বাপ-বেটা দুজনে এখনো মৌজ করে-করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। সবার নজর ওদের দুজনের ওপর। কী ভাগ্য দুজনের! পুরো একটা বোতল ওদের মাঝখানে! পেট ভরে খেয়ে মাধব বেঁচে যাওয়া পুরির ঠোঙাটা নিয়ে গিয়ে একটি ভিখারিকে দিয়ে দিল।
ভিখারিটি দাঁড়িয়ে ওদের দিকে ক্ষুধাতুর চোখে তাকাচ্ছিল। দেয়ার গৌরব, আনন্দ আর উল্লাসে মাধব জীবনে এই প্রথম অনুভব করে।
ঘিসু বলে–’নে রে, যা ভালো করে খা আর আশীৰ্বাদ কর। যার দৌলতে খাওয়া ও তো মরে গেছে। তবু তোর আশীৰ্বাদ ওর কাছে পৌঁছবে। মন খুলে পরান খুলে আশীৰ্বাদ কর, বড় কষ্টের রোজগারের পয়সা রে!
মাধব আবার অকাশের দিকে তাকিয়ে বলে–ও ঠিক বৈকুণ্ঠে যাবে গো বাবা, ও বৈকুণ্ঠের রানী হবে।’
ঘিসু উঠে দাঁড়িয়ে যেন উল্লাসের তরঙ্গে সাঁতরাতে-সাঁতরাতে বলে–’হ্যাঁ বাবা, বৈকুণ্ঠেই যাবে বৈকি। কাউকে কষ্ট দেয়নি, দুখখু দেয়নি। মরতে-না-মরতে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সাধটি পুরিয়ে দিয়ে গেছে। ও যদি বৈকুণ্ঠে না-যাবে তো কি ওই ধুমসো-ধুমসো লোকগুলো যাবে যারা গরিবগুলোনরে দুহাতে লুটছে আর নিজেদের পাপ ধুয়ে ফেলতে গঙ্গায় গিয়ে চান করছে, মন্দিরে পুজো দিচ্ছে!’
ভক্তিশ্রদ্ধার এই অনুভূতিটি তাড়াতাড়ি বদলে যায়। অস্থিরতাই নেশার বৈশিষ্ট্য, এর পর দুঃখ আর হতাশা মনে ভর করে।
মাধব বলে–’বাবা, বেচারি কিন্তু জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। মরল, তা-ও কত যন্ত্রণা সয়ে।’
বলে চোখে হাত-চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়। ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ওঠে। ঘিলু বোঝায়–কাঁদছিস কেন বাবা, আনন্দ কর। বউ এই মায়া থেকে ছুটি পেয়ে গেছে। এই জঞ্জাল থেকে রেহাই পেয়েছে। বড় ভাগ্যিমানী ছিল রে, তাই তো এত তাড়াতাড়ি মায়ামমতা কাটিয়ে চলে গেছে।’
তারপর দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে গান গাইতে শুরু করে দেয়– ঠগিনী, কেঁয়ো নৈনা ঝমকায়ৈ। ঠগিনী!’ সব মাতাল এদের দুজনকে দেখছে। এরা দুজনে মত্ত হয়ে গান গেয়ে চলে। তারপর দুজনে নাচতে শুরু করে দেয়। লাফ দেয়। ঝাঁপ দেয়। পড়েও যায়। উঠে হেলেদুলে। চলে। কতরকম ভাবভঙ্গি করে। অভিনয় করে। তারপর শেষ পর্যন্ত নেশায় চুরচুর হয়ে ওখানেই টলে পড়ে যায়।
পৌষের রাত – প্রেমচন্দ
এক
হলকু এসে বলে–পেয়াদাটা এসেছে। দাও, যে কটা টাকা রেখেছিলাম, দিয়ে দিই ওকে, আপদ বিদেয় হোক।
মুন্নি ঝাঁট দিচ্ছিল। পেছন ফিরে বলে–তিনটে তো মাত্তর টাকা, দিয়ে দিলে কম্বল কোত্থেকে আসবে শুনি? পৌষ-মাঘ মাসের রাতে ক্ষেতে কী করে কাটাবে? গিয়ে ওকে বলে দাও, ফসল উঠলে চুকিয়ে দেব। এখন নেই।
