মিউনিসিপ্যালিটির একজন গম্ভীর সদস্য–যিনি নিজেকে দেশ আর জাতির খাঁটি খাদেম বলে দাবি করেন–অত্যন্ত জ্বালাময়ী ভাষায় বললেন–’ভদ্রমহোদয়গণ, একবার তাদের অবস্থিতি লক্ষ করুন। এটা যে শুধু শহরের মধ্যস্থল তা নয়, বরং এটা শহরের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র; অতএব প্রতিটি সম্মানিত ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও এই পথ দিয়ে চলাফেরা করতেই হয়। উপরন্তু অভিজাত ব্যক্তিবর্গের পুণ্যশীলা স্ত্রী-কন্যারা বিকিকিনির জন্য অহরহ এখানে আসতে বাধ্য হন। এসব নির্লজ্জ, অর্ধউলঙ্গ বেশ্যাদের সাজ-পোশাকের চাকচিক্য দেখে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনেও নানারকম রঙিন-রঙিন আকাঙ্ক্ষা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ায়, আর ঘরে ফিরে এসে তাঁদের দরিদ্র স্বামীদের ওপর বিভিন্ন প্রসাধন দ্রব্য, নিত্যনতুন শাড়ি ইত্যাকার অনেক জিনিসের জন্য পীড়াপীড়ি করেন। ফলে সুখী-স্বচ্ছন্দ পরিবারগুলো অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। ভদ্রমহোদয়গণের অবগতির জন্য আমি আরো একটি জিনিসের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের কচি ছেলেরা জাতির ভবিষ্যৎ। জাতি তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে। জাতিকে কালের ঘূর্ণাবর্ত থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব এদেরই। এইসব ছেলেদের সকাল-সন্ধ্যা এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। এসব বেশ্যারা সবসময় রকমারি মনমাতানো সাজ পরে। লোভনীয় প্রসাধনীর আবরণে নিজেদের ঢেকে সবাইকে রূপচর্চায় আমন্ত্রণ জানায়। এসব দেখেশুনে আমাদের অপরিণামদর্শী, আত্মভোলা ছেলেরা যৌবনের উন্মাদনায় বিহ্বল হয়ে নিজেদের এর ভেতর জড়িয়ে ফেলে। এ-অবস্থায় তাদের পক্ষে নিজেদের সৎস্বভাবকে পাপের বিষাক্ত ছোবল থেকে সরিয়ে রাখা কি সম্ভব? অতএব মহোদয়গণ, এসব রূপোপজীবীরা কি এদের জাতি গঠনমূলক কাজ থেকে বিমুখ করে তাদের মনে পাপ-বাসনা সৃষ্টি করে তাদের একটা বিশ্রী ব্যাকুলতা, চাঞ্চল্য আর উত্তেজনার শিকারে পরিণত করছে না?
এই সুযোগে যোগ-বিয়োগে সিদ্ধহস্ত একজন প্রাক্তন শিক্ষক বললেন–মহোদয়গণ, মনে রাখবেন–পরীক্ষায় ফেলের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় এবার দেড় গুণ বেড়ে গেছে।
অতঃপর একজন চশমাধারী সদস্য উঠলেন। তিনি একখানা সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। বললেন–’আমাদের শহর থেকে দিন-দিন মর্যাদাবোধ, আভিজাত্য, পৌরুষ, পুণ্যশীলতা আর সংযম যাচ্ছে উঠে। এর বদলে হীনমন্যতা, কাপুরুষতা, বদমায়েশি, চৌর্যবৃত্তি বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ দিন-দিন ধ্বংসের দুর্গম অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। হত্যা, লুণ্ঠন আর আত্মহত্যার ভেতর দিয়ে মানুষের এই রূপ প্রকট হয়ে উঠছে। এর একমাত্র কারণ এসব অস্পৃশ্য নারীদের আত্মঘাতী প্রভাব। আত্মভোলা শহরবাসীরা এসব ছলনাময়ী নারীদের রূপের শিকার হয়ে সিদ্ধ-অসিদ্ধ যে কোনো উপায় টাকা সংগ্রহ করে এদের পেছনে ঢালছে। মাঝে-মাঝে এ ব্যাপারে তারা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে, তারা মনুষ্যত্ববোধ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে বসে, ফলে হয় তারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেয়, অথবা জেলখানার চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
একজন পেনশনপ্রাপ্ত সদস্য উঠলেন। তিনি একটি বিস্তৃত আর উন্নত বংশের পৃষ্ঠপোষক। পৃথিবীর ভাব ও মিঠেকড়ার সঙ্গে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। এখন জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অবশিষ্ট দিনগুলো একটু আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দিতে চান এবং বংশধরদের নিজের পক্ষপুটে উন্নত আর উদ্ধত দেখে যেতে চান। তিনি অত্যন্ত আবেগময়ী ভাষায় বললেন–জনাব, রাতের পর রাত এদের তবলার ডুগডুগি, গলাবাজি, এদের গ্রাহকদের হৈ-হল্লা, গালিগালাজ, শোরগোলের প্রচণ্ড শব্দ শুনতে-শুনতে আশেপাশের ভদ্রলোকদের কানে তালা লাগার উপক্রম হয়েছে। রাতের নিদ্রা, দিনের বিশ্রামকে পণ্ড করে প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছে এরা। উপরন্তু এদের সর্বগ্রাসী প্রভাবে আমাদের বৌ-ঝিরা কীভাবে প্রভাবিত তা সকলেই অনুমান করতে পারেন…।’ শেষের অংশটুকু বলতে তার গলার শব্দ আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। ফলে তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হল না। সকল সদস্যেরই তার প্রতি গভীর সহানুভূতি ছিল। কারণ দুর্ভাগ্যবশত তার প্রাচীন বাড়িটি এসব রূপোপজীবীদের এলাকার একেবারে নিকটে।
এরপর একজন রক্ষণশীল সদস্য দণ্ডায়মান হলেন। রক্ষণশীলতা তাঁর কাছে নিজের সন্তান-সন্ততির মতোই প্রিয়। তিনি বললেন–’বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ভ্রমণকারী আমাদের এই প্রসিদ্ধ শহর পরিদর্শনে আসেন। এসব দেখার পর তাদের মনে কী ধারণা জন্মে তা একবার ভেবে দেখুন।’
এবার মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান বক্তৃতা করতে উঠলেন। কাঠখোট্টা গোছের এই ভদ্রলোকটির ছোট-ছোট হাত-পা। কিন্তু তার মাথাটা বেশ বড়-সড় বলে খানিকটা গম্ভীর দেখায়। তিনি বললেন–বন্ধুগণ, এ-ব্যাপারে আংশিকভাবে আপনাদের সঙ্গে আমি একমত। সত্যিই এদের জন্যে আমাদের শহর, আমাদের সংস্কৃতি দারুণ সংকটের মুখোমুখি। কিন্তু মুশকিল বাধছে এর প্রতিকার নিয়ে। যদি এদের এই নীচ ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয় তা হলে প্রশ্ন উঠবে–এরা খাবে কী করে?
একজন সদস্য প্রশ্ন করলেন–’এরা বিয়ে করে না কেন?’
এ প্রশ্নে একটা তরল হাসির রোল উঠল। হলের থমথমে ভাব এতে বেশ খানিকটা লঘু হয়ে হলের প্রতিটি মানুষের মুখমণ্ডলে একটা সরস ভাব ফুটে উঠল।