একটা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আধবুড়ো লোক তখন থেকে পেছনে লেগে আছে, দেখুন মা, খুব ভাল চানাচুর। এক প্যাকেট নিয়ে দেখুন।
স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বললনা বাবা। বললাম না, আমাদের চাইনে। ঘোমটা তার খোলা ছিল, গলার নেকলেসটা স্পষ্ট চোখে পড়ছিল সকলের। তাকে অনেক করে মানা করেছিলাম—এত দামী গয়না পরে প্রকাশ্যে বেরিও না।
তার স্পষ্ট বক্তব্য—এটা লোককে দেখাতে না পারলে আর কি লাভ? হালে তৈরি করেছি, লোকের চোখ টাটাক তারিফ করুক!
এই সময়ে আমাদের তিন চারজন ফেরিওয়ালা ও পথচারী ঘিরে ফেলেছিল। আর সত্যিই ম্যাজিক! স্ত্রী হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—আমার নেকলেস?
সবকজনই নিঃশব্দে সরে পড়েছিল, অন্য কিছু লোক দৌড়ে এল। বার কণ্ঠে সহানুভূতিপূর্ণ ধিক্কার—এই রাত্রিতে এত দামী গয়না পরে এখানে বসেছিলেন কোন্ আক্কেলে?
সবাই সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। আমরা সশব্দে বাড়ির দিকে চললাম। আমি ব্ৰিক্তিতে গজগজ করতে করতে আর স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে। এত দামী জিনিসটা এমনভাবে হারানোর দুঃখে বাড়ি গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। ফ্ল্যাট বাড়ি, সব বাড়ি থেকে গৃহিণীরা ছুটে এল। খবর শুনে তারা বেজায় খুশি; যেমন মাগী দেমাক দেখাতে গিয়েছিল। বেশ হয়েছে!
কেউ-কেউ বলল, তোমার বুদ্ধি আর কবে হবে লো! এমন দামী জিনিস পরে রাস্তায় বসতে গিয়েছ?
একজন প্রতিবেশী বলল—ঐ রকম অরক্ষিত স্থানে গেলেই বা কেন?
অন্য সবাই একবাক্যে প্রতিবাদ করে উঠল—কোন্ জায়গাটা সুরক্ষিত বলতে পারেন? এসব কথা বললে উনি বলবেন—এমনটিতে কতই হয়।
একজন পরামর্শ দিল—যান না, একটা ডায়েরি করে আসুন। কাতরভাবে বললাম—আমার সঙ্গে আপনারা যদি কেউ যেতেন….। সবাই নিঃশব্দে সরে পড়ল। বাধ্য হয়ে আমি একাই গেলাম। তারা তো প্রথমেই যুক্তি দেখালো ও জায়গাটা আমাদের এলাকা, না, লেক থানার এলাকা? ঠিক কোন্ জায়গাটায় আপনারা ছিলেন, বলুন তো?
অনেক তর্কাতর্কির একজন বলল, ঠিক আছে। ডায়েরি নিয়ে নাও, আর নিলেই বুঝি কিছু হবে মনে করছেন? ও, বিনোদ কোথায় গেলে। তবে বলিহারি যাই মশাই, এই বয়সে মেয়েছেলে নিয়ে লেকে বসতে গেছে? আচ্ছা, তিনি নিজেই হাতান নিতো?
হাতজোড় করে বললাম—সঙ্গে যিনি ছিলেন। তিনি আমার আপন স্ত্রী, একরূপ বলতে পারেন একই মায়ের পেটের….। মানে তার নিজের জিনিস তিনি কেন লুকাতে যাবেন?
