‘আজ কী ব্যাপার?’ মদন বিস্মিত।
‘কিছু না। ইন্দু মদনের নজর বাঁচিয়ে বলল–’আজ অবকাশ মিলেছে।‘
বিয়ের পর পনেরো বছর কেটে যাবার পর ইন্দুর আজ অবকাশ মিলেছে আর তা-ও যখন তার মুখের ওপর ছায়া পড়েছে। নাকের ওপর এক কালির মতো রেখা আর ব্লাউজের নিচে উন্মুক্ত পেটের কাছে কোমরে চর্বির দু-তিনটে স্তর দেখা যাচ্ছে। আজ ইন্দু এমন সাজগোজ করেছিল যাতে তার ত্রুটিগুলোর একটাও নজরে না-আসে। এইসব সাজ-গোজ, আঁটসাঁটভাবে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। এ হতে পারে না’–মদন ভাবল আর এ-চিন্তা তাকে আঘাত করল। সে আরেকবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ইন্দুর দিকে–যেভাবে ঘোড়ার ব্যাপারি কোনো নামী ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে দেখে। যেখানে যে গলদ ছিল মাতালের দৃষ্টিতে তা দেখা যাচ্ছিল না …ইন্দু সত্যিসত্যি সুন্দরী। পনেরো বছর বাদে আজ ফুলো, রশিদা, মিসেস রবার্ট আর তার বোনেরা তার সামনে জল ভরে নিচ্ছে…মদনের মনে দয়া এল, আর এল ভয়।
আকাশে মেঘ ছিল না কিন্তু বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছিল। ঘরের গঙ্গা বাড়তে শুরু করে তার জল কিনার ছাপিয়ে পুরো পার্বত্যভূমি আর পার্শ্ববর্তী বসতিগ্রাম আর শহরগুলোকে আপন গ্রাসের মধ্যে নিয়ে নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই তীব্র গতিতে স্রোত প্রবাহিত হতে থাকলে কৈলাস পর্বতও ডুবে যাবে। …এদিকে ছোট মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। এমন কান্না সে কাঁদেনি।
মদন তার কান্নার আওয়াজে দু চোখ বন্ধ করে আবার যখন খুলল তখন ছোট মেয়েটা সামনে দাঁড়িয়েছিল–যুবতী হয়ে। না, না…ও তো ইন্দু। আপন মায়ের মেয়ে, আপন মেয়ের মাসে তাকে চোখের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে দেখল, ঠোঁটের ফাঁকে হাসি নিয়ে দেখতে থাকল।
এই কামরায় ধুনোর ধোয়ায় একদিন মদনের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আজ ইন্দুর সাজগোজের সুগন্ধ তাকে পাগল করে দিল। হালকা বৃষ্টি ভারি বৃষ্টির চেয়ে বিপজ্জনক হয়ে থাকে। এইজন্য বাইরের জল ওপরের কোনো কড়িতে পড়ে ইন্দু আর মদনের মাঝখানে টপটপ করে পড়তে শুরু করল …কিন্তু মদন তো তখন মাতাল। এই নেশায় তার দু’চোখ ছোট হয়ে আসছিল আর শ্বাস পড়ছিল দ্রুত যেন তা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস নয়।
‘ইন্দু’ মদন বলল … তার কণ্ঠস্বর বিয়ের রাতের কণ্ঠস্বরের দুই গ্রাম ওপরে ছিল। ইন্দু দূরে চোখ মেলে বলল–’জি’, আর তার আওয়াজ ছিল দুই গ্রাম নিচে … আজ ছিল চাঁদনি রাতের বদলে অমাবস্যার রাত…
এর পরে মদন ইন্দুর দিকে হাত বাড়লে ইন্দু নিজেই মদনের সঙ্গে মিশে গেল। ফের মদন আপন হাতে ইন্দুর চিবুক তুলে ধরে দেখল, সে কী হারিয়েছে, কী পেয়েছে? ইন্দু মদনের কালী-হয়ে-যাওয়া মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলল … এ কী? মদন চকিত হয়ে বলল–’তোমার দু চোখ ফুলে গেছে।’
‘এমনিই’। ইন্দু ছোট মেয়ের দিকে ইশারা করে বলেছিল–এই হতভাগী আমায় সারা রাত জাগিয়ে রেখেছে…’
মেয়েটা এখন চুপ করে আছে। মনে হচ্ছে দম নিয়ে দেখছে এখন কী হতে পারে? আকাশ থেকে জল পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মদন ফের সযত্নে ইন্দুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল–’হাঁ…কিন্তু এই অশ্রু?’
