দুজনে আলু বের করে-করে গরম-গরম খেয়ে চলে। কাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। তাই আলু ঠাণ্ডা হবার তর সইছে না। ফলে বারকয়েক দুজনেরই জিভ পুড়ে যায়। খোসা ছাড়ালে আলুর ওপরটা খুব বেশি গরম বলে মনে হয় না, কিন্তু দাঁতের নিচে পড়া মাত্রেই ভেতরটাকে, জিভ, গলা আর টাকরাকে পুড়িয়ে দেয়। ওই অঙ্গারটাকে তখন মুখে রাখার চাইতে অনেক বেশি ভালো পেটের ভেতরে পাচার করে দেয়া। সেখানে ওটাকে ঠাণ্ডা। করার মতো যথেষ্ট বস্তু রয়েছে। তাই দুজনে গপাগপ গিলে ফেলছে। যদিও এ করতে গিয়ে চোখে জল এসে পড়ছে ওদের।
খেতে-খেতে জমিদারের বিয়েতে বরযাত্রী যাবার কথা ঘিসুর মনে পড়ে যায়। বছর কুড়ি আগে সেই বরযাত্রী হয়ে গিয়েছিল। সেই ভোজ খেয়ে যে তৃপ্তি সে পেয়েছিল তা তার জীবনে মনে রাখার মতো ঘটনা, আজও সে স্মৃতি তার উজ্জ্বল হয়ে আছে। বলে—’ওই ভোজের কথা ভুলতে পারি না। তারপর সারা জীবনে অমন খাবার আর পেট পুরে খাইনি। মেয়ের বাড়ির লোকেরা সবাইকে পেট ভরে পুরি খাইয়েছিল, সব্বাইকে! ছোট-বড় সবাই পুরি খেয়েছিল, একেবারে খাঁটি ঘিয়ে ভাজা! চাটনি, রায়তা, তিন রকমের শুকনো তরকারি, একটা ঝোল, দই, মিষ্টি। কী বলব, এ-ভোজে সেদিন কী আস্বাদ পেয়েছিলাম! কোনও নিষেধ-মানা ছিল না। যে-জিনিস যত খুশি চেয়ে নাও, যত চাই খাও। সবাই অ্যাত্ত-অ্যাও খেয়েছিল যে, কেউ জল পর্যন্ত খেতে পারেনি। পরিবেশকরা পাতে গরম-গরম, গোল-গোল, সুগন্ধি কচুরি দিয়েই। চলছিল। যত মানা করি আর চাই না, পাতের উপর হাতচাপা দিয়ে রাখি, কিন্তু তবু ওরা দিয়ে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। তারপর যখন আঁচিয়ে এলাম, তখন পান-এলাচও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার তখন পান খাবার হুঁশ কোথায়। দাঁড়িয়ে থাকতেই পারছিলাম না। চটপট গিয়ে আমার। কম্বল পেতে শুয়ে পড়েছিলাম। এত দিলদরিয়া ছিলেন ওঁরা।’
মাধব মনে-মনে জিনিসগুলোর স্বাদ কল্পনা করতে-করতে বলে—’আজকাল কেউ তো আর আমাদের অমন ভোজ খাওয়ায় না।’
‘আজকাল আর খাওয়াবে কে, খাওয়াবেই-বা কী? ওই জমানাটাই ছিল আলাদা। এখন তো সবাই পয়সা বাঁচানোর ধান্দাতেই আছে। বিয়ে-সাদিতে খরচ করে না, ক্রিয়া-করমে খরচ করে না। বলি গরিবগুলানের পয়সা লুটে-লুটে রাখবি কোথায়?’
