উপত্যকার মধ্য দিয়ে আমি দ্রুত ছুটছিলাম, আর আমার গাড়িগুলোর মধ্য থেকে এই ক্যারাভানের দল সতৃষ্ণ বিষণ্ণ চোখ মেলে দেখে নিচ্ছিল বিলীয়মান মালভূমি, ছোট-বড় উপত্যকা ও তিরতির করে বয়ে-যাওয়া আঁকাবাকা ছোটো নদী। ঝাপসা চোখের জলে শেষবারের মতো বিদায় জানাচ্ছে যেন। প্রতিটি কোণা-খাজে যেন ওদের চোখ সেঁটে যাচ্ছে, চলে যাবার সময়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যাবে যেন; আমারও কেমন মনে হল আমার চাকাগুলো বোধহয় ভারি হয়ে উঠেছে, দুঃখে ও লজ্জায় যেন আটকে যাচ্ছে তারা, আর যেন দুটবার শক্তি নেই আমার, আমি বোধহয় থেমেই পড়ব এবার।
হাসান আবদাল স্টেশনে আরো শরণার্থীরা এল। ওরা শিখ, পাঞ্জা সাহেব থেকে আসছে, সঙ্গে লম্বা কৃপাণ, ভয়ে মুখ ওদের পাশুটে; বড়-বড় ডাগর চোখের বাচ্চাগুলো পর্যন্ত যেন এক নাম-না-জানা ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। ওরা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার খোপে ঢুকে পড়ল। একজনের ঘর-বাড়ি সব গেছে, আরেকজনকে পালিয়ে আসতে হয়েছে পরনের শালোয়ার-কামিজ মাত্র সম্বল করে; আর একজনের পায়ে কোনো জুতো নেই; ওই কোণার লোকটি এতটাই ভাগ্যবান যে সে তার সবকিছুই নিয়ে আসতে পেরেছে, মায় তার ভাঙা কাঠের তক্তপোশটা পর্যন্ত! যার সবকিছু গেছে সে বসে আছে শান্ত, চুপচাপ, গুম হয়ে, অন্যজন যে কিনা সারাজীবনে একটা পিঠের টুকরোও জোটাতে পারেনি সে-ও তার হারানো লাখ টাকার গল্প বলছে, আর নেড়েদের শাপশাপান্ত করছে। বালুচিসেনারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে মৃদু-মৃদু হাসছে।
তক্ষশিলায় আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। আমার গার্ডসাহেব স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘আশপাশের গ্রাম থেকে একদল হিন্দু শরণার্থী আসছে। তাদের জন্য এই ট্রেনটাকে অপেক্ষা করতেই হবে।’ এক ঘণ্টা কেটে গেল। আমার গাড়ির মধ্যেকার লোকজনেরা তাদের পোটলা-পুটলি খুলল এবং পালিয়ে আসার সময়ে যৎসামান্য যে যা আনতে পেরেছিল তাই খেতে আরম্ভ করল। বাচ্চারা হৈ-হল্লা করছিল আর তরুণী মেয়েরা শান্ত গভীর চোখে তাকিয়েছিল জানলার বাইরের দিকে। হঠাৎ দূরে ঢাকের আওয়াজ শোনা গেল। হিন্দু শরণার্থীদের এক জাঠ এদিকেই আসছে। জাঠ আরো কাছে এগিয়ে এল, স্লোগান দিতে দিতে। আরো কিছু সময় কাটল। এবারে দলটা স্টেশনের একেবারে কাছে এসে পড়ল। ঢাকের আওয়াজ আরো জোর হল আর একঝাক গুলিগোলার আওয়াজ এল কানে। তরুণী মেয়েরা ভয়ে জানলা থেকে সরে গেল। এই দলটা ছিল হিন্দু শরণার্থীদের এক জাঠ-প্রতিবেশী মুসলমানদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে যাদের নিয়ে আসা হয়েছে। প্রতিটি মুসলমানের কাঁধের উপরে ঝোলানো রয়েছে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা এক-একজন কাফেরের