‘খুশিতে।’ ইন্দু জবাব দিয়েছিল–’আজকের রাত আমার’–ফের এক অদ্ভুত হাসি হেসে সে মদনকে আঁকড়ে ধরেছিল। কেমন এক আনন্দের অনুভূতিতে বলল মদন–আজ অনেক বছর পরে আমার মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হল, ইন্দু। আমি হামেশা চেয়েছিলাম
‘কিন্তু তুমি তো বলনি।’ ইন্দু বলল, মনে আছে, বিয়ের রাতে আমি তোমার কাছে কিছু চেয়েছিলাম?
‘হ্যাঁ–মদন বলল–’তোমার দুঃখ আমাকে দাও।’
‘তুমি তো আমার কাছে কিছু চাওনি।’
‘আমি!’ মদন বিস্মিত হয়ে বলল–’আমি কী চাইব? আমি যা কিছু চাইতে পারতাম সবই তুমি আমায় দিয়েছ। আমার আত্মীয়জনের প্রতি ভালোবাসা–তাদের লেখাপড়া, বিয়েশাদি–এইসব সুন্দর বাচ্চা–এইসব কিছুই তো তুমি দিয়েছ।
‘আমিও তো তাই বুঝতাম।’ ইন্দু বলল–’কিন্তু এখন আমি জানতে পেরেছি, এইসব নয়।’
কী বলতে চাইছ?’
‘কিছু না ইন্দু থেমে গিয়ে ফের বলল—
‘আমি একটা জিনিস রেখেছি।’
‘কী জিনিস রেখেছ?’
ইন্দু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল–’আমার লজ্জা …আমার খুশি … ওই সময় তুমিও তো বলে দিতে পারতে … তোমার সুখ আমাকে দাও … তা হলে আমি …বলতে-বলতে ইন্দুর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।
আর কিছুক্ষণ পরে ইন্দু বলল–’এখন তো আমার কাছে কিছুই রইল না।
মদনের ধরা-হাত শিথিল হয়ে গেল। সে যেন মিশে গেল মাটিতে–এই অশিক্ষিত স্ত্রীলোক–এ কি কোনো মুখস্থ করা কথা–?
তো … এ তো এখনি তার সামনে জীবনের ভাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন তো তার ওপর বারবার হাতুড়ি পড়ছে আর চারিদিকে উড়ছে আগুনের ফুলকি …।
কিছুক্ষণ পরে মদনের হুঁশ ফিরে এলে সে বলল–’আমি বুঝেছি ইন্দু।’
তারপর কাঁদতে-কাঁদতে মদন আর ইন্দু পরস্পরের সঙ্গে মিশে গেল। ইন্দু মদনের হাত ধরে তাকে এমন দুনিয়ায় নিয়ে গেল যেখানে মানুষ মরে গিয়েই পৌঁছতে পারে।
অনুবাদ : ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
ঠাণ্ডা গোশত – সাদত হাসান মান্টো।
ঈশ্বরসিং হোটেলের কামরায় প্রবেশ করতেই, কুলবন্ত কাউর পালং থেকে উঠে দরজার খিল বন্ধ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। রাত তখন ১২টা। সারা শহরে নীরবতা
কিছুক্ষণ দেখে কুলবন্ত কাউর খাটের উপর ধপাস করে বসে পড়ে। ঈশ্বরসিং বিশ্রী এক চিন্তার ধকল থেকে মুক্তির চেষ্টা করছিল; কৃপাণ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণে। কিছু সময় কেটে গেল, কুলবন্তের উপবেশনের আসন মনঃপুত হওয়ায় সে দু পা পালং-এর নিচের দিকে ঝুলিয়ে নাড়তে থাকে। তবুও ঈশ্বরসিং-এর মুখে কোনো রা নেই।