লুটবার বেলায় ক্ষ্যামা নেই, শুধু খরচের বেলাতেই যত্ত হিসাব।
‘তুমি খানবিশেক পুরি খেয়েছিলে বোধহয়? ‘বিশখানার বেশিই খেয়েছিলাম।’
‘আমি হলে পঞ্চাশখানা সেঁটে ফেলতাম।’
‘খানপঞ্চাশের কম আমিও খাইনি। তাগড়া জোয়ানমদ্দ ছিলাম। তুই তো আমার আদ্দেকও নোস।’
আলু খাওয়া হয়ে গেলে দুজনেই জল খেয়ে ওখানেই আগুনের সামনে কাপড়ের খুঁট গায়ে জড়িয়ে পেটে পা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে। যেন দুটো বড়-বড় অজগর কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে আছে।
ওদিকে বুধিয়া সমানে ঝাঁকিয়ে চলেছে।
সকালে ঘরে ঢুকে মাধব দেখে বউটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ওর মুখের উপর মাছি ভন করছে। উপরদিকে চেয়ে রয়েছে পাথরের মতো স্থির নিশ্চল দুটি চোখ। সমস্ত শরীর ধুলোয় মাখামাখি। ওর পেটে বাচ্চাটা মরে গেছে।
মাধব ছুটতে-ছুটতে ঘিসুর কাছে যায়। তারপর দুজনে জোরে-জোরে হাহাকার করতে-করতে বুক চাপড়াতে থাকে। পাড়াপড়শিরা কান্নাকাটি শুনে ছুটতে-ছুটতে আসে এবং চিরাচরিত রীতি অনুসারে এই হতভাগা দু’জনকে সান্ত্বনা দেয়।
কিন্তু বেশি কান্নাকাটির সময় নেই। শবাচ্ছাদনের নতুন কাপড় আর কাঠের ভাবনা ভাবতে হবে। এদিকে ঘরে পয়সা তো যেমন চিলের বাসায় মাংস তেমনি শূন্য।
বাপ-বেটা দুজনে কাঁদতে-কাঁদতে গায়ের জমিদারের কাছে যায়। উনি এই দুজনের মুখই দেখতে পারেন না। বারকয়েক এ দুজনকে নিজের হাতে পিটুনি দিয়েছেন চুরি করেছে বলে কিংবা কথা দিয়ে ঠিকমতো কাজে আসেনি বলে। জিজ্ঞেস করেন—’কী হয়েছে রে ঘিলুয়া, কাঁদছিস কেন? আজকাল তো কোথাও তোর দেখা মেলা ভার। মনে হচ্ছে যেন এ গাঁয়ে থাকার ইচ্ছে নেই তোর।‘
ঘিসু মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে জলভরা চোখে বলে—’কত্তামশায় গো! বড় বিপদে পড়েছি! মাধবের বউটা কাল রাতে মরে গেছে। সারাটা রাত ছটফট করেছে কত্তা! আমরা দুজন ওর শিয়রে বসে ছিলাম। ওষুধবিমুদ যদুর পেরেছি, সব করেছি। তবুও বউটা আমাদের দাগা দিয়ে গেল, কত্তা। একখানা যে রুটি করে খাওয়াবে এমন কেউ আর রইল না। কত্তাবাবু! একেবারে পথে বসেছি। সংসারটা ছারখার হয়ে গেল, হুজুর। হুজুরের গোলাম আমরা। এ-বিপদে হুজুর আপনি ছাড়া কে ওর ঘাটের দায় উদ্ধার করবে? আমাদের হাতে যা কিছু দু-চার পয়সা ছিল, সব ওষুধ আর পথ্যিতে শেষ হয়ে গেছে। হুজুর যদি দয়া করেন তাহলেই ওকে ঘাটে তুলতে পারব। আপনি ছাড়া আর কার দোরে গিয়ে হাত পাতব, হুজুর!’
জমিদারবাবু দয়ালু। তবে ঘিসুকে দয়া করার মানে তো ভস্মে ঘি ঢালা। ইচ্ছে হল বলে দেন–ভাগ, দূর হ সামনে থেকে। এমনিতে তো ডেকে পাঠালেও আসিস না। আজ গুরজ পড়েছে, তাই এসে খোশামোদ করছিস। হারামদাজা, বদমাস কোথাকার! কিন্তু রাগ করার বা সাজা দেয়ার সময় এখন নয়। মনে-মনে গজগজ করতে-করতে দুটো টাকা বের করে ছুঁড়ে দেন। সান্ত্বনার একটি কথাও মুখ দিয়ে বের হয় না। ওদের দিকে ফিরেও তাকান না, যেন কোনোমতে ঘাড় থেকে আপদ দূর করেন।