লোকটির নাম বোধহয় রামহরি, সে হেসে বলল—আজকাল আকছাড়ই এমনি হচ্ছে, মোশাই।
বিনোদ আর আসে না, একটু বিরক্তি প্রকাশ করল রামহরি, ঋজিয়ে উঠল—ওর নাইট ডিউটি, একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে। ঝামেলা বাধাবেন আপনারা, আর খেটে মরব আমরা।
বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমার প্রেসকার্ডটার কথা মনে পড়ে গেল। ইন্সপেক্টারের ঘরে গিয়ে প্রেসকার্ডটি দেখিয়ে বললাম আমি বিশ্ববার্তা পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার। একটা কেস লেখাতে এসেছিলাম।
ইন্সপেক্টার ফোনে কার সঙ্গে চাপা গলায় টাকা পয়সা লেনদেন নিয়ে কথা বলছিল। ফোনটার মাউথপিসটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল—আমার কাছে। আপনাকে কে পাঠিয়েছে? জরুরি কাজ করছিলাম….
তারপর সমস্ত ব্যাপারটা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল—ছেলে ছোঁকরারা লেকে গিয়ে প্রেম করে, আপনারা গেলেন কোন লজ্জায়? বিনোদকে ডাক…।
ঘুম ভেঙে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বিনোদ এসে সেলাম করে দাঁড়ালে তাকে বেশ রাগতভাবে বলল—লোকটা আমার কাছে এসে সাফাই গাইছে। দেখো তো ব্যাপারটা।
আবার ফোন নিয়ে সাহেব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাইরে বেরুলে বিনোদ আর রামহরি আমাকে ধমকাতে লাগল—ও ঘরে গেলেন কেন?
তবে শেষ পর্যন্ত ডায়েরি লিখে নিয়ে বলল—আর কোনদিন লেকের এ দিকটায় মেয়েছেলে নিয়ে বসবেন না। কানা বাঞ্ছাকে কথা দেওয়া আছে। তার তো প্রেস্টিজ আছে।
টেবিলের ওপর কাচ চাপা থানা এলাকার ম্যাপ পড়েছিল, পাশে পাশে লাল দাঃ দেওয়া। আমার বসার জায়গায় লাল পেন্সিলে গোল করে লেখা কানাবাঞ্ছার এলাকা।
ব্যাপারটার এখানেই ইতি হত। কিন্তু পরদিন আমাদের কাগজে খবরটা বেরুলো ‘লেক এলাকায় সাংবাদিক সর্বস্বান্ত।’
নেকলেসটা হারানোর পর তাদের দাম্পত্য কলহ যে কতটা গুরুতর অবস্থা ধারণ করল আমরা বুঝতে পারলাম। যে শিবুদা কোন দিন নাইট ডিউটি করত না, বউকে একা রেখে আসবে না বলে, সে আমাদের সঙ্গে শিফট বদল করে নাইট ডিউটি নিতে লাগল, অজিতের দোকানে তার টিফিন বরাদ্দ হয়ে গেল। একদিন কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল–পদ্ম আমার ওপর এমন রেগে আছে যে, কয়েকদিন বাড়িতেই থাকছে না, বোনেদের বাড়ি গিয়ে বসে আছে। আচ্ছা, আমার দোষটা কোথায় বলো তো?
ওর মম্ব্য শুনলে আমার এই বয়সে ডিভোর্স করতে ইচ্ছা করছে, যে সমস্ত পুরুষমানুষ নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারে না, তার মরণই ভালো। আচ্ছা, আমি কি করতে পারতাম?
আমরা কি আর বলব, চুপ করে থাকলাম। হঠাৎ, উত্তেজিত হয়ে শিবুদা বলল, যেমন করে হোক, আমি নেকলেসটা উদ্ধার করবই। তোদের বউদি আমাকে কি ভেবেছে—তাঁ। আমি যে পুরুষ মানুষ তা প্রমাণ করে ছাড়ব।
ক’দিন পরে শিবুদা বলল কাগজে খবরটা পড়ে নেকলেসটা যে বানিয়েছিল, সেই গোরা এসে নতুন ঝামেলা বাধালো। আমাকে দোকানে ডেকে এনে চুপিচুপি বলল—আমার তৈরি মল আমার কাছেই ফিরে আসবে, মেলোমশায়! তার আগে একটু চেষ্টা করবেন….।