কুলবন্ত কাউর মোটাসোটা গড়নের মহিলা। উজ্জ্বল দুটি চোখ। উপরের ঠোঁটে হালকা গোঁফের রেখা। একটু পরখ করলেই বোঝা যায় বড়ই রাশভারি মহিলা। ঈশ্বরসিং মাথা নিচু করে এককোণে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার পাগড়ি খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। হাতের মুষ্ঠিতে ধরে রাখা কৃপাণ ক্রমশ ঝুলে পড়ছে, অথচ তার দেহের গড়ন ও উচ্চতা দেখে মনে হয়, সে একজন সুঠাম দেহের অধিকারী যুবক। কিছুক্ষণ এমনি নীরবতায় অতিক্রান্ত হয়। কুলবন্তের উজ্জ্বল নয়নযুগল নেচে ওঠে। নীরবতা ভঙ্গ করে কুলবন্ত তাকে ডাকে, ঈশ্বর সিয়া।’ ঈশ্বরসিং চোখ তুলে তাকায়। কিন্তু কুলবন্তের তির্যক দৃষ্টির দিকে চেয়ে থাকা তার পক্ষে দুরূহ। তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
কুলবন্ত চিৎকার করে উঠল, ‘ঈশ্বর সিয়!’ স্বরটা সামলে নিয়ে খাট থেকে উঠে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?’ ঈশ্বরসিং শুষ্কঠোঁটে জিহ্বা ঘষে নিয়ে উত্তর দেয়, আমি জানি না।’ কুলবন্ত রেগে ওঠে, এটা কি কোনো জবাব হল?
ঈশ্বরসিং কৃপাণ একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং খাটে সটান শুয়ে পড়ে। তাকে দেখে মনে হয় সে অনেক দিন যাবত রোগে ভুগছে। কুলবন্ত খাটের দিকে তাকাল, সেখানে ঈশ্বরসিং শুয়ে ছিল। কুলবন্তের মনে সহানুভূতি ও আবেগের সঞ্চার হল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মায়াভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে তোমার কী হয়েছে বল তো।’
ঈশ্বরসিং ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর কুলবন্তের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে আর ডাকে, কুলবন্ত। তার কণ্ঠ বিষাদভরা।
কুলবন্তের চোখে প্রেমের আবেগ ফুটে ওঠে, জী, বল’, বলে সে সাড়া দেয়।
ঈশ্বরসিং পাগড়ি খুলে ফেলে। আশ্রয়কাতর দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকায়। মাংসল পেটে জোরে চড় মেরে, মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘মাথা বিগড়ে গেছে। মাথায় ঝাঁকুনির ফলে তার চুলের খোঁপা খুলে যায়। কুলবন্ত হাতের আঙুলে স্বামীর চুল আঁচড়াতে থাকে। এমনিভাবে স্বামীর চুলে আঙুল চালিয়ে প্রীতিভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ঈশ্বরসিং, এতদিন কোথায় ছিলে?’ কবিরে’, ঈশ্বরসিং কুলবন্ত কাউরকে ভীরু দৃষ্টিতে দেখতে থাকে এবং দু’হাতে তার দু বাহু জাপটে ধরে বলে, ‘গুরুর দিব্যি, তুমি অত্যন্ত বাজে মেয়ে!
