান থেকে কাল সকালেই যাবার অনুমতি দিন। আর নয়—আমি আবার সেই মগের মুল্লুকেই ফিরে যাব। এখানে থাকলে সত্যিই বলছি পাগল হয়ে যাব।
কিন্তু যাকে আপনি প্রাণের চাইতেও ভালবাসতেন, তাকে যে এমনি করে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করলে, তাকে এত সহজে নিষ্কৃতি দেবেন?
দেবো না নিশ্চয়ই-এবং জানতে পারলে তাকে আমি গলা টিপে শেষ করতাম। উত্তেজনায় মধুসূদনের কণ্ঠস্বরটা কাঁপতে থাকে।
আর আপনার অনুরোধেই এই হত্যা-রহস্যের তদন্তের ভার আমি হাতে নিয়েছি। এক্ষেত্রে আপনিই যদি চলে যান তো আমার এখানে থাকার অর্থই হয় না মধুসূদনবাবু।
কিন্তু মিঃ রায়
শুনুন মিঃ সরকার, আমি মনে মনে একটা প্ল্যান করেছি, আর প্ল্যানটা যদি আমার সাকসেসফুল হয় তো দু-একদিনের মধ্যেই এ রহস্যের একটা হয়তো কিনারা করতে পারব বলে আশা করি।
কি প্ল্যান মিঃ রায়?
বসুন আপনি, আমি বলছি।
কিন্তু আপনি কি সত্যিই কাউকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছেন মিঃ রায়?
অনুমান মাত্র। অনুমান অবিশ্যি ভুল হতে পারে, তাই আপনার সাহায্য নিয়ে আমার অনুমান সত্যি কি মিথ্যা যাচাই করে দেখতে চাই মিঃ সরকার একটিবার!
বেশ, বলুন। আমি আপনাকে সাধ্যমত আমার সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি।
তারপর দুজনে বসে এক ঘণ্টা ধরে নানা আলোচনা করল।
আলোচনা-শেষে কিরীটী বললে, বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই আমার প্ল্যানটা?
হুঁ, বুঝেছি। কিন্তু—
আর কিন্তু নয় মিঃ সরকার-রাত প্রায় শেষ হয়ে এল, এবার শুতে যান।
মধুসূদন সরকার নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
পরের দিন প্রত্যুষে।
বেলা তখন প্রায় সাতটা হবে। সকলেই এসে গতরাত্রের মত উপরের লাইব্রেরী ঘরে জমায়েত হয়েছেন।
সকলের চোখ-মুখ দেখলেই বোঝা যায়, গতরাত্রে কারও চোখেই ঘুম ছিল না।
সকলের চোখ-মুখেই নিদ্রাহীন রাত্রি ও গত সন্ধ্যার দুর্ঘটনার উদ্বেগটা যেন স্পষ্ট হয়ে রয়েছে তখনও।
নিদারুণ উদ্বেগ, অশান্তি ও দুশ্চিন্তার মধ্যে যে সকলের রাত কেটেছে, কিরীটীর বুঝতে সেটা আদৌ কষ্ট হয় না সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে।
কারও মুখেই কোন কথা নেই। সকলেই যেন বোবা।
আজ অবিশ্যি সকলের মধ্যে শকুন্তলা দেবীও ছিল। কারণ কিরীটীর ইচ্ছাতেই তাকেও লাইব্রেরী ঘরে আসতে হয়েছিল।
সমস্ত ঘরের মধ্যে যেন একটা থমথমে বিষণ্ণ ভাব।
একসময় ভৃত্য গোকুলই গত সন্ধ্যার মত চায়ের ট্রেতে করে চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। এবং গত সন্ধ্যার মতই দ্বিতীয়বার গিয়ে আবার গোকুল বাকি চায়ের কাপগুলো নিয়ে এল। তারপর প্রত্যেকের হাতে চায়ের কাপ তুলে দেওয়া হল।
চায়ের কাপ সকলেই হাতে নিল বটে, কিন্তু কিরীটী লক্ষ্য করলে, কারুরই যেন চায়ের কাপে চুমুক দিতে তেমন কোন আগ্রহই নেই আজ।
পুতুলের মতই যেন যে যার চায়ের কাপ হাতে বসে আছেন।
কিরীটী আরাম করে নিজের হস্তধৃত চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, কি হল, সব চুপচাপ বসে কেন? চা খান! ভয় নেইনির্ভয়ে খান। কেউ যদি গতকাল চায়ের কাপে বিষ দিয়ে থাকে, আজ নিশ্চয়ই আবার সাহস পাবে না। তাছাড়া যিনিই গত সন্ধ্যায় বিজনবাবুর চায়ের কাপে বিষ দিয়ে থাকুন না কেন, আমার কাছে তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।
সকলে যাঁরা ঘরের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, যেন চমকেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে।
হ্যাঁ, আজ তাকে আমি চোখে-চোখেই রেখেছি। অতএব নির্ভয়ে সকলে চা পান করুন।
বৃন্দাবনবাবুই অতঃপর সর্বপ্রথম চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
তারপর ডাঃ অধিকারী। একে একে তারপর সকলেই যে যার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
সর্বশেষে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন মধুসূদন সরকার।
এবং দুই চুমুক চা পান করবার পরই ঠিক গত সন্ধ্যার মতই অব্যক্ত একটা যন্ত্রণায় মুখ-চোখ বিকৃত করে মধুসূদন সরকার চেয়ারের উপর ঢলে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে।
তার হাত থেকে চায়ের কাপটা মেঝেতে পড়ে গেল।
সর্বাগ্রে বৃন্দাবন সরকারই চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শঙ্কাজড়িত ব্যাকুলকণ্ঠে বলে উঠলেন, কি-কি হল?
ডাঃ অধিকারী বললেন, সর্বনাশ! আবার পয়েজন নাকি?
ঘরের আর সকলেই নির্বাক। আর প্রত্যেকের হাতেই তখন ধরা রয়েছে যাক যাঁর চায়ের কাপটি।
কিরীটী তার চায়ের কাপটা একপাশে নামিয়ে মধুসূদনবাবুর কাতরোক্তি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, এবারে সে এগিয়ে এসে হতবাক বিমূঢ় সকলের দিকে বারেকের জন্য দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে মধুসূদন সরকারকে স্পর্শ করে মৃদুকণ্ঠে বললে, হি ইজ ডেড!
২০. আর্তকণ্ঠে যেন কথাটা প্রশ্নের মত
ডেড! আর্তকণ্ঠে যেন কথাটা প্রশ্নের মতই পুনরুচ্চারণ করলেন বৃন্দাবন সরকার।
হ্যাঁ, স্টোন ডেড!
