নারীমূর্তিটি আর কেউ নয় তার সেই পলায়িতা স্ত্রী। যাকে তিন মাস আগে হঠাৎ দেখে ভেবেছিল গোর থেকে বেরিয়ে এসেছে। দু’বেলা ভালো খাবার খেয়ে, ভালো ভালো সাবান, ক্রিম এবং আরো নানান প্রসাধনী দ্রব্য ব্যবহার করার দরুন তার খোয়ানো রঙ রূপ আবার ফিরে এসেছে। নরম মাংসে গাল অনেক পুরে গছে এবং চোখজোড়া আবার নব জীবনের আলোয় চমকাচ্ছে। তার বর্তমান রূপযৌবন– যেন বিয়ের প্রথম রাতের রূপযৌবন; প্রভেদ শুধু প্রথম তার চেহারায় একরাশ পবিত্রতা উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই পবিত্রতা, সেই নিষ্পাপতার জায়গায় একটা সূক্ষ্ম গাম্ভীর্যতা, একটা হৃদয়গ্রাহী অনুতপ্ততা বিরাজিত।
তখনো সন্ধ্যা উতরোয়নি। জুয়েলারির দোকানের কাছে এসে পৌঁছল সে। বিভিন্ন দোকানে তখন লেনদেন, বেচাকেনা চলেছে পুরাদস্তুর। গ্রাহক ছাড়া একটা দোকানও খালি নেই। এর আগে আর কোনো জিনিস বিক্রি করার সুযোগ তার হয়নি– তাই সে দোকানে ঢুকবে কি ঢুকবে না ইতস্তত করছিল, কিন্তু লোকের এ ভিড় দেখে সে আরো ঘাবড়ে গেল। এত লোকের সামনে আংটি বিক্রির কথা কী করে বলা যায়। মানুষ আবার না জানি কী মনে করে বসে।
সে প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো ঘুরতে থাকল বিভিন্ন দোকানের আশপাশে। গ্রাহক দু’চার জন বেরিয়ে গেলে পরমুহূর্তে আবার দু’চার জন এসে ঢোকে। এ ভিড় আগের মতোই। শেষ পর্যন্ত একটা দোকানে সে দেখল গ্রাহক অপেক্ষাকৃত কম। এবং অনেক সাহসের ভর করে সে ওখানে ঢুকে পড়ল।
‘বলুন,– আপনার কী প্রয়োজন?’– জহুরি জিজ্ঞেস করল।
‘আমি–আমি কানের দুল দেখতে চাই’– সে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল। পরে জহুরি দুলের বাক্সের ভিড় জমিয়ে তুলল।
‘এ জোড়ার দাম কত?’ অগত্যা একজোড়া দুল পছন্দ করে বলল সে।
‘পঁয়ষট্টি টাকা।’
‘বাস, এটাই ঠিক। কিন্তু মাফ করবেন– সাথে টাকা আনতে ভুলে গেছি আমি, আপনি এ জোড়া আলাদা করে রাখুন। কালকে এসেই নিয়ে যাব।’
‘ঠিক আছে, ও কিছু না– ও কিছু না।’– জহুরি বাক্সগুলো তুলতে তুলতে নিস্পৃহ গলায় বলল।
দোকান থেকে বেরিয়ে সে লম্বা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
রাত তখন অনেক হয়ে গেছে। সে ভাবল আজকের প্রোগ্রামটা বাতিল করে দিতে হয়। কাল কোনো কর্মচারী দিয়েই বরং আংটিটা পাঠাব। অথবা কালকে কোনো একটা উপলক্ষে টাকা কিছু পেয়েও যেতে পারি।
প্রতি পদক্ষেপে তার আকাঙ্ক্ষার পরাজয় ঘটতে লাগল। এবং চলতে চলতে সে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মন তার দুঃখে ভারাক্রান্ত নয়। বরং তার মন-মেজাজ এক অদ্ভুত উৎফুল্লতায় সক্রিয়। সেই রূপোপজীবিনীর প্রকোষ্ঠ এখান থেকে সামান্য দূরে। হঠাৎ সেই বেশ্যার কথা তার মানসপটে ভেসে উঠল। তার কাছে না গেলেও অন্তত দূর থেকে হলেও তার রংঢং দেখার ইচ্ছে জাগল তার মনে।
