জমিদারমশাই যখন দু’টাকা দিয়েছেন, তখন গাঁয়ের বেনে মহাজনেরা নিষেধ করে কী করে! ঘিসু জমিদারের নামের ঢাক পেটাতেও খুব ওস্তাদ! ওরা কেউ দেয় দু’আনা, কেউ চার আনা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘিসুর হাতে টাকাপাঁচেকের মতো পুঁজি যোগাড় হয়ে যায়। এছাড়া কেউ গমটম দেয়, কেউ-বা কাঠ। তারপর দুপুরবেলা ঘিসু আর মাধব বাজার থেকে কফনের জন্য নতুন কাপড় আনতে যায়। এদিকে অন্যরা বাঁশ কাটতে শুরু করে।
গায়ের কোমলমনা মেয়েরা এসে মৃতাকে দেখে, বেচারির অসহায় অবস্থার কথা ভেবে দুফোঁটা চোখের জল ফেলে চলে যায়।
বাজারে এসে ঘিসু বলে–’ওকে জ্বালানোর মতো কাঠ তো যোগাড় হয়ে গেছে, তাই না রে মাধব?’
মাধব বলে—’হ্যাঁ, কাঠ তো অনেক হয়েছে, এখন কফন হলেই হয়।’
‘তাহলে চল সস্তা দেখে একখানা কফন কিনে নিই।‘
‘হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী? মড়া তুলতে-তুলতে রাত হয়ে যাবে। রাতের বেলায় কফন অত কে দেখতে যাচ্ছে?’
‘কেমনতর যে বাজে নিয়ম সব, বেঁচে থাকতে গা ঢাকার জন্য একখানা ঘেঁড়া তেনাও
যে পায়নি মরলে তার নতুন কফন চাই।
‘কফনটা তো মড়ার সঙ্গেই পুড়ে যায়।’
‘তা না তো কি থেকে যায় নাকি? এই টাকা পাঁচটা আগে পেলে বউটাকে একটু ওষুধ-পথ্যি খাওয়াতে পারতাম।’
দুজনেই দুজনের মনের কথাটা টের পাচ্ছে। বাজারে এখানে-ওখানে ঘুরছে তো ঘুরছেই। কখনো এ দোকানে, কখনো ও-দোকানে। নানা রকমের কাপড়-রেশমি কাপড়, সুতি কাপড় সব দেখে, কিন্তু কোনোটাই পছন্দ হয় না। এই করতে-করতে সন্ধ্যা নামে। তখন দুজনেই এক দৈবী প্রেরণাবশে একটি পানশালার দরজায় এসে দাঁড়ায়, তারপর প্রায় পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা মতো ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর গদির সামনে গিয়ে ঘিসু বলে–’সাহজী, এক বোতল আমাদেরকেও দিন।’
এরপর কিছু চাট আসে, মাছভাজা আসে, আর ওরা দুজনে বারান্দায় বসে নিশ্চিন্ত মনে মদ গিলে চলে।
কয়েক ভাড় তড়বড় করে গেলবার পর দুজনেরই একটু-একটু নেশার আমেজ আসে। ঘিসু বলে–কফন দিলে হতটা কী? শেষঅব্দি পুড়েই তো যেত। বউয়ের সঙ্গে তো আর যেত না।’
মাধব আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন সব দেবতাকে তার নিষ্পাপ কাজের সাক্ষী মেনে বলে—’দুনিয়ার দস্তুরই যে এই, নইলে লোকে বামুনঠাকুরদের হাজার-হাজার টাকাই-বা দেয় কেন? কে দেখছে, পরলোকে কী পাচ্ছে না-পাচ্ছে।’
বড়লোকদের হাতে পয়সা আছে, ইচ্ছে হলে ওড়াক গে। আমাদের কাছে উড়িয়ে দেয়ার মতন আছেটা কী!