সকলে স্তম্ভিত নির্বাক।
ডাঃ অধিকারী একটু পরে মৃতদেহের সামনে একসময় ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত নির্বাক হলেও—মধুবাবুর চায়ের কাপটা কোথায় গেল?-বলতে বলতে কিরীটী নিচু হয়ে হাত ঢুকিয়ে উপবিষ্ট মধুসূদনের সোফার তলা থেকে চায়ের কাপটা তুলে নিল। তারপরই কাপটা হাতে নিয়ে মধুসূদন সরকারকে লক্ষ্য করে বললে, স্পেনডিড! সত্যিই চমৎকার অভিনয় করেছেন মধুবাবু, উঠুন—এতটা সাকসেস্ সত্যিই আমি আশা করিনি।
বিস্মিত হতবাক সকলের চোখের সামনে এবারে মধুসূদন সরকার চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলেন।
কিরীটী ডাঃ অধিকারীর দিকে চেয়ে এবারে বললে, বাধ্য হয়েই আজকের এই অভিনয়টুকু মিঃ সরকারকে দিয়ে আমাকে করাতে হল ডাক্তার অধিকারী। কিন্তু কেন করেছিলাম এবারে
আমি সেই কথাটাই বলব।
কিরীটীর কথায় ও মধুসুদনকে চোখ মেলে উঠে বসতে দেখে এতক্ষণে যেন সকলে সম্বিৎ ফিরে পান। সকলেই একটা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
সকলেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটী তখন আবার বলছে, হ্যাঁ, কোন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই আজকের এই অভিনয়ের অনুষ্ঠানটি আমি মধুবাবুর সঙ্গে গতরাত্রে পরামর্শ করে করেছি এবং আজকের ব্যাপারটা নিছক একটা অভিনয় হলেও, গতকাল সন্ধ্যায় ঠিক অনুরূপ ব্যাপারটি নির্মম ও নিষ্ঠুর সত্য বলেই আমরা জানি। কারণ গত সন্ধ্যায় ঠিক আজকের মতই কাপে এক চুমুক দিয়েই বিজনবাবু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন আমাদের সকলেরই চোখের সামনে-এবং যদিও ময়না তদন্তের ফলাফল এখনো আমরা জানতে পারিনি, তথাপি আমি আপনাদের সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারি, হতভাগ্য বিজনবাবুর মৃত্যুর পশ্চাতেও আছে আগের দুবারের মতই মারাত্মক নিকোটিন বিষপ্রয়োগই।
ঘরের মধ্যে সকলেই স্তব্ধ, বিমূঢ় ও নির্বাক।
কিরীটী আবার বলে, নিকোটিন বিষপ্রয়োগেই যদি বিজনবাবুর মৃত্যু হয়ে থাকে তো কাল নিশ্চয়ই তার চায়ের কাপের মধ্যেই আমাদের অলক্ষ্যে হয় নিজ হাতে বা অন্য কারও সহযোগিতায় হত্যাকারী ঐ মারাত্মক নিকোটিন বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। রান্নাঘরের পাশের ঘরে গত সন্ধ্যায় শকুন্তলা দেবী গোকুলের সাহায্যে আমাদের জন্য চা তৈরী করেছিলেন বলেই আমরা জানি। এবং ঐ সময় তারা দুজনেই বাইরে গিয়েছিলেন—শকুন্তলা দেবী দুবার ও গোকুল একবার। কাজেই ঐ গোকুল বা শকুন্তলা দেবী যদি চায়ে না বিষ মিশিয়ে থাকেন–
সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকলের দৃষ্টি অদূরে উপবিষ্ট শকুন্তলার উপর গিয়ে পতিত হল।
না, না, আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, সহসা যেন চাপা আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল শকুন্তলা, বিষ আমি দিইনি—
কিন্তু কিরীটী শকুন্তলার সেই আর্ত চিৎকারে যেন কর্ণপাতও করল না। সে যেমন বলছিল বলতে লাগল, যা, কেবল শকুন্তলা দেবী বা গোকুলই নয়—কাল এ-বাড়িতে যাঁরা ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন তাদের যে কারও পক্ষেই বিজনবাবুর চায়ের কাপে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল। অর্থাৎ যে কেউ বিষ মেশাতে পারেন।
আবার ঐ সময় চিৎকার করে উঠলেন বৃন্দাবন সরকার, হাউ অ্যাবসার্ড! এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়?
ঠিকই বলছি বৃন্দাবনবাবু, একমাত্র আমি ও শচীবিলাসবাবু ব্যতীত কাল সকলেই আপনারা এ ঘর থেকে ঐ সময়ের মধ্যে বেরিয়েছেন আমার স্পষ্ট মনে আছে।
সকলেই এবারে চুপ।
তাই যদি হয়, তাহলে আপনাদের যে কারো পক্ষেই গতকাল চায়ের কাপে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল এ কথাটা নিশ্চয়ই কেউ ডিনাই করতে পারবেন না! যাক যা বলছিলাম, তারপর ট্রেতে করে চায়ের যে কাপগুলো গোকুল নিয়ে এল তার মধ্যেই কোন একটি কাপে নিকোটিন বিষমিশ্রিত চায়ে চুমুক দিয়েই নিজের অজ্ঞাতে বিজনবাবু আমাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করলেন। কথা অবিশ্যি এর মধ্যে একটা আছে। গোকুলই সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েছিল। নিজে যদি দোষী হয় তো সে জেনেই পূর্বাহ্নে বিজনবাবুর হাতে বিষমিশ্রিত চায়ের কাপটি তুলে দিয়েছিল; আর সে যদি নির্দোষী হয়ে থাকে তো অজ্ঞাতেই সে বিজনবাবুর হাতে ঐ বিষের কাপটি তুলে দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আর একটা সন্দেহ জাগতে পারে আমাদের মনে। বিজনবাবুর হাতে অজ্ঞাতে বা না জেনে যদি গোকুল বিষের কাপটি তুলে দিয়েই থাকে, তাহলে কি বিজনবাবুর মৃত্যুটা অ্যাকসিডেন্টাল! আর তাই যদি হয়, হত্যাকারীর এইম কার উপরে ছিল? কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বিজনবাবুর মৃত্যুটা একেবারে অ্যাকসিডেন্টাল নয়। বিজনবাবু হত্যাকারীর লিস্টে তত ছিলেনই-আরো কেউ ছিল!
সে কি! অধস্ফুট কণ্ঠে প্রশ্ন করেন এবারে ডাঃ অধিকারী।
হ্যাঁ, ডাঃ অধিকারী। আরও কেউ ছিল এবং এখনও তিনি পূর্ববৎ হত্যাকারীর লিস্টে আছেন।
কিরীটীর শেষের কথায় সকলে আবার ভীতদৃষ্টিতে পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
মৃত্যু–আবার কার জন্য মৃত্যু এখানে ওৎ পেতে আছে কে জানে?
এ কি সর্বনেশে কথা!
কিরীটী একটু থেমে আবার তখন বলতে শুরু করেছে, তবে আমার বিশ্বাস, বেচারী গোকুল হয়ত দোষী নয়। তা সে যাই হোক, বর্তমানে আমাদের সব চাইতে বেশী ভাববার কথা হচ্ছে, পর পর যেভাবে তিনটি মৃত্যু এ বাড়িতে ঘটেছে সেরকম নাটকীয় ব্যাপারের আর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই দিকেই আমাদের দৃষ্টি দেওয়া কর্তব্য নয় কি?
কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়-সহসা কিরীটীকে বাধা দিয়ে ডাঃ অধিকারী বললেন, দশরথের কথা ছেড়ে দিলেও সারদা আর বিজনের মৃত্যু যদি ঐ নিকোটিন বিষপানেই তাদের অজ্ঞাতে হয়ে থাকে তো গ্লাসে ও কাপে–
কিরীটী শেষ করতে দিল না ডাঃ অধিকারীকে কথাটা, বললে, কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে, নিকোটিন বিষ গ্লাসে পাওয়া উচিত ছিল ও কাপেও পাওয়া উচিত ছিল, তাই না?
হ্যাঁ, মানে–
ডাঃ অধিকারী, গ্লাসেও যেমন নিকোটিনের নামগন্ধ পাওয়া যায়নি, ঐ কাপেও পাওয়া যেত না। তাই মিথ্যে আমি কাপটা আর কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্য বিমলবাবুকে পাঠাতে বলিনি।
তবে?
কিন্তু কেন? গ্লাসে ও কাপে যদি সত্যই নিকোটিন দেওয়া হয়ে থাকে তো কেন নিকোটিন অ্যানালিসিসে কাপে বা গ্লাসে পাওয়া যাবে না? সহসা কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা ঋজু ও ধারাল হয়ে ওঠে। সে বলতে থাকে, পাওয়া যায়নি ও যাবে না—তার কারণ সারদাবাবুর ঘরে যে গ্লাসটা পাওয়া গিয়েছিল এবং গতকাল সোফার তলায় যে কাপটা পাওয়া গিয়েছে, আদপেই। সে গ্লাস এবং সেই কাপ সারদাবাবু বা বিজনবাবু ব্যবহার করেননি তাদের মৃত্যুর পূর্বে।
হোয়াট ড়ু ইউ মিন, মিঃ রায়? তার মানে?
