সে পালিয়ে যাবার পর থেকেই তার দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল সেই ভাগ্যবানটি কে, যার ভালোবাসার পুরস্কার তাকে দিয়েছে। হতে পারে সে তার বন্ধুদের একজন। অথবা কোনো আগন্তুক। কিন্তু এখন তাকে এ অবস্থায় দেখে আর সেরকম অনুসন্ধানের কোনো ইচ্ছা তার মনে উদয় হল না। সে সমস্ত ব্যাপারটাকে বিরক্তিকর বলে মনে করছে। তার ইচ্ছা অতিদ্রুত এ মেয়েটি তার সঙ্গ ত্যাগ করুক।
সে বলে যেতে লাগল– ‘তোমার ভদ্রতা এবং নিষ্পাপ হৃদয়তার ওপর আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, তুমি নিশ্চয় আমাকে তোমার ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবে না। এ ঘর ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর অন্য কোনো আশ্রয় নেই। এ ঘর থেকে চলে গিয়ে আমি বড় কষ্ট করেছিলাম। তুমি আমার ওপর চাকরানির মতো ব্যবহারে কর! আহ্! আমি তারই উপযুক্ত।’
‘এত জোরে চেঁচিও না, চাকর শুনে ফেলবে।
অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছিল। সে জোর করে নিজের পা-জোড়া ছাড়িয়ে নিল। অতি মোলায়েমভাবে যাতে মেয়েটির কোনো চোট না-লাগে। টুপিটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
অফিসে তার স্ত্রীর সেই কান্নার অবস্থাটা বারবার তার মনের আনাচে-কানাচে ফিরতে লাগল। তার কাছে বড় আশ্চর্য লাগছে। একি শৈশবকালের সেই চঞ্চল সুন্দরী মেয়েটি– যার সাথে ছ’মাস আগে তার প্রেম ছিল? একি সেই তন্বী প্ৰিয়তমা যে সুরভীর প্রেমে সে পাগল ছিল! সে নিজের দেহে সামান্য ধুলোও সহ্য করতে পারত না! এবং যার সাথে বাগানের ছোট পথ দিয়ে ভ্রমণ করার সময় গৌরবে নিজের বুক ফুলে যেত!
‘অগত্যা সে যদি আমার সাথে থাকতেই চায়।’ সে মনে মনে বলল– ‘তাহলে এমনিই থাকুক। আমি এত নীচ নই যে তাকে সামান্য রুটি আর কাপড় থেকে বঞ্চিত করব। তবে একথা সত্য যে, তার সাথে আমি কোনো সম্পর্ক রাখব না। আমি জানি, অবশ্য আমার একান্ত ইচ্ছাও সে আমার অমনোযোগিতা, অবহেলায় দুঃখ পেয়ে বিষণ্ন বদনে অথবা আমার ভর্ৎসনা সহ্য করতে না-পেরে একসময় তাড়াতাড়ি আবার পালিয়ে যাবে।’
তার স্ত্রী ফিরে আসার পর প্রায় দু’সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেছে। অথচ সে একটি বারের জন্যও তার দিকে ফিরে তাকায়নি। যেন ঘরে সে নেই-ই। এদিকে কিন্তু তার স্ত্রী তার সামান্য সান্নিধ্যের জন্য উন্মুখ। কিন্তু তার উপস্থিতি মনের কল্পনায় জিইয়ে রেখেই সে দিন কাটিয়ে দিতে লাগল।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে শিয়রে তেপায়ার উপর রাখা ফুলদানির ওপর। ফুলদানিতে সুন্দর সুন্দর সতেজ ফুল যত্নের সাথে সাজানো থাকে। সে তখন মাত্র বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় কাগজ নিয়ে বসে, ঠিক তখনি চাকর চা নিয়ে আসে। সুন্দর করে কাটা আগুনে-সেঁকা টোস্ট। আর চা– যা প্রথম প্রথম বিয়ের সময় তার ভাগ্যে জুটত। সে বাথরুম থেকে এসে ড্রয়িংরুমে যেতে যেতে দেখে সব জিনিস থরে থরে সাজানো। শার্ট বা স্যুটের সাথে ম্যাচ করা নেকটাই এবং রুমাল। পালিশ করা জুতো।– দুপুরে চাপরাসি বাসা থেকে খাবার নিয়ে যায়। তখন তার প্রিয় শবজি এমন সুস্বাদুভাবে পাকানো থাকত যে, জিহ্বা চুক্ চুক্ করে আওয়াজ দিয়ে ওঠে।