অন্যান্য দিনের মতো আজকেও সেই পল্লিটা ঝকঝক করছে। আর পুরুষ পরওয়ানার মতো আলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কোনো কোনো প্রকোষ্ঠের খোলা বাতায়ন দিয়ে হালকা নীল আলো বাইরে অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো কোনো ঘর থেকে নরনারীর সম্মিলিত কলহাস্যের ফাঁকে ফাঁকে সারেঙ্গির তারের ঈষৎ ঝংকার বাতাসের সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
সে ধীর পদবিক্ষেপে হাঁটছে। হাঁটছে প্রতিটি ঘরের সামনে দিয়ে। এবং প্রতিটি বেশ্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানকার প্রায় বেশ্যার সাথে সে পরিচিত। এবং অনেকের প্রকোষ্ঠেই তার পদধূলি পড়ে। কিন্তু আজ সে খুব জোরে জোরে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
নিষিদ্ধ পল্লির শেষ প্রান্তে এসেই হঠাৎ তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ল। এবং তার পরনের সেই বেগুনি রঙের নকশাযুক্ত শাড়িটিও। নেহাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেই বেশ্যাদের সাথে তার স্ত্রীর তুলনায় লেগে গেল তার মন।
এ পর্যন্ত সে যত মেয়ে দেখেছে প্রত্যেকের রংঢং নাটকের নায়িকাদের মতো মনে হয়েছে তার। ওদের যত বেশি দূর থেকেই দেখেছে তত বেশি প্রবঞ্চক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তাদের তুলনায় তার কাছে মনে হয়েছে তার স্ত্রী অনন্যা। তাদের মুখের কৃত্রিম তিলকের ছড়াছড়ি হয়তো তার স্ত্রীর মধ্যে নেই, কিন্তু তাই বলে তার মুখের লাবণ্য তাতে এতটুকুও ম্লান নয়। এবং সে শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েদের বেহায়াপনা আচরণ তার স্ত্রীর মধ্যে নেই। আর তাদের সাজসজ্জার প্রতিও তার মনে ঘৃণার উদ্রেক করে। কেউ-বা চেহারায় একরাশ পাউডারের প্রলেপ লাগিয়ে রাখে, কেউ-বা তেরছি সিঁথি বের করে রাখে, চুলের মধ্যে ডজনে ডজনে ক্লিপ আর পিন গেঁথে রাখে। অবশ্য দু’একখানা সুন্দর চেহারা যে নেই তা নয়। কিন্তু তাদের পোশাক-পরিচ্ছদের না আছে কোনো রীতি-নীতি, না আছে রঙ-পছন্দে গভীর আন্তরিকতা। সব আজেবাজে রঙের সমাবেশ। কেউ কেউ তো গ্রাম্য মেয়েদের মতো একরাশ অলংকারে ভারি হয়ে থাকে।
হৃদয়ে ভাসমান স্ত্রীর ছবি নিয়েই সে বাড়ির দিকে এগুচ্ছিল। হঠাৎ বিয়ের প্রথম জীবনের কথা তার চোখের সামনে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল। কী অদ্ভুত মাদকতায় ভরা সেই জীবন! যখন দাম্পত্য-জীবনের আনন্দ প্রথমবার তার সমস্ত হৃদয়মনে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং হৃদয় তার ঝড়ে-পাওয়া পাতার মতো কেঁপে উঠেছিল। সেই রাতের বিলম্বিত মুহূর্তে পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেই কাটিয়ে দেয়ার মুহূর্ত। ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে যেতে সে পথ চলতে থাকল।