তীক্ষ্ণ একটা চীৎকারের মতই যেন ডাঃ অধিকারীর প্রশ্নটা কিরীটীর প্রতি নিক্ষিপ্ত হল।
এবারে শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে কিরীটী বললে, একসাটলি তাই ডাঃ অধিকারী। বলতে বলতে সহসা জামার পকেট থেকে একটা কাপ বের করে সম্মুখস্থিত টেবিলের উপরে রক্ষিত ক্ষণপূর্বের যে কাপটি মধুসূদনের সোফার তলা থেকে নিচু হয়ে কিরীটী বের করেছিল সেই কাপটি অন্য হাতে তুলে নিয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে আবার বললে, দেখুন সকলে, এই দুটি কাপ হুবহু এক। অথচ আপনাদের চোখের সামনে—এই কিছুক্ষণ পূর্বে যে কাপটি আমি সোফার নিচে থেকে বের করেছিলাম সে কাপে আদৌ মধুবাবু আজ চা পান করেননি তার মৃত্যুর অভিনয়ের সময়। তিনি চা পান করেছিলেন আসলে এইমাত্র আমার জামার পকেট থেকে যে কাপটি বের করলাম সেই কাপে!
সর্বনাশ! তবে কি—
ঠিক তাই ডাঃ অধিকারী। সেই কারণেই সারদাবাবুর ঘর থেকে যে গ্লাসটা পাওয়া গিয়েছিল সেই গ্লাস কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে যেমন কোন নিকোটিনের ট্রেস মাত্রও পাওয়া যায়নি, তেমনি গত সন্ধ্যায় বিজনবাবুর মৃত্যুর পর যে কাপটি আমি সোফার নিচে পেয়েছিলাম সে কাপটিতেও নিকোটিনের ট্রেস বা নামগন্ধও পাওয়া যেত না। সো ইউ অল অ্যানডারস্ট্যাও নাউ? আসল ব্যাপার, গতকাল অত্যন্ত ট্যাক্টফুলি তার কাজ হাসিল করেছিল হত্যাকারী। যদিও প্রথম দুবারে ট্যাক্টফুলনেসের তার প্রয়োজন হয়নি, কারণ বিষপ্রয়োগের সময় নো বডি ওয়াজ প্রেজেন্ট দেয়ার!
কিন্তু হাউ, কেমন করে? প্রশ্ন করলেন আবার ডাঃ অধিকারী।
কেমন করে, তাই না ডাক্তার? আসল বিষমিশ্রিত কাপটি হত্যাকারী গতকাল কি ভাবে আমাদের চোখের সামনে ম্যানেজ করে অন্য একটা কাপ রিপ্লেস করল! ওয়েল-ভাবতে গেলে যদিও ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ও অবিশ্বাস্য, তথাপি হত্যাকারী বা খুনীর পক্ষে গতকাল কাপটা রিপ্লেসের ব্যাপারে যা প্রয়োজন ছিল সেটা হচ্ছে তার খানিকটা তত্রপ, ক্ষিপ্রতা এবং খানিকটা নার্ভ-যে দুটোই অবিসংবাদিত ভাবে হত্যাকারীর ছিল। কালকের ব্যাপারটা একবার সকলে আবার কুল ব্রেনে ভেবে দেখুন। অতর্কিতে যখন বিজনবাবু হঠাৎঅসুস্থ হলেন বিষপান করে, আর অজ্ঞাতে আমরা সকলেই যেন কিছুটা ননপ্লাসড় হয়ে পড়েছিলাম ঘটনার আকস্মিকতায় ও আমাদের সকলের মনই তখন বিজনবাবুর দিকে-আমাদের সকলের সেই অসতর্ক মোমেন্ট-টুকুরই ত্বরিত সদ্ব্যবহার করেছিল হত্যাকারী অর্থাৎ ঐ মুহূর্তেই সে ঠিক আজকের আমার মতই আসল কাপটি অন্য একটি নির্দোষ কাপ দিয়ে সবার অলক্ষ্যে রিপ্লেস করেছিল। আশা করি এবারে আপনারা সকলেই আমার আজকের অনুষ্ঠানের সত্যকার উদ্দেশ্যটা উপলব্ধি করতে পারছেন।
কিরীটীর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অধস্ফুট চিৎকার করে বললেন মধুসূদন সরকার, কে-কে তবে কাপটা সরিয়েছিল?
নিঃসন্দেহে এ সে-ই মিঃ সরকার, যে সারদাবাবু দশরথ ও বিজনবাবুকে হত্যা করেছে। গম্ভীরকণ্ঠে কিরীটী প্রত্যুত্তর দিল।
কিন্তু কে-কে সে?
কে—সেটাই তো আমাদের খুঁজে এখন বের করতে হবে মিঃ সরকার—এবং সেটা যতক্ষণ
সম্ভব হচ্ছে, হত্যাকারীকেও আমরা স্পট-আউট করতে পারব না। সে আমাদের নাগালের বাইরেই অন্ধকারে থেকে যাবে।
আপনি-আপনি জানেন মিঃ রায়?
হয়ত জানি বা হয়ত জানি না, মিঃ সরকার। কিন্তু তার চাইতেও বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ। যে কথাটা সেটা হচ্ছে-আপনারা সকলেই কাল যাঁরা ঐ দুর্ঘটনার সময়ে এ ঘরে উপস্থিত ছিলেন, আজও আছেন এবং আবার কিছুক্ষণ পূর্বে যা আমি আপনাদের বলেছি সেটাই রিপিট করছি। যে মৃত্যুর অভিনয় আজ মধুসূদনবাবুকে দিয়ে করিয়েছি ক্ষণপূর্বে এই ঘরে সেটা অভিনয় এবং নিছক মিথ্যা হলেও, আবার আচমকা যে কোন মুহূর্তেই হয়ত ঠিক ঐভাবেই কারো না কারো আপনাদের মধ্যে মৃত্যু তার সত্য নিয়ে দেখা দিতে পারে। ঠিক হয়ত ঐভাবেই। হত্যাকারী আবার কারও উপরে অ্যাটেম্পট নিতে পারে, যদি তার হত্যার প্রয়োজন না এখনও ফুরিয়ে গিয়ে থাকে। তাই সকলের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, যাতে গত তিনবারের হত্যার মত আবার ঐ নৃশংস ব্যাপার ভবিষ্যতে না ঘটে। যদি আপনাদের মধ্যে কেউ এমন। কিছু জানেন যা এখনও পর্যন্ত পুলিস জানতে পারেনি, অথচ যার সাহায্যে পুলিসের এই হত্যা-রহস্যের তদন্ত সহজ হয়—সে কথাটা অন্তত আমাকে খুলে বলুন। জানবেন এই সময় কোন কিছু ঐ হত্যা-রহস্য সম্পর্কে গোপন রাখা মারাত্মক হবে। বলুন, আমি আবার অনুরোধ জানাচ্ছি সকলের কাছে, বলুন!
কিন্তু সকলেই চুপ। নির্বাক। যেন পাথর।
ছুঁচ পতনের শব্দটুকু পর্যন্তও বুঝি শোনা যাবে।
ধীরপদে ঐ সময় থানা-অফিসার বিমল সেন ও সুশান্ত এসে ঘরে প্রবেশ করল। সত্যি কথা বলতে কি, সকলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
২১. আরো দুটো রাত দুটো দিন
আরো দুটো রাত দুটো দিন তারপর কেটেছে।
এবং একমাত্র শচীবিলাসবাবু ব্যতীত সকলেই তখনও সরকার ভিলাতেই উপস্থিত।
শচীবিলাসকে যেতে অনুমতি দিয়েছে বিমল সেন।
কিন্তু যাঁরা আছেন তখনও সরকার ভিলায় তারা বুঝি সত্যই পাগল হয়ে যাবে। সর্বক্ষণ এক দুর্বিষহ অকথিত মানসিক যন্ত্রণার পীড়ন সকলকেই যেন কেমন বিমূঢ় করে রেখেছে।
বিজনবাবুর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিরীটীর অনুমানটাও মিথ্যা হয়নি। নির্ভুল সত্য বলেই প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ বিজনবাবুর ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও মৃত্যুর কারণ মারাত্মক বিষ নিকোটিন বলেই প্রমাণিত হয়েছে ইতিমধ্যে।
সবাই যে যার ঘরে চুপচাপ সর্বক্ষণই প্রায় বসে বা শুয়ে কাটান। যাবতীয় পান ও আহারের ব্যাপারে সদা-সতর্ক পুলিসপ্রহরী নিযুক্ত করেছে কিরীটী বিমল সেনের সাহয্যে। তথাপি যেন আহারে ও পানে ভীতি রয়েছে সকলের।
কেউ যেন কিছুতেই মোয়াস্তি পাচ্ছে না।
মৃত্যুভয়ে, মৃত্যু-আশঙ্কায় এমনিই বুঝি মানুষ তার আপন অজ্ঞাতে ভীত, সশঙ্কিত।
তবু আশ্চর্য, মৃত্যু আসবেই এবং প্রতিনয়ত আসছেই!