মৃতদেহ। এ-রকম মৃতদেহের সংখ্যা দুশো, অত্যন্ত নিরাপদে তাদের স্টেশনে এনে বালুচি রক্ষকদের হাতে দিয়ে দেয়া হল। মুসলমান জনতা চাপ দিল যে, এই মৃত হিন্দু শরণার্থীদের যথোচিত সম্মানের সঙ্গে হিন্দুস্তানের গেট পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। বালুচি সৈন্যরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিল তাদের তারপর প্রত্যেক গাড়ির মধ্যিখানে কয়েকটা করে মৃতদেহ রেখে দিল। এরপর মুসলমান জনতা আকাশের দিকে তাক করে গুলির আওয়াজ করল ও স্টেশনমাস্টারকে আদেশ দিল আমাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে দেবার জন্য। আমি সবেমাত্র চলতে শুরু করেছি এমন সময়ে কে একজন চেন টেনে আমাকে থামিয়ে ফেলল। তারপর মুসলমান জনতার দলপতি একটা গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে বললেন যে, ঐ দুশোজন শরণার্থী চলে যাওয়ায় তাদের গ্রাম যেহেতু গোল্লায় যাবে, তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রেন থেকে দুশোজন হিন্দু ও শিখ নামিয়ে নিতে হবে; যাই হোক-না কেন, দেশের জনশক্তির ক্ষতিপূরণ করতেই হবে। বালুচি সৈন্যরা দেশপ্রেমের জন্য উচ্চকণ্ঠে তাঁদের জয়গান করল, এবং বিভিন্ন বগি থেকে দুশোজন শরণার্থীকে বেছে নিয়ে জনতার হাতে তুলে দিল।
‘সব কাফেররা সার দিয়ে দাঁড়াও!’ ওদের নেতা হুঙ্কার দিল; ঐ নেতাটি আশপাশের গ্রামের এক শাসালো সামন্তপ্রভু। শরণার্থীরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল, মরে জমে গেছে যেন। জনতা কোনোমতে ওদের একটা সারি করে দাঁড় করিয়ে দিল। দুশো লোক… দুশো জীবন্ত মৃতদেহ…নগ্ন…ভয়ে মুখগুলো সব নীল….চোখের তারায় বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে রক্তলোলুপ তীর….
বালুচি সৈন্যরাই শুরু করল।
পনের জন শরণার্থী টলমল পায়ে শ্বাস টানতে-টানতে মরে পড়ে গেল।
এই জায়গাটা ছিল তক্ষশিলা।
আরো কুড়িজন পড়ল।
এখানেই ছিল এশিয়ার মহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে হাজার-হাজার বছর ধরে লক্ষ-লক্ষ ছাত্ররা মানুষের সভ্যতা বিষয়ে তাদের প্রথম পাঠ নিয়েছে।
আরো পঞ্চাশজন মুখ থুবড়ে পড়ল মরে।
তক্ষশিলার জাদুঘরে সুন্দর-সুন্দর মূর্তি ছিল, অলংকারের অতুলনীয় কারুকৃতি, দুর্লভ শিল্প ও ভাস্কর্যের নিদর্শন, আমাদের গর্বের সভ্যতার ছোটো-ছোটো উজ্জ্বল সব দীপশিখা।
তবুও আরো পঞ্চাশটি প্রাণ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।
এ-সবের প্রেক্ষাপটে ছিল সিরকপের রাজপ্রাসাদ, খেলাধুলার জন্য এক বিরাট অ্যাম্ফিথিয়েটার আর তারো পেছনে অনেক মাইল জুড়ে একটা গৌরবান্বিত ও মহান এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
আরো তিরিশজন মৃত।
এখানে রাজত্ব করতেন কণিক। ওঁর রাজত্বে প্রজাদের ছিল শান্তি, সমৃদ্ধি আর এক সাধারণ ভ্রাতৃত্বের বোধ।