বাবু ধনীরাম ছুটিতে বাড়িতে ফিরে এলেন। তাঁকে আগের তুলনায় আধখানা দেখাচ্ছিল। ইন্দু তার কোলে বাচ্চাকে তুলে দিলে উনি খুশি হয়ে উঠলেন। তার পেটের ভিতর এমন এক ফোঁড়া হয়েছিল যা চব্বিশ ঘণ্টা তাকে শূলের ওপর চড়িয়ে রাখত। যদি বাচ্চা না-থাকত তবে বাবুজির দশগুণ বেশি খারাপ অবস্থা হত।
কয়েকবার চিকিৎসা করা হল। শেষ চিকিৎসায় ডাক্তার বাবুজিকে আধ আনা মাপের পনেরো-বিশটা গুলি রোজ খেতে দিয়েছিলেন। প্রথম দিনই তার এত ঘাম হয়েছিল যে, দিনে তিন-চারবার কাপড় বদলাতে হত। প্রতিবার মদন কাপড় খুলে নিয়ে বালতিতে নিঙড়াত। কেবল ঘামেই বালতির এক-চতুর্থাংশ ভরে যেত। রাতে তাঁর বমি-বমি ভাব হল আর তিনি চিৎকার করে বললেন–’বউমা, একটা দাঁতন দাও। জিভের স্বাদ বড় খারাপ লাগছে। বউমা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁতন নিয়ে এল। বাবুজি উঠে দাঁতন চিবোতে শুরু করলেন, এমন সময় বমি এল, বমির সঙ্গে রক্তও এল। তাড়াতাড়ি তাকে শিয়রের দিকে শুইয়ে দেয়া হল। তাঁর চোখের মণি উল্টে গেল। আর কয়েকবার দমকের পরেই তিনি আকাশের ফুলবাগানে পৌঁছে গেলেন, সেখানে তিনি নিজের ফুলটি চিনে নিয়েছিলেন।
বাচ্চার জন্ম হবার পর মোটে বিশ-পঁচিশ দিন হয়েছে। ইন্দু মুখ চাপড়ে কপাল আর বুক চাপড়ে বিবর্ণ করে তুলল নিজেকে। মদনের চোখের সামনে ছিল সেই দৃশ্য–যা রোজ তার খেয়ালে নিজের মৃত্যুর পরের দৃশ্য হয়ে উঠেছিল। তফাত এই ছিল যে, ইন্দু চুড়ি ভেঙে ফেলার বদলে খুলে রেখে দিয়েছিল। মাথায় ছাই দেয়নি। কিন্তু জমিতে আছড়ে পড়ে সারা শরীরে মাটি লেগে যাওয়ায় আর চুল ছড়িয়ে পড়ায় চেহারা ভয়ানক হয়ে গিয়েছিল ইন্দুর। সবাই দেখ আমি সব হারিয়েছি’-র বদলে সবাই দেখ আমরা সব হারিয়েছি’—
ঘরের বাইরের কত বোঝা তার ওপর এসে পড়েছিল, তার পুরো আন্দাজ মদনের ছিল না। সবাক থেকেই তার হৃৎপিণ্ড এক লাফে মুখে এসে গিয়েছিল। সে বোধহয় বাঁচতে পারত না যদি সে ঘরের বাইরে নালার ধারে ভিজে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে নিজের হৃদয় নিজের জায়গায় নিয়ে না আসত। ছোট বাচ্চা কুন্দন, খুকি দুলারি আর পাশী এমনই চেঁচাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল পাখির বাসায় শিক্রে বাজের আক্রমণে পাখির ছানাগুলো ঠোঁট তুলে চি-চি করছে। যদি কেউ তাদের পাখার নিচে সামলে রাখতে পারে তো সে ইন্দু–নালার ধারে পড়ে থেকে মদন ভাবছিল, এখন তো আমার কাছে এ দুনিয়া শেষ হয়ে গেল। কী, আমি কি আর বাঁচতে পারব? জীবনে আর কোনোদিন হাসতে পারব? সে উঠে ঘরের ভিতরে চলে গেল।
সিঁড়ির নিচে ছিল স্নানের ঘর। সেখানে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করতে-করতে মদন ফের একবার এই কথা মনে-মনে আওড়াল : আমি আর কখনো হাসতে পারব? আর সে খিলখিল করে হাসছিল, যদিও তার বাপের মৃতদেহ তখন পর্যন্ত বৈঠকখানায় পড়ে ছিল।
বাপকে আগুনে সঁপে দেয়ার আগে মদন মেজের উপর পড়ে থাকা মৃতদেহের সামনে দণ্ডবতের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়েছিল। তার জন্মদাতার কাছে এই ছিল তার শেষ প্রণাম, তখন সে আর কাঁদল না। তার এই অবস্থা দেখে শোকের অংশীদার সব আত্মীয়স্বজন, পাড়ার লোক বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল।
তারপর হিন্দু প্রথা অনুসারে সর্বজ্যেষ্ঠ হবার কারণে মদনকেই চিতায় আগুন দিতে হল। জ্বলন্ত মাথার উপর কপাল-ক্রিয়ার লাঠি মারতে হল। মেয়েছেলেরা বাইরে শ্মশানের কূপের জলে স্নান করে ঘরে ফিরে গেল। যখন মদন ঘরে পৌঁছল তখন সে কাঁপছিল। ধরিত্রী-জননী কিছুক্ষণের জন্য যে শক্তি আপন সন্তানকে দিয়েছিলেন রাত এসে যাবার পর তা বিক্ষিপ্ততায় অবসিত হয়ে গেল… তার কোনো সাহায্য প্রয়োজন ছিল। কোনো এক রকম ভাবনার অনুষঙ্গ যা মৃত্যুর চেয়েও বড়। ওই সময় ধরিত্রী-জননীর কন্যা জনকতনয়া ইন্দু যেন কোনো ঘড়া থেকে জন্ম নিয়ে ওই রামকে নিজের দু-বাহুর মধ্যে টেনে নিল। এ রাতে যদি ইন্দু আপন অস্তিত্ব মদনের ওপর উৎসর্গ করে না-দিত তবে এত বড় দুঃখ মদনকে ডুবিয়ে দিত নির্ঘাত।
দশ মাসের মধ্যেই ইন্দুর দ্বিতীয় সন্তান চলে এল। স্ত্রীকে এই নরকের আগুনে ঠেলে দিয়ে মদন নিজের দুঃখ ভুলে গেল। কখনো কখনো তার মনে হয়েছে আমি যদি বিয়ের পর বাবুজির কাছ থেকে ইন্দুকে ডেকে নিয়ে না-আসতাম তবে বোধহয় এত শীঘ্র তিনি মারা যেতেন না। কিন্তু সে বাপের মৃত্যুতে যে লোকসান হয়েছে তা পূরণ করার কাজে লেগে গিয়েছিল। আগে অযত্নের ফলে কারবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এ বিষয়ে মদনের বিবশতা চলে গেল।
একদিন বড় ছেলেকে মদনের কাছে রেখে দিয়ে ছোট বাচ্চাকে বুকে নিয়ে ইন্দু বাপের বাড়ি গেল। পরে মুন্না বারবার জিদ করলে মদন কখনো তা মেনে নিত, কখনো নিত না। বাপের বাড়ি থেকে ইলুর চিঠি এল–’আমার এখানে ছেলের কান্নার আওয়াজ আসছে। ওকে কেউ মারে না তো…?’ মদন বড় বিস্মিত হল, এক মূর্খ অশিক্ষিত স্ত্রীলোক … এরকম কথা কী করে লিখতে পারে? ফের সে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিল–’এ-ও বোধহয় কোনো মুখস্থ-করা কথা।’
এভাবে এক বছর কাটল। কখনো এত আয় হয়নি যে তা দিয়ে কোনো আয়েশ করা যেতে পারে। কিন্তু সংসার-নির্বাহের মতো আয় নিশ্চয়ই হয়ে যেত। কষ্ট হত তখনি যখন কোনো বড় খরচ সামনে দেখা দিত। …কুন্দনকে স্কুলে ভর্তি করানো আছে, দুলারি- মুন্নিকে ভালো দিন দেখে পাঠানো হয়েছে। ওই সময় মদন মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকত, আর ইন্দু একদিক থেকে এসে মুচকি হেসে বলত–কেন দুঃখ করছ? মদন তার দিকে আশাভরা নজরে তাকিয়ে বলত–দুঃখী হবে না? কুন্দনের বি এ ক্লাশে ভর্তি করানো আছে …মুন্নি …’ ইনু ফের হেসে বলত, চল আমার সঙ্গে’–আর মদন ভেড়ার বাচ্চার মতো ইন্দুর পিছনে পেছনে চন্দনের সিন্দুক পর্যন্ত যেত। ওই সিন্দুকে মদন সমেত কারুরই হাত দেয়ার অনুমতি ছিল না। কখনো কখনো এই বিষয়ে ক্ষেপে গিয়ে মদন বলত–মরবে তো ওই সিন্দুক বুকে করে নিয়ে যাবে’, ইন্দু বলত–’হাঁ, নিয়ে যাব। তারপর ওই সিন্দুক থেকে প্রয়োজন মতো অর্থ বার করে রাখত সামনে।