জন্মের মতই মৃত্যু স্বাভাবিক এবং অনিবার্য, তবু মানুষ চিরদিনই জন্মের পর জ্ঞান হওয়া অবধি মৃত্যুভয়েই যে সিটিয়ে রয়েছে।
কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা আছে।
মানুষের সহ্যশক্তির একটা সীমারেখা রয়েছে—সেই কথাটি ভেবেই সেদিন রাত্রে খাবারের টেবিলে বসে কিরীটী সকলকে লক্ষ্য করে বললে, কাল সকাল থেকেই আপনারা সবাই মুক্ত।
সকলেই একসঙ্গে কথাটা শোনামাত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
তাহলে সত্যিই অসহ্য এই প্রতি মুহূর্তের বোবা-যন্ত্রণা থেকে তারা মুক্তি পেল সকলে!
অভিশপ্ত মত্যু-আতঙ্কে-ভরা এই সরকার ভিলা ছেড়ে তারা যেখানে যার খুশি চলে যেতে পারবেন!
একে একে সকলে খাবার টেবিল ছেড়ে ডাইনিং হল থেকে বের হয়ে গেলেন। শুধু টেবিলের সামনে বসে রইল কিরীটী আর শকুন্তলা।
টেবিলের উপর টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বলছে।
সহসা কিরীটী শকুন্তলাকে সম্বোধন করে বললে, আপনিও নিশ্চয় চলে যাচ্ছেন কালই শকুন্তলা দেবী?
য়্যাঁ! সহসা যেন নিদ্রোখিতের মতই তাকালো শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে, এবং মৃদুকণ্ঠে বললে, হ্যাঁ, যাব।
কথাটা বলে আর দাঁড়াল না শকুন্তলা।
চেয়ার থেকে আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, নিঃশব্দে ঘর থেকে এবারে বের হয়ে গেল। কিরীটীও ঘর থেকে বের হয়ে তার নির্দিষ্ট ঘরে এসে প্রবেশ করল।
ঐদিনই দ্বিপ্রহরে সারদাচরণের লাইব্রেরী ঘরের বইগুলো দেখতে দেখতে একটা বাঁধানো ফটোর অ্যালবাম পেয়েছিল কিরীটী। অ্যালবামটা এনে নিজের শয্যার তলায় রেখে দিয়েছিল। সেটা বের করে টেবিলের সামনে আলোয় এসে বসল।
সারদাচরণের ফ্যামিলি অ্যালবাম।
একটার পর একটা পাতা উলটে যায় কিরীটী অ্যালবামের।
নানাবয়েসী মেয়ে-পুরুষের ফটো সেই অ্যালবামে রয়েছে আঁটা।
ফটোগুলো দেখতে দেখতে সহসা একটা ফ্যামিলি গ্রুপ ফটোর প্রতি নজর পড়ে কিরীটীর।
মধ্যস্থলে সারদাচরণ, তাকে বেশ চেনা যায়—বাইরের ঘরে ও লাইব্রেরী ঘরে সারদাচরণের যে ফটো আছে তার সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে। তার এক পাশে বৃন্দাবন সরকার ও অন্যপাশে তার দাঁড়িয়ে মধুসূদনই সরকার নিশ্চয়ই।
ফটোটা অন্ততঃ দশ-বারো বৎসর পূর্বের। কারণ দশ বৎসর তো মধুসূদন গৃহছাড়াই।
পরিবর্তনও হয়েছে মধুসূদনের চেহারায় ইতিমধ্যে যথেষ্ট।
এবং দশ বৎসরে চেহারার পরিবর্তন তো হবারই কথা।
তখন মধুসূদন দাড়ি-গোফ রাখতেন না, এখন চাপদাড়ি ও ভারী গোঁফ মুখে শোভা পাচ্ছে।
চাপদাড়ি ও গোঁফ।
কিরীটী বোধ হয় নিজের চিন্তায় তম্ময় হয়ে গিয়েছিল, সহসা একটা দীর্ণ আর্ত চিৎকার ও দুড়ম দুড়ুম পর পর দুটো গুলির শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে কিরীটী।
চকিতে কিরীটী অ্যালবামটা টেবিলের উপরেই ফেলে রেখে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে আসে।
গুলির শব্দ ও চিৎকার সকলেই শুনেছিলেন নিশ্চয়ই, কারণ কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সকলকেই বাইরের বারান্দায় দেখতে পায়।
কিরীটীর নির্দেশমতই গত কদিন ধরে বারান্দা ও সিঁড়ির সামনে যে আলোটা ছিল সেটা সারারাত ধরেই জ্বালানো থাকত।
আলোটা অবিশ্যি খুব পর্যাপ্ত নয়। তবে পর্যাপ্ত না হলেও সমস্ত বারান্দা ও সিঁড়ির অর্ধেকটা ভালই দেখা যাচ্ছিল।
সিঁড়ির কাছাকাছিই বারান্দাটা ডাইনে বেঁকে গিয়েছে পশ্চিম দিকে।
ডাঃ অধিকারী, মিঃ মল্লিক, শকুন্তলা ও বৃন্দাবন সরকারকে দেখতে পেল কিরীটী।
কেবল মধুসূদন সরকারকেই দেখতে পেল না তাদের মধ্যে।
কথা বললেন প্রথমে বৃন্দাবন সরকারই, পর পর দুটো গুলির আওয়াজ আর কার যেন চিৎকারের শব্দ শুনলাম।
হ্যাঁ, কিন্তু মধুসূদনবাবু কোথায়? তাঁকে দেখছি না? বললে কিরীটী।
দাদা তো পশ্চিমের ঘরে—বললেন বৃন্দাবন সরকার।
চলুন তো-বলে সর্বাগ্রে এগিয়ে গেল কিরীটী এবং তাকে অনুসরণ করে অন্যান্য সকলেই যেন কেমন ভীতভাবে অগ্রসর হল।
মধুসূদন সরকারের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। এবং ঘরে আলো জ্বলছিল।
সর্বাগ্রে সেই ঘরে কিরীটীই পা দিয়ে থমকে দাঁড়াল।
ঘরের মেঝেতে কে একটা লোক উবুড় হয়ে পড়ে আছে আর তার চারপাশে রক্তের যেন একেবারে ঢেউ খেলে যাচ্ছে এবং দক্ষিণ বাহুমূলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মেঝের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় বসে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মধুসূদন সরকার ক্ষতস্থানটা বাঁ হাতে চেপে।
এ কি! কি সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি কথাটা বলে সর্বাগ্রে ডাঃ অধিকারীই আহত মধুসূদনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
কি হয়েছে? ব্যাপার কি দাদা? বৃন্দাবনও এগিয়ে যান।
কিরীটী ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে ভূপতিত মৃত রক্তাক্ত দেহটা উটে দিতেই যেন সকলে চমকে উঠল মৃতের দিকে তাকিয়ে এবারে।
গুলিবিদ্ধ মৃত ব্যক্তি আর কেউ নয়-ভৃত্য গোকুল।
এ কি! এ যে দেখছি গোকুল! বললেন মিঃ মল্লিক।
হ্যাঁ-ওই বেটাই। যন্ত্রণা-ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন মধুসূদন সরকার, ঘরের দরজা আমার ভেজানোই ছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়তে পড়তে বোধ হয় একটু তন্দ্রামত এসেছিল, হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হতেই চেয়ে দেখি আমার জলের গ্লাসে শিশি থেকে কি একটা ঢালছে ঐ গোকুল। তাই দেখেই সঙ্গে সঙ্গে আমি বালিশের তলা থেকে রিভলবারটা নিয়ে ওকে গুলি করতে যাব হঠাৎও আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ধস্তাধস্তি করতে করতে একটা ফায়ার আমার হাতে লাগে, আর একটায় বোধ হয় ওই বেটা ফিনিশ হয়েছে
ঘরের মেঝেতেই একটা বেঁটে মত কালো শিশিও পাওয়া গেল মৃত গোকুলের পাশেই।
কি সর্বনাশ! ডাঃ অধিকারী বললেন, শেষ পর্যন্ত ঐ বেটাই—
পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে শিশিটা আলগোছে মেঝে থেকে তুলে নিয়ে বৃন্দাবন সরকারের দিকে চেয়ে কিরীটী বললে, থানায় বিমলবাবুকে এখনি একটা খবর দিন বৃন্দাবনবাবু!
থানায়?
হ্যাঁ, যান—গোকুলের ব্যাপারটা বিমলবাবুকে এখুনি জানানো কর্তব্য।
বেশ।
বৃন্দাবন সরকার তখুনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
এবার কিরীটী ডাঃ অধিকারীর দিকে তাকিয়ে বললে, ওঁর হাতের উৎটা পরীক্ষা করে দেখলেন ডাঃ অধিকারী?
নাঃ, এই দেখছি-বলে ডাঃ অধিকারী মধুসূদন সরকারের হাতের উৎটা পরীক্ষা করে বললেন, না সামান্যই, সুপারফিসিয়াল একটা স্কিন ডিপ উণ্ডের উপর দিয়ে গিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
তা হোক, ড্রেস করে দিন। কিরীটী বললে শান্তকণ্ঠে।
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই থানা থেকে বিমল সেন এসে গেল। সে আবার মধুসূদন সরকারের জবানবন্দি নিল। জবানবন্দি নিতে নিতেই একসময় বললে বিমল, যাক, শেষ পর্যন্ত যে বেটা ঘায়েল হয়েছে এই রক্ষে! নইলে আরও যে এমন কতগুলো খুন করত কে জানে! উঃ সাংঘাতিক!
সকলে লাইব্রেরী ঘরের মধ্যেই জমায়েত হয়েছিলেন আজও।
ডাঃ অধিকারী বললেন, যা বলেছেন মিঃ সেন। মধু আজ খুব বেঁচে গিয়েছে।
লাকিই বলতে হবে। মিঃ মল্লিক বললেন।
যাহোক সে-রাত্রিও অতিবাহিত হল একসময়।
এবং পরের দিন সকাল দশটার ট্রেনেই মিঃ মল্লিক ও ডাঃ অধিকারী চলে গেলেন কলকাতায়।
কিরীটীও তাদের সঙ্গে একই ট্রেনে কলকাতায় গেল।
পরের দিন শকুন্তলাও কলকাতা চলে গেল।
দিন সাতেক বাদে।
বৈকালের দিকে সরকার ভিলায় যখন কিরীটী, সুশান্ত ও বিমল সেন এসে প্রবেশ করল, মধুসূদন সরকার তখন বাইরের ঘরে বসে একজন বৃদ্ধ বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
ওদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে মধুসূদন সাদরে আহ্বান জানালেন, আসুন, আসুন–বসুন।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদের ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বললেন, তাহলে আজ আমি উঠি মিঃ সরকার। তাহলে ঐ কথাই রইল। সামনের সপ্তাহেই রেজেস্ট্রি হবে।
বেশ।
ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। আপনারা বসুন মিঃ রায়, আমি কাউকে চা দিতে বলে আসি।
না, না—আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না মিঃ সরকার, বসুন। চা একটু আগেই থানা থেকে খেয়ে আসছি। কিরীটী বললেন।
আমার এখানেও না হয় এক কাপ করে থোক। বলেই মধুসূদন মৃদু হেসে কথাটা শেষ করলেন, এখানে চা খেতে আপনাদের ভো আর ভয় নেই। চা রহস্যের তো মীমাংসা হয়েই গিয়েছে, কি বলেন মিঃ রায়!
তা হয়েছে বটে। তবে চা পরে হবেখন। আপনি বসুন।
কিরীটীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরের বারান্দায় কয়েকজোড়া মিলিত জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
কারা যেন আসছে বলে মনে হচ্ছে! মিঃ সরকার বললেন।
বোধ হয় ডাঃ অধিকারী, বৃন্দাবনবাবু ওঁরা সব এলেন। বললে কিরীটী।
সত্যিই পরমুহূর্তেই ডাঃ অধিকারী, তার পশ্চাতে মিঃ মল্লিক, বৃন্দাবন সরকার ও শকুন্তলা এসে ঘরে প্রবেশ করল।
কি ব্যাপার ডাঃ অধিকারী, আপনারা–
মধুসূদনকে কথাটা শেষ করতে দিল না কিরীটী। সে বললে, সকলকেই আজ এখানে আমি ডেকে আনিয়েছি।
কিন্তু ব্যাপারটা কি?
আপনি শুনে হয়ত খুশী হবেন মিঃ সরকার, কিরীটী বললে, সারদাবাবু দশরথ, বিজনবাবু ও গোকুলের হত্যারহস্যের মীমাংসা
মীমাংসা! কথাটা বললেন বৃন্দাবন সরকার।
হ্যাঁ বৃন্দাবনবাবু, সেই রহস্যের মীমাংসার জন্যই আজ সকলে আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি।
কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই কেমন যেন একটু বিব্রত ও অস্বােয়াস্তি বোধ করছেন বোঝা গেল।
কিরীটী কিন্তু একান্ত নির্বিকার।
একটা অখণ্ড স্তব্ধতা যেন ঘরের মধ্যে থমথম করছে।
২২. ধীরে ধীরে কিরীটী
ধীরে ধীরে কিরীটী তার বক্তব্য শুরু করে :
শুনে নিশ্চয়ই সুখী হবেন আপনারা, গত এক মাস ধরে পর পর যে চারটি নিষ্ঠুর হত্যা এই সরকার ভিলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই হত্যা-রহস্যের পশ্চাতে যে আছে সে যত চালাক ও চতুর হোক না কেন, আমার চোখে শেষ পর্যন্ত সে ধুলো দিতে পারেনি–
এসব আপনি কি বলছেন মিঃ রায়? তবে কি গোকুল হত্যাকারী নয়? প্রশ্ন করলেন বৃন্দাবন সরকার।
শান্তকণ্ঠে কিরীটী বলে ওঠে, না, না বৃন্দাবনবাবু, ইট ওয়াজ নট গোকুল।
তবে কে-কে?