হলকু কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। পৌষ মাস মাথার ওপর এসে গেছে। কম্বল ছাড়া রাতে মাচায় কিছুতেই সে শুতে পারবে না। কিন্তু পেয়াদা যে শুনবে না, চোটপাট করবে, গালাগালি দেবে। মরুক গে, শীতে না-হয় মরব, আপদটা তো এখন বিদেয় হবে। এই ভেবে সে তার মোটাসোটা গতরটা নিয়ে (যা তার নামটাকে মিথ্যে প্রমাণিত করেছে।) বউয়ের কাছে গিয়ে খোশামোদ করে বলে–যা, এনে দে, ঝামেলা তো মিটুক। কম্বলের কিছু একটা উপায় করবই।
মুন্নি ওর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে–আর করেছ উপায়! শুনি। তো একটু, কী উপায় করবে? কেউ খয়রাত দেবে নাকি কম্বল? জানি না আর কত বাকি আছে, এ যেন কিছুতেই শোধ হচ্ছে না। বলি, তুমি চাষবাস ছেড়ে দাও না কেন? মরে-মরে কাজ করবে, তারপর যেই ফসল উঠবে অমনি বাকি বকেয়া চুকাবে, ব্যস শেষ। ধার শোধ করতেই যেন আমাদের জন্ম। পেট ভরাতে মজুরি কর। চুলোয় যাক। অমন চাষ-বাস। দেব না আমি টাকা–কিছুতেই দেব না।
হলকু বিষণভাবে বলে–তাহলে গালাগালি খাব?
মুন্নি তড়পে ওঠে–গালাগালি দেবে কেন? এ কি ওর রাজত্ব নাকি?
কথাটা বলে ফেলেই ওর কোঁচকানো ভুরু শিথিল হয়ে পড়ে। হল্কুর ঐ কথাগুলোর রূঢ় সত্যতা যেন একটি হিংস্র পশুর মতো চোখ পাকিয়ে দেখতে থাকে। গিয়ে তাকের উপর থেকে টাকা ক’টা বের করে এনে সে হলকুর হাতে তুলে দেয়। বলে–তুমি এবার চাষাবাদ ছেড়ে দাও। মজুরি করলে তবু শান্তিতে একখানা রুটি খেতে পাব। কারু ধমকানি তো শুনতে হবে না।
হলকু টাকা ক’টা হাতে নিয়ে এমনভাবে বাইরে যায় যেন সে তার কলজেটাকেই ছিঁড়ে দিতে যাচ্ছে। মজুরির রোজগার থেকে একটা-একটা করে পয়সা বাঁচিয়ে সে তিনটে টাকা জমিয়েছিল একটা কম্বল কিনবে বলে। সে টাকা ক’টাও আজ বেরিয়ে যাচ্ছে। এক-একটা পা ফেলছে আর মাথাটা যেন তার দৈন্যের ভারে নুয়ে-নুয়ে পড়ছে।
দুই
পৌষের অন্ধকার রাত। আকাশের তারাগুলোও যেন শীতে থরথর করে কাঁপছে। হলকু ক্ষেতের একপাশে আখের পাতার ছাউনির নিচে বাঁশের মাচার উপর তার পুরনো মোটা সুতির চাদরখানা মুড়ি দিয়ে পড়ে-পড়ে হিহি করে কাঁপছে। মাচার নিচে ওর সঙ্গী কুকুর জবরা মুখখানাকে পেটের মধ্যে খুঁজে শীতে কুঁ-কুঁ করে চলেছে। দুজনের কারোরই চোখে ঘুম নেই।
হাঁটুদুটোকে ঘাড়ের সঙ্গে চাপতে-চাপতে হলকু বলে–কিরে জবরা, শীত করছে? বলেছিলাম না, বাড়িতে খড়ের উপর শুয়ে থাক, তা এখানে কী করতে এসেছিস? ম এবার ঠাণ্ডায়। আমি কী করব? ভেবেছিলি আমি বোধহয় হালুয়া-পুরি খেতে আসছি, তাই ছুটতে-ছুটতে আগে-আগে চলে এসেছিস? এখন কাদ বসে-বসে।