জবরা শুয়ে-শুয়ে লেজ নাড়ে আর তার কুঁ..উঁ…শব্দটাকে দীর্ঘায়িত করে একটা হাই তুলে চুপ করে যায়। তার সারমেয়-বুদ্ধি বোধহয় মনে করে যে ও কুঁ…কুঁ…করছে বলে মনিবের ঘুম আসছে না।
হাত বের করে জবরার ঠাণ্ডা পিঠে হাত বুলোতে-বুলোতে হলকু বলে–কাল থেকে আমার সঙ্গে আর আসিসনে। এলে ঠাণ্ডায় জমে যাবি। এই শালার পশ্চিমা বাতাস কী। জানি কোত্থেকে বরফ বয়ে আনছে। দেখি উঠে আর এক ছিলিম তামাক খেয়ে নিই। কোনোমতে রাতটা তো কাটবে। আট ছিলিম টানা তো শেষ। এই হল গে চাষবাসের মজা। আবার এক-একজন এমন ভাগ্যবানও আছেন যাদের কাছে শীত গেলে ভয়ে পালাবে। মোটা-মোটা সব লেপ, তোষক, কম্বল। সাধ্য কি যে শীত পাত্তা পাবে! বরাতের জোর আর কি! খেটে মরব আমরা, মজা লুটবে অন্যে!
হলকু ওঠে। গর্ত থেকে খানিকটা আগুন বের করে কলকে সাজায়। জবরাও উঠে বসে! তামাক খেতে-খেতে হলকু বলে-খাবি তামাক? শীত আর কমে কই। হ্যাঁ, একটু যা মনটাকেই বুঝ দেওয়া।
জবরা ওর মুখের পানে স্নেহভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।
হলকু–আজ একটু শীত সয়ে নে। কাল আমি এখানটায় খড় বিছিয়ে দেব। খড়ের ভেতর ঢুকে শুয়ে থাকিস, তাহলে শীত লাগবে না।
থাবাদুটোকে হলকুর হাঁটুর উপর তুলে দিয়ে হল্কুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে যায় জবরা। হল্কুর গালে ওর গরম নিঃশ্বাস লাগে।
তামাক খেয়ে হলকু আবার শুয়ে পড়ে। এবার সংকল্প করে শোয় যে যত যাই হোক না কেন এবার ঘুমাবই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর বুকের ভেতরে কাঁপুনি শুরু হয়ে। যায়। একবার এ-পাশ ফিরে শোয়, আবার ও-পাশ। কিন্তু শীত যেন পিশাচের মতো ওর বুকে চেপে বসে থাকে।
কিছুতেই আর থাকতে না-পেরে সে জবরাকে আস্তে করে তুলে কোলে টেনে নেয়। জবরার মাথাটাকে আস্তে-আস্তে চাপড়াতে থাকে। কুকুরটার গা থেকে না-জানি কেমন একটা দুর্গন্ধ আসে, তবু হলকু তাকে কোলে জাপটে ধরে এমন আরাম পায় যা সে ইদানীং কয়েকমাস পায়নি। জবরা বোধহয় ভাবে এই বুঝি স্বর্গ। হলকুর নিষ্পাপ মনে কুকুরটির। প্রতি লেশমাত্র ঘৃণাও নেই। সে তার কোনও অভিন্নহৃদয় বন্ধু বা ভাইকেও এমনি আগ্রহের সঙ্গেই আলিঙ্গন করত। আজকের এই দৈন্যদশা তার মনকে মোটেই আহত করেনি।
এই অদ্ভুত মিত্রতা তার হৃদয়ের সমস্ত দ্বারকে উন্মুক্ত করে দিয়ে হৃদয়ের প্রতিটি অণুকণাকে যেন আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলেছে।
হঠাৎ জবরা জানোয়ারের পায়ের আওয়াজ পায়। অন্তরঙ্গ এই আত্মীয়তা তার মনে এক নতুন উন্মাদনা জাগিয়ে তোলে, যার কাছে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপটও তুচ্ছ। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সে ছাউনির বাইরে এসে ঘেউ-ঘেউ করে ওঠে। হলকু কয়েকবার চু-চু করে ডাকে। তবু সে তার কাছে ফিরে আসে না। ক্ষেতের চারপাশে ছুটে-ছুটে ডাকাডাকি করে চলে। কিছুক্ষণের জন্য এলেও তাড়াতাড়ি আবার ছুটে যায়। কর্তব্যভাবনা যেন ওর মনটাকে আকাক্ষার মতোই উথালপাথাল করে তোলে।