একসঙ্গে সকলেরই কণ্ঠ হতে যেন ঐ কথাগুলি উচ্চারিত হল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় একই সময়ে।
সে কে—সেই কথাই তো আজ আপনাদের আমি বলব। সারদাবাবু ও দশরথের মৃত্যুর ব্যাপারটা হত্যাকারী খুব ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করলেও, বিজনবাবুর হত্যার পরই খুনী আমার চোখের সামনে-ব্যাপারটা আগাগোড়া স্থিরচিত্তে ঐদিনই রাত্রে চিন্ত করবার পর থেকেই ক্রমশঃ-হ্যাঁ, আমার চোখের সামনে আকার নিতে থাকে একটু একটু করে। আর আমার সেই সন্দেহের ব্যাপারটা খুনী যে মুহূর্তে অনুমান করতে পারলে সেই মুহূর্ত থেকেই সে বিচলিত হয়ে ওঠে।
কিন্তু সে কে? অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন ডাঃ অধিকারী।
বলছি ডাঃ অধিকারী। ডোনট বি ইমপেসেট! যা, খুনী বিচলিত হবার সঙ্গে সঙ্গে অনন্যোপায় হয়েই সে শেষ চালটি চালে।
শেষ চাল? প্রশ্ন করল বিমল সেন।
হ্যাঁ, রাদার ইউ ক্যান সে-দি লাস্ট অ্যাটেমণ্ট। কিন্তু দুটি মারাত্মক ভুল সে করে বসে ঐ শেষবারের মত আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে গিয়ে, যার ফলে যেটুকু তখনও আমার কাছে অস্পষ্ট ছিল তাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে দিনের আলোর মতই সঙ্গে সঙ্গে।
তাহলে গোকুলের মৃত্যুই রাতেই–
ডাঃ অধিকারীর কথাটা শেষ হল না, কিরীটী তাকে বাধা দিয়ে বললে, হা ডাক্তার, আমি সেই রাত্রেই জানতে পেরেছিলাম কে সে-কে হত্যা করেছে এমন নৃশংসভাবে পর পর এতগুলো লোককে। সেদিন আপনাকে আমি বলেছিলাম যে অর্থ অনর্থম। তা এ ব্যাপার অর্থ অনর্থম্ তো বটেই-সেই সঙ্গে পঞ্চশরের খেলাও ছিল, যেজন্য হত্যাকারী সর্বপ্রথম সারদাচরণকে হত্যা করে। সত্যি অত্যন্ত ট্যাক্টফুলি সে সারদাচরণকে হত্যা করেছিল ছদ্মবেশে এই সরকার ভিলাতে এসে
ছদ্মবেশে? উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করেন বৃন্দাবন সরকার।
হ্যাঁ বৃন্দাবনবাবু, হি ওয়াজ ইন ডিসগাইজ অ্যাট দ্যাট টাইম! কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সকলের চোখে, এমন কি আপনার চোখে ধুলো দিতে পারলেও, কিন্তু এ বাড়ির একজনের চোখে ধুলো দিতে পারেনি-সে হচ্ছে পুওর দশরথ।
দশরথ? ডাঃ অধিকারী বললেন।
হ্যাঁ, দশরথ। এবং দশরথ তাকে চিনতে পেরেছে সন্দেহ করেই খুনী আর কালবিলম্ব করে তাকেও শেষ করে বা করতে বাধ্য হয়।
কিন্তু কে সে? বললেন বৃন্দাবন সরকার আবার।
আপনাদের সরকার ভিলার নবনিযুক্ত ভৃত্য শ্রীমান কেতু।
কেতু!
হ্যাঁ। কিন্তু কে সে কেতু? কি তার আসল পরিচয়? আর কেনই বা হত্যাকারীকে কেতু পরিচয়ে ছদ্মবেশে এই সরকার ভিলাতে আসতে হয়েছিল?
একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে শুরু করে, সে অন্য পরিচয়ে এসেছিল এই জন্য যে, তার সত্যকারের পরিচয়ে সারদাচরণ বেঁচে থাকা পর্যন্ত এই সরকার ভিলায় প্রবেশ দুঃসাধ্য ছিল। অথচ সারদাচরণকে হত্যা করতে হলে এখানে তাকে প্রবেশ করতেই হবে। তাই অনেক কৌশল খাটিয়ে সে কেতু হয়ে এই সরকার ভিলায় এসে প্রবেশ করল। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, সে ধরা পড়ে গেল পুরাতন ভৃত্য দশরথের চোখে। যা হোক, সেই কারণেই। কেতু পরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তার কোন সন্ধানই আর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কারণ কেতু বলে কেউ সত্যই ছিল না সেদিন আর আজও নেই।
কিন্তু কে-কে সেই কেতু? অধীরভাবে আবার মধুসূদন সরকারই প্রশ্ন করলেন।
বলছি-সবই বলব একে একে। এবারে আমি আসছি হতভাগ্য বিজনবাবুর হত্যার ব্যাপারে। বিজনবাবুকে হত্যাকারী সরিয়েছে তার সম্পত্তিটা হাত করবার জন্য। আর বিজনবাবুর হত্যার ব্যাপারটাই হচ্ছে হত্যাকারীর চরম নৃশংসতা। একটু আগেই আপনাদের আমি বলেছি, ঐ বিজনবাবুর হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী ক্রমশঃ আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু কেন? কি ভাবে? এ ধরনের হত্যারহস্যের মীমাংসায় পৌঁছতে হলে প্রধানতঃ তিনটি কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক প্রত্যেকেরই। মোটিভ, প্রবাবিলিটি ও চান্স। প্রথমেই ধরা যাক প্রবাবিলিটি-বিজনবাবু নিহত হবার পরই সর্বপ্রথম যে কথা আমার মনে উদয় হয়েছিল সেটা হচ্ছে বিজনবাবু সিমপ্লি বাই অফ মিসটেক নিহত হয়েছেন কিনা। যে কথাটা সেদিনও কিছুটা আপনাদের সামনে আমি আলোচনা করেছিলাম। অর্থাৎ কোন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে হত্যা করতে গিয়ে ভুলবশতঃ বিজনবাবুকে প্রাণ দিতে হয়েছিল কিনা। কিন্তু অনেক ভেবেও কোন কূল-কিনারা না পেয়ে শেষে স্থির করলাম, না, ভুল নয়-ইচ্ছা করেই এবং খুনীর প্রয়োজনেই তাকেও হত্যা করা হয়েছে। বিজনবাবু এক চুমুক চা পান করার সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেলেন। আগেই অবশ্য প্রমাণ করে দিয়েছি আমি, কি ভাবে নিকোটিন বিষপ্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিষ একমাত্র সেক্ষেত্রে মেশাতে পারে কে এবং কার পক্ষে সর্বাপেক্ষা সেটা সম্ভব ছিল তা পরে বিবেচ্য, কিন্তু বর্তমানে প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যেভাবে মারা গেলেন সেভাবে আমাদের মধ্যে অন্য কেউই সে সন্ধ্যায় মারা যেতে পারত কিনা। হ্যাঁ, পারত। কিন্তু খুনী এখানে প্রবাবিলিটির উপরে একটা স্রেফ চান্স নিয়েছিল মাত্র সে সন্ধ্যায়। সৌভাগ্যবশতঃ খুনীর সে চান্স ফলে গেল। হি ওয়াজ সাকসেসফুল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিজনবাবুর মৃত্যুর পর-পরের দিন মধুবাবুকে নিয়ে যখন আমি তার আগের সন্ধ্যার অভিনয়টা করি সে সময়ও যদি একবারও ডাঃ অধিকারী—আপনি—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি আমার অনুরোধ সত্ত্বেও মুখ না বন্ধ করে থাকতেন তো পুওর গোকুলকে ঐভাবে সে রাত্রে প্রাণ দিতে হত না হয়ত।
না, না—এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়? আমি-আমি সত্যিই কিছু জানি না। ব্যাকুল কন্ঠে প্রতিবাদ জানালেন ডাঃ অধিকারী।
এখনো আপনি সত্যকে ঢাকবার চেষ্টা করছেন ডাঃ অধিকারী—সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী বলে ওঠে কঠিন কণ্ঠে। সেদিন মধুবাবুর অভিনয়কালে ব্যাপারটা সত্য ভেবে যে উদ্বেগ আপনার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল, সেটা আর কারও চোখে না পড়লেও আমার চোখকে ফাকি দিতে পারেনি। শুনুন ডাক্তার-অর্থের লোভই সেদিন আপনার মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। বলুন-বুকে হাত দিয়ে আপনি বলুন তো একটা কথা—আপনার অভিন্নহৃদয় বন্ধু মৃত সারদাবাবুর সঙ্গে তার মৃত্যুর তিনদিন আগে যখন দেখা করতে এই সরকার ভিলাতে এক বেলার জন্য আপনি এসেছিলেন সে সময় ছদ্মবেশী কেতুকে কি আপনি চিনতে পারেন নি? আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারেননি আসলে সে কে?
আমি–আমি–
হ্যাঁ, কেতুই যে ছদ্মবেশে আমাদের মধুসূদনবাবু তা কি বুঝতে পারেননি আপনি সেদিন, বলুন?
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।
বৃন্দাবন চিৎকার করে উঠলেন, কেতুই দাদা?
হ্যাঁ–কেতুই ছদ্মবেশী আপনার দাদা মধুসূদনবাবু। আপনি-আপনিও বোধ হয় সন্দেহ করেছিলেন বৃন্দাবনবাবু? কিন্তু কেন আমাকে সে কথা বলেননি-তাহলে তো হতভাগ্য বিজনবাবু ও গোকুলকে ঐভাবে ঐ শয়তানের হাতে নিষ্ঠুরভাবে মরতে হত না!
