হলকু আগুনের সামনে বসে ওম পোহায়। একটু পরেই গায়ের চাদর খুলে সে বগলদাবা করে রাখে। পা দুখানা মেলে দেয়, ভাবখানা যেন শীতকে ডেকে বলছে ‘দেখি কর, তোর যা খুশি।’ শীতের অসীম ক্ষমতাকে হারিয়ে দেয়ার বিজয়গর্বকে সে হৃদয়ে চেপে রাখতে পারছে না।
জবরাকে বলে, কী রে, আর শীত লাগছে-না তো?’
জবরা কুঁ-কুঁ করে যেন বলে–এখন কী করে আর শীত লাগবে?
আগে থাকতে কথাটা মনে আসেনি। নইলে কি আর শীতে এত ভুগতাম।
জবরা লেজ নাড়ে।
‘বেশ বাবা, এস তো দেখি এই আগুনটাকে টপকে পার হই। দেখি কে যেতে পারে? পুড়েটুড়ে গেলে বাবা, আমি কিন্তু ওষুধ দেব না।’
অগ্নিকুণ্ডটার দিকে কাতর নয়নে তাকিয়ে দেখে জবরা।
‘মুন্নিকে কাল আবার বলে দিও-না যেন তাহলে ঝগড়া করবে।’ বলে সে লাফ দিয়ে আগুনটার উপর দিয়ে টপকে যায়। পায়ে একটুখানি আঁচ লাগে বটে, তবে তা তেমন কিছু নয়। জবরা আগুনের পাশ দিয়ে ঘুরে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়।
হলকু বলে–’উঁহু, এটা ঠিক হচ্ছে না। উপর দিয়ে টপকে এস’, বলে সে আবার লাফ দিয়ে আগুনের এ-পাশে চলে আসে।
চার
পাতা সব পুড়ে ছাই। বাগানে অন্ধকার আবার ছড়িয়ে পড়ে। ছাইয়ের নিচে কিছু-কিছু আগুন। রয়েছে, যা বাতাসের ঝাঁপটা এলে একটুখানি জ্বলে উঠে পরক্ষণেই আবার নিভে যায়।
হলকু আবার চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে গরম ছাইয়ের পাশে বসে গুনগুন করে একটা গান ধরে। গা-টা ওর গরম হয়েছে বটে, কিন্তু আস্তে-আস্তে আবার শীত যত বাড়ে ওকে তত আলসেমিতে পেয়ে বসে।
জোরে ঘেউঘেউ করে ক্ষেতের দিকে জবরা ছুটে যায়। হলকুর যেন মনে হয় একপাল জানোয়ার ওর ক্ষেতে এসে ঢুকেছে। বোধহয় নীলগাইয়ের পাল। ওদের দাপাদাপি, ছুটোছুটির আওয়াজও পরিষ্কার হলকুর কানে আসে। ওরা বোধহয় ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলছে। ওদের চিবানোর চড়চড় আওয়াজও শোনা যায়। হলকু মনে মনে বলে–নাহ্ জবরা থাকতে কোনো জানোয়ারের সাধ্যি নেই ক্ষেতে ঢুকবে। ও ছিঁড়েই ফেলবে। এ আমার মনের ভুল। কই, আর তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না! আমিও কী যে ভুল শুনি!
জোর হাঁক পাড়ে সেজবরা, জবরা!
জবরা ঘেউ-ঘেউ করে চলে। হল্কুর ডাক শুনে কাছে আসে না।
আবার ক্ষেতের ফসল খাওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। এবারে নিজের মনকে সে আর ধোকা দিতে পারে না। কিন্তু জায়গা ছেড়ে ওঠা যেন বিষের মতো লাগে। বেশ জুত করে গরম হয়ে বসেছিল। এই কনকনে শীতে ক্ষেতে যাওয়া, জানোয়ারগুলোর পেছনে ছুটোছুটি করা অসহ্য মনে হচ্ছে। নিজের জায়গা ছেড়ে সে একটুও নড়ে না।
জোরে হাঁক দিয়ে ওঠে সে-হিলো! হিলো!! হিলো!!!
জবরা আবার ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে। জানোয়ারগুলো ক্ষেতটাকে শেষ করে ফেলছে। ফসল পেকে উঠেছে। এবার কী সুন্দর ফসল হয়েছিল! কিন্তু নচ্ছার এই জানোয়ারগুলো যে সব বরবাদ করে ফেলছে।
দৃঢ় সংকল্প করে হলকু উঠে দাঁড়ায়। দু’তিন পা এগিয়েও যায়; কিন্তু আচমকা একটা ঠাণ্ডা, উঁচ বেঁধানো, বিছের হুলের মতো বাতাসের ঝাঁপটা এসে ওর গায়ে লাগতেই ও আবার নিভুনিভু আগুনের কাছটাতে ফিরে এসে বসে পড়ে। ছাইগুলোকে খুঁচিয়ে দিয়ে গরম করতে বসে ঠাণ্ডা গা-টাকে।
ওদিকে গলা ফাটিয়ে ফেলছে জবরা। নীলগাইগুলো ক্ষেতটাকে শেষ করে ফেলছে। এদিকে হলকু গরম ছাইয়ের পাশে শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে। অকর্মণ্যতা যেন দড়ির বাঁধনের মতো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
ছাইয়ের পাশে গরম মাটির উপর চাদরমুড়ি দিয়ে সে শুয়ে পড়ে।
সকালে ওর ঘুম ভাঙলে দেখে চারদিকে রোদ ঝলমল করছে। মুন্নি ডেকে বলছে– আজ কি তুমি শুয়েই থাকবে গো? এখানে এসে আরাম করে তুমি ঘুমিয়ে রয়েছ আর ওদিকে সারাটা ক্ষেত যে হতচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
হলকু উঠে বলে–তুই কি ক্ষেত হয়ে আসছিস নাকি?