এসব কাণ্ডকারখানায় তার অধরপ্রান্তে এক টুকরো দুঃখের হাসি ফোটে এবং সে মনে মনে বলে– ‘এসব আদর-যত্ন করছে নেহাত আমাকে দ্বিতীয়বার বাধ্য করার জন্যে। কিন্তু এ বান্দা আর এসব চমকে ভুলবে না।’
সে প্রায় সন্ধ্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং রাত একটা-দুটোর আগে খুব কম সময়ই ফিরে আসে। কোনো সময় সমস্ত রাতই বাইরে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু তাতে বাধা দেয়ার বা অনুসন্ধান করার কেউ নেই। অতএব তার এ আরাম-আয়েশের কোনো ঘাটতি দেখা যায় না।
এভাবেই ধীরে ধীরে তিন মাস অতিবাহিত হয়ে গেল।
বর্ষাকাল। অতএব একদিন সমস্ত আকাশ মেঘে ছেয়ে ফেলেছে এবং কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। সে অফিসে একটা মোটা অঙ্কের চেক কেটে চাপরাসিকে দিয়ে বড় উদ্বিগ্নচিত্তে সময় কাটাতে লাগল। গত আট দিন একটা রাতও সে ঘর থেকে বের হয়নি। দীর্ঘক্লান্তির অবসাদ, কখনো-বা আলসে করে অনেকক্ষণ পর্যন্ত অফিসে বসে থেকেছে। কখনো-বা মন চায়নি তাই সব দিনের আরাম সুদে-আসলে আজকে উসুল করে নেবে।
কিছুক্ষণ পর চাপরাসি খালি হাতে ফিরে এল। তার চেক ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ তার হিসাবে আর মাত্র কয়েক টাকা আর আনা পাই ছাড়া কিছুই বাকি নেই।
তার এ পরিণতি সম্বন্ধে সে-ও সচেতন ছিল। কিন্তু পরিণতিটা যে এত সকালে এসে যাবে তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। কারো কাছ থেকে ধার নেয়ার কথা ভাবল সে এবং সঙ্কোচচিত্তে দু’একজনের কাছে ফোনে নিজের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল। কিন্তু মাসের শেষ অতএব এখন এত টাকা কোথায়!
হঠাৎ মনে পড়ল তার বাক্সে একটা সোনার আংটি পড়ে আছে— যার উপর দামি একটা পাথর বসানো। এটা তার স্ত্রী উপহার দিয়েছিল তাকে। যখন স্ত্রীর সাথে আত্মীয় সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে গেছে তখন এই স্মৃতিটাই-বা আর রাখে কেন?
যে-বাসনার আগুন একটু আগে ধিমা হয়ে গিয়েছিল এ মুহূর্তে আবার জ্বলে উঠল। সে ভাবল ‘আংটি নিয়ে আমাকে সন্ধ্যার আগেই জুয়েলারির কাছে গিয়ে পৌঁছনো চাই।’ তৃতীয় প্রহরে সে বাক্স থেকে আংটি বের করে বাইরে পা দিল। আঙিনা অতিক্রম করতেই সে দেখল বেগুনি রঙের শাড়িতে আপাদমস্তক ঢেকে বাতাসে এক অপূর্ব মাদকতা ছড়িয়ে একটি নারীমূর্তি হঠাৎ তার সামনে দিয়ে চলে গেল। নারীটি তাকে দেখেনি। কিন্তু সে তাকে একনজর দেখে নিয়েছে। এ দেখাটা নেহাত সামান্য হলেও তাকে আশ্চর্য করে দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট।