এ-কথা শুনে ঈশ্বরসিং-এর ধ্যান ভাঙে, যেন হাত থেকে সব তাসগুলো ছিটকে পড়েছে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দেখতে থাকে এদিক-ওদিক। তার মাথায় চুলের গোড়ায় ঘামের প্রলেপ দেখা দেয়। কুলবন্ত কাউর তাকে দৃষ্টি আকর্ষণের বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তারপর খাট থেকে নিচে নেমে রেগে নাসা ফুলিয়ে বলে, ঈশ্বর সিয়া, কোন হারামজাদির কাছে। তুমি এতদিন ছিলে, কে আমার বুক থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল?
ঈশ্বরসিং পালঙ্কে শুয়ে হাই তোলে। কুলবন্ত কাউর রাগে গরগর করতে থাকে, আমি জিজ্ঞাসা করছি সে কে? কে?’
ঈশ্বরসিং প্রাণহীন কণ্ঠে উত্তর দেয় ‘কেউ না, কুলবত্ত কেউ না।’ কুলবন্ত কোমরে হাত রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, ‘ঈশ্বর সিয়া, আমি আজ সত্য-মিথ্যা যাচাই করবই। গুরুজির দিব্যি করে বল, তোমার কল্পনারাজ্যে কি কোনো নারীর ছবি নেই?
ঈশ্বরসিং কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু কুলবন্ত তার সুযোগ না-দিয়েই গর্জন করে ওঠে, কসম খাওয়ার আগে ভেবে দেখ, আমিও সরদার নেহালসিং-এর মেয়ে। মিথ্যা বললে কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলব। নাও, এবার গুরুজির কসম খাও…বলো তোমার চিন্তা-ভাবনা কোনো নারী নিয়ে কিনা?’
ঈশ্বরসিং বেদনার সঙ্গে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে হ্যাঁ’ বলে। কুলবন্ত মুহূর্তের জন্য পাগল হয়ে যায়। লাফিয়ে গিয়ে ঘরের কোণায় রাখা কৃপাণ তুলে নেয় হাতে। কলার খোসার মতো কৃপাণের কভার ছুঁড়ে ফেলে ঈশ্বরের ঘাড়ের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।
তড়িৎ ফিনকি দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছোটে।
এতেও কুলবন্তের সাধ মেটে না। ঈশ্বরের চুলের জটা ধরে টানতে-টানতে অশ্লীল ভাষায় সেই অদৃশ্য নারীকে তিরস্কার করতে থাকে। ঈশ্বরসিং কিছুক্ষণ পর দুর্বল কণ্ঠে আবেদন জানায়, কুলবন্ত ওসব ভুলে যাও।’ তার কণ্ঠে বেদনার অতলান্ত ছায়া। কুলবন্ত কাউর পেছনে সরে দাঁড়ায়। ঈশ্বরসিং-এর গলায় কৃপাণের আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে তার গোঁফের ওপর এসে পড়েছে। রক্তাক্ত ঈশ্বরসিং কৃতজ্ঞতা ও অভিযোগের মিশ্ৰদৃষ্টিতে কুলবন্তের দিকে চোখ তুলে তাকায়; কুলবন্ত, তুমি এত তাড়াতাড়ি এমন কাজ করলে! যাক যা হওয়ার হয়ে গেছে। কুলবন্ত আবার রেগে ওঠে, কিন্তু সে তোমার কোন আত্মীয়া বল?’ এবার রক্ত ঈশ্বরসিং-এর মুখে এসে পড়ে। রক্তের স্বাদ জিহ্বায় অনুভব করে। তার সারা দেহ শিউরে ওঠে। আর আমি … আমি এই কৃপাণ দিয়ে … ছয় জনকে খুন করেছি।’ মনে-মনে উচ্চারণ করে ঈশ্বরসিং।
কুলবন্তের মাথায় শুধু দ্বিতীয় মহিলার ছবি, আমি জিজ্ঞেস করছি কে সেই হারামজাদি?’ ঈশ্বরসিং-এর চোখ ঢুলুঢুলু করছিল। তার মুখ হালকা উজ্জ্বল দেখায়, সে কুলবন্তকে বলে, সেই নিপাপকে তিরস্কার কর না।’ কুলবন্ত চিৎকার করে ওঠে, আমি জানতে চাই, সে কে?
