‘বাবুজি খুশি হও…ছেলে হয়েছে।’
‘ছেলে?’ মদন বলল। উদ্বেগের স্বরে ফের জিজ্ঞেস করল–’বউ কেমন আছে?’
বেগম বলল–’ভগবানের দয়ায় ভালো আছে। এখন পর্যন্ত প্রসূতিকে ভালো রেখেছেন। পেটের ছেলে বেশি খুশি হয়ে গেলে ওর পেটের ফুল পড়ত না…’
‘ও। মদন বোকার মতো চোখ মিটকে বলল, আবার কামরার দিকে যাবার জন্যে এগোল। বেগম ওকে সেখানেই থামিয়ে দিয়ে বলল–’অন্দরে তোমার কী কাজ?’ তারপর হঠাৎ দরজা বন্ধ করে চট করে ভিতরে চলে গেল।
তখন পর্যন্ত মদনের পা কাঁপছিল। ভয়ের জন্য নয়, সান্ত্বনায়, আর বোধহয় এজন্য যে, এই দুনিয়ায় কোনো আগন্তুক এলে আশেপাশের লোকের এই অবস্থাই হয়। মদন শুনেছিল যখন ছেলে হয় তখন ঘরের দরজা আর দেয়াল কাঁপে। তখন ভয় হয় যে বড় হয়ে ওই ছেলে আমাকে বেচে দেবে, না রাখবে। মদন অনুভব করল যেন সত্যিসত্যি দেয়ালগুলো কাঁপছে। সূতিকাঘরে চকলি-বৌদি আসেনি, কারণ তার নিজের বাচ্চা খুবই ছোট ছিল। হাঁ, দরিয়াবাদী পিসি অবশ্যই পৌঁছেছিল। বাচ্চার জন্মের সময় সে রাম-রাম রাম-রাম রটনা করতে লাগল। আস্তে-আস্তে সে শব্দও ক্ষীণ হয়ে আসে।
সারা জীবনে আর কখনো মদনের এমন ব্যর্থ আর বেকার বলে মনে হয়নি নিজেকে। এর মধ্যে ফের দরজা খুলে পিসি বেরিয়ে এসেছিল। বারান্দায় বিজলিবাতির মৃদু আলোয় তাকে ভূতের চেহারার মতো একদম দুধ-শাদা দেখাচ্ছিল। মদন তার পথ আগলে বলল–’পিসি, ইন্দু ঠিক আছে, না?’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ পিসি তিন-চারবার বলে নিজের কম্পিত হাত মদনের মাথায় রেখে তাকে নামিয়ে আনল, চুমু খেল আর বাইরে চলে গেল দ্রুত।
বারান্দার দরজা থেকে পিসিকে বাইরে যেতে দেখা গেল। সে বৈঠকখানায় গিয়ে দেখল বাচ্চারা ঘুমিয়েছে। পিসি এক-এক করে প্রত্যেকের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে ছাদের দিকে চোখ তুলে কিছু বলল, তারপর শ্রান্ত হয়ে খুকির পাশে শুয়ে পড়ল। তার দুটি ঠোঁটের ওঠা-নামা থেকে বোঝা যাচ্ছিল, সে কেমন করে কাঁদছে…মদন বিস্মিত হল…পিসি তো অনেক জায়গায় দিন কাটিয়েছে, তবে কেন আজ তার আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠছে?