কিন্তু ওদের সবাইকে কী বলবি? ওরা জিজ্ঞেস করবে-না কফন কই? ঘিলু হাসে—’আরে ধ্যাৎ, বলব টাকা ট্যাক থেকে কোথায় যে খসে পড়ে গেছে, অনেক খুঁজেছি, পাইনি। ওরা বিশ্বাস করবে না ঠিকই, তবু ওরাই আবার টাকা দেবে।’
মাধবও হেসে ফেলে; এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে বলে–’আহা! বড় ভালো ছিল গো বেচারি! মরেও খুব খাইয়ে গেল।
আধ বোতলের ওপর শেষ হয়ে যায়। ঘিষু দুসের পুরি আনিয়ে নেয়। সঙ্গে চাটনি, আচার, মোটর কারি। গুঁড়িখানার সামনেই দোকান। মাধব ছুটে গিয়ে দুটো ঠোঙায় করে সব জিনিস নিয়ে আসে। পুরো দেড়টি টাকা আরও খরচ হয়ে যায়। হাতে শুধু ক’টা পয়সা বাকি থাকে।
দুজনে এখন খোশমেজাজে বসে পুরি খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন বনের বাঘ বনে বসে তার শিকার সাবাড় করছে। না-আছে জবাবদিহি করার ভয়, না-আছে বদনামের ভাবনা। এসব ভাবনাচিন্তাকে ওরা অনেক আগেই জয় করে নিয়েছে।
ঘিসু দার্শনিকের মতো বলে–এই যে আমাদের আত্মা খুশি হচ্ছে, এতে কি বউ আনন্দ পাবে না?
মাধব ভক্তিতে মাথা নুইয়ে সায় দেয়–‘খুব পাবে, আলবৎ পাবে। ভগবান, তুমি অন্তযামী। ওকে সগৃগে নিয়ে যেও। আমরা দুজনে মন খুলে আশীৰ্বাদ করছি। আজ যে খাওয়াটা খেলাম অমনটা সারাজীবনে কোনোদিন কপালে জোটেনি।
খানিক বাদে মাধবের মনে একটা সন্দেহ জাগে। বলে–’আচ্ছা বাবা, আমরাও তো একদিন ওখানে যাব।’
ঘিসু এই সোজা সহজ প্রশ্নটার কোনো জবাব দেয় না। পরলোকের কথা ভেবে এই আনন্দটাকে মাটি করতে চায় না সে।
‘যদি ও ওখানে আমাদের জিগ্যেস করে তোমরা আমাকে কফন দাওনি কেন, তাহলে কী বলবি?’
বলব, তোর মুণ্ডু।’
‘জিগ্যেস তো ঠিকই করবে।’
‘তোকে কে বলেছে যে ও কফন পাবে না? তুই কি আমাকে অমন গাধা ঠাউরেছিস? ষাটটা বছর কি দুনিয়াতে ঘোড়ার ঘাস কেটে আসছি। বউ কফন ঠিকই পাবে আর এর থেকে অনেক ভালো পাবে।’
মাধবের বিশ্বাস হয় না। বলে–’দেবেটা কে? পয়সা তো তুই খেয়ে ফেলেছিস। ও তো আমাকেই জিগ্যেস করবে। ওর সিথেয় সিঁদুর যে আমিই পরিয়েছি।’
ঘিসু গরম হয়ে বলে–’আমি বলছি ও কফন পাবে। তোর পেত্যয় হচ্ছে না কেন?
‘দেবেটা কে বলছিস-না কেন?
ও লোকগুলানই দেবে যারা এবার দিয়েছে। হ্যাঁ, তবে এর পরের টাকাটা আর আমাদের হাতে আসবে না।
যেমন অন্ধকার বেড়ে চলে, আকাশের তারাগুলোর দীপ্তি বাড়ে, মদের দোকানের রঙতামাশাও তেমনি বাড়তে থাকে। কেউ গান গায়, কেউ ডিগবাজি খায়, কেউ-বা তার সাথীর গলা জড়িয়ে ধরে। কেউ তার ইয়ারের মুখে মদের ভাড় তুলে দেয়।
এখানকার পরিবেশে মাদকতা, হাওয়াতে নেশা। কত লোক তো এখানে এসে এক টোক খেয়েই মাতাল হয়ে পড়ে। মদের থেকেও বেশি এখানকার হাওয়া ওদের নেশা ধরায়। জীবনের দুঃখ-কষ্ট ওদের এখানে টেনে আনে। কিছু সময়ের জন্য ওরা ভুলে থাকে ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে। নাকি বেঁচেও নেই, মরেও নেই।