তিন
আরো একটা ঘণ্টা কাটে। রাত যেন শীতকে হাওয়ার ঝাঁপটা দিয়ে-দিয়ে আরো শাণিয়ে তোলে। হলকু উঠে বসে হাঁটুদুটোকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে দু-হাঁটুর মাঝখানে মাথাটা খুঁজে নেয়। তবুও শীত মানে না। মনে হচ্ছে যেন সব রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে। ধমনীতে রক্তের বদলে বরফ বইছে। সে ঝুঁকে আকাশের দিকে তাকায় রাত আর কত বাকি! সপ্তর্ষিমণ্ডল এখনো যে আকাশের অর্ধেকটাও ওঠেনি। উপরে উঠে এলেই তবে গিয়ে ভোর হবে। এখনো প্রহরখানেক রাত রয়েছে।
হলকুর ক্ষেত থেকে একটু দূরে আমবাগান। পাতাঝরা শুরু হয়ে গেছে। বাগানে রাশি-রাশি শুকনো পাতা। হল্কু ভাবে ওদিকে গিয়ে পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বেলে বেশ করে আগুন পোহায়। এত রাতে কেউ পাতা কুড়োতে দেখলে ভাববে ভূত। কে জানে কোনো জানোয়ার-টানোয়ার কোথাও লুকিয়ে বসে আছে কিনা; কিন্তু আর যে বসে থাকা যাচ্ছে না।
পাশের অড়হর ক্ষেতে গিয়ে কয়েকটা গাছ উপড়ে নিয়ে, তা দিয়ে একটা ঝড়র মতো বানিয়ে হাতে খুঁটে জ্বালিয়ে নিয়ে সে বাগানের দিকে যায়। জবরা তাকে দেখে কাছে এসে লেজ নাড়ে।
হলকু বলে, আর যে থাকতে পারছি না রে জবরু! চল, বাগানে পাতা কুড়িয়ে আগুন পোহাই। গা গরম করে নিয়ে এসে শোব। এখনো অনেক রাত। জবরা কু-কুঁ করে সম্মতি জানিয়ে সামনের বাগানের দিকে এগিয়ে যায়।
ঘুটঘুটি অন্ধকার বাগানে। অন্ধকারে দুরন্ত হাওয়া পাতাগুলোকে মাড়িয়ে দিয়ে যায়। গাছ থেকে শিশিরবিন্দু টুপটুপ করে নিচে ঝরে-ঝরে পড়ে।
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া মেহেদি ফুলের গন্ধ বয়ে আনে।
হলকু বলে–কী মিষ্টি গন্ধ রে জবরু! তুইও নাকে সুগন্ধ পাচ্ছিস তো?
জবরা মাটিতে পড়ে থাকা এক টুকরো হাড় খুঁজে পায়, দাঁত দিয়ে সেটাকে চিবোতে শুরু করে।
মাটিতে আগুনটাকে রেখে হলকু পাতা জড়ো করতে লেগে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে একরাশ পাতা জমে ওঠে। ঠাণ্ডায় ওর হাত দুখানা কাপে। খালি পা দুটো যেন অবশ হয়ে পড়ে। পাতার পাহাড় সে খাড়া করেছে। শীতকে এই আগুনের কুণ্ডে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে সে।
খানিক বাদেই আগুন জ্বলে ওঠে। আগুনের শিখা উপরের গাছের পাতাগুলোকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যায়। সেই চঞ্চল আলোয় বাগানের বিরাট-বিরাট গাছগুলোকে মনে হয় অথৈ আঁধারকে কারা যেন মাথায় তুলে রেখেছে। অন্ধকারের এই সাগরে এই আলোটা যেন। একখানা নৌকোর মতো হেলতে-দুলতে থাকে।