এই গ্রন্থে উর্দু কথাসাহিত্যের সেরা লেখকদের সেরা গল্পগুলোর সন্নিবেশের ফলে পাঠক একটি সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন–আমরা এই আশা রাখি।
শহিদুল আলম
২২/২, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুল, ঢাকা।
এই গ্রন্থে উর্দু কথাসাহিত্যের সেরা লেখকদের সেরা গল্পগুলোর সন্নিবেশের ফলে পাঠক একটি সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন–আমরা এই আশা রাখি।
শহিদুল আলম
২২/২, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুল, ঢাকা।
ঝুপড়ির দরজায় বাপ-বেটা দুজনে নিভে যাওয়া আগুনটার সামনে চুপচাপ বসে। ওদিকে ঘরের ভেতরে ছেলের জোয়ান বউ বুধিয়া প্রসববেদনায় আছাড়পাছাড় খাচ্ছে। থেকে-থেকে ওর মুখ দিয়ে এমন কলজে-কাঁপানো আওয়াজ আসছে যে ওরা দুজন বুকে। পাথর চেপে কোনও মতে তা সহ্য করছে। শীতের রাত, প্রকৃতি নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। সমস্ত গ্রামখানা মিশে গেছে অন্ধকারে।
ঘিসু বলে—’মনে হচ্ছে বাঁচবে না। সারাটা দিন দৌড়ঝাঁপ করেই কাটাল। যা না, গিয়ে একবারটি দেখে আয় না।’
মাধব ক্ষেপে দিয়ে বলে—’মরবেই যদি তো তাড়াতাড়ি মরে না কেন? দেখে করবটা কী?’
‘পরাণে তোর একটুও দরদ নেই রে! সারাটা বছর যার সঙ্গে সুখে-শান্তিতে ঘর করলি, তার সঙ্গেই অমন বেইমানি!’
‘আমি যে ওর ছটফটানি আর হাত-পা ছোঁড়া চোখে দেখতে পারছি না।’
চামার-বাড়ি; সারা গায়ে ওদের বদনাম। ঘিসু একদিন কাজে যায় তো তিনদিন ঘরে বসে থাকে। মাধবটা কাজে এত ফাঁকিবাজ যে আধঘণ্টা কাজ করে তো একঘণ্টা বসে ছিলিম টানে। তাই ওরা কোথাও মজুরি পায় না। ঘরে যদি একমুঠো খাবার থাকে তো ব্যস, ওরা যেন কাজ না-করার শপথ নেয়। দুচারটে উপোস দেবার পর ঘিসু গাছে উঠে কাঠকুটো ভেঙে আনে আর মাধব বাজারে গিয়ে বেচে আসে সেগুলোকে; তারপর যতক্ষণ সে পয়সা হাতে থাকে দু’জনে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। আবার যখন উপোস করার হাল হয়, তখন আবার হয় কাঠকুটো কুড়িয়ে আনে কিংবা জনমজুরির খোঁজে বের হয়। গায়ে কাজের কমতি নেই। চাষাভুষোর গাঁ, খেটে-খাওয়া মানুষের হাজার রকমের কাজ। তবু ওদের দুজনকে লোকে কেবল তখনি ডাকে যখন দুজনের মজুরি দিয়ে একজনের কাজটুকুতেই সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকে না। এ দুজন যদি সাধু-সন্ন্যাসী হত, তবে সন্তোষ এবং ধৈর্যের জন্য কোনো সংযম-নিয়মেরই আবশ্যকতা হত না, কারণ এ-সব ছিল ওদের স্বভাবজাত। ছন্নছাড়া অদ্ভুত জীবন ওদের। ঘরে দুচারখানা মাটির বাসন ছাড়া সম্পত্তি বলতে কিছু নেই। ছেঁড়া কাপড় পরে নিজেদের নগ্নতাকে কোনোমতে ঢেকে জীবন কাটায়। সংসারের সব রকমের ভাবনাচিন্তা থেকে মুক্ত। ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। গালাগালি খায়, খায় মারধরও, তবুও কোনো দুঃখ নেই। গরিব এত যে, পরিশোধের আশা লেশমাত্র নেই জেনেও সবাই ওদের কিছু না-কিছু ধার দেয়। মটর বা আলুর সময় অন্যের ক্ষেত থেকে মটর কিংবা আলু চুরি করে তুলে নিয়ে এসে সেগুলোকে ভেজে বা পুড়িয়ে খেয়ে নেয়; কিংবা পাঁচদশ গাছা আখ ভেঙে এনে রাতের বেলা বসে-বসে চোষে। ঘিসু এই রকম আকাশবৃত্তিতেই ষাট-ষাটটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে; আর মাধবও বাপের বেটা, অনুসরণ করে চলেছে তারই পদাঙ্ক; বরং বলা চলে বাপের নামকে আরও উজ্জ্বল করে চলেছে। এই যে এখন দুজনে আগুনের সামনে বসে আলুগুলো পোড়াচ্ছে তা-ও কারো-না-কারো ক্ষেত থেকে তুলে আনা। ঘিসুর বউটা তো অনেকদিন আগেই দেহরক্ষা করেছে। মাধবের বিয়ে হয়েছে এই গত বছর। মেয়েটি এদের ঘরে এসে পরিবারে একটা শৃঙ্খলা এনেছে। গম পিষেই হোক বা ঘাস তুলেই হোক সেরটাক আটার যোগাড় সে ঠিক করে নিত আর এই বেহায়াদুটোকে পিণ্ডি গেলাত। মেয়েটা ঘরে আসার পর এরা দু’জন আরও আলসে, আরও আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; বরং বলা চলে ওদের গুমরও যেন বেড়ে গিয়েছিল। কেউ কাজ করতে ডাকলে ইদানিং বিনাদ্বিধায় দুনো মজুরি হেঁকে বসত। এই মেয়েটিই আজ এদিকে প্রসববেদনায় মরে যাচ্ছে আর এরা দু’জন বোধকরি এই আশায় অপেক্ষা করে আছে যে, ও চোখ বুজলে আরাম করে ঘুমোতে পারবে।
ঘিলু আলু বের করে খোসা ছাড়াতে-ছাড়াতে বলে, ‘গিয়ে দেখ তো কী অবস্থা বেচারির! পেত্নীর নজর লেগেছে, তাছাড়া আর কি? এসব ঝাড়াতে-টাড়াতে তো ওঝা কম করেও একটা টাকা চাইবে!’
মাধবের ভয়, সে ঘরে ঢুকলে ঘিসু আলুগুলোর বেশির ভাগটা-না সাবাড় করে দেয়। বলে—’ওর কাছে যেতে আমার ভয় করছে।’
‘ভয় কিসের রে, আমি তো এখানে রয়েছিই!’
‘তাহলে তুই-ই গিয়ে দেখ না।‘
‘আমার বউ যখন মারা গিয়েছিল, আমি তিনদিন ওর কাছ থেকে নড়িনি। আর তাছাড়া আমাকে দেখলে ও লজ্জা পাবে না? কোনোদিন যার মুখ দেখিনি, আজ তার উদলা গা দেখব! ওর তো এখন গা-গতরের হুঁশ-টুশও নেই। আমাকে দেখে ফেললে ভালো করে হাত-পা-ও হুঁড়তে পারবে না।’
‘আমি ভাবছি যদি বাচ্চাটাচ্চা হয়ে পড়ে তাহলে কী হবে? শুঠ, গুড়, তেল কিছুই তো ঘরে নেই।’
‘সবই এসে যাবে। ভগবান দিক তো! যারা এখন একটা পয়সা দিচ্ছে না, তারাই কালকে যেচে এসে টাকা দেবে। আমার ননটা ছেলে হয়েছে, ঘরে তো কোনোদিন একটা কানাকড়িও ছিল না, তবু ভগবান কোনও-না-কোনও মতে কাজ তো চালিয়ে দিয়েছেন।’
.
যে-সমাজে দিনরাত খেটে-খাওয়া মানুষের হাল ওদের চাইতে বেশি কিছু ভালো নয়, যেখানে চাষিদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে যারা মুনাফা লোটে তারাই চাষিদের চেয়ে অনেক বেশি সংগতিপন্ন, সে-সমাজে এ-ধরনের মনোবৃত্তির সৃষ্টি হওয়া কিছু অবাক হবার মতো কথা নয়। বরং বলব ঘিলু চাষিদের চাইতে ঢের বেশি বুদ্ধিমান, তাই সে নির্বোধ চাষিদের পালে না-ভিড়ে আড্ডাবাজদের কুৎসিত দলে গিয়ে জুটেছিল। তবে হ্যাঁ, ওর মধ্যে এতটা ক্ষমতা ছিল না যে, আড্ডাবাজদের নিয়মকানুন ঠিকঠাক রপ্ত করে। তাই ওর দলভুক্ত অন্য সবাই যেখানে গাঁয়ের মাতব্বর কিংবা মোড়ল হয়ে গেছে, সেখানে সারা গাঁ ওর নিন্দে করে। তবু এ-সান্ত্বনাটুকু ওর আছে যে, ওর হাঁড়ির হাল খারাপ হলেও অন্ততপক্ষে ওকে ওসব চাষিদের মতো হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় না। ওর সরলতা এবং নিরীহতা থেকে অন্যরা অনুচিত মুনাফা লুটতে পারে না।
© 2023 BnBoi - All Right Reserved
© 2023 BnBoi - All Right Reserved