কুলবন্ত কাউর এক পলকে ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার দিব্যি, বল, কোথায় ছিলে, শহরে গিয়েছিলে?’ ঈশ্বর চুলের খোঁপা তৈরি করতে গিয়ে উত্তর দেয়, কোথাও না।
কুলবন্ত রেগে বলে, তুমি নিশ্চয় শহরে গিয়েছ, বহু টাকা লুট করেছ। এখন আমার কাছে লুকোবার চেষ্টা করছ।’
বাপের জন্ম নই যদি তোমার সঙ্গে মিথ্যে বলি।’ কুলবন্ত চুপসে যায়। কিন্তু আবার হঠাৎ রেগে ওঠে, আমার বোধগম্য হচ্ছে না, সে রাতে তোমার কী হয়েছিল। বেশ ভালোই ছিলে। শহর থেকে লুণ্ঠিত সব অলঙ্কারপত্র আমার পরনে। হঠাৎ কি জানি তুমি উঠে দাঁড়ালে আর জামাকাপড় পড়ে কোথায় বেরিয়ে পড়লে।
ঈশ্বরসিং-এর চেহারা ফ্যাকাশে আকার ধারণ করে। কুলবন্ত তার এই পরিবর্তন দেখে বলে, ‘দেখলে, তোমার চেহারার রঙ কেমন পাল্টে গেল। ঈশ্বর সিয়া, দিব্যি করে বলছি, নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে।’
‘তোমার মাথার দিব্যি দিয়ে বলছি, সত্যিই কিছু হয়নি। ঈশ্বরসিং-এর কণ্ঠ প্রাণহীন। কুলবন্তের সন্দেহ আরও সুদৃঢ় হয়, ঠোঁট কামড়িয়ে জোরের সঙ্গে বলে, ঈশ্বর সিয়া, কী ব্যাপার বল তো, আটদিন আগে তুমি যেমন ছিলে এখন তো তেমন নেই।’
ঈশ্বরসিং উঠে বসে। যেন কেউ তাকে হামলা করেছে। কুলবন্তকে পাশে বসিয়ে বলে, কুলবন্ত আমার কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
কুলবন্তের অভিযোগ শেষ হয় না, বলে, তুমি সেদিন রাতে বাইরে কেন গিয়েছিলে? জাহান্নামে! বলছনা কেন?’
‘কিছু হলে তো বলব।’
‘আমাকে নিজ হাতে পুড়িয়ে মার যদি মিথ্যে বল।
ঈশ্বরসিং দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে এবং মুখখানি কানের কাছে নিয়ে গিয়ে চুপি-চুপি কী যেন বলে। গোঁফের কেশরাজি কুলবন্তের নাকে প্রবেশ করলে তার হাঁচি পায়। দুজনেই হেসে ওঠে।
ঈশ্বরসিং কুলবন্তকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে দেখতে থাকে; এখন অতীতের কথা ভুলে যাও।’
কুলবন্ত কাউরের উপরের ঠোঁটে শিশিরের মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। এক বিচিত্র ভঙ্গিতে চোখের পুতলি ঘুরিয়ে বলে, চল সন্ধি করি।’
ঈশ্বরসিং তার সুডৌল বাহু ধরে জোরে চাপ দেয়। কুলবন্ত কাউর চটপট করে একদিকে সরে পড়ে, ‘সরে যাও ঈশ্বর সিয়া। ব্যথা পাই।’ ঈশ্বরসিং আবার কুলবন্ত কাউরকে পাকড়াও করে পাশে বসায় এবং মিষ্টি আলাপে তার হৃদয় কোমল করার চেষ্টা করে। কুলবন্ত এই ততশামোদে গলে মোম হয়ে যায়।
কুলবন্তের উপরের ঠোঁট মৃদু কাঁপছিল। ঈশ্বরসিং-এর মনে হিংস্রতা জেগে ওঠে। সজোরে তার বাহু ধরে কচলান দিয়ে বলে, কুলবন্ত গুরুজির দিব্যি করে বলছি, তুমি বড় ভালো।’
কুলবন্ত তার বাহুতে চাপ দেয়ার ফলে সৃষ্ট লাল দাগ দেখে বলল, তুমি বড় নিষ্ঠুর ঈশ্বর সিয়া।
ঈশ্বরসিং ঘন কালো গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসে, তুমি কোনো অংশে কম নও।’ কুলবন্ত কাউর জ্বলন্ত আগুনে দেয়া কড়াইয়ের মতো জ্বলে ওঠে। অন্যদিকে ঈশ্বরসিং যেন কিসের ভাবনায় মগ্ন। সে কুলবন্তের উপস্থিতি পর্যন্ত ভুলে যায়। কুলবন্ত নিচু গলায় বলে ঈশ্বর সিয়া, তুমি কোন জগতে বিচরণ করছ?’