ঘরের সব কটি প্রাণীই যেন বিমূঢ়।
২৩. মধুসূদনবাবু তখন ধীরে ধীরে
মধুসূদনবাবু তখন ধীরে ধীরে বোধ হয় সোফাটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার আর উঠে দাঁড়ানো হল না। শান্ত অথচ তীক্ষ্ণকণ্ঠে কিরীটী মধুসূদন সরকারকে লক্ষ্য বললে, উঁহু মিঃ সরকার, উঠবার চেষ্টা করবেন না কারণ আজ আমরা প্রস্তুত হয়েই এসেছি।
সকলকে আরও আশ্চর্য করে দিয়ে আরও শান্ত ও একান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে মধুসূদন এবারে কথা বললেন, ওঠবার চেষ্টা আমি করিনি মিঃ রায়—আর তার প্রয়োজনও নেই। তবে এটা ঠিকই, আপনার উর্বর কল্পনাশক্তির প্রশংসা না করেও আমি পারছি না। মিঃ সুশান্ত ঘোষালের কথায় সেদিন এখন দেখছি আপনাকে একটু ওভার-এস্টিমেট করে ভুলই করেছিলাম।
ভুল করেছিলেন বৈকি! ভেবেছিলেন আপনার চাতুরী বুঝি কেউ ধরতে পারবে না। মধুবাবু, আমাদের দেশে একটা চলতি প্রবাদ আছে-অধিক লোভে তাঁতি নষ্ট। সারদাবাবু যে উইল করে গিয়েছিলেন সেটা যদি মাস-চারেক আগে আপনার অভিন্নহৃদয় বন্ধু আমাদের সলিসিটার মিঃ শচীবিলাসবাবুর কাছ থেকে না জানতে পারতেন
শচীবিলাস বললেন, আশ্চর্য! আপনি-আপনি সেকথা জানলেন কি করে মিঃ রায়?
অনুমান–নিছক সেটা অনুমান মাত্র শচীবিলাসবাবু।
অনুমান?
হ্যাঁ। মধুসূদনবাবু বর্মা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে এসেছেন দু-সপ্তাহকাল আগে নয়—চার মাস পূর্বে। এবং তিনি যে এসেই আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন সেকথা প্রথম আমি মাত্র পরশু জানতে পারি আপনার ফার্মের পার্টনার রথীন বোসের কাছ থেকেই। তারপর বাকিটা অনুমান করে নিতে আমার কষ্ট হয়নি।
চুপ কর শচী, ওর দৌড়টা একবার শেষ পর্যন্ত আমাকে দেখতে দাও। লেট হিম স্পিক। বললেন আবার মধুসূদন সরকার।
কিন্তু সব কথা আমার বলবার আগে–বিমলবাবু, আমার অনুরোধ, সরকার সাহেবের রক্তাক্ত হাত দুটি আপনি লৌহবলয়াকৃত করুন! বললে কিরীটী।
নিশ্চয়ই। উঠে দাঁড়াল বিমল সেন এবং মধুসূদনের দিকে এগিয়ে গেল।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন মিঃ সরকার, আইআই মাস্ট নট আলাউ দিস ইনসাল্ট!
কিন্তু তার কোন প্রতিবাদই কাজে লাগল না।
মধুসূদন সরকারের হাতে বিমল সেন হ্যাণ্ডকাপ পরিয়ে দিলেন।
হ্যাঁ, এবার সব কিছুই এক্সপ্লেন করে আপনাদের বলব।
কিরীটী নিশ্চিন্ত কণ্ঠে আবার শুরু করল, অবশ্যই এই খেলাটি ইস্কাবনের সাহেবেরই খেলা নয়—সাহেবের বিবিও আছেন-হরতনের বিবি।
চকিতে সুশান্ত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
আশ্চর্য হচ্ছেন সুশান্তবাবু আমার কথা শুনে, তাই না? সেই জন্যেই সে রাত্রে আপনাকে ফিরবার পথে সাবধান করে দিয়েছিলাম, অল দ্যাট গ্লিটারস ইজ নট গোেল্ড এবং কেয়ার ঝোপের পাশেই থাকে বিষধর কালনাগ বলে। যাক গে সে কথা, যা বলছিলাম বলি। ইস্কাবনের সাহেব অর্থাৎ আমাদের ঐ সরকার সাহেবের দিকে চেয়ে দেখুন, ঠিক তাসের ইস্কাবনের মতই মুখখানি নয় কি ওঁর?
ঘরের মধ্যে উপস্থিত যাঁরা ছিলেন সকলেরই দৃষ্টি মধুসুদন সরকারের মুখের উপরে গিয়ে নিবন্ধ হল এবং সকলেরই যেন মনে হল কিরীটী মিথ্যা বলেনি। মধুসূদনের মুখখানি যেন হুবহু তাসের ইস্কাবনের সাহেবের মতই দেখতে।
সত্যিই আশ্চর্য!
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে পরমুহূর্তেই আবার সকলে তার মুখের দিকে তাকাল।
কিরীটী বলছিল, এবারে চেয়ে দেখুন সকলে আমাদের শকুন্তলা দেবীর মুখের দিকে? হুবহু হরতনের বিবি নয় কি এবং ওঁদের দুজনের ঐ বিচিত্র মুখাকৃতিই—সত্য বলতে কি, প্রথম দিন ওঁদের দেখেই ওঁদের প্রতি মন আমার আকৃষ্ট হয়েছিল।
সকলের দৃষ্টি আবার ঘুরে গেল শকুন্তলা দেবীর মুখের দিকে।
এতটুকু অতিশয়োক্তি নয়-আশ্চর্য, হুবহু যেন হরতনের বিবিটিই! কিরীটী আবার বলতে শুরু করে, এবারে শুনুন ঐ সাহেব-বিবির খেলা। মধুসূদনবাবুর সঙ্গে যে কারণে বিবাদ হয়েছিল তাঁর কাকা সারদাবাবুর এবং যে কারণে একদিন বিতাড়িত হতে হয় তাঁর পিতৃগৃহ থেকে সে হচ্ছে ওঁর অতিরিক্ত জুয়াখেলায় আসক্তি—কেমন কিনা বৃন্দাবনবাবু?