ঈশ্বরসিং-এর গলার স্বর জড়িয়ে আসে, ‘বলছি’। এরপর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে তাজা রক্ত দেখে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মানুষও এক বিচিত্র জীব।
কুলবন্ত তখনও তার উত্তরের প্রতীক্ষায় ছিল; ‘ঈশ্বর সিয়া, তুমি কাজের কথা বল। ঈশ্বরসিং রক্তাক্ত গোঁফের ফাঁকে আবার মুচকি হাসে, কাজের কথাই বলছি। আমার গলা ধরে আসছে–এখন ধীরে-ধীরে সব কথাই বলব।’ কথা বলার সময় তার মাথায় চুলের গোড়ায় শীতল ঘামের প্রলেপ দেখা দেয়।
‘কুলবন্ত, আমার প্রিয় … আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না, আমার কী হয়েছে? মানুষ এক বিচিত্র জীব। শহরে লুটতরাজের সময় আমিও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। গহনাপত্র ও টাকা যা লুট করে এনেছি, সব তোমার হাতে দিয়েছি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলিনি।’ ঈশ্বরসিং কাটা ঘায়ের ব্যথায় ঝাঁকিয়ে ওঠে। কুলবন্ত কাউরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই–বরং রূঢ়কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করে, ‘কোন কথা?’
গোঁফে জমে যাওয়া রক্ত ফুঁ দিয়ে অপসারণ করে ঈশ্বরসিং বলে, ‘যে-বাড়িতে…আমি লুঠতরাজের মানসে প্রবেশ করেছিলাম…সেখানে সাতজন লোক ছিল। ছয়জনকে আমি খুন করি এই কৃপাণ দিয়ে; যেটা দিয়ে তুমি আমাকে … বাদ দাও সে সব কথা … শোনো … একটি সুন্দরী মেয়ে … তাকে তুলে আমি সঙ্গে নিয়ে আসি।’
কুলবন্ত কাউর নীরবে শুনতে থাকে। ঈশ্বরসিং আরেকবার ফুঁ দিয়ে গোঁফে জমাট রক্ত দূর করে বলে, কী বলব, দারুণ সুন্দরী মেয়েটি …তাকেও হত্যা করতাম। কিন্তু হায় …আমি তার রূপে মজে যাই।’ কুলবন্ত শুনে বলে, হু। এবং আমি তাকে তুলে নিয়ে চলতে থাকি রাস্তায় …কী জানি বলছিলাম? হ্যাঁ, রাস্তায় …নদীর তীরে একটি বৃক্ষের ছায়ায় তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখি।’ এ কথা বলতে বলতে ঈশ্বরসিং-এর। গলা শুকিয়ে আসে।
কুলবন্ত ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলে, তারপর কী হল?
ঈশ্বরসিং অতিকষ্টে ধীরকণ্ঠে বলে, কিন্তু…তার স্বর তলিয়ে যায়; কুলবন্ত কাউর ধমক দিয়ে বলে, তারপর কী হল?
ঈশ্বরসিং তার বুজে আসা চোখ মেলে কুলবন্তের দিকে তাকায়; তার দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাগে থরথর করে কাঁপছে। আসলে সে…মরে গিয়েছিল, সেটা ছিল তার মৃত লাশ…যেন ঠাণ্ডা গোশত…! কুলবন্ত আমাকে তোমার হাত ধরতে…দাও।’
কুলবন্ত কাউর নিজের হাত ঈশ্বরসিং-এর হাতে রাখে, তখন তার হাত বরফের চেয়ে অধিক ঠাণ্ডা, যেন ঠাণ্ডা গোশত।
আনন্দী – গোলাম আব্বাস
মিউনিসিপ্যালিটির সভা বেশ জমেছে। হল লোকে পরিপূর্ণ। অন্যান্য দিনের সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে প্রতিটি সদস্য আজ উপস্থিত রয়েছেন। আলোচনার বিষয়–শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত বেশ্যাদেরকে শহর থেকে অপসারণ করা। কারণ, এরা মানবতা, সংস্কৃতি আর আভিজাত্যের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কলঙ্কের মতো বিরাজ করছে।