মুন্নি বলে–হ্যাঁ, সারাটা ক্ষেত ছারখার হয়ে গেছে। আরে, এমন করেও কেউ ঘুমোয় গো? তোমার তাহলে এখানে টং বানিয়ে কী লাভটা হল?
হলকু ছুতো দেখায়–মরতে-মরতে যে আমি কোনোমতে বেঁচেছি সেই যথেষ্ট। আর তুই আছিস তোর ক্ষেতের চিন্তা নিয়ে। পেটে আমার সে যে কী যন্ত্রণা, এমন অসহ্য যন্ত্রণা যা কেবল আমিই টের পেয়েছি।
.
দুজনে ক্ষেতের আলে এসে দাঁড়ায়। দেখে, সারাটা ক্ষেত তছনছ হয়ে গেছে, জবরা মাচার নিচে চিত হয়ে শুয়ে, যেন তার ধড়ে প্রাণ নেই।
দুজনেই ক্ষেতের হাল দেখে। মুন্নির মুখে বেদনার ছায়া, হলকু কিন্তু খুশি।
চিন্তিত হয়ে মুন্নি বলে–এবার মজুরি করে জমির খাজনা শুধতে হবে।
খুশিমনে বলে হলকু–রাতে শীতে তো আর এখানে শুতে হবে না।
পেশোয়ার এক্সপ্রেস – কৃষণ চন্দর
যখন পেশোয়ার স্টেশন ছেড়ে আসি তখন আমি তৃপ্তিতে একদলা ধোঁয়া উগরে দিয়েছিলাম। আমার খোপে-খোপে ছিল সব হিন্দু আর শিখ শরণার্থীরা। তারা এসেছিল পেশোয়ার, হাটমর্দন, কোহাট, চরসরা, খাইবার, লাণ্ডি কোটাল, বানু, নওশেরা, মানশেরা সীমান্ত প্রদেশের এইসব জায়গা থেকে। স্টেশনটা খুব সুরক্ষিত এবং সেনাবাহিনীর অফিসারেরাও খুব সজাগ ও দক্ষ। তবে, যতক্ষণ-না সেই রোমান্টিক পঞ্চনদীর দেশের দিকে আমি রওনা দিলাম, তারা অস্বস্তিতেই ভুগছিল। অন্য আর পাঁচজন পাঠানদের থেকে অবশ্য এই শরণার্থীদের তফাত করা যাচ্ছিল না। তাদের চেহারা বেশ লম্বা ও সুদর্শন, শক্ত গড়নের হাত-পা, পরনে কুল্লা ও লুঙ্গি, কারো-বা শালোয়ার; তাদের ভাষা গাঁয়ের পুশতু। প্রত্যেক খোপে দুজন করে বালুচি সেপাই খাড়া পাহারায় ছিল। রাইফেল হাতে ওরা একটু করে হাসি বিলিয়ে যাচ্ছিল হিন্দু-পাঠান ও তাদের বৌ-বাচ্চাদের দিকে, যারা তাদের হাজার-হাজার বছরের বসবাসের ভূমি ছেড়ে পালাচ্ছে। এই পাহাড়ি জমি তাদের শক্তি জুগিয়েছে, তার তুষার-ঝরনা তাদের তৃষ্ণা মিটিয়েছে, এবং এই ভূমির রোদ-ঝলমল বাগান থেকে তোলা মিষ্টি আঙুরের স্বাদে ভরে গেছে তাদের প্রাণ। হঠাৎ একদিন এই দেশ-গা তাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেল; শরণার্থীরা, সম্ভবত অনিচ্ছুকভাবেই পাড়ি দিল গরম ক্রান্তিদেশীয় সমভূমির এক নতুন দেশে। ঈশ্বরের কাছে তারা কৃতজ্ঞ যে তাদের প্রাণ, ধনসম্পত্তি ও মেয়েদের ইজ্জত কোনোরকমে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু রাগে ও দুঃখে হৃদয়ে তাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছিল যেন, আর তাদের চোখ যেন সাতপুরুষের ভিটের ঐ গ্রানাইট বুকের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে চলে গিয়ে অভিযোগে প্রশ্ন তুলেছিল : ‘মা, মাগো, নিজের সন্তানদের কেন এভাবে ফিরিয়ে দিলে? কেন তোমার বুকের উষ্ণ আশ্রয় থেকে নিজের মেয়েদের বঞ্চিত করলে? এইসব নিষ্পাপ কুমারীরা, যারা তোমার অঙ্গে আঙুরলতার মতো জড়িয়ে ছিল, কেন হঠাৎ তাদের টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলে? মা, মাগো, কেন মা?’