ওদিকের কামরা থেকে ধূনোর গন্ধ এসে ছেয়ে ফেলে মদনকে। বেগম দাই কাপড়ে কিছু জড়িয়ে নিয়ে বাইরে আসে। তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় মদন। তার খেয়াল ছিল না সে কোথায় রয়েছে। দু চোখ খুলে তাকিয়েছিল কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। এর মধ্যে ইন্দুর এক মরার মতো আর্তনাদ ভেসে এল—’হা…য়’। আবার বাচ্চার কান্নার শব্দ।
তিন-চার দিনের মধ্যে অনেক কিছু ঘটল। মদন ঘরের এক দিকে গর্ত খুঁড়ে ফুল পুঁতে ফেলল। অন্দরে কুকুরগুলোকে বাধা দিল আসতে। কিন্তু তার কিছুই খেয়াল ছিল না। তার মনে হয়েছিল ধূনোর গন্ধ মাথায় ঢুকে যাবার পর আজই তার হুঁশ ফিরে এসেছে। কামরায় একা সে আর ছিল ইন্দু, নন্দ আর যশোদা–আর অন্যদিকে ছিল নন্দলাল…ইন্দু বাচ্চার দিকে তাকিয়ে দেখে জানবার চেষ্টায় বলল–একেবারে ঠিক তোমার মতোই হয়েছে…’।
হতে পারে।’ মদন বাচ্চার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল–’আমি তো বলছি এ হল ভগবানের দয়া। তুমি বেঁচে গেছ।
‘হ্যাঁ, ইন্দু বলল–’আমি তা বুঝেছি…’
‘শুভ-শুভ বল’, মদন একদম ইন্দুর কথা কেটে দিয়ে বলল–এখানে যা-কিছু হবার হয়েছে, আমি তো তোমার কাছে আসব না।’ একথা বলে মদন দাঁতের তলায় কথা চেপে নিল।
‘চুপ কর।’ ইন্দু বলল।
মদন তা শুনে দু হাতে কান চেপে ধরল আর ইন্দু হাসতে লাগল হালকা আওয়াজে।
ছেলে হবার পর কয়েকদিন পর্যন্ত ইন্দুর নাভি ঠিক জায়গায় আসেনি। সে ফিরে-ফিরে ওই বাচ্চার এমন তদারকি করছিল যে, এর পরে ও বাইরের দুনিয়ায় গিয়ে নিজের আসল মাকে ভুলে গিয়েছিল।
এখন সবকিছু ঠিকঠাক। ইন্দু শান্তির সঙ্গে চারদিকে চোখ তুলে তাকায়। মনে হয়েছিল সে কেবল মদনের নয়, দুনিয়ার সকল অপরাধীকে মাফ করে দিয়েছে, আর লোকের ভালো হবার ওষুধ আর করুণা বিতরণ করছে। মদন ইন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে–এই সব রক্তস্রাবের পর ইন্দু কিছু দুর্বল হয়ে গিয়ে তাকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। হঠাৎ ইন্দু দু হাত নিজের বুকের উপর রাখল।
‘কী হল?’ মদন শুধায়।
‘কিছু না।’ ইন্দু কিছুটা উঠে বসবার চেষ্টা করে বলল–’ওর খিদে পেয়েছে। বাচ্চার দিকে ইশারা করল ইন্দু।
‘এর–খিদে?’-মদন একবার বাচ্চার দিকে দেখে ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল–’তুমি কী করে জানলে?’
‘দেখছ না’, ইন্দু নিচের দিকে নজর রেখে বলল–সব ভিজে গেল।’
মদন সতর্কভাবে ইন্দুর ঢিলে-ঢালা বুকের দিকে তাকাল। দুটি স্তনই দুধে ভরে আছে, আর গন্ধ আসছে। ইন্দু বাচ্চার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল–’ওকে আমার কাছে দিয়ে দাও।
মদন কড়াইয়ের আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে তার তাপ নিল। তারপর কিছুটা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে বাচ্চাকে তুলে নিল যেন একটা মরা ইঁদুর। শেষ পর্যন্ত ইন্দুর কোলে বাচ্চাকে তুলে দিল। ইন্দু মদনের দিকে তাকিয়ে বলল–’তুমি বাইরে যাও!
‘কেন? বাইরে কেন যাব?’ মদন জিজ্ঞেস করে।
যাও না…’ ইন্দু কিছু গর্বের সঙ্গে, কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলল–তোমার সামনে আমি বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারব না।’
‘আরে!’ মদনের বিস্ময় কণ্ঠে–’আমার সামনে খাওয়াতে পারবে না?’ তারপর অবুঝভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বাইরের দিকে চলে গেল। দরজার কাছাকাছি পৌঁছে সে আবার ইন্দুর দিকে তাকাল–আজ পর্যন্ত ইন্দুকে এত সুন্দর লাগেনি।