বৃন্দাবনবাবু নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।
আমাদের বিতাড়িত ইস্কাবনের সাহেব অনন্যোপায় হয়ে চলে গেলেন তখন একেবারে ভাগ্যান্বেষণে সুদূর বর্মা দেশে মগের মুল্লকে। সেখানে এ ধনীকাষ্ঠব্যবসায়ীর নজরে পড়ে কিঞ্চিৎ ভাগ্যও একটু একটু করে ফিরিয়ে আনছিলেন, কিন্তু যার রক্তে একবার জুয়ার নেশা ধরেছে-সে যে বাঘের মতই নররক্তের আস্বাদ পেয়েছে—সে নেশা সে ভুলবে কি করে? তাই ছুটলেন আবার জুয়ার আড্ডায় যেই হাতে কিছু জমেছে। এবং সেইখানেই অর্থাৎ প্রেমের এক জুয়ার আড্ডাতেই পরিচয় ঘটল সাহেব-বিবির পরস্পরের। দেবা চিনলেন দেবীকে, দেবী চিনলেন দেবাটিকে। সেও আজ থেকে বৎসর দেড়েক আগেকার কথা। এসব সংবাদ অবিশ্যি আমাকে রেঙ্গুন পুলিসের দপ্তর থেকেই সংগ্রহ করতে হয়েছে কষ্ট করে। তথাপি ভুলভ্রান্তি অবশ্য থাকতে পারে। এবং ভুলভ্রান্তি যদি থাকেও, সরকার সাহেব আশা করি সংশোধন করে দিতে পারবেন।
কথাগুলো বলে কিরীটী তাকাল মধুসূদনের মুখের দিকে।
রোমকষায়িত দৃষ্টিতে তাকালেন মধুসূদন সরকার কিরীটীর দিকে নিরুপায় পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মত।
আর শকুন্তলা চোখ নামিয়ে নিল একান্ত অসহায়ের মতই যেন।
আবার কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কাহিনীর বিবৃতির মধ্যে ফিরে যায়, জুয়োতে সর্বস্বান্ত হয়ে অনন্যোপায় সাহেব আবার ফিরে এলেন বাংলাদেশে দীর্ঘ দশ বৎসর পরে এবং সঙ্গে এবারে এলেন তাঁর বিবিসাহেবা, কারণ জুয়োর আড্ডায় পরিচয়টা উভয়ের তখন নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে ফিরে সরকার সাহেব কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গলাধাক্ক খেলেন। এবারে কি উপায় করা যায় যখন ভাবছেন, ঐ সময় কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সারদাচরণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন শকুন্তলাকে। এবারে কিন্তু হার হল না, কারণ শকুন্তলার রূপ দেখে প্রৌঢ় সারদাচরণের মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। অতএব বহাল হল কুন্তলা তার। কাজে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সরকার সাহেবের। যে প্ল্যান করে শকুন্তলাকে তিনি কাকার কাছে চাকরি করার জন্য পাঠালেন সেটা গোড়াতেই বানচাল হয়ে গেল। কারণ পঞ্চশরের বানে কাহিল হলেন সারদাচরণ আর ঐশ্বর্যের লোভে শকুন্তলা তার পূর্ব চুক্তি বোধ হয় ভুলে গেলেন। যা হয়েছিল সাহেবের সঙ্গে। ফলে নাটকের দৃশ্যান্তর হল। মধুসূদন দেখলেন বেগতিক। কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়বার পাত্র তিনি নন। তাতেই কেতুর আবির্ভাব ঘটল সরকার ভিলায়, কাজও হাসিল হল বটে সারদাচরণেরই নিজ হাতে তৈরী রোজ স্পেইং সলুশনের মধ্যস্থিত বিষ নিকোটিনের সাহায্যে, কিন্তু দশরথ আসল পরিচয়টা জেনে ফেলল, ফলে হতভাগ্য দশরথকেও মরতে হল ঐ মারাত্মক নিকোটিন বিষে।
এই পর্যন্ত বলে কিরীটী একটু থামল।
তারপর? প্রশ্ন করল সুশান্ত।
তারপর? তারপর আসতে হল আমাকে। এদিকে উইলের আসল মর্মকথা মধুসুদন তার বন্ধুর কৃপায় পূর্বাহ্নেই জেনেছিলেন। এবং দশরথ ও সারদাচরণকে সরিয়ে সাহসও তার বেড়ে গিয়েছিল—অতএব অর্থের লোভে হতভাগ্য বিজনবাবুকেও এবারে মরতে হল। পূর্বেই বলেছি সারদাবাবু ও দশরথের মৃত্যু ও তাদের ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে আমার মনে দুটি সন্দেহ হয়। এক—যেভাবে তাদের মৃত্যু ঘটেছে তাতে করে হত্যাকারী বাইরের কেউ নয়—ভিতরেরই। দুই-প্রথম মৃত্যুর সঙ্গে দ্বিতীয় মৃত্যুর যোগাযোগও আছে এবং ঐভাবে হত্যা করা কোন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভবপর নয়। তখনো হত্যার মোটিভ বা উদ্দেশ্যটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। পরিষ্কার হল উইলের মর্মকথা শোনবার পর। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে সারদাচরণের গৃহে তার ড্রয়ারের মধ্যে প্রসাধনদ্রব্যগুলো দেখে ও বাগানে সেদিন শকুন্তলা দেবীর খোঁজে সেই চায়না বাঁশের ঝাড়ের কাছে গিয়ে চুরুটের শেষাংশ দেখে, শকুন্তলা ও মধুসূদনবাবুকে ঘিরে যে সন্দেহটা আমার মনে দানা বাঁধবার চেষ্টা করছিল সেটা যেন ক্রমশঃ শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। এবং সেই মুহূর্তেই এল আকস্মিকভাবে বিজনবাবুর মৃত্যু।
কিরীটী এই পর্যন্ত বলে আবার থামল।
২৪. পাইপটায় টোবাকো ভরে
পাইপটায় টোবাকো ভরে তাতে অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী পাইপে গোটা-দুই টান দিয়ে আবার তার কাহিনী শুরু করল :
বিজনবাবুর মৃত্যুটা যদিও মর্মান্তিক, তথাপি তার মৃত্যু ঐভাবে সেদিন না ঘটলে হয়ত এত তাড়াতাড়ি এই জটিল রহস্য আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠত কিনা সন্দেহ। কিন্তু তার মৃত্যুর পরই ক্রমশঃ হত্যাকারী আমার দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। আর সেই কারণেই আপনাদের এখানে আমি কৌশলে বন্দী করেছিলাম সে-সময়।
কিন্তু কেন যে কৌশলে ওদের আমার সাহায্যে এই সরকার ভিলায় আপনি বন্দী করেছিলেন সেটাই এখনও বুঝতে পারিনি মিঃ রায়! বললে বিমল সেন।
মানুষের নার্ভেরও একটা সীমা আছে মিঃ সেন! তারই পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম আমি এই আশাতে যে শেষ পর্যন্ত মানসিক পীড়নে কারো মুখ দিয়ে কোন কথা যদি বের হয়ে পড়ে। হলও তাই। হত্যাকারী তখন আন্দাজ করতে পেরেছে সে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর সেই আতঙ্কেই সে যখন অনন্যোপায় হয়ে তার দক্ষিণ হস্ত গোকুলকে শেষ করে দেবে বলে মনস্থ করল। এবং তাকে হত্যা করতে গিয়েই সে দুটি মারাত্মক ভুল করল—যার ফলে সে আমার দৃষ্টির সামনে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল।
মারাত্মক ভুল! প্রশ্ন করল বিমল সেন।
হ্যাঁ মিঃ সেন, দুটি মারাত্মক ভুল। এক হচ্ছে, হত্যা করতে গিয়ে রিভলবারের সাহায্য নিয়ে এবং দুইসেই নিকোটিনের শিশিটি আমার হাতে অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ে তুলে দিয়ে। রিভলবার দিয়ে হত্যা করতে গিয়েই নিজের দেহেও তাকে ক্ষতের সৃষ্টি করতে হল এবং নিকোটিনের শিশির গায়ে তার হাতের আঙুলের ছাপও পাওয়া গেল-হত্যার মারাত্মক দুটি প্রমাণ। কিন্তু এবারে আমাকে উঠতে ববে—আজকের শেষ গাড়িটা আমাকে ধরতেই হবে
বিমল সেন বললেন, কেন, আজ রাতটা থেকে যান না।
উপায় নেই—
কেন?
কাল আমার বিয়ে।
বিয়ে! সে কি? পাত্রী কে? কার মেয়ে? কি নাম? সুশান্তই জিজ্ঞাসা করল।
কার মেয়ে তা দিয়ে কি হবে? নাম তার কৃষ্ণ, সুশান্তবাবু।
কৃষ্ণা?
হ্যাঁ, একটি পার্শী মেয়ে—
পার্শী মেয়েকে আপনি বিয়ে করবেন! সুশান্ত বললে, বাংলাদেশে কি মেয়ে ছিল না?
বন্ধু, তুমি জান প্রেম অন্ধ—
হুঁ, তা অঘটনটা ঘটল কোথায়?
সিংহলে।
তাহলে সত্যিই এতদিনে কিরীটী রায় কুমারত্ব ঘুচাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
হ্যাঁ, চলি ভাই—সামনের শনিবার আমাদের ম্যারেজ-পার্টিতে আসা চাই—আপনারা তিন বন্ধুই-সকলকে আমার হয়ে নিমন্ত্রণ জানাবেন।
কিরীটী বের হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে কলকাতায় একটা হোটেলে কৃষ্ণা এসে বোম্বাই থেকে উঠেছিল। কিরীটী এসে ঢুকতেই কৃষ্ণা বলে, আমি তো ভেবেছিলাম বুঝি এলেই না! গতকাল আসার কথা
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসে।
হাসছ যে?
কিছু না, চল–
কোথায়?
বাঃ, রেজেস্ট্রি অফিসে যেতে হবে না?
কৃষ্ণার মুখটা লাল